Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

দেবরাজ রায় : এক সাদাকালো সময়ের ছবি

সপ্তর্ষি রায় বর্ধন

অক্টোবর ২৩, ২০২৪

Debraj Roy
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

মধ্য সত্তরের দশকে, আমাদের শৈশবে কলকাতা মহানগরী দেখেছিল প্রথম টেলিভিশন সম্প্রচার। তিন ঘণ্টা খানেক অধিবেশনের পনের মিনিট বরাদ্দ ছিল বাংলা সংবাদের জন্য। রেডিওর খবরের অভ্যাসে তখন আমাদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মন্দ্র মোহময় কণ্ঠস্বর। বেতারের যবনিকা ভেদ করে সংবাদ পাঠকের মুখ দেখার সুযোগ নেই- অতএব দূরদর্শনের কল্যাণে, সেই প্রথম অনুষ্ঠানের ঘোষক, উপস্থাপক এবং সংবাদ পাঠকদের মুখচ্ছবি ও কণ্ঠের সঙ্গে একযোগে পরিচিতি। অনেক নামই আজ বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছে। এসেছে নতুন মুখ। রঙিন সাজে সেজেছে টেলিভিশন। বেড়েছে চ্যানেল। সম্প্রতি অভিনেতা, সংবাদ পাঠক দেবরাজ রায়ের মৃত্যু সেই সাদা কালো যুগের স্মৃতি আরেকবার উসকে দিয়ে গেল। গত মাসে চলে গেছেন ছন্দা সেন, সেই সময়ের আরেক পরিচিত মুখ। (Debraj Roy)

শুরুটা সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে, কলকাতা ট্রিলজির প্রথম ছবি “প্রতিদ্বন্দ্বী”তে। উত্তাল নকশাল আন্দোলনের চালচিত্রে এক মধ্যবিত্ত পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান “টুনু”–র চরিত্রে।

বাংলা বিনোদন জগতের অন্যতম খ্যাতনামা অভিনেতা ছিলেন দেবরাজ। মঞ্চ, পর্দা হয়ে দূরদর্শনে সংবাদপাঠ— যা আগেই বলেছি, সব ক্ষেত্রেই আলাদা মাত্রা যোগ করেছিলেন তিনি। ১৯৫০ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্ম অভিনেতার। দুই প্রবাদপ্রতিম নাট্যব্যক্তিত্ব– তরুণ রায় এবং দীপান্বিতা রায়ের অভিভাবকত্বে বড় হয়ে উঠেছিলেন দেবরাজ অর্থাৎ অভিনয় ছিল তাঁর রক্তমজ্জায়। স্ত্রী অনুরাধা– তিনিও জনপ্রিয় অভিনেত্রী। একটা সময় অবধি চুটিয়ে অভিনয় করেছেন মঞ্চ ও পর্দা জুড়ে। শুরুটা সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে, কলকাতা ট্রিলজির প্রথম ছবি “প্রতিদ্বন্দ্বী”তে। উত্তাল নকশাল আন্দোলনের চালচিত্রে এক মধ্যবিত্ত পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান “টুনু”–র চরিত্রে। ছোট চরিত্র হলেও ছবির প্রোটাগনিস্ট সিদ্ধার্থর(ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়) সামনে যেন সে এক স্বচ্ছ মুকুর, যার মধ্যে সিদ্ধার্থ খোঁজ পায় তার অস্থির মনের।

অন্ধকার ফুঁড়ে ভেসে ওঠে তাঁর নিষ্পাপ মুখ “আমি এখানে বলতে এসেছি কারা আমাকে মেরেছে আমি জানি কিন্তু আমি তাদের নাম বলব না।

দেবরাজের পরের ছবি মৃণাল সেনের “কলকাতা ৭১” যার প্রকাশকাল ১৯৭২। এ ছবি আসলে চারটি গল্পের একত্রীকরণ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ সান্যাল, সমরেশ বসুর তিনটি গল্পে ‘১৯৩৩’, ‘১৯৪৩’, ‘১৯৫৩’ সালের ঠিকানা বসিয়ে, ‘৭১”-এসে পৌঁছয় মৃণাল সেনের নিজের লেখা চতুর্থ গল্পের সূত্র ধরে। আবার সেই উত্তাল মহানগরের ছবি উঠে আসে পর্দায়। গৌরাঙ্গর চরিত্রে দেবরাজ। কোন এক ভোর রাতে ময়দানের এক কোণে গুলিতে প্রাণ যায় তাঁর। তিনি যেন ফিরে আসেন। অন্ধকার ফুঁড়ে ভেসে ওঠে তাঁর নিষ্পাপ মুখ “আমি এখানে বলতে এসেছি কারা আমাকে মেরেছে আমি জানি কিন্তু আমি তাদের নাম বলব না। আমি চাই আপনারা নিজেরা তাদের খুঁজে বার করুন। খুঁজতে গিয়ে আপনারা কষ্ট পান, যন্ত্রনা পান– এমন নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন না, এমন নিঃস্পৃহ থাকতে পারবেন না।”
মন ধাক্কা খায় – হৃদয় মুচড়ে ওঠে ।

এক কথায় সিনেমার দুই কিংবদন্তির হাত ধরে দেবরাজের অভিষেক হয়েছিল রুপোলি পর্দায়। এই দুটি খানিক ব্যতিক্রমি সিনেমার পরে অভিনেতা দেবরাজের প্রবেশ বাণিজ্জিক ছবির চৌহুদ্দির অন্দরে। এখনও টিভিতে মান্না দে’র গলায় সলিল চৌধুরীর সুরে ‘বাজে গো বীণা’ গান শুনলেই স্মৃতিবিহ্বল হই আমরা। সাদা কালো ছবিতে দাড়িওয়ালা দেবরাজ রায় গাইছেন প্রেমিকা মর্জিনা মিঠু মুখোপাধ্যায়ের উদ্দেশে। পরিচালক দীনেন গুপ্তর ছবি, ‘মর্জিনা আবদাল্লা’! ১৯৭৫ সালে তপন সিনহা তৈরি করলেন “রাজা” – নাম ভূমিকায় দেবরাজ। এছাড়াও তাঁর পুরো ফিল্ম কেরিয়ার জুড়ে, তিনি অন্যান্য খ্যাতিমান পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তরুণ মজুমদার, বিভূতি লাহার ছবি ছাড়াও তিনি কাজ করেছেন অজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নতুন দিনের আলো’, সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি’, অগ্রদূতের ‘সেদিন দুজনে’, অজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘করোটি’, অমল রায় ঘটকের ‘দেবর’, দীনেন গুপ্তের ‘নটী বিনোদিনী’, রাম মুখোপাধ্যায়ের ‘রক্ত নদী ধারা’, শান্তিময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পরিক্রমা’ ইত্যাদি ছবিতে।

আরও পড়ুন:

আরও পড়ুন: খেলা ভাঙার খেলা

দেবরাজের অপর পছন্দের জায়গা ছিল থিয়েটারের মঞ্চ এবং অবশ্যই বেতারের শ্রুতি নাটক। তাঁর বাবা তরুণ রায় ছিলেন এক বিশিষ্ট বাঙালি নাট্যকার, সাহিত্যিক, মঞ্চাভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক। বাংলা একাঙ্ক নাটকের একটি নতুন ধারার প্রবর্তক ছিলেন তিনি। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভবানীপুরের চক্রবেড়িয়া রোডে নিজের বাড়িতে “থিয়েটার সেন্টার” নামে একটি রঙ্গালয় স্থাপন করেন। সেখানে তিনি নিয়মিত নাট্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত অপর সংস্থাটি ছিল “মুখোশ”। মা দীপান্বিতা রায়ও ছিলেন রঙ্গমঞ্চের মানুষ। সেই নাটকের আবহেই দেবরাজের বড় হয়ে ওঠা। ষাটের দশকে খুবই অল্প বয়সে অভিনয় জগতে তাঁর আত্মপ্রকাশ। পরবর্তীতে বাংলা শ্রুতি নাটকের ক্ষেত্রেও দেবরাজের কণ্ঠ পরিচিতি পায়।

নাটকের আবহেই দেবরাজের বড় হয়ে ওঠা। ষাটের দশকে খুবই অল্প বয়সে অভিনয় জগতে তাঁর আত্মপ্রকাশ।

বাচিক শিল্পী ঊর্মিমালা ও জগন্নাথ বসুর সঙ্গে এক আলাপচারিতায় উঠে এল দেবরাজ রায় সম্পর্কে নানা তথ্য। আকাশবাণীর কলকাতা “ক”-এর নাটক একটা সময় সাঙ্ঘাতিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর সমান্তরালে শ্রোতারা আস্বাদ পান “বিবিধ ভারতী” প্রচার তরঙ্গে প্রচারিত বিজ্ঞাপনদাতাদের শ্রুতি নাটকের অনুষ্ঠানগুলির। বাংলা থিয়েটারের বিখ্যাত অভিনেতা, নাট্যকারদের সমাগম ঘটেছিল তখন এই শ্রুতি নাটকের আঙিনায়। দেবরাজ ছিলেন সেই অভিনেতাকুলের অন্যতম কণ্ঠ। “দেবরাজ প্রচণ্ড অন্তর্মুখী হলেও তাঁর কৌতুকবোধ জানান দিত সময়ে সময়ে। ওঁর মতো হৃদয়বান ও নিষ্পাপ লোক আমাদের জগতে আর দুটি ছিল না,” বললেন জগন্নাথদা। প্রসঙ্গত শোনালেন লন্ডনে “সিটি অফ জয়” এর শুটিংকালে কলকাতা থেকে যাওয়া সহঅভিনেতাদের সঙ্গে দেবরাজের ঐকান্তিক মুহূর্তের কথা। উল্লেখ্য, এই ছবিতে “বিমল” নামে একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দেবরাজ। ঊর্মিমালাদি জানালেন “মর্জিনা আবদুল্লা” ছবি দেখেই অনুরাধার মনে ধরেছিল দেবরাজকে এবং তার পরেই পত্রালাপ ও প্রেম”! তাঁদের বিয়ের গল্পটিও চমকপ্রদ যা শোনালেন জগন্নাথদা। “নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে দেখি সানাই নেই, আলো নেই; বর বউ দুজনেই টর্চ হাতে তাদের বাড়ির নীচে থিয়েটার হলে সবাইকে আসন দেখিয়ে বসিয়ে দিচ্ছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মঞ্চে শুরু হল নাটকের অভিনয়। এদিকে তো খিদেতে পেট চুঁই চুঁই। বাড়িতে বলে এসেছি নেমন্তন্ন, এদিকে তার কোনও লক্ষ্মণ নেই, কিছু বুঝতেই পারছি না। নাটক শেষ হতে তরুণবাবু জানালেন, আসলে আমরা তো নাটকের লোক, তাই যে কোনও শুভ কাজ আমরা নাটক ছাড়া ভাবতে পারি না। চিন্তা করবেন না, তিনতলার ছাদে যোগাড় যন্ত্র রয়েছে– শিল্পী ও দর্শকেরা আজ একসঙ্গে বসে আমরা খাওয়া দাওয়া করব।”
“সুক্ষবিচার”, “প্রাণেশ্বরী”, “রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ” এরকম অসংখ্য শ্রুতি নাটকে অভিনয় করেছিলেন দেবরাজ। ভারী অথচ দরাজ কণ্ঠস্বর নিয়ে তিনি প্রাণ দিয়েছিলেন বহু চরিত্রে।

“নটি বিনোদিনী” ছবিতে দাশু নিয়োগীর চরিত্র এর থেকে খানিক আলাদা- কুটিল, ক্রূর, হিসেবি এক মানুষের মুখ। কিন্তু দেবরাজ সেখানেও সহজ এবং সাবলীল।

ঋজু, সৌম্য দর্শন, সুকণ্ঠের অধিকারি দেবরাজ রায় তাঁর সিনেমা জীবনের অধিকাংশ সময় পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করে গেছেন, বলা যায় বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু সেই সব চরিত্রায়নের মধ্যে ছিল যে সাবলীলতা তা বুঝিয়ে দেয় অভিনয় মাধ্যমটির উপরে তার মজ্জাগত দক্ষতা। “গণদেবতা”র যতীন, “নতুন দিনের আলো”র সমীর, “কলকাতা ৭১” এর গৌরাঙ্গ অথবা “প্রতিদ্বন্দী”র টুনু- সবাই যেন বাঁধা পড়েছে এক প্রচার বিমুখ অভিনেতার গভীর মননে, যার অন্তঃস্থলে আসলে রোপিত হয়েছে চলতি সমাজের নিয়ম নীতি, শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক ধরণের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। “নটি বিনোদিনী” ছবিতে দাশু নিয়োগীর চরিত্র এর থেকে খানিক আলাদা- কুটিল, ক্রূর, হিসেবি এক মানুষের মুখ। কিন্তু দেবরাজ সেখানেও সহজ এবং সাবলীল।

ঋজু, সৌম্য দর্শন, সুকণ্ঠের অধিকারি দেবরাজ রায় তাঁর সিনেমা জীবনের অধিকাংশ সময় পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করে গেছেন, বলা যায় বাধ্য হয়েছেন।

অভিনেতা দেবরাজের জীবনাবসানে আসলে একটা সময়ের স্মৃতি আরেকটু ম্লান হয়ে গেল। যে স্মৃতি বাঙালি মধ্যবিত্তের সাদামাটা জীবন যাপনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিটপী লতার মতো। সে স্মৃতি রঙিন নিওন আলোজ্বলা রাজপথের নয়, যার মধ্যে নেই ইন্টারনেটের তড়িৎগতি অথবা রিমোট হাতে বোকা বাক্সের সামনে বসে শত চ্যানেলের পৈঠাপার করবার অস্থিরতা। যার মধ্যে আসলে বসত করে সাদামাটা সাদাকালো এক নস্টালজিয়া!

Author Saptarshi Roy Bardhan

সপ্তর্ষি রায় বর্ধনের জন্ম, কর্ম এবং বর্তমান ঠাঁই তার প্রাণের শহর কলকাতায়। প্রথাগত ছাত্রজীবন কেটেছে কলকাতার পাঠভবন স্কুল, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে। লেখাজোকা, ছবি তোলা, নাট্যাভিনয় আর হেরিটেজের সুলুক সন্ধানের নেশায় মশগুল। সঙ্গে বই পড়া, গান বাজনা শোনা আর আকাশ পাতাল ভাবনার অদম্য বাসনা। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন- "রূপকথার মতো- স্মৃতিকথায় প্রণতি রায়", "খেয়ালের খেরোখাতা" এবং "চব্য চোষ্য লেহ্য পেয়"।

Picture of সপ্তর্ষি রায় বর্ধন

সপ্তর্ষি রায় বর্ধন

সপ্তর্ষি রায় বর্ধনের জন্ম, কর্ম এবং বর্তমান ঠাঁই তার প্রাণের শহর কলকাতায়। প্রথাগত ছাত্রজীবন কেটেছে কলকাতার পাঠভবন স্কুল, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে। লেখাজোকা, ছবি তোলা, নাট্যাভিনয় আর হেরিটেজের সুলুক সন্ধানের নেশায় মশগুল। সঙ্গে বই পড়া, গান বাজনা শোনা আর আকাশ পাতাল ভাবনার অদম্য বাসনা। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন- "রূপকথার মতো- স্মৃতিকথায় প্রণতি রায়", "খেয়ালের খেরোখাতা" এবং "চব্য চোষ্য লেহ্য পেয়"।
Picture of সপ্তর্ষি রায় বর্ধন

সপ্তর্ষি রায় বর্ধন

সপ্তর্ষি রায় বর্ধনের জন্ম, কর্ম এবং বর্তমান ঠাঁই তার প্রাণের শহর কলকাতায়। প্রথাগত ছাত্রজীবন কেটেছে কলকাতার পাঠভবন স্কুল, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে। লেখাজোকা, ছবি তোলা, নাট্যাভিনয় আর হেরিটেজের সুলুক সন্ধানের নেশায় মশগুল। সঙ্গে বই পড়া, গান বাজনা শোনা আর আকাশ পাতাল ভাবনার অদম্য বাসনা। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন- "রূপকথার মতো- স্মৃতিকথায় প্রণতি রায়", "খেয়ালের খেরোখাতা" এবং "চব্য চোষ্য লেহ্য পেয়"।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস