চিরন্তন বাঙালির অভিজ্ঞান কী? এর উত্তরে আড্ডা-আলসেমির আগেই জায়গা করে নেবে সিনেমা। বাঙালি সিনেমাখোর। সেই অনেক অনেক আগে থেকেই। আমরা সিনেমাকে বিনোদন হিসেবে দেখি না। জীবন হিসেবে গ্রহণ করেছি। সুতরাং সিনেমা বাঙালি, বাঙালিই সিনেমা। আদ্দিকাল থেকে যত রকম ভাল-খারাপ সিনেমা হয়ে এসেছে, বাঙালির ছোঁয়া কোনও না কোনও ভাবে আছে। তার পর আমরা যে দু’জনের ওপর পেটেন্ট কায়েম করেছি, তাঁরা হলেন উত্তম ও সুচিত্রা। এর পর সিনেমার নানাবিধ কারিকুরিতেও থাবা বসিয়ে নিজেদের বাঘ প্রমাণ করেছি। এমন বাঘ প্রমাণ করার তালিকায় অনেক নমস্য ব্যক্তির নাম করা যায়। তবে বিশেষ ভাবে স্মরণীয় অজয় কর। যিনি সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা করেছেন। পরিচালক হিসেবে বাঙালির মনকে আয়ত্ত করেছেন। বলা যায়, উনিও ওঁর কীর্তি দিয়ে বাঙালিকে চিরন্তন সিনেমাখোরে উন্নীত করেছেন।
অজয় কর জন্মেছিলেন কলকাতায়। ১৯১৪ সালে। মাত্র সতেরো বছর বয়স থেকে ছবি তোলায় নিজেকে পোক্ত করেছেন এবং তার কিছু কাল পর থেকেই সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে বেশ নামডাক করেছেন। ঠিক কবে থেকে করেছেন, কী বিষয়ে করেছেন, আমাদের মতো ম্যাঙ্গো পিপল-এর না জানলেও চলবে, শুধু জানতে হবে যে তাঁর কাজে পদে পদে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। কেবল মুন্সিয়ানায় থেমে থাকেননি। অভিনবত্ব দেখিয়েছেন। যেমন ধরা যাক, সপ্তপদী ছবির বিখ্যাত ওথেলো-ডেসডিমনা নাটকের দৃশ্য। তখনকার দিনে, একই দৃশ্যে, দু’জন অভিনেতার জন্য দু’রকম আলো এবং দু’রকম ক্যামেরার লেন্স ব্যবহার করে দৃশ্যটি রূপায়িত হয়। এক ধরনের লেন্স ও সঙ্গতের আলোয় ধরা থাকবে ডেসডিমনার নিষ্পাপ, মায়াময় রূপ আর অন্য রকম লেন্স ও আলোয় ধরা থাকবে ওথেলোর অন্তর্দ্বন্দ্ব। এমনটা বাংলা সিনেমায় সম্ভবত অজয় কর-ই প্রথম চালু করেন। এ ছাড়া ব্যাক প্রোজেকশন, ফ্রন্ট প্রোজেকশনও উনিই চালু করেছিলেন। এমনকী কায়াহীনের কাহিনি সিনেমার জন্য স্টুডিয়োর পুকুর পাড় বাঁধিয়েছিলেন, যাতে আন্ডারওয়াটার ফোটোগ্রাফি করতে পারেন। সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি, কিন্তু এমন একটা ঘটনার সাক্ষী এবং তার অনুপ্রেরণা তো থেকেই গেল।
এই অজয় কর তো টেকনিক্যাল জিনিয়াস, দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফার। বাকি থাকল পরিচালক অজয় কর। যাঁর ব্যাপ্তি বাঙালি মনে অনেকটা জুড়ে। অজয় কর মানে সপ্তপদী, হারানো সুর, সাত পাকে বাঁধা, পরিণীতা, মাল্যদান আর আরও অনেক। কানন দেবী খুব স্নেহ করতেন এই মানুষটিকে। আর তাঁর কাছ থেকেই মিলেছিল প্রথম পরিচালনার গুরুভার। ১৯৪৯ সালে তিনি অজয়বাবুকে তাঁর শ্রীমতী পিকচার্সের ‘বামুনের মেয়ে’, ‘অনন্যা’ ও ‘মেজদিদি’ ছবির ক্যামেরার দায়িত্ব দেওয়ার সঙ্গে পরিচালনার দায়িত্বও দিয়েছিলেন। তবে স্বনামে নয়। ‘সব্যসাচী’ নামের এক পরিচালকগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে। এর সদস্যরা হলেন কানন দেবী, অজয় কর ও বিনয় চট্টোপাধ্যায়।
সে সময় অজয় করের পরিধি জুড়ে সত্যজিৎ রায়, হরিসাধন দাশগুপ্ত,রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, বংশী চন্দ্রগুপ্ত এবং হলিউড। হলিউডের সিনেমা তাঁকে বুঁদ করে রেখেছে। হলিউডের ছবি বানানোর কায়দা কেবল ফিল্ম থেকে নয়, পত্রপত্রিকার লেখা, ইন্টারভিউ—সব থেকে শুষে নিচ্ছেন তিনি। তাঁর থ্রিলার এবং হরর মুভির ধারা খুব প্রিয় ছিল। তাই সিডনি ল্যানফিল্ডের ‘দ্য হাউন্ড অব দ্য বাসকারভিলস’-এর মতো স্টুডিয়োয় তৈরি ছবির কলাকৌশল অজয় করকে নিজের বৈশিষ্ট্য চিনতে এবং নিজস্ব একটা সিনেমা ভাষা তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। তিনি স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবেই সিনেমার জগতে পা রেখেছিলেন। তাঁর নিজস্ব ঘরানায়। তাঁর এই নিটোল, পূর্ণাঙ্গ নিজের মতো আত্মপ্রকাশ ঘটল যখন বিকাশ রায়, বীরেন নাগ, সুবোধ দাশ ও অজয় কর যৌথ উদ্যোগে তৈরি করলেন ‘চয়নিকা চিত্রমন্দির’ ও ‘সিনে ক্রাফট্স’ প্রযোজনা সংস্থা এবং অজয় করের পরিচালনায় তৈরি হল, ‘জিঘাংসা’।
জিঘাংসা ছবি কত বিখ্যাত হয়েছিল, তার জলার আলো-আঁধারির দৃশ্য কতটা জনপ্রিয় ছিল, সে কথা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে চলেছে। আমি শুনেছি আমার জ্যাঠা-বাবাদের কাছে, অন্যরা হয়তো শুনেছে অন্য কোনও বাড়ির অজয় কর-পাগল মানুষদের কাছ থেকে। কিন্তু এ সবের থেকেও ওঁর বেশি দক্ষতা ছিল বাঙালির মন বোঝার ক্ষেত্রে। উনি একটি বাঙালি চাল টিপে বুঝে ফেলতে পারতেন বাঙালি জাতির ভাতের চরিত্র। অজয় করের সিনেমার মধ্যে কেমন যেন একটা মৃদু আনন্দ, একটা ব্যাথার আবেশ কিছুটা না-পাওয়া আবার শেষে এসে পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠার একটা বৃত্ত ছিল। সে মাল্যদানের যতীনের চরিত্রের মমত্ব, যা প্রেমের মোড়কে কুড়ানির কাছে শাশ্বত হয়ে ওঠে। কিংবা রিনা ব্রাউনের প্রেমের বিশ্বাসে আঘাত, সে আজীবন রেভারেন্ড কৃষ্ণেন্দু মুখার্জির বাবার আজ্ঞা পালন করে চলে। আর কৃষ্ণেন্দু একনিষ্ঠ থেকে যায় তার নিজের যন্ত্রণার প্রতি। উত্তরণের চেষ্টা মানুষ হিসেবে করে, নিজের যন্ত্রণা থেকে নিজেকে কখনও মুক্ত করে না।
এমন হাজারও উদাহরণ দেওয়া যায় অজয় করের পরিচালনার। বাঙালি সব সময় গদগদ এবং গ্যাদগ্যাদে ইমোশনে বয়ে চলা জাত, সেই বাঙালির ইমোশনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে, সেই ইমোশনকেই অত্যন্ত সংযত ভাবে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করেছেন অজয় কর। সাত পাকে বাঁধা সিনেমায় দুই প্রধান চরিত্র, সুখেন্দু ও অর্চনার মধ্যে কখনও ভালবাসা শেষ হয় না। প্রশ্ন জাগে এক জন হয়তো খানিক প্রতিশোধের বশে আরও একটি বিবাহ করে। অন্য জন মায়ের প্রতি, বাবার প্রতি, বিশ্ব সংসারের প্রতি অভিমানে নিজের ওপর প্রতিশোধ তোলে, নিজেকে পলে পলে কষ্ট দিয়ে। হরেক ইমোশনের এই বৃত্ত অনবরত ভাঙা-গড়া করতে এবং তাকে রূপায়িত করতে যে মুন্সিয়ানা লাগে তা নিশ্চিত ভাবেই অজয় করের আয়ত্তে ছিল। তিনি সত্যজিৎ রায় নন, মৃণাল সেন নন। তিনি শ্বাশত বাঙালির প্রতিচ্ছবি, যিনি বাঙালি আসলে কী ভাবে চিন্তা করে, তার মনন কী, তাঁর অনুভূতির তার কোথায় বাঁধা—এ সবই আয়নার মতো তুলে ধরতে পেরেছিলেন। মোদ্দা কথা বাঙালি কোন ধারাটা মেনে চললে একটা সূক্ষ ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে তার অতিনাটকীয়তা এবং যাপনের মধ্যে, সেটাই অজয় কর অত্যন্ত সফল ভাবে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিলেন আমাদের কাছে আমাদের জীবন। এবং সেই জন্যই তাঁর বক্স অফিস সব সময় পূর্ণ।
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।