(House Sparrow)
‘খড় খুঁটি—অশ্বথ্থের শুকনো পাতা চুপে উল্টাই
দু’একটা পোকা যদি পাই
আমারে চেনো না নাকি: আমি যে চড়াই।’
জীবনানন্দের কবিতার সেই চড়াই পাখি এখন তবু দেখা যাচ্ছে কলকাতার কোথাও কোথাও। কিন্তু কিছু বছর আগেও চড়াই যেন হঠাৎ করেই বিলুপ্ত হয়ে যেতে শুরু করেছিল শহর বা মফস্বলের পরিধি থেকে। বিভিন্ন সহজ কারণ জটিল হয়ে দেখা দিতে শুরু করেছিল আচমকাই। খবরের কাগজে লেখালেখি, পরিবেশকর্মীদের সাবধানবার্তা, ছোট্ট চড়াই যেন হয়ে উঠল বিশাল এক লাইমলাইটে থাকার বিষয়! (House Sparrow)
আরও পড়ুন: বজবজে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
বছর দুয়েক আগে ম্যানিলা শহরে স্থানান্তরিত হওয়ার পরই চড়াইয়ের দেখা পেয়ে তাই মন ভাল হয়ে গিয়েছিল। এমনিতে পাখির ডাক এখানে কানে আসা দুষ্কর। গোটা শহরটাই যেন এক শপিং মল। কিন্তু চড়াই পাখি দেখা যায় এদিক-সেদিক বেশ ভালো রকমই। বরং কাকের দেখা নেই একেবারেই। নগরায়ন বা আধুনিক স্থাপত্যের বাড়াবাড়িতে কলকাতা শহরে চড়াইয়ের সংখ্যা কমতে শুরু করার তত্ত্ব তাই বেশ সন্দেহজনক লাগে মাঝেমধ্যেই। কারণ, ম্যানিলা শহরটা জুড়েই গগনচুম্বী বহুতল কেবল। (House Sparrow)
বছর দুয়েক আগে ম্যানিলা শহরে স্থানান্তরিত হওয়ার পরই চড়াইয়ের দেখা পেয়ে তাই মন ভাল হয়ে গিয়েছিল।
বাড়ির চারপাশে দেখা যায় বলেই ইংরেজিতে এদেরকে বলে বোধহয় হাউজ স্প্যারো। বাংলায় নামটা বরং বেশ অবমাননাকর, পাতি চড়াই! ছোটবেলার জীবন বিজ্ঞান ক্লাস মনে পড়ে, নিজেরাও যখন ‘পাতি’ একদমই। সিলেবাসে ছিল লিঙ্গভেদে পায়রা চেনার ধরণ-ধারণ। কিন্তু পায়রার থেকে চড়াই পরিচিতিতে কম কীসে? এমএম স্যারের ‘এক্সট্রা ক্লাস’-এ অগত্যা নোট যোগ হয়ে চলে খাতায়: দৈর্ঘ্য: প্রায় ১৫-১৬ সেন্টিমিটার। ওজন: ৫০ থেকে ৭০ গ্রাম। ছেলে ও মেয়ে চড়াই পাখিকে আলাদাভাবে চেনা যায় তাদের গায়ের রঙ দেখে। পুরুষ চড়াইয়ের মাথা, ঘাড়ের পালক মরচে বাদামি বা চকলেট বাদামি রঙের। লেজের দিকটা ধূসর। অন্যদিকে, স্ত্রী চড়ুই পাখির গায়ের রঙ ওপরের দিকে ধূসর বাদামি এবং পেটের দিকটা সাদাটে। পুরুষ চড়াই পাখি দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি তারা মিষ্টি সুরে গানও গায় নাকি। পরে জেনেছি, এ সবই স্ত্রী চড়াইকে আকর্ষণ করার জন্য। যে পুরুষ যত বেশি সুন্দর, যত বেশি সুর তার গলায়, ততই চড়াইয়ের মহিলা মহলে তার দাম বেশি। (House Sparrow)
আরও পড়ুন: সংগ্রাহক শিরোমণি পরিমল রায়
এবং এই কারণেই কি পরকীয়ায় আসক্ত প্রাণীদের মধ্যে মোটামুটি প্রথম দিকেই থাকে চড়াইয়ের নাম? ২০১৬ সালে চিকাগো প্রেস জার্নালে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে, আমাদের চারপাশে থাকা চড়াই পাখিরা পরকীয়ায় রীতিমতো অভ্যস্ত। এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, পরকীয়া এই পাখিদের জিন শক্তিশালী করতে এবং প্রজনন ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। একাধিক পুরুষের সঙ্গে মিলিত হওয়ার ফলে বেশি সুস্থ হয় তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
এবং বাস্তু শাস্ত্রের দিকে তাকালেও দেখা যাচ্ছে, গৃহ শান্তি এবং সৌভাগ্য ফেরাতে যথেষ্ট কার্যকরী হয় চড়াই। বাড়িতে বা ঘর-বারান্দার চৌহদ্দিতে চড়াই পাখির ডাক বা তার পাখার ঝটপটানি ইতিবাচক শক্তিকে ঘরে আনতে আর নেতিবাচক ক্ষমতাকে বের করে দিতে সাহায্য করে। এছাড়াও চড়াইয়ের ডাক দূর করে আমাদের অহংকার, উত্তেজনা কমিয়ে শান্ত করে মনকে। ফলে বাড়ির চৌহদ্দিতে চড়াই পাখির বাসা থাকলে, বাস্তু মতে তা প্রভাব ফেলে আমাদের সম্পর্কেও। (House Sparrow)
চিনের তৎকালীন চেয়ারম্যান মাও জে দং নির্দেশ দিলেন দেশ জুড়ে চড়াই পাখি নিধনের। কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছিল, জমির পাকা ধান নষ্ট করছে চড়াই পাখির দল।
তবে এই ছোট্ট প্রাণীটাকেও কম রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পড়তে হয়নি। সময়টা ১৯৫৮। চিনের তৎকালীন চেয়ারম্যান মাও জে দং নির্দেশ দিলেন দেশ জুড়ে চড়াই পাখি নিধনের। কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছিল, জমির পাকা ধান নষ্ট করছে চড়াই পাখির দল। ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন দেশের হাজার হাজার কৃষক। সেই কারণে মহামান্য চেয়ারম্যানের নির্দেশে শুরু হয় চড়াই নিধন যজ্ঞ। খোদ চেয়ারম্যানের কথায় ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’। কিন্তু এর ফল হয় মারাত্মক। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়ার প্রতিশোধ তুলে নেয় প্রকৃতিই। ব্যক্তির মালিকানায় থাকা খামার বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন মাও। বদলে যৌথ খামারের দৃষ্টিভঙ্গীতে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় চাষের দিকে নজর দেওয়ার নিদান আসে। কিন্তু নির্বিচারে চড়াই হত্যার ফলে জমিতে পোকামাকড়ের বাড়বাড়ন্ত দেখা দেয়। দেশ জুড়ে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। ‘দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন’ ডেকে আনে ‘দ্য গ্রেট ফেমিনিন’। প্রায় একশো কোটি চড়াইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ প্রকৃতি তুলে নেয় হাজার হাজার মানুষের প্রাণের বিনিময়ে। (House Sparrow)
আরও পড়ুন: বীরভূমের হারিয়ে যাওয়া নৌবন্দর সুপুরে
পাখিদের নিয়ে কথায় সালিম আলীর কথা আসবে না, সেটা অসম্ভব। এই চড়াইয়ের নামেই নিজের আত্মজীবনীর নাম তিনি রেখেছিলেন ‘দ্য ফল অফ আ স্প্যারো’। তবু দেখা যাচ্ছে যে, গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে চড়াই পাখির সংখ্যা। এর প্রধান কারণ হল নগরায়ণ ও পরিবেশ দূষণ। আধুনিক স্থাপত্যের ফলে বাসা তৈরির জায়গার অভাব দেখা দেওয়াও একটা বড় কারণ অবশ্যই। এছাড়াও, মোবাইল টাওয়ার থেকে নির্গত রেডিয়েশন এবং কীটনাশকের ব্যবহারও চড়াইয়ের জীবনচক্রের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলেছে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। (House Sparrow)
আশার আলো কিছুটা হলেও আছে। প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন (IUCN) চড়াইকে ঘোষণা করেছে ‘ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত’ বলে। কিন্তু তার জন্য দরকার আমাদের একটু সচেতনতা এবং ছোট ছোট পদক্ষেপ। সেটুকু হাত আমরা বাড়িয়ে দিতে পারি না? (House Sparrow)

শুভদীপ চক্রবর্ত্তী
শুভদীপের জন্ম মফস্বল শহর বাটানগরে, ইডেন গার্ডেনসে সে বছর বিশ্বকাপ ফাইনালে ভুল রিভার্স সুইপ মারছেন মাইক গ্যাটিং। পড়াশোনা নঙ্গী হাই স্কুল, এবং পরবর্তীতে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে। অর্থনীতি এবং সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনার পর চাকরিসূত্রে পুরুলিয়া থেকেছেন বেশ কিছু বছর।
2 Responses
সমৃদ্ধ হলাম । চীনের চেয়ারম্যান এর বৈজ্ঞানিক ভাবনা ভালো বলে জানতাম
ভালো লেখা