Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

বিপ্লবী শান্তি-সুনীতি, বিস্মৃতির শতবর্ষ পরে

রজত চক্রবর্তী

সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৩

Article on freedom fighter Shanti Suniti
Article on freedom fighter Shanti Suniti
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

সিল্কের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিলো গায়ে। আয়নায় একবার দেখে নিলো নিজেকে, ঘুরেফিরে। বুকের মাঝখানে হাত দিয়ে দেখল ঠিকঠাকই আছে যন্ত্রটা। ঠান্ডা। শাড়ির কুঁচিটা একবার ঠিক করল। একবার গোড়ালি দিয়ে চেপে ধরে পেছনদিকের কাপড় ঠিক করে নিলো। আজ জিরো আওয়ারের ক্লাস আছে বলে তাড়াতাড়ি স্কুলে বেরনোর প্রস্তুতি। এরকমই বাড়িতে বলা আছে। দিনটা ১৪ই ডিসেম্বর, ১৯৩১। ক্লাস এইটের ছাত্রী। সকাল সাড়ে ন’টা। এমনিতে স্কুলের একটা বাস আসে নিয়ে যেতে। কিন্তু আজ আগেই বেরতে হবে। বেরিয়ে পড়ল। বন্ধু শান্তি ঘোষও (Shanti Ghosh) বেরিয়ে পড়েছে। শাড়ি আর সিল্কের চাদর। গল্প করতে করতে চলেছে দু’জন। ছ’সাত মাসের বড় শান্তি। ন্যাশনাল গার্লস স্কুলের সামনে ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সতীশ রায়। দুই কিশোরী চেপে বসল ঘোড়ার গাড়িতে। গাড়ি চলতে শুরু করল।

সুনীতি চৌধুরী (Suniti Chowdhury) আর শান্তি ঘোষ (Shanti Ghosh)। দু’জনেরই ব্লাউজের ভেতরে লুকোনো আছে পটাসিয়াম সায়ানাইডের ছোট্ট শিশি আর ঠান্ডা ছোট্ট দুটি মেশিন। ৪৫০ বোরের পিস্তল শান্তির কাছে আর ৩২০ বোরের পিস্তল সুনীতির কাছে। মণীদা, মানে মণীন্দ্রলাল চৌধুরী, পিস্তল পৌঁছে দিয়েছিল শান্তির কাছে। তারপর শান্তি থেকে সুনীতির কাছে। ঘোড়ার গাড়ি এগোচ্ছে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোর দিকে। কুমিল্লার কুখ্যাত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ স্টিভেন্স। অখিলচন্দ্র নন্দী তাঁর ‘বিপ্লবীর স্মৃতিচারণ’-এ লিখছেন – ‘গায়ে সিল্কের চাদর, জামার ভেতরে আগ্নেয়াস্ত্র, একটু পরেই বিরাট একটি বপুর সামনে দাঁড়াতে হবে ঐ ছোট্ট দুটি মেয়েকে। কিন্তু একটুও ভয় নেই তাদের, বেশ গল্প করছে ও হাসছে। যেন সেজেগুজে পিকনিকে যাচ্ছে। আমাকে দেখে হাসতে লাগল, ভাবখানা এই – একটু পরেই বিজয় পতাকা উড়িয়ে দেব’।

Shanti Ghosh
বিপ্লবী শান্তি ঘোষ

 ঘোড়ার গাড়ি এসে থামল কালেক্টর অফিসের সামনে। সুনীতির বাবা, উমাচরণ চৌধুরী কালেক্টার অফিসেই চাকরি করতেন। সুনীতি’র তাই ঢুকতে কোনও সংকোচ বা অসুবিধা হল না। সঙ্গে শান্তি। দুই কিশোরী। বেণি দুলিয়ে সোজা কালেক্টারের দরজার সামনে। হাতে একটা দরখাস্ত— মেয়েদের সাঁতার শেখার ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি সংক্রান্ত। সুনীতি’র স্মৃতিচারণে – “বিনা বাধায় বারান্দা পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম। এবারে এক আর্দালীর সাক্ষাৎ মিললো। ইন্টারভিউ স্লিপ নিয়ে ভেতরে গেল সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেড়িয়ে এল বাঙালী এসডিও (নাম ছিল, নেপাল সেন) সহ স্বয়ং শ্বেতকায় মিঃ স্টিভেন্স। আমাদের হাতে দরখাস্ত ছিল, দেখল ভালো করে।…সাহেব আমাদের দরখাস্তের উপর রেফারেন্স লিখতে ভেতরে চলে গেল। এতটা সময় নষ্ট করা উচিৎ হয়নি। এর মধ্যেই তো কাজ শেষ করবার কথা। প্রমাদ গুনলাম- কি হবে যদি আর না আসে? যদি আর্দালীর হাতেই পাঠিয়ে দেয় দরখাস্তটা— তাহলে সব পরিকল্পনা তো ভেস্তে গেল। না। আমাদের সকল চিন্তা দূর করে আমাদের সামনে উপস্থিত হলো দু’জনেই…যদিও আমাদের লক্ষ্য একজন। লক্ষ্য সম্পর্কে আমরা ততক্ষণে সজাগ সতর্ক। লক্ষ্যভেদে একান্ত প্রস্তুত। এবার আর মুহূর্ত বিলম্ব হলো না। রিভলবার ব্লাউজের ভেতর থেকে বের করে চাদরে ঢাকা হাতে নিয়ে একেবারে উদ্যত। সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আর কথা নয় ছুটলো বুলেট। সাহেব দুজনও ছুটল ঘরের ভেতরের দিকে, আর আমাদের পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের পিঠের উপর বেয়ারা-আর্দালীর দল, মায় বাগানের মালিরাও বাদ গেল না।”

আরও পড়ুন: অপরাজেয় ডাক্তার হৈমবতী সেন

সুনীতির হাতের তালু এত ছোট ছিল যে, তর্জনি পিস্তলের টিগার্টে পৌঁছত না, তাই সে মধ্যমা দিয়ে গুলি চালানো প্র্যাকটিস করেছিল। অব্যর্থ লক্ষ্য। প্রথমে কিল-চড়-লাথি-ঘুষি, তারপর গরুর দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হল কিশোরী দু’জনকে। নাহ, মহিলা পুলিশ ছিল না তখন। দুই ফুলের মতো কিশোরীকে বেঁধে ফেলে রেখেছে বারান্দায়। সমস্ত কাগজে উঠেছিল প্রতিবাদের ঝড় এই প্রকাশ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে। আর মেয়ে দু’টি? ভাবছে সফল, না বিফল? ভারি পর্দার তলা দিয়ে কোনওরকমে দেখার চেষ্টা করছে ঘরের ভেতরে। অন্ধকার নেমে আসছে চোখ জুড়ে। অত্যাচারী শাসক ঘরে শুয়ে আছে। সাদা চাদরে ঢাকা। তাহলে আমরাও পেরেছি স্বাধীনতার লড়াইয়ে কিছুটা ভূমিকা পালন করতে! সারা গায়ে ব্যথা। কালশিটে। জমাট রক্ত। অনেক কষ্টে একে অপরের দিকে তাকাল শান্তি আর সুনীতি। দু’জনের চোখে তৃপ্তি। চোখে বন্ধ করল সুখে। ঠোঁট দুটো অস্ফুটে বলে উঠল— বন্দেমাতরম।

Suniti Choudhury
বিপ্লবী সুনীতি চৌধুরী

সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ল দুই কিশোরীর কথা। বেলা একটায় পিছমোড়া করে তাদের চাপানো হল প্রিজন ভ্যানে। রাস্তার দু’পাশে জনসমাগম। দুই কিশোরী চিৎকার করে উঠল– ‘বন্দেমাতরম’। সে শব্দ ছড়িয়ে পড়ল ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল-কানাইলালের বাংলায়, মাস্টারদার বাংলায়, অরবিন্দ-বাঘাযতিন-রাসবিহারীর বাংলার পথে ঘাটে। ক্লাস এইট আর ক্লাস সেভেন, দুই কিশোরী, সদ্য ফোটা ফুলের মতো কোমল কিন্তু ভেতরে তাদের বজ্রের কাঠিন্য। অকথ্য অত্যাচারের চিহ্ন সারা গায়ে। তল্লাশির নামে খুলে নেওয়া হয়েছিল তাদের পরনের শাড়ি। সে নিয়ে বিস্তর লেখালেখি কাগজে কাগজে। কিছুই জানে না দু’জন। জানে না তাদের জন্য কোন মারাত্মক শাস্তি অপেক্ষা করে আছে। জানতেও চায় না। তারা জানে শুধু, শুধুমাত্র, দেশকে স্বাধীন করার জন্য তাদের উপর যে আদেশ এসেছিল, তা সফল করতে পেরেছে। ছড়িয়ে পড়ল বাংলার ঘরে ঘরে দুই বীরাঙ্গনার কথা। দুই কিশোরীর ছবিসহ পামফ্লেট বিলি হতে লাগল হাজারে হাজারে। স্বাধীনতার ডাক। সংগ্রামের ডাক।

আবেগের উন্মাদনায় একটা কাজ সংগঠিত করে ফেলা এক কথা, কিন্তু উন্মাদনার রেশ কেটে যাওয়ার পর জেলে, কারাগারের অন্ধকারে, দৈহিক ও মানসিক অত্যাচারের মুখোমুখি হওয়ার সময় প্রমাণিত হয় মানসিক দৃঢ়তা, যা উৎসারিত হয় আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা থেকে। বারো দিন কুমিল্লা জেলে রেখে পর্যুদস্ত পুলিশের কর্তারা। শত অত্যাচারেও মুখ দিয়ে একটি শব্দ বার করাতে পারেনি তারা। তড়িঘড়ি ওদের পাঠিয়ে দিল কলকাতায়। ২৭শে ডিসেম্বর ১৯৩১। 

pamphlet
দুই কিশোরীর ছবিসহ পামফ্লেট বিলি হতে লাগল হাজারে হাজারে

কলকাতায় ওদের বিচারের জন্য গঠন করা হল বিশেষ আদালত। কলকাতায় আলিপুর সেন্ট্রাল জেল। গোপন তথ্য বার করার জন্য আরও ভয়ংকর অত্যাচার, কুখ্যাত পুলিশ অফিসারদের। বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, নগ্ন দেহে বরফের উপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুইয়ে রাখা, নখের ডগায় পিন ঢুকিয়ে দেওয়া— এইসব অত্যাচারের কথা শুনেছিল ওরা। মুখোমুখি হতে যাচ্ছে এবার। চাঁদপুর থেকে গোয়ালন্দ, স্টিমারে আসছে পুলিশ পাহারায়। কী করছিল কিশোরী দু’জন! প্রিয় দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে বলে চোখ জলে ভরে যাচ্ছিল! না। স্টিমারে দু’জনে একে অপরের আঙুলগুলো নিজের হাতের ভেতর শক্ত করে ধরেছিল। তারপর আঙুলের ডগায় পিন ফুটিয়ে দিচ্ছিল সজোরে। সহ্যশক্তি বাড়াচ্ছিল দু’জনে এইভাবে। আর প্রতিজ্ঞা করছিল, শত অত্যাচারে কোনও তথ্য ফাঁস করবে না। মৃত্যু এলেও নয়। ক্লাস এইটের শান্তি আর সেভেনের সুনীতি। শান্তি দাস (ঘোষ) জন্মেছিলেন ২২ নভেম্বর, ১৯১৬। সুনীতি চৌধুরী (ঘোষ) জন্মেছিলেন ২২ মে, ১৯১৭। জন্মের শতবর্ষ পেরিয়ে গেল অনাদরে, অবহেলায়। আমরা মনে রাখতে জানি না, কারণ, মুহূর্তের জীবনকেই তো যাপন করার উৎসবে মেতে উঠি। ভুলে যাই আমাদের উৎসভূমি। শিকড়।

কলকাতায় আলিপুর সেন্ট্রাল জেল। গোপন তথ্য বার করার জন্য আরও ভয়ংকর অত্যাচার, কুখ্যাত পুলিশ অফিসারদের। বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, নগ্ন দেহে বরফের উপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুইয়ে রাখা, নখের ডগায় পিন ঢুকিয়ে দেওয়া— এইসব অত্যাচারের কথা শুনেছিল ওরা। মুখোমুখি হতে যাচ্ছে এবার।

 জেলের গাড়ি সশস্ত্র পুলিশে বোঝাই। তার মাঝে খদ্দরের লাল পাড় শাড়ি ও লাল ব্লাউজ পরে বসে আছে দুটি রক্তকরবী ফুল। দুই মেয়ের আবদারে শান্তি দাসের মামা আগের দিনই দিয়ে গেছিল খদ্দরের শাড়ি ও ব্লাউজ। এ নিয়েও বিস্তর জেদাজেদির ঘটনা ঘটেছিল জেলারের সাথে। কলকাতা হাইকোর্ট। গাড়ি গিয়ে পৌঁছল গেটের সামনে। গেটের দু’পাশে সার দিয়ে পুলিশবাহিনী। তার মাঝখান দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দুই কিশোরীকে। কোর্ট-কক্ষে তিল ধারণের জায়গা নেই। কাঠগড়ায় ভোরের মাধবীলতার মায়া মেখে দুটি কন্যা। নিশ্চুপ কোর্টকক্ষ। বিচারক আসন নিয়েছেন। হঠাৎ দুই মেয়ে চিৎকার করে উঠল, আমাদের বসতে চেয়ার দেওয়া হোক। আত্মমর্যাদাবোধ। স্থির দৃষ্টি বিচারকের দিকে, যার হাতে আছে ওদের মৃত্যু পরোয়ানা। চেয়ার আনা হল শেষমেশ।

handcuffed-hands

১৮ জানুয়ারি, ১৯৩২ থেকে মামলা চলেছিল ২৮ জানুয়ারি, ১৯৩২ পর্যন্ত। চূড়ান্ত রায় ঘোষণার দিন, ২৮ জানুয়ারি ’৩২, সকাল আটটায়, দু’জনকে নিয়ে যাওয়া হল হাইকোর্টে। সাড়ে ন’টা। বিচারক এলেন। রায় পড়তে লাগল ঘণ্টা দেড়েক। দণ্ডাদেশ ঘোষিত হল অবশেষে – ‘যাবজ্জীবন কারাবাস’। দু’জনের মুখের হাসিটুকু মিলিয়ে গেল। দু’জনেই চেয়েছিল ফাঁসি। জীবনকে বলি দিয়ে জীবন জাগানোর শপথ। শান্তি দাস তাঁর স্মৃতিচারণে লিখছেন— ”ফাঁসির আদেশের প্রতীক্ষা করছিলাম। তাই যাবজ্জীবন কারাবাসের দণ্ডাদেশে যেন হতাশ হলাম। চরম মুক্তির পূর্ব মুহূর্তে এ যেন চিরজীবনের বন্ধনের ব্যবস্থা।”

সাড়ে ন’টা। বিচারক এলেন। রায় পড়তে লাগল ঘণ্টা দেড়েক। দণ্ডাদেশ ঘোষিত হল অবশেষে – ‘যাবজ্জীবন কারাবাস’। দু’জনের মুখের হাসিটুকু মিলিয়ে গেল। দু’জনেই চেয়েছিল ফাঁসি। জীবনকে বলি দিয়ে জীবন জাগানোর শপথ। 

জেনানা ফাটক। প্রেসিডেন্সি জেল। জেলে তখন বিপ্লবী কমলা দাশ, বিভা দাশগুপ্তরা ওদের অভ্যর্থনা করল। সুনীতির ডাকনাম ছিল বুলবুল। মিষ্টি গলা। গানে গানে ভেঙে দিতে পারত কয়েদখানার গরাদ।
তারপর মেদিনীপুর জেল। যেদিন হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠতে গেছে, সেদিন স্টেশনে কাতারে কাতারে মানুষ। কুলি-কামিন থেকে শুরু করে সবাই পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে চিৎকার করছিল— বন্দেমাতরম। দুটি কিশোরীর দেশের প্রতি আত্মত্যাগ নাড়িয়ে দিয়েছিল বেঁচে থাকার অর্থ। ট্রেন ছেড়ে দেবার পরেও সবাই পেছন পেছন দৌড়েছিল আবেগ আর ভালোবাসায়। তারপর কারাজীবন। কোনও ক্ষোভ বা হতাশা তাদের কারাজীবনে দেখা যায়নি, সমর্পণের তেজ ছিল সে জীবনযাপনে। দেশের জন্য কিছু করতে পারার তৃপ্তি ছিল।

Jail Prison
দণ্ডাদেশ ঘোষিত হল অবশেষে – ‘যাবজ্জীবন কারাবাস’

খাওয়া তখনও শেষ হয়নি, জমাদারনি তাড়া লাগালো, শিগগির তৈরি হয়ে নিন, গান্ধিজী এসে পড়বে এখুনি। খেয়ে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই দরজায় টুক টুক শব্দ। গান্ধী-টুপি পড়া ফর্সা, লম্বা, সুদর্শন এক ভদ্রলোক এবং তাঁর পেছনে গান্ধিজী। সালটা ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। ব্রিটিশ কর্তারা বাংলার বন্দিদের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি দিয়েছে গান্ধিজীকে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন শুরু হয়েছে। গান্ধিজী এসেছেন প্রেসিডেন্সী জেলে। বন্দিমুক্তি আন্দোলন তখন চলছে। বাংলার বিভিন্ন জেল থেকে প্রতিনিধি হিসাবে কয়েকজনকে আনা হয়েছে প্রেসিডেন্সী জেলে। শান্তি আর সুনীতি এসেছে মেদিনীপুর জেল থেকে। কথা বলছে গান্ধিজীর সাথে। দু’জনেই দয়াভিক্ষার বিরোধী, দু’জনেই সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী। বিতর্ক ছিল আলোচনায়। বাপুজি ছিলেন অচঞ্চল। শান্তি দাসের কথায় – “বিদায় নেবার আগে গান্ধিজী প্রতিশ্রূতি দিয়ে গেলেন, ‘তোমাদের মুক্তি আমি অর্জন করবই। তোমাদের প্রতিষ্ঠিত করব স্বাভাবিক জীবন-যাত্রার মধ্যে’। মুক্তির জন্য সময় লাগল আরও কিছুটা। ২৪ এপ্রিল, ১৯৩৯। শান্তি-সুনীতির কারাগার জীবন শেষ হল।

Gandhi
রাজনৈতিক পটপরিবর্তন শুরু হয়েছে। গান্ধিজী এসেছেন প্রেসিডেন্সী জেলে

শুরু হল আরেক নতুন দীর্ঘ লড়াই। হার না মানা এই মানসিক জোর এরা কোথা থেকে পেয়েছিল! ভাবলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়! নিজের উপর কতখানি বিশ্বাস ও আস্থা থাকলে আর কত সুদৃঢ়ভাবে পা দুটি মাটিতে প্রোথিত থাকলে এই জোর পাওয়া যায়। ভাসমান অ্যাপ সমৃদ্ধ নকলনবিশ ধার করা জীবন নয়। মাথা উঁচু করে নিজেকে ও চারপাশকে দাঁড় করানোর জেদ। জেল থেকে যখন বেরোলেন দু’জনে, শান্তির বয়স ২৩ আর সুনীতির ২২। ম্যাট্রিক, আইএসসি, এমবি (বর্তমানে এমবিবিএস) একে একে দুরন্ত রেজাল্ট করে ডাক্তার হলেন সুনীতি। কোন অবস্থায়! যখন তাঁর বাবার পেনশন বন্ধ পুলিশি অত্যাচারে, দুই দাদা গ্রেফতার আর ছোটভাই শুধু দু’বেলা দুমুঠো খাবার যোগানোর জন্য ফেরিওয়ালা হয়ে ঘুরে ঘুরে যক্ষ্মায় মারা গেছে। সেই নিরন্ন অবস্থা থেকে আরেক লড়াইতে জয়ী হলেন। ডাঃ সুনীতি চৌধুরী হলেন। আজীবন দুঃস্থ গরিবদের সেবা করে গেলেন। লড়াই করলেন গণতন্ত্রের পক্ষে। ১৯৪৭ সালে বিয়ে করলেন কমিউনিস্ট ট্রেড ইউনিয়নের নেতা প্রদ্যোৎকুমার ঘোষকে। অন্যদিকে শান্তি ঘোষ বেঙ্গলি উইমেনস কলেজ থেকে পাশ করলেন। কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন। ১৯৪১ সালে নেতাজীর সাথে তাঁর দীর্ঘ কথা হল। ১৯৪২ সালে যোগ দিলেন কংগ্রেসে, দেশ গড়ার কাজে। বিয়ে করলেরন অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন দাসকে, সংসারজীবনে থিতু হলেন। ১৯৫২-৬২ এবং ৬৭-৬৮, তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ লেজিলেস্টিভ কাউন্সিলের সদস্য। ১৯৬২-৬৪ ছিলেন লেজিলেস্টিভ অ্যাসেম্বলির মেম্বার। এগুলি সংক্ষেপে উল্লেখ করার কারণ একটাই, জীবনকে তীব্র ভালোবাসাময় যাপনযোগ্য করার লড়াই থেকে একমুহূর্ত সরে না আসার উদাহরণ রাখার জন্য। স্বাধীনতার পর সুনীতি চন্দননগর হাসপাতালে যোগ দিলেন ডাক্তার হিসাবে। লেডি ডাক্তার প্রান্তিক মানুষদের ‘মা’ মারা গেলেন ১২ জানুয়ারি, ১৯৮৮। শান্তি ঘোষের জীবনাবসান ঘটল একবছর পর, ১৯৮৯ সালে।

নিঃশব্দে অজান্তেই চলে গেল দুই বীরাঙ্গনার জন্মের শতবর্ষ। ‘শান্তি-সুনীতি’ একসঙ্গে উচ্চারিত হত বিপ্লবীদের কাছে। অথচ স্বাধীন দেশে তাঁরা অনুচ্চারিতই থেকে গেলেন আড়ালবাসী হয়ে। 

তথ্যসূত্র:

ভারতী সেন (বিপ্লবী সুনীতি চৌধুরীর কন্যা), সুনীতি চৌধুরী, শান্তি ঘোষ  বিপ্লবী অখিল নন্দী ও বিপ্লবী বীণা ভৌমিকের (দাস) স্মৃতিচারণ।

 

ছবি সৌজন্য: লেখক,  Istock, Pixabay, Facebook

Author Rajat Chakraborty

আঞ্চলিক ইতিহাস ও বিস্মৃত বাঙালি রজত চক্রবর্তীর চর্চার প্রিয় বিষয়। বর্তমান পত্রিকা, ভ্রমণআড্ডা, হরপ্পা, পরম্পরা, মাসিক কৃত্তিবাস, নতুন কৃত্তিবাস ইত্যাদি নানা পত্রিকায় তাঁর লেখালেখি দেখা যায়। পঞ্চাননের হরফ, গৌরপ্রাঙ্গনের গোরা, আশকথা পাশকথা, পান্থজনকথা তাঁর উল্লেখযোগ্য বই। বাংলার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের খোঁজে 'ধুলো মাটি বাংলা' প্রকাশিতব্য।

Picture of রজত চক্রবর্তী

রজত চক্রবর্তী

আঞ্চলিক ইতিহাস ও বিস্মৃত বাঙালি রজত চক্রবর্তীর চর্চার প্রিয় বিষয়। বর্তমান পত্রিকা, ভ্রমণআড্ডা, হরপ্পা, পরম্পরা, মাসিক কৃত্তিবাস, নতুন কৃত্তিবাস ইত্যাদি নানা পত্রিকায় তাঁর লেখালেখি দেখা যায়। পঞ্চাননের হরফ, গৌরপ্রাঙ্গনের গোরা, আশকথা পাশকথা, পান্থজনকথা তাঁর উল্লেখযোগ্য বই। বাংলার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের খোঁজে 'ধুলো মাটি বাংলা' প্রকাশিতব্য।
Picture of রজত চক্রবর্তী

রজত চক্রবর্তী

আঞ্চলিক ইতিহাস ও বিস্মৃত বাঙালি রজত চক্রবর্তীর চর্চার প্রিয় বিষয়। বর্তমান পত্রিকা, ভ্রমণআড্ডা, হরপ্পা, পরম্পরা, মাসিক কৃত্তিবাস, নতুন কৃত্তিবাস ইত্যাদি নানা পত্রিকায় তাঁর লেখালেখি দেখা যায়। পঞ্চাননের হরফ, গৌরপ্রাঙ্গনের গোরা, আশকথা পাশকথা, পান্থজনকথা তাঁর উল্লেখযোগ্য বই। বাংলার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের খোঁজে 'ধুলো মাটি বাংলা' প্রকাশিতব্য।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com