Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

প্রকাশগলির ভিতর দিয়ে

বিতান দে

ডিসেম্বর ১৭, ২০২৪

Bitan De
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

(Publication) প্রকাশক ভাবলেন আর ছাপার অক্ষরে হাতে হাতে চলে এল একটা আস্ত বই! বিষয়টা যদি এমন হত? ভূতের রাজার তিন বরের মতন এমন কোনও বর পাওয়া গেলে প্রকাশকের দপ্তর থেকে ক্রেতার বুকসেল্ফ, পাঁচতলা মল পুরোটাই বই গোছের কোনও বিজ্ঞাপনে ছেয়ে যেত কলকাতার রাস্তাঘাট। আমজনতা বাজার করেন। প্রতিদিন আলু, পটল, বেগুন, কুমড়ো বা মাছ কেনার মতন নিত্যদিনের প্রয়োজনে বই কি হয়ে উঠত অত্যাবশ্যক? এমন নানান আজগুবি কিন্ত প্রাসঙ্গিক ভাবনা নিয়ে ক’টা কথা জানানোর দায় থেকে যায় প্রকাশকের। বই নির্মাণ একটি শিল্প এমন কথা মনে করেন কেউ কেউ, কেউ ভাবেন সব বই বই নয়, আবার কেউ কেউ দীর্ঘ ৪০ বছর অতিক্রান্ত করে এগিয়ে চলেছেন আরও চল্লিশের পথে। বাস্তবিক ছবিটা আপাত সরল মনে হতে পারে। ভাবতে পারেন, এটাই তো প্রকাশনার কাজ! কিন্ত এই সবকিছুর ভিতর, একটি বইয়ের হয়ে ওঠার রাস্তা খুব মসৃণ নয়। (Publication)

আরও পড়ুন: বহুরূপে সম্মুখে তোমার

এই যেমন ধরুন লেখক একটি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করলেন। সেই পাণ্ডুলিপি হাতে লেখা কাগজের পাতায় হতে পারে, কিংবা হতে পারে প্রযুক্তির খাতার পাতায় অর্থাৎ টাইপ ফরম্যাটে। যেভাবেই হোক, পাণ্ডুলিপি পৌঁছে যাবে প্রকাশকের দপ্তরে। বানান বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকলে লেখকের ভার লাঘব এবং প্রকাশকও খানিক হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। যদি সেখানেই প্রথম বাম্পারের ধাক্কা সামলাতে হয়, তাহলে গাড়ির গতি কমতে বাধ্য! অতএব শরণাপন্ন হতে হবে বানান সংশোধক থুড়ি প্রুফ রিডারের।

লেখক ও প্রকাশক এই দুই নদীর মাঝখানে সাঁকোর মতন অবস্থান সম্পাদকের। লেখক কী লিখবেন, কেন লিখবেন এবং কী লিখবেন না, কেন লিখবেন না তার কাঠামো নির্ধারণের গুরুদায়িত্ব সম্পাদকের। এই দায়ভার কখনও বাড়ে বৈ কমে না! লেখক যে নামজাদা লেখক হয়ে উঠলেন, তার শতকরা ষাট ভাগ লেখকের কৃতিত্ব হলে চল্লিশ ভাগ থেকে সম্পাদককে বঞ্চিত করা নীতিবিরুদ্ধ! কিছু পত্রিকার দিকেই তাকিয়ে দেখুন না—এক্ষণ, দেশ, কৃত্তিবাস, অনুষ্টুপ থেকে হাল আমলে রাবণ বা বোধশব্দ; সম্পাদনার গুরুত্ব বোঝার ক্ষেত্রে এমন উদাহরণ ভুরিভুরি। একসময়ের আনন্দবাজার গোষ্ঠীর কথা মনে আছে নিশ্চয়ই! লেখক কীভাবে তৈরি হবেন, কীভাবে একটা লেখাকে পত্রিকা বা বইয়ের স্বার্থপযোগী করে তোলা যাবে; এই সবই সম্পাদক ভাবেন এবং ভাবা প্র্যাকটিস করেন। তবে হাল আমলের ‘সম্পাদিত’ বিভিন্ন বইয়ের দিকে তাকালে সম্পাদকের কাজের বিষয়ে সংশয় তৈরি হওয়া বিচিত্র নয়। কুড়ি বা পঁচিশটা লেখা নিয়ে যদি একটা ভূমিকাস্থানীয় কিছু লিখে দিলেই ‘সম্পাদনা সুসম্পন্ন’ হয়ে যায়, তবে ‘গতস্য শোচনা নাস্তি’! হায় রে হুতোম, সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা-র সম্পাদক আজকের দিন দেখলে বোধহয় মূর্ছা যেতেন।

বানানবিধির বিধিনিষেধ পেরিয়ে প্রথম দফার পরীক্ষা পেরোনো গেলেই উপস্থিত দ্বিতীয় দফা। পাণ্ডুলিপির লেজা থেকে মুড়ো এবং মুড়ো থেকে লেজা পর্যন্ত কপিটি তো খুঁটিয়ে দেখা প্রয়োজন! লেখক এবং প্রকাশক (যদি সম্পাদক থাকেন তো অবশ্যই তিনিও) পারস্পরিক বিনিময়ের মতোই সেই কপির খুঁটিনাটি আলোচনা সেরে ফেলতে পারেন; নচেৎ দ্বারস্থ হতে হবে কোনও পাঠ সম্পাদক তথা কপি এডিটরের। আপাদমস্তক সেই কপি ছানবিনের পর বাদবাকি পরিবর্তন থাকলে অবশ্যই সেরে ফেলতে হবে। তবে এই গোটা কাজটা মোটেই বিমান সফরের মতো দ্রুতগতিতে হয় না। প্রুফ রিড থেকে কপি এডিট, সবটাই বেশ সময়সাপেক্ষ।

আরও পড়ুন: হেলাল-তর্পণ: জনপ্রিয়তা, জিজ্ঞাসা ও সংশয়

এরপর আসরে নামার পালা লে আউট ডিজাইনারের। কথাটা গালভারী শোনালেও একদা পরিচিত কম্পোজিটার কথাটায় আপত্তি আছে। পাণ্ডুলিপি রিটন স্ক্রিপ্টই হোক বা টাইপ, ডিজাইনার তো গোটা বইটিকে সাজাচ্ছেন! কেবল কম্পোজটুকু করলেই তাঁর মুক্তি নেই। তাহলে কেন তিনি কেবল কম্পোজিটারের তকমাধারী হয়ে থেকে যাবেন? সেই সাজানোর কাজ প্রায় দুর্গম গিরি কান্তার মরু পার হওয়ার মতোই দুষ্কর! লে আউট যদি প্রকাশকের পছন্দ হয় তবে লেখকের পছন্দ নাও হতে পারে; আবার লেখক সবুজ সিগনাল দিলেও লালবাতি হাতে পথ আটকে দাঁড়াতে পারেন প্রকাশক! দড়ি টানাটানির শেষে কোনপক্ষ জয় ছিনিয়ে নিল এবং তাতে বেচারা লে আউট ডিজাইনারের কী হাল হল, সে তো জানেন তারা আর স্বয়ং ঈশ্বর!

ক্রেতা আর পাঠকের পক্ষে এসব কোনওটাই জানা হয়ে ওঠে না। এর প্রায় লেজুড় হিসেবেই থেকে যায় প্রচ্ছদ নামক বিষয়টি। প্রচ্ছদশিল্পী কে হবেন, তাঁর আদৌ কোনও স্বাধীনতা থাকবে কী না, নামজাদা প্রচ্ছদশিল্পীর করা কোনও কাজ ব্যবহার করা গেলে তার সুবিধা ও অসুবিধার তালিকা কত দীর্ঘ হতে পারে, কোনও স্টক ইমেজ ব্যবহার করেই প্রচ্ছদের কাজ সেরে নেওয়া সম্ভব কী না এমন বিভিন্ন প্রশ্নের জান কেটে অবশেষে মুক্তি পাওয়া গেলে বই যায় ছাপাখানায়।

কী ভাবছেন, এইবার বুঝি কাজ শেষ? সে গুড়ে বালি। ছাপাখানা পুরো পিডিএফটি পাওয়ার পর শুরু করে ইম্পোজ.। পিওডি বা প্রিন্ট অন ডিমান্ডের সুবিধায় আপনি চাইলে ১০ কপি বইও ছাপাতে পারেন! সংখ্যা বেড়ে ২০০ বা ৫০০-তে গেলে ট্রেসিং অফসেট বা সিটিপি (অফসেট, কম্পিউটার টু প্লেট)-তে ছাপলে ছাপা খরচ কমে অনেকটাই। এরইমধ্যে রয়েছে কাগজ বাছা, অর্থাৎ কোন ধরনের কাগজে বইটি প্রকাশ পাবে তার খুঁটিনাটি ছাপাখানাকে জানানো। বইটি পেপারব্যাক, হার্ডবাউন্ড নাকি অন্য কোনও ধরনের হবে, জ্যাকেট থাকলে তার উপর কোনও ল্যামিনেশন থাকবে কী না, এমবসিং-ডিবসিংয়ের কোনও প্রয়োজনীয়তা যদি থাকে; এমন সব খবরাখবর থাকবে ছাপাখানার অন্দরমহলে।

আরও পড়ুন: আলোপৃথিবীর নেপথ্যকাহিনি

বাহিরমহলে কেবল লেখকের পদশব্দ! বই কি এবার সরাসরি হাতে পেলেন পাঠক থেকে ক্রেতারা? সেটি এখনই হচ্ছে না। ছাপার মেশিন চলার পর রয়েছে আরও বেশকিছু বড় কাজ। বইয়ের ভাঁজাই ও বাঁধাই। পারফেক্ট বাইন্ডিং হলে একরকম, হার্ডবাউন্ডে সেলাই করে সেরেজা দিয়ে বাঁধাই করলে আরেকরকম, আবার রাউন্ড বাইন্ডিং হলে অন্য কিসিমের পদ্ধতি! প্রত্যেকদিন বাঁধাইখানার ওই আঠার মাথা ধরানো গন্ধ বা কাপড়-কাগজ ও বোর্ডের ভ্যাপসা গন্ধের ভিতর যদি যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, তাহলে খুব বেশিদিন সেই বাঁধাইখানার ভিতর যেতে মন চাইবে না।

অথচ অসংখ্য বাঁধাইকর্মী দিনের পর দিন ওই কাজই করে চলেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে! তাঁদের কাজের উপর নির্ভর করে বইটি কী রূপে এসে পৌঁছবে প্রকাশকের হাতে। পাঠকের মনমতন প্রোডাকশন হাতে পাওয়ার অন্তরালে থাকা এইসব বাঁধাইকর্মীদের কথা কীভাবেই বা জানবেন ক্রেতারা? কেবল বাঁধাইকর্মীরা নন, বিভিন্ন বইয়ে প্রয়োজনসাপেক্ষে ব্যবহৃত হয় সিল্ক স্ক্রিন। তার কালির গন্ধ সাময়িক সুঘ্রাণ মনে হতে পারে কারও কারও, কিন্ত দীর্ঘদিন ওই গন্ধ সইতে হলে দমবন্ধ লাগতে পারে! সেখানেও অসংখ্য কর্মী একটানা কাজ করে চলেছেন, মূলমন্ত্র সেই নিষ্ঠা!

এভারেস্ট আরোহণের পূর্বের বেসক্যাম্পগুলো পেরোনো অবশেষে সম্পন্ন হল। এইবার পাহাড়চূড়ায় ওঠার পালা! হাতে বই এল প্রকাশকের, লেখক দেখবেন ছাপার অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে তাঁর নাম! পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে বইটির বিক্রয়মূল্য নির্ধারিত হয়েছে কিন্ত বাধ সাধার বিভিন্ন সম্ভাবনা তখনও কাজ করে যাবে। একটি বই প্রকাশক অনলাইন বা অফলাইন মাধ্যমে ডিস্ট্রিবিউটরের কাছে পৌঁছে দেবেন। ডিস্ট্রিবিউটর মহাশয় তার উপর ধার্য করবেন ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমিশন! ক্রেতা পাবেন ২০ বা ২৫ শতাংশ ছাড়। এরপর প্রকাশকের লক্ষ্মীলাভের সম্ভাবনাটা একটু বিবেচনা করলেই বোঝা যাবে, মুদ্রিত মূল্য ঠিক কোন কোন বিষয়ের সঙ্গে একেবারে সমানুপাতিক সম্পর্কে জড়িয়ে আছে!

আরও পড়ুন: টিনা-টিয়া

ডিজাইনার, প্রচ্ছদশিল্পী, কপি এডিটর, ছাপাই ও বাঁধাই এবং ডিস্ট্রিবিউটর; এতগুলো ধাপ পেরিয়ে প্রকাশককে ভাবতে হয় তিনি মুদ্রিত মূল্য কত ধার্য করবেন! তাছাড়া বই যদি জনপ্রিয়তা পায় তাহলে এক কথা নাহলে বছর দুই-তিন ধরে অল্প অল্প করে আর্থিক লেনদেন। এর বাইরে রয়েছে লেখকের প্রাপ্য রয়ালটি। এতসবের পরেও পাঠকের গোঁসা, এত দাম করলে কীভাবে বই কেনা সম্ভব! এই দ্বন্দ্বের অবসানে রঙ্গমঞ্চে নেমেও প্রকাশক মহাশয়দের খুব বেশি কিছু করার থাকে না। যুক্তি-প্রতিযুক্তির ভিতরে একটু একটু হারিয়ে যেতে থাকে এই অন্দরমহলের কাহিনি।

কত না বলা গল্পের ভিতর থেকে উঠে আসে আস্ত একটা ছাপা বই, কজন’ই বা জানেন, জানতে চান! জানানোর দায় ও দায়িত্বটুকুও পালন করি না আমরা। বদলে বিভিন্ন পরিসরে চলে নানান তর্যা আর হারিয়ে যান অসংখ্য কারিগররা! বই হয়ে ওঠার গল্পের ধুয়োটুকু ধরিয়ে দেওয়া গেল। নৌকায় চেপে বাকি নদীটুকু পেরোতে চাইলে দেখবেন ঠিক পেরেছেন। তখন অনুযোগ আর অভিযোগের বহর সরিয়ে ভাবলে দেখবেন, শীতের সকালের রোদের মতন এই নির্মাণের পথটা বড় মিঠে, মোলায়েম।

Author Bitan De

বিতান দে, বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, অনুরাগী ও পাঠক। খাদ্য সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি ভালোবাসেন সিনেমা দেখতে ও খেলাধূলার চর্চা করতে। প্রকাশনা এবং কপি এডিটের নেশাকে পেশায় রূপদানের চেষ্টায় আছেন।

Picture of বিতান দে

বিতান দে

বিতান দে, বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, অনুরাগী ও পাঠক। খাদ্য সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি ভালোবাসেন সিনেমা দেখতে ও খেলাধূলার চর্চা করতে। প্রকাশনা এবং কপি এডিটের নেশাকে পেশায় রূপদানের চেষ্টায় আছেন।
Picture of বিতান দে

বিতান দে

বিতান দে, বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, অনুরাগী ও পাঠক। খাদ্য সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি ভালোবাসেন সিনেমা দেখতে ও খেলাধূলার চর্চা করতে। প্রকাশনা এবং কপি এডিটের নেশাকে পেশায় রূপদানের চেষ্টায় আছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস