সন্ন্যাসীর আবার খাই খাই কেন? আসলে, ঠাকুর রামকৃষ্ণের ভাবশিষ্য বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda) তাঁর জীবনকালে অক্ষরে অক্ষরে গুরুবাক্য মেনে চলেছেন। গুরু বলতেন, “খালি পেটে ধর্ম হয় না।”
শৈশব থেকেই পছন্দ ছিল বাসমতী চালের ভাত, পোলাও। হয়ত তখন থেকেই তাঁর ‘জিভেখড়ি’ হয়ে যায়। নিজে খেতে ভালবাসতেন কচুরি। এতটাই অনুরক্ত ছিলেন যে কোনও এক সাধুকে মজার ছলে বলেন, “আমি গিরি বা তোতাপুরী, কোনো সম্প্রদায়ের নই, আমি কচুরি।” কাঁচা লংকার প্রতি ছিল অমোঘ টান। যে লংকা দুটো খাওয়ার পর অন্যের চোখে জল, সেখানে তিনি সেই ঝাল লংকা চিবিয়েই যাচ্ছেন। আর ছিল অমিত চানাচুর-প্রীতি।
শুধুমাত্র তিনি যে রসনা-রসিক ছিলেন তাই নয়, তিনি একজন উচ্চমানের রাঁধুনিও ছিলেন। চপ কাটলেটও খুব ভালো বানাতেন। গুরুভাইদের নির্দেশ দিচ্ছেন খাবার সুস্বাদু করার জন্যে যেন কাঠের আঁচে রান্না করা হয়।

স্বামীজীর (Swami Vivekananda) মাংসপ্রীতি ছিল প্রশ্নাতীত, তিনি বিশ্বাস করতেন আমিষ খাবারের সঙ্গে ধর্মের কোনও বিরোধ নেই। বিবেকানন্দের মাংসপ্রীতি সম্বন্ধে স্বামী অভেদানন্দ লিখেছেন, “সেদিন নরেন বলিল, চল আজ তোদের কুসংস্কার ভাঙিয়া দিই…। সন্ধ্যার সময় কাশীপুর বাগান হইতে পদব্রজে আমরা নরেনের সঙ্গে বিডন স্ট্রিটে বর্তমানে যেখানে মিনার্ভা থিয়েটার, তাহার নিকটে পীরুর দোকানে উপস্থিত হইলাম। নরেন ফাউলকারি অর্ডার দিল…। রাত্রে কাশীপুরে ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিলেন, কোথায় গিয়েছিলি? আমি বলিলাম, কলিকাতার বিডন স্ট্রিটে পীরুর দোকানে।… জানতে চাইলেন কী খেলি? আমি বলিলাম মুরগির ডালনা। শেষ পর্যন্ত ঠাকুর ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন, বেশ করেছিস।” হাইকোর্ট মান্যতা দিল। খেয়াল রাখা দরকার, সেই সময় বাঙালির হেঁশেলে মুরগির ডিম বা মুরগি কোনওটাই ঢুকত না।

নরেন্দ্রনাথের অতিরিক্ত মুরগি-প্রীতি বিষয়ে কোনও একজন ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কাছে নালিশ করেন। ঠাকুরের জবাব ছিল, “খেয়েছে তো কী হয়েছে! তুই যদি রোজ হবিষ্যিও খাস, আর নরেন যদি রোজ হোটেলে মাংস খায়, তা হলেও তুই নরেনের সমান হতে পারবি না।” এ তো একেবারে সুপ্রিম কোর্টের শিলমোহর, ‘আমিষের সাথে ধর্মবোধের বিরোধ নেই’। এই মাংসপ্রীতির ধারা বজায় ছিল সন্ন্যাস জীবনেও। শিকাগো ধর্ম-মহাসভায় যাওয়ার আগে তিনি পরম মমতায় তাঁর গুরুভাইদের ও শুভানুধ্যায়ীদের নিজহাতে পোলাও মাংস রেঁধে খাইয়েছিলেন। এই রসনাপ্রীতির জন্যে ওঁকে বিদ্রুপেরও সম্মুখীন হতে হয়েছিল। অন্য অনেক ব্যাপারের মতো এগুলোকেও তিনি নিজগুণে বিন্দুমাত্র আমল দেননি। তাঁর মরজীবন গত হওয়ার পর অমৃতবাজার পত্রিকার হেডলাইন হয়েছিল, ‘A meat eating Sadhu’.

মাংসের মতোই স্বামীজির অতি প্রিয় ছিল জলের রুপোলি ফসল— ইলিশ। ১৯০১ সালের ৬ জুলাই বেলুড় মঠে বসে তিনি এক চিঠিতে ক্রিস্টেনকে লিখেছিলেন, পৃথিবীতে এমন জিনিসটি আর হয় না। নদীতে ইলিশ উঠেছে। লিখছি আর দেখছি। নীচে শত শত মাছ ধরার নৌকা, সবাই মাছ ধরায় ব্যস্ত। আমাদের ইলিশ তোমাদের আমেরিকান ইলিশের চেয়ে বহুগুণে উৎকৃষ্ট।
খাদ্যরসিক বিবেকানন্দের নশ্বর জীবনের শেষ দিনেও মধ্যাহ্নভোজনের মেনুতে ইলিশ বাদ পড়েনি। স্বামী প্রেমানন্দের একটা চিঠি থেকে বিবেকানন্দের শেষ মধ্যাহ্নভোজন সম্পর্কে জানা যায়— “গঙ্গার একটা ইলিশ মাছ এ বৎসরে এই প্রথম কেনা হল। তার দাম নিয়ে আবার কত রহস্য হতে লাগল। একজন ছিল তাকে বললেন,‘তোরা নূতন ইলিশ পেলে নাকি পূজা করিস, কী দিয়ে পূজা করতে হয় কর’… আহারের সময় অতি তৃপ্তির সহিত সেই ইলিশ মাছের ঝোল, অম্বল, ভাজা দিয়া ভোজন করিলেন, কহিলেন– একাদশী করে খিদেটা খুব বেড়েছে, ঘটিবাটিগুলো ছেড়েছি কষ্টে।”
আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথের শ্রীরামকৃষ্ণ
নরেন, পরবর্তীকালের স্বামী বিবেকানন্দ, যতটা ভোজন-রসিক ছিলেন, তার থেকে বেশি ছিলেন রসনা-রসিক। নিজে খেতেন অল্প, অন্যদের খাইয়ে পেতেন অপার আনন্দ। এও যেন এক ধরনের জীবসেবা, যা প্রকৃত অর্থেই তাঁর কাছে ছিল ঈশ্বরসেবা।
*তথ্যসূত্র:
১. Complete Works of Swami Abhedananda, by Abhedananda.
২. Life of Swami Vivekananda, by Eastern and Western disciples.
*ছবি সৌজন্য: Wikipedia, RKMath.org
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, পাহাড়িয়া এবং ভ্রামণিক, আলোকচিত্র শিল্পী (জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত), ললিত কলা একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত (অনার মেন্সান), ‘Federation International de la Arte Photograhoque’ থেকে Excellence Honors প্রাপ্ত (EFIAP)। এছাড়াও তিনি একজন প্রকৃতি প্রেমিক ও পুষ্পপ্রেমিক। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের পুষ্প প্রদর্শনীর বিচারক। ওঁর লেখা প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।
16 Responses
কত কি জানার।
স্বামীজীর মতন এক যুগপুরুষের এই মাটির কাছাকাছি রূপটা আমাদের কাছে অনেক অংশেই অজানা। লেখক, নিজে রসনা রসিক বলে এই তথ্যগুলো পরিবেশন করেছেন সুললিত ভাবে।
ধন্যবাদ স্বপন। স্বামীজীর ব্যাপ্তি এত বিশাল রে তার হদিস পাওয়া ভার।
C. Ghosh. স্বামীজী সম্বন্ধে অনেক জানা বাকি।
Very beautiful and informative presentation. It clearly shows us the lesser-known parts of Swamiji’s life. Thank you Sir for enlighten us.
প্রান্তিক, স্বামীজী এক উচ্চ পর্যআয়এর রন্ধন শিল্পী ছিলেন। উনি কি ছিলেন না, সেটাই ভাবায়।
Thank you Subhadeep for your kind words.
Sir very informative regarding unknown part of Swamiji life.Excellent.🙏
এইটুকু ছোট্ট জীবনে স্বামীজীর এত কর্মকান্ড ভাবতেই পারা যায়না। ভারতবর্ষের একটা বড় অংশ তো পায়ে হেঁটেই ঘুরেছিলেন।তাঁর পায়ের নিচের ধুলার একটা কণাও যদি হতে পারতাম।
অসাধারণ লেখা। এত সাবলীল ভাবে এত গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয় পরিবেশন করার জন্য ধন্যবাদ।
U. B. Thakur, স্বামীজীর মঊল্যআ
U. B. Thakur, স্বামীজীর মূল্যায়ন এখনো বাকি।
🙏
Very interesting.প’ড়ে ভাল লাগল ।
অনেক ধন্যবাদ চিত্রলেখা রায়।
অভয়, সুন্দর বলেছ, ভজনানন্দ ও ভোজনানন্দ। তবে মনে হয় আরো একটা হবে অন্তত, চেতনানন্দ।
Life of SWAMI VIVEKANANDA Was Full of Thrills & Inspiration . Dr. Asoke Kumar Ghosh will be ever RESPECTED FOR INFORMING Us a part of it . Thank You SIR. – SATYTENDRA, A Man of 75+ Age.