ইতিহাস বলে, সে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, আবার ফিরে আসে। হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেল্ফ। কিন্তু এই প্রবাদ কি মনুষ্য, মানে আমাদের জীবনেও খাটে? আমরা যা কিছু ফেলে আসি বা এসেছি, তা কি কখনও ফিরে পাই? স্মৃতি-বিজড়িত সুমধুর ছেলেবেলাও আমরা টের পাওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলেবেলা গ্রন্থটিকে “বালক” কবিতা দিয়ে আরম্ভ করেছিলেন। “বয়স তখন ছিল কাঁচা – হাল্কা দেহখানা/ ছিল পাখির মতো, শুধু ছিল না তার ডানা।” বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই “ডানা” আমরা মেলে ধরতে শিখি। বয়স ও বুদ্ধি আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়। (Childhood)
আরও পড়ুন: আলোপৃথিবীর নেপথ্যকাহিনি
ইদানীং মনে হয়, ছেলেবেলা বলতে আর কিছুর অস্তিত্ব নেই। শিশুরা ছোট থাকতে না থাকতেই, বেশ বড় হয়ে যাচ্ছে। যা আমরা, প্রাপ্তবয়স্করা শিক্ষা ও অনুশীলন নিয়ে, বছরের পর বছর, পড়াশুনা করে শিখেছি, তা এরা– আজকের যুগের কচিকাঁচারা– প্রায় জন্ম থেকেই দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে পেয়ে যাচ্ছে। আজকের অধিকাংশ মা-বাবারা অবাক নেত্রে যখন প্রত্যক্ষ করেন তাঁদের বাচ্চারা মোবাইল নামক যন্ত্রটিকে নিজেদের পুষ্যি হিসেবে বিবেচনা করছে, তখন প্রযুক্তিকে দোষ দিয়ে কোনও লাভ নেই বললেই চলে। “দাও, দাও, আমাকে আরও দাও”। এই চাহিদা কেন এবং কখন হল, তা যুগের সমাজতত্ববিদরা বিশ্লেষণ করবেন। কখনও কি আজকের দিনের শিশুদের মধ্যে আমাদের নিজেদের ছোটবেলার প্রতিচ্ছবি লক্ষণীয় হয়?
ছেলেবেলা বলতে আর কিছুর অস্তিত্ব নেই। শিশুরা ছোট থাকতে না থাকতেই, বেশ বড় হয়ে যাচ্ছে। যা আমরা, প্রাপ্তবয়স্করা শিক্ষা ও অনুশীলন নিয়ে, বছরের পর বছর, পড়াশুনা করে শিখেছি
ছেলেবেলা এমন এক মুহূর্ত যা ফিরে আসে না। যদি কখনও ফিরে আসে, তা স্মৃতির সমুদ্রের ঢেউয়ের জলোচ্ছ্বাসের মতো। যুগ পাল্টায়। সময়ের সঙ্গে, ইতিহাসের পাতা বদলায়। কিন্তু বিশ্বের যে কোনও জায়গায়– তা সে বড় কোনও শহর বা জাঁকজমক ভরা প্রসিদ্ধ স্থানই হোক বা ছোট্ট কোনও কোণের দারিদ্র ও অতি কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করা পরিবারই হোক, শিশুদের স্বভাব এবং ব্যবহারে এক আশ্চর্য রকম মিল থাকে। তারা “মা” শব্দটা প্রথম উচ্চারণ করে। “বাবা”র চেয়েও আগে। যে কোনও ভাষাতে, পৃথিবীর যে কোনও পরিবারে, এই বিধির বিধান প্রযোজ্য।
আমাদের ছোটবেলাটা কোথায় যেন আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। এখন পার্কে গিয়ে দোলনায় চড়ার থেকে, মোবাইলে হরেক রকমের গেম খেলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ শিশুরা। খোলা বাতাস ও আকাশে পাখিদের কলরব তাদের হয়তো আর টানে না। হয়তো সেভাবে শোনেনি বলেই! কিন্তু এমন কেন ও কখন ঘটল?
আরও পড়ুন: ডিজিটাল পরিকাঠামো ও বিশ্বায়ন
আমি আমার মা বাবার একমাত্র সন্তান। আমাদের সময়ে বরং ছেলে মেয়েদের মধ্যে অগাধ মেলামেশা ছিল। তখন বাবা মায়েরা কোনওদিনও ভাবতেন না যে তাঁদের সন্তানেরা অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেললে বা ফুর্তি করলে, কোনও বিপদ ডেকে আনতে পারে।

দেশপ্রিয় পার্কে, আমাদের বাড়ির খুব কাছে, একবার এক দোলনার আঘাতে, আমার চোখের ঠিক উপরে ভ্রুর কাছে একটি স্টিচও পড়েছিল। কিন্তু দোলনায় চড়া ছিল আমার নেশা। সে এমনই রকম পেয়ে বসেছিল, যে আমার বাবা আমাদের আগের বাড়ির ছাদে, একটি দোলনা তৈরি করে দিয়েছিলেন। দোলনায় চড়তে আমার এখনও বেশ ভালোই লাগে! দু’পা মাটিতে, পিছনের দিকে ঠেলে, যখন দোলনাটা আকাশের দিকে উঠতে থাকে, তখন মনে হয় যে আমি পাখিদের কেউ। আমার ডানা হয়তো এই মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়বে।
সে এমনই রকম পেয়ে বসেছিল, যে আমার বাবা আমাদের আগের বাড়ির ছাদে, একটি দোলনা তৈরি করে দিয়েছিলেন।
সত্যজিৎ রায় তাঁর “তিন কন্যা” ছবিটিতে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিনটি কন্যা চরিত্রকে চিত্রায়িত করেন, তার শেষটিতে মৃণ্ময়ীকে আমরা দেখি। মৃণ্ময়ী এক স্বাধীনচেতা নারীকণ্ঠ। সে কোনও বাঁধ মানে না। তাকে তার পোষ্য ‘চরকি’র মতো বাঁধন-ছেঁড়া এক স্বপ্নের বাস্তবায়িত রূপে প্রকাশ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এবং তারপরে চলচ্চিত্র জগতের নূভেল্ ভাগ্-এর স্রষ্টা সত্যজিৎ রায় নিজে। রায় মশাইয়ের আগে সিনেমা আমাদের দেশে প্রধানত পুরুষ-কেন্দ্রিক ছিল। “পথের পাঁচালি”র নির্মাতা হয়ে, তিনি দেখিয়েছিলেন যে নারীরা শুধুই নেচে বা গান গেয়ে মানুষদের মন ভরানোর জন্য নয়। সর্বজয়া, চারু, মৃণ্ময়ী, রতন – এরা সবাই নারীর এক দর্পণ যা একটু হলেও ভিন্ন, যা স্বাভাবিক এবং সাবলীল।
ঋত্বিক ঘটক যখন তাঁর “বাড়ি থেকে পালিয়ে” বানান, তখন সেই ছবি এক ধরণের আলোড়ন তুলেছিল। ভারতীয় সিনেমায় এর আগে, শিশু চলচ্চিত্রের আগমন হয়নি। ওঁর জন্ম-শতবর্ষে আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য রইল। ভারতীয় সিনেমায় ছোটরা একটু অন্য ভাবে এসেছে। মনে পড়ছে এখন তপন সিন্হার “সফেদ হাতি”। তখন সেই ধবধবে সাদা ‘ঐরাবত’-এর জন্য সকলের চক্ষু দিয়ে অশ্রু ঝরেছিল। ভাবা যায়! জ্যোৎস্নার আলোয় এক অলৌকিক অভিজ্ঞতা নিয়ে এই ছবি ছোটদের ছোটবেলার সারল্য তুলে ধরেছিল বড়দের মনের অন্দরেও। শিশু সাহিত্য বিশ্বের দরবারে একটু যেন অবহেলিত বর্তমান যুগে। হ্যারি পটার যদি শিশু সাহিত্যের একমাত্র প্রতীক হয়ে ওঠে এখন, তাহলে বলব যে এক চরম দুর্দিন শীঘ্রই আসন্ন। আজ ছোটরা লীলা মজুমদার, সুকুমার রায় না পড়ে, যদি শুধুই হ্যারি পটার কোনও খাদ্যের মতো গিলতে থাকে, তবে বঙ্গীয় শিশু সাহিত্য কোন তলানিতে ঠেকবে?
আরও পড়ুন: প্রকাশগলির ভিতর দিয়ে
ছোটদের ছোটবেলা ছোট হতে হতে, এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে আছে যে তার গভীরতা স্কেলে মাপা যাবে। কিন্তু ছোটরা তা টের পাওয়ার আগেই তাদের ছোটবেলাটি উধাও বা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে, মা বাবাকে বিরক্ত করে, প্রশ্ন করতাম, “আমি কবে বড় হব?” মাঝেমাঝে আমার মনে প্রশ্ন জাগে, ‘আচ্ছা! এখন কি বাচ্চারা আর পুতুল কিংবা অন্য খেলনা পাওয়ার জন্য বায়না করে না? বোধহয় করে না। কারণ আমি লক্ষ্য করি যে ছোটদের খেলনার দোকান প্রায় ফাঁকাই যায় আজকাল। রাস্তায় বেরোলে এটা সকলের চোখে পড়বার কথা। মোবাইল ফোন এখন সর্বগ্রাসী!

বইয়ের বদলে আজ ফোনের উপর ঝুঁকে ঘাড় কাত ও ব্যথা হওয়ার জোগাড়! বই পড়ার কথা তো হাতে গোনা কয়েক জনের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়, কী বড় কী ছোট! বাচ্চারা কোনওদিকে না তাকিয়ে, এখন শুধুই ফোনের দিকে তাকায়। শীতের ছুটিতে এখন চিড়িয়াখানায় যাওয়া অতীত। মালয়েশিয়া, ব্যঙকক্-এর মতো জায়গায় যায় শিশুরা। যুগের সাথে মানিয়ে চলাটাই বোধহয় সব থেকে বুদ্ধিমত্তার কাজ এখন। তাই সই। ছোটরা যেন তাদের ছোটবেলাটা পরিপূর্ণ রূপে উপভোগ করে। কারণ এই সময়টা জীবনে একবারই আসে!
ছোটরা যেন তাদের ছোটবেলাটা পরিপূর্ণ রূপে উপভোগ করে। কারণ এই সময়টা জীবনে একবারই আসে!
তখন অনেক সহজ ও সরল ছিল বেঁচে থাকা। বাবা ছাড়াও যে আজকের যুগের ছোটরা, শুধু মা-মা সংসারে, বড় হতে পারে এবং হচ্ছে, এটা এক দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ। যুগের সাথে সামাজিক নিয়ম ও ব্যবহার বদলায়। স্মৃতির দর্পণে ছোটবেলা সময়টা সদাই সুমধুর। নিছক আনন্দ, খেলা ধুলা ও নির্ভেজাল ভালোবাসা দিয়ে তৈরি মানব জীবনের ইতিহাসের এই কটাদিন। কখন সেই ছোটবেলাটা হারিয়ে গিয়ে প্রাপ্তমনষ্কদের বড়বেলায় বিলীন হয়ে যায়, তা আমরা কেন, কোনও সমাজতত্ববিদও টের পান না। ছেলেবেলা তাই আনন্দময় হোক, এই কামনা করতে করতে আজ শেষ দাড়ি টানলাম।
আমি, হৈমন্তী দত্ত রায়, যদিও ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করেছি, বাংলা ভাষার চর্চা আমাদের বাড়ীতে বহু যুগ ধরে। মাতৃ ভাষা না পড়লে বা না জানলে, সে যেই হোক – পুরুষ কিংবা নারী – সঠিক অর্থে মানুষ হয়ে উঠতে পারে না।
বাংলা ভাষাতে লেখা বই পড়তে ভালো লাগে কেন? উত্তরে বলবো – ‘সেখানে আমি নিজের পরিচয় খুঁজে পাই।‘
আমার চারটির বেশী ইংরেজিতে লেখা বই এম্যাজনে পাওয়া যায় এখনও। বাংলায় আমি লিখতে শুরু করেছি খুবই ইদানীং। আত্মপ্রকাশ আমার লক্ষ্য এবং উপলব্ধি। পাঠক যদি আমার লেখা পড়ে আনন্দ পান, সেটাই হবে আমার সব থেকে বড়ো প্রাপ্তি।