(Deepavali)
লোকশিল্পে পুতুল ঐতিহ্য নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। মাটির পুতুলকে, বাংলার অন্যতম বৈচিত্র্যময় শিল্প হিসাবে দেখে এসেছি আমরা। কখনও মেলায়, কখনও রাস্তার ধারে অথবা ট্রেনেও খেলনা হিসাবে বিক্রি হয়েছে এসমস্ত পুতুল। আজ সেসব মুছে যাচ্ছে বললে ভুল বলা হবে না। মাটির পুতুলের শিল্প ছিল সমাজের এক আয়না। যা বলত শ্রমজীবি মানুষের কথা। তাঁদের জীবিকা তুলে ধরত। অথচ এখন হারিয়ে যাচ্ছে সেসব বিভিন্ন ধরণের পুতুল। একসময় বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল পুতুল, যা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। বহু রকম পুতুল জনপ্রিয়তার অভাবে হারিয়ে গেছে একটু একটু করে। থাকার মধ্যে, গ্রাম বাংলার কিছু ঘরে, অথবা সংগ্রাহকদের সংগ্রহে… (Deepavali)
আরও পড়ুন: হাতি নয়, ঘোড়ার পিঠে বিশ্বকর্মা! ব্যতিক্রমী বিশ্বকর্মা পুজো
এককালে শিশু বা কিশোর মনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল পুতুল খেলা। দীপাবলির সময়টাতে এক ধরনের বিশেষ মাটির পুতুল তৈরি হত। যাকে বলে ‘মাছওয়ালা-মাছওয়ালি পুতুল’। পুরুষ ও মহিলা মাছ বিক্রেতার মাথায় তাদের একটি করে মাছ। নামের মতো পুতুলের শিল্প শৈলী স্বতন্ত্র। রাজ্যের বাইরে এই ধরনের পুতুলগুলোকে গোয়ালিনী নামে ডাকা হয়। দীপাবলিতে আলোর উৎসবে পুতুলগুলো আলাদা মাত্রা পায়। (Deepavali)
পর্তুগিজ মাছ বিক্রেতাদের ভারিনা বলা হয়। তারা সাধারণত এক ধরনের লম্বা স্কার্ট পরে মাথার ঝুড়িতে মাছ নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে বেড়ান। আমাদের এখানেও শহরে বা গ্রামের হাটে বাজারে মাছ বিক্রেতারা ঝুড়ি করে মাছ বিক্রি করেন। এই মাছওয়ালা-মাছওয়ালি মাটির পুতুল ঘর সাজানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। (Deepavali)

মাছওয়ালা-মাছওয়ালি পুতুল শ্রমিকশ্রেণী বা খেটে খাওয়া মানুষদের কথা তুলে ধরে। যাদের শ্রমের ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন। পরিশ্রম করেই তাদের জীবন চলে। সেখানে জীবনের চড়াই উতরাই নিয়ে পর্যায়গুলো। প্রতিদিনকার ধূসর সুখ দুঃখের টুকরো মুহূর্তগুলো খেটে খাওয়া অভাবি জীবন যাপনের বৃত্তের মধ্যে আবর্তিত হয়। দীর্ন নাগরিক জীবনে কখনও শীতল হাওয়ার স্পর্শ লাগে আবার কখনও ঝঞ্ঝার অভিঘাত। শ্রমজীবি মানুষের দুঃখ সেখানে বড় আপনজন। (Deepavali)

মাছ ভাজা বাঙালির প্রিয়! তাইতো বলে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। রুই, কাতলা থেকে ইলিশের গরম গরম মাছ ভাজা আর তার তেল জিভে জল এনে দেয়। সেই মাছ ছাড়া বাঙালির একদিনও চলে না। আর বাঙালির রসনাকে তৃপ্ত করতে মাছ বিক্রেতারা ভিন্ন ভিন্ন রকম মাছ জোগান দেন। (Deepavali)
“পুরুষ মাছ বিক্রেতার চেহারা হয় সুঠাম। পুরুষ পুতুলটির মাধ্যমে মাছ বিক্রেতার শারীরিক শ্রমের চেহারাটা প্রতিফলিত হয়। পুরুষ ও মহিলা মাছ বিক্রেতা উভয়ের মাথাতেই থাকে এক বিশাল মাছ। মৃৎশিল্পী মহিলা মাছ বিক্রেতার পুতুলটিকে নিপুণভাবে বানান।”
দীপাবলির আগে থেকেই বিভিন্ন মৃৎশিল্পীদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় নানা রকম পুতুল বানানোর প্রস্তুতি। একদিকে কালী প্রতিমা তৈরির কাজ এবং অন্যটি হল বিভিন্ন পুতুল এই সময় তৈরি হয়। কুমোরপাড়ায় দম ফেলার অবকাশটুকু নেই। হরেক রকমারি প্রদীপ, দীপলক্ষ্মী পুতুল, গণেশ লক্ষ্মী, হামাগোপাল, মাটির খেলনা, আলু, পটল, বিভিন্ন সবজি ইত্যাদি সব বাজার ভরে চলে আসে এই সময়। (Deepavali)
দীপাবলির সময় এইসব মাটির পুতুল দিয়ে ঘর সাজানোর মজাই আলাদা। ঝুলনের সময়তেও এর মধ্যে বেশ কিছু পুতুলের চাহিদা থাকে। এ রীতি আজকের নয়। বহুদিনের। (Deepavali)

মৃৎশিল্পীদের থেকে কথা বলে জানা যায়, এইসব পুতুলগুলো তৈরি করা হয় ছাঁচে বসিয়ে। আবার কখনও সেগুলো বানানো হয় আঙুল দিয়ে টিপে। ভেজা মাটির পুতুল রোদে শুকিয়ে গেলে তারপরে তাতে দেওয়া হয় রঙের প্রলেপ। নিখুঁতভাবে রঙ করা হয়। খড়িমাটির সঙ্গে মেশানো হয় বিভিন্ন রঙ। মাটির পুতুলগুলো ধীরে ধীরে রঙিন করা হয়। মৃৎশিল্পীরা সেগুলিকে আকর্ষণীয় করে তোলেন। (Deepavali)
আরও পড়ুন: বৃহৎ বঙ্গে বাংলা ভাষা শিখেছিল পর্তুগিজরা
পুরুষ মাছ বিক্রেতার চেহারা হয় সুঠাম। পুরুষ পুতুলটির মাধ্যমে মাছ বিক্রেতার শারীরিক শ্রমের চেহারাটা প্রতিফলিত হয়। পুরুষ ও মহিলা মাছ বিক্রেতা উভয়ের মাথাতেই থাকে এক বিশাল মাছ। মৃৎশিল্পী মহিলা মাছ বিক্রেতার পুতুলটিকে নিপুণভাবে বানান। বিভিন্ন অলঙ্কারে তাকে সাজানো হয়। হলুদ সোনালি রঙ দিয়ে পুতুলের গায়ে গহনার নকশা করা হয়। দীপাবলি এলেই প্রাণ পায় মাছওয়ালা-মাছওয়ালি পুতুল। (Deepavali)
ঘর সাজিয়ে তোলার জন্যে। সাধারণত মৃৎশিল্পী পরিবারে খুদে সদস্যরা ও মহিলারাই বেশি এসব পুতুল বানায়। দুঃখের বিষয় আজ হাতে গোনা কিছু শিল্পী এই পুতুল বানানোর উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে চলেছেন। (Deepavali)
ছবি সৌজন্য- লেখক
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
মুকুট তপাদার। ইন্ডিপেন্ডেন্ট রিসার্চার। ইতিহাস-শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে ফটোগ্রাফি ও লেখালেখি। গবেষণার বিষয় গঙ্গার পশ্চিম পাড়ের ইতিহাস ও শিল্পকর্ম।