যেকোনও উৎসবের প্রেক্ষাপটে প্রকৃতির যেমন অবদান থাকে, তেমনই কৃষ্টি-আচারের আমেজ-আবহাওয়ারও একটা ভূমিকা থাকে। অনেকেরই অজানা এই লোকবিশ্বাস যে—মহালয়াতে জলগ্রহণ উৎসব সেরে দীপান্বিতা অমাবশ্যায় আলো দেখানো পথ ধরে ফিরে যান তৃপ্ত আত্মারা। দেবী লক্ষ্মী এবং মহালক্ষ্মী বলে কথিত কালীপূজার মাঝখানে চোখ এড়িয়ে যায় আমাদের দেবীলক্ষ্মীর বোন অলক্ষ্মীর পুজোয়। এই অলক্ষ্মীকে পুজো দিয়ে খুশি করে বিদায় দিয়ে তবেই হয় মহালক্ষ্মীপুজো। প্রকৃতিতে ফসলের মাঠ তখন সবুজের শূন্যতার হাহাকারে ভরা। তবু সোনালীরং এর কেমোফ্লাজ, মানুষের মনে ধরে। আমেরিকার প্রতিটি খামারে এই সোনালী খড়ের গাদা-কে ‘আরামের গদি’ বানিয়ে বসে পরে ইয়া হোৎকা গাঢ়-কমলা কুমড়োগুলো। সেই পুরু চামড়া কুমড়োগুলোর রান্নাঘরে কোনও কদর নেই, অন্যথা এর ছাল ছাড়াতে গেলে ‘ফ্রোজেন শোলডার’ অর্জন অবধারিত। (Halloween)

এই কুমড়োগুলোর আকার দেশীয় কুমড়োর চাইতে কম করে ছ’গুণ বড়। বটি-দা-ছুড়ি- এইটি কাটায় অচিরেই ‘অযোগ্য’ প্রমাণিত হয়। ভেতরটা তালের মতো আঁশের মণ্ডতে ভরা। বড়া তো দূরে থাক, আমার মতোই বে-গুনী। পরিষ্কার করে সেই মণ্ডগুলোকে তালের মতোই চাঁছতে হলেও বোঁটকা গন্ধ খুব। তবে এদেশে নুন মাখানো বিজ দিয়ে ‘রোস্টেড সিড’ খাবার রেওয়াজ রয়েছে বটেক। আবার আমেরিকাবাসী মধ্যপ্রাচ্যের বাসিন্দারা এ সময় ভাত ও মাংস একসঙ্গে সাঁতলে এই হোৎকা কুমড়োর মধ্যে ভাপিয়ে খায় তুরস্কের খাবার সুস্বাদু ‘বাল্কাবাজি দোলমাসি’। শুধু এই সময়েই এর আগমন!
কৃষিজমির মালিকেরা এই সময়ের সদ্ব্যবহার করতে ব্যবসা জমিয়ে বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরি করে নেন ‘পাম্পকিন প্যাচ’ আর ছোট্ট ওয়াগনে বা হুড খোলা জিপ জাতীয় গাড়িতে একচক্কর ঘুরিয়ে গুটিকয় পছন্দসই কুমড়ো বগলদাবা করে বাচ্চাদের ফিরিয়ে দেয় বাড়ি।
মা-বাবা-বাচ্চারা হেমন্তের এক হিমেল ঘুটঘুটে রাত্তিরে ভূতুড়ে চরিত্রের পোশাক পরে দোরে দোরে কড়া নেড়ে বলবে ‘ট্রিক অর ট্রিট’। আর বদলে ঝুলিতে ভরে উঠবে ক্যান্ডির পাহাড়।
যাঁরা ফার্মে যেতে পারলেন না, তাঁরা গ্রসারি স্টোরে এক হাতে সত্যিসত্যি কুমড়ো তোলেন, ‘জ্যাক ও লেনটার্ন’ বানাতে। সেই রামের সঙ্গে সুগ্রীব দোসরের মতো কুমড়ো কাটার বিশেষ যন্ত্রপাতিও। অন্যহাতে প্লাস্টিকের ‘জ্যাক ও লেনটার্ন’ কেনেন বাচ্চারা বাড়ি বাড়ি ক্যান্ডি সংগ্রহ করবে বলে। মা-বাবা-বাচ্চারা হেমন্তের এক হিমেল ঘুটঘুটে রাত্তিরে ভূতুড়ে চরিত্রের পোশাক পরে দোরে দোরে কড়া নেড়ে বলবে ‘ট্রিক অর ট্রিট’। আর বদলে ঝুলিতে ভরে উঠবে ক্যান্ডির পাহাড়। বাড়ি ফিরে বাছতে হবে কোনওটাতে এলার্জি হয় এমন আছে কী না। দিন শেষ হয়— মা-বাবা ও বাচ্চাদের মধ্যে উচ্চগ্রামের ‘ডিল’ দিয়ে, প্রতিদিন ক’টা করে খাওয়ার অনুমতি পাওয়া যাবে।
‘বাণিজ্যে বসতে উৎসব’— এভাবেই আজ ‘চলমান অশরীরি’। সরকারি সূত্র জানায় আমেরিকার মাটিতে প্রতিবছর ৯.১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়িত হয় এই উৎসবে।

এই অক্টোবর মাসের কান ঘেঁষেই প্রাচ্যের ভূতচতুর্দশী যখন, পাশ্চাত্যে তখন জোড়দার ‘হ্যালোইন উৎসব’। তবে বাহবা দিতেই হবে যে এই ভূতোৎযাপনকে কেমন করে এক ‘চাইল্ড-ফ্রেণ্ডলি’ উৎসব করে তুলতে পারল পাশ্চাত্য। একে তাই ‘চকলেট বিতরণ উৎসব’ বললেও ভুল হবে না। ‘রামনাম জপো’ বলে ভূতকে তাড়িয়ে দেওয়ার কোনও সিনসিনারি নেই। উপরন্তু সবার বাড়ির সামনের উঠোনই যেন প্যান্ডেল হয়ে ওঠে এক ভূতকেন্দ্রিক উদ্যাপনে। যেখানে দশফুট কঙ্কাল নানা স্বরে ডেকে যায়। কখনও বা বেশ কয়েকটি মিলে পিকনিক করে। গুলটি গুলটি বেলুনে, ধবধবে সাদা ভূতগুলো বাতাসে হেলছে দুলছে এদিক ওদিক। সুদীর্ঘ ধবধবে সাদা মাকড়সার জাল বুনছে নিকষ কালো দেড়হাত কালো মাকড়সা। আর গাছের ডালের আবছা আলোয় এদিক ওদিক ঝুলছে অসংখ্য বাদুর। রক্তমুখী পিশাচ, বিভৎস হাস্যমুখে ফোকলা দেঁতো ডাইনী, সবুজচোখী মিশমিশে কালো বেড়াল, ঘুতধুতে পেঁচার মেলায়, ঝাঁটা পিটিয়ে ডাইনি তাড়ানোর উপাখ্যান নেই, বরংচ ইয়াব্বরা ঝাঁটার ঝাণ্ডা হাঁকিয়ে এখানে দৃশ্যমান কুশ্রীডাইনি।
কুমড়োর চোখ মুখ এঁকে কেটে তৈরি ‘জ্যাক ও লেনটার্ন’-এর ভেতরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে ততক্ষণে কুপি সদৃশ মোমবাতি। তাই ‘জ্যাক ও লেনটার্ন’-এর চোখ, মুখ থেকে বেরুচ্ছে আগুনের হল্কা। সে-ই তখন বাড়িটির সিংহদুয়ারের দুপাশে সিংহের প্রক্সি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বাররক্ষী।
আর কুমড়োর চোখ মুখ এঁকে কেটে তৈরি ‘জ্যাক ও লেনটার্ন’-এর ভেতরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে ততক্ষণে কুপি সদৃশ মোমবাতি। তাই ‘জ্যাক ও লেনটার্ন’-এর চোখ, মুখ থেকে বেরুচ্ছে আগুনের হল্কা। সে-ই তখন বাড়িটির সিংহদুয়ারের দুপাশে সিংহের প্রক্সি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বাররক্ষী। ‘যদি কুমড়ো পটাশ নাচে, খবরদার যেও না কেউ…’
সুকুমার রায়ের সৌভাগ্য হয়নি হালের হ্যালোইন উৎসব দেখে যাওয়ার কিংবা অগাথা ক্রিস্টির ‘হ্যালোইন পার্টি’ পড়ার। নতুবা নির্ঘাৎ ‘আস্তাবলের’ বদলে লিখতেন ‘বাসভবনের কাছে’।

তবে যিনি এডওয়ার্ড লীয়রের নন সেন্সিকেল কবিতার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, তাঁর জানার আওতায় কোনওভাবে এসেছিল কী ইউরোপের কেল্টিক জনজাতির ২০০০ বৎসর আগে থেকে প্রতি বৎসরের মৃত্তিকার শেষফসলদানের উদ্যাপনের গপ্পো এবং নববর্ষবরণের ‘সামহাই’ উৎসবে অন্যান্য সবজির সঙ্গে কুমড়োরও গুরুত্বপূর্ণতা? আমেরিকার লোকসাহিত্যে ‘বনফায়ার’ এর মাধ্যমে কেল্টিকদের অশুভ আত্মাকে বিতাড়িত করে, শুভ আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের বহু উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সংযোগের ফল হিসেবে বিদেহী আত্মাকে তুষ্ট করতে যেমন তাঁরা করতেন পশু ও ফসল বলিদান, তেমনই পুরোহিতরা ভবিষ্যৎবাণীর মতো মহাশক্তির ক্ষমতার্জনও করতেন এই উৎসবের মাধ্যমে। আমাদের দেশেও যেমন চালকুমড়ো বলি একসময় খুব প্রচলিত ছিল। এই বনফায়ার উৎসবের জমায়েতে মানুষ পশুর মাথা ও চামড়া পরিধান করতেন -যা আজ মনে করা হয় হ্যালোয়িনের ‘কস্টিউম’ মগজপ্রসুতির উৎস। আদিম সেই জমায়েতে ‘খাদ্য’-কে ঘিরে জমত পোকামাকড় এবং তাঁদের সৎগতি করতে, হামলে পড়ত বাদুর। স্কটল্যাণ্ডের লোকউপকথায় ঘরে বাদুরের উপস্থিতিকে মৃত্যুর সংকেত বলে মনে করা হত। এভাবেই বিভিষিকাময় বাদুরও ঢুকে পরল হ্যালুইন সংস্কৃতিতে।
খৃষ্টপূর্ব ৪৩-শে রোমানদের কেল্টিক জয়ের পরও তাঁদের অক্টোবর মাসের ‘ফসলউৎসব’, ‘ফেরালিয়া’— মৃতদের স্মরণস্মারক হয়ে রইল। এর সঙ্গে ‘পোমোনা‘ উৎসবের ফল ও বৃক্ষদেবীর কথা মনে করে জুড়ল সেখানে আপেলও। যেহেতু ১৭ এবং ১৮ শতকে অবিবাহিত মেয়েদের বিয়ে সংক্রান্ত অনেক সংস্কার ঘিরে ছিল এই হ্যালোইন দিনের আপেলকে নিয়ে।
খৃষ্টপূর্ব ১০০০-এর মধ্যে বিদেহী আত্মার স্মরণদিবস হিসেবে ২-রা নভেম্বর নির্ধারিত হয়ে যায় ‘অল সোলস্ ডে’। আর ১-লা নভেম্বর হয়ে উঠল ‘অল সেইন্টস ডে’ বা সকল ‘হেলোস’ যাঁরা সকল সেইন্টদের সম্মান জানালেন সেদিন, তাঁদের ‘দিবস’ হিসেবে। এভাবেই প্রাকদিবস অক্টোবর ৩১ হয়ে উঠল ‘অল হেলো ইভ’ যা পরে ‘হ্যালোইন ডে’-তে নামান্তরিত হয়।
সকলের ধারণা যে ১৭৮৬ খৃষ্টাব্দে স্কটিশ কবি রবার্ট বার্ণস তাঁর ‘হ্যালোইন’ কবিতায় প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন।
আরও অনেক শতক পর খৃষ্টধর্মাবলম্বী পোপ-রা ‘সামহেই’-এর মতো ‘পাগান’ ছুটিগুলোকে বাতিল করে এক নিজস্ব ধর্মীয় আচারের রূপ দিলেন। খৃষ্টপূর্ব ১০০০-এর মধ্যে বিদেহী আত্মার স্মরণদিবস হিসেবে ২-রা নভেম্বর নির্ধারিত হয়ে যায় ‘অল সোলস্ ডে’। আর ১-লা নভেম্বর হয়ে উঠল ‘অল সেইন্টস ডে’ বা সকল ‘হেলোস’ যাঁরা সকল সেইন্টদের সম্মান জানালেন সেদিন, তাঁদের ‘দিবস’ হিসেবে। এভাবেই প্রাকদিবস অক্টোবর ৩১ হয়ে উঠল ‘অল হেলো ইভ’ যা পরে ‘হ্যালোইন ডে’-তে নামান্তরিত হয়। অর্থাৎ সেই সুকুমার রায়ের ‘ঠিকানা’ কবিতার মতো ফিরে আসি শুরুতে। পৃথিবীর সর্বত্রই দেশ কাল নির্বিশেষেই অলক্ষ্মী পুজোয় তাঁদের শান্ত করার পরই শুরু হয় শুভপুজোর লক্ষ্মীর আহবান।

যদিও ওল্ড ইংল্যাণ্ড এবং আয়ারল্যণ্ডের মানুষেরা অক্টোবর-অন্তিমে ভূত-প্রেত-অশরীরির ঘুরন্ত উপস্থিতি মেনে খাবার উৎসর্গ করতেন এবং ‘মামিং’ নামের এক আচারে লিপ্ত হলেন— যেদিন অদ্ভুত পোষাকে ‘ট্রিট’ ভিক্ষে করতেন দোর থেকে দোরে। যার থেকেই শুরু হ’ল আজকের ‘ট্রিট অর ট্রিক’ -এর উপাখ্যান।
১৮ শতকের শেষভাগ থেকেই একটু একটু করে রূপ পাল্টাচ্ছিল ঐতিহ্যবাহী কেল্টিক প্রথা। ১৯ শতকের মধ্যভাগে আলুর ফসল-দুর্ভিক্ষের সময় আমেরিকায় চলে আসার সঙ্গে আইরিশরা নিয়ে এল মুলো-আলু-বিট-কে কার্ভ করে বানানো ‘জ্যাক ও লেন্টার্ন’-এর আচার ও সংস্কার। অন্যমতে ১৯২০ সালেই হ্যালোইন সাম্রাজ্যে কুমড়ো পেল কল্কে।
দক্ষিণ প্রান্তের আমেরিকায় শুরু হল ফসল উদ্যাপনের সঙ্গে ‘উৎস দেশ’ থেকে আনিত কৃষ্টি হিসেবে ভৌতিক গল্পের আদানপ্রদান ও ভাগ্যবিচারের রেওয়াজ। মনে করা হয় ১৯৫০ সাল থেকে খেলা, চকলেট, পোশাক, দোরে দোরে কড়া নাড়ার নির্মল আনন্দ এবং মজাকে মধ্যমণি করে ‘হ্যালোইন’ এক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় উৎসব হয়ে উঠল—শিশুদের মনের আনন্দকে প্রাধান্য দিয়ে।
নিরাপত্তার খাতিরে ‘স্ট্রেনজার ডেনজার’ থেকে শিশুদের রক্ষা করতে বাধ্যবাধকতায় তাঁদের পিছু পিছু পথে নামলেন মা-বাবারাও। সময়ের দাবীতে মজার ‘হেলোয়িন পোশাক’ চড়ল তাঁদের গায়েও।
আজ ১৭৯ মিলিয়ন মানুষের উদ্যাপনের সময়, বড়দেরকেও এই একটিদিনে খানিক্ষণের জন্য হলেও ‘ছেলেবেলা’ ফিরে পাওয়ার সুযোগ করে দেয় ‘হ্যালোইন’।
চিত্র – লেখিকার সংগ্রহ থেকে
ডক্টর শুভশ্রী নন্দী আকাশবাণীর শিল্পী। প্রতিষ্ঠিত বাচিকশিল্পী এবং আটলান্টার প্রথম
বাচিকশিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘শব্দকল্পদ্রুম’ এর শিক্ষয়িত্রী এবং ‘আটলান্টা আবৃত্তি ও ভাষাশিক্ষাকেন্দ্র’-এর প্রতিষ্ঠাত্রী। উত্তর আমেরিকার বঙ্গসম্মেলন ও বাংলা পডকাস্টের উপস্থাপিকা। ‘দেশ’, ‘আনন্দবাজার’, ‘এইসময়’, ‘এবেলা’, রোববার, ও ‘আজকাল’ পত্রিকার নিয়মিত লেখিকা। কলকাতার ‘তারা টিভি’ ও ‘রূপসী বাংলা’-ইত্যাদি নানা চ্যানেলে অনুষ্ঠান করেছেন।
সুদূর বিদেশে বাংলা সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে, নানা কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত।