(Kalpana Dutta)
ভ্যাপসা গরম। অন্ধকার রাত। গ্রামের লোকেরা মাঠে, চণ্ডীমণ্ডপে, সান-বাঁধানো পুকুর পাড়ে শুয়ে থাকে। শহর থেকে দূরে এক গ্রাম। পুজো মণ্ডপে বেশ ক’টা মশারির তলায় গুটিশুটি মানুষ শুয়ে। কাছাকাছি যেতেই, তারা নড়েচড়ে উঠল। কেউ কেউ উঠে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। পুজো মণ্ডপে মশারির নীচে বসে অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ পরে যিনি এলেন তিনি কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার পর চলে গেলেন সন্তর্পণে। এলেন আর একজন। ছোটখাটো চেহারা, চুল ছোট করে ছাঁটা, আধময়লা ধূতি ও পাঞ্জাবী পরে। প্রদীপের মিটিমিটি আলোতে কিছু দেখা যায় না। তাই বুঝতে পারিনি, কে মাস্টারদা। পরিচয় পেলাম। স্বল্পভাষী, নিরীহ মানুষটি অত্যন্ত সহজভাবে কথা শুরু করলেন।(Kalpana Dutta)
আরও পড়ুন: বিপ্লবী শান্তি-সুনীতি, বিস্মৃতির শতবর্ষ পরে
‘আইএসসি পরীক্ষা কেমন হয়েছে?’ আন্তরিক গলার স্বর।
‘ভাল হয়নি!’ ফিসফিস করেই বললাম। কথা হচ্ছিল ফিসফিস করেই।
‘কাজ কি বেশি পড়েছিল?’ প্রদীপের আলোয় মুখটাও ভাল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে জিজ্ঞাসা করার ধরনে মনে হল, তিনি পরীক্ষায় খারাপ করা পছন্দ করেননি। (Kalpana Dutta)
রাত দুটো বেজে গেছে। আরও কিছুক্ষণ থেকে যাওয়ার ইচ্ছা সত্ত্বেও মাস্টারদা ভবিষ্যতে আবার দেখা করবেন বলে চলে গেলেন। (Kalpana Dutta)

কল্পনা দত্ত তাঁর স্মৃতি কথায় মাস্টারদা তথা সূর্য সেনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের দিনটি এমনই বর্ণনা দিয়েছেন।
কলকাতার বেথুন কলেজ তখন বাংলার বীরাঙ্গনাদের মাতৃভূমি। ১৯২৮ সালে বিপ্লবী কল্যাণী দাস তাঁর বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুললেন ‘ছাত্রীসংঘ’ নামে একটি মহিলা সংগঠন যাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল পরাধীন ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে ছেলেদের পাশে থেকে বৈপ্লবিক কর্মকান্ডে সরাসরি যুক্ত হওয়া। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, বীনা দাস, কল্পনা দত্ত, সুহাসিনী গাঙ্গুলী, ইলা সেন, সুলতা কর, কমলা দাশগুপ্ত প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরাঙ্গনারা ছিলেন এই ‘ছাত্রীসংঘ’ এর সক্রিয় সদস্যা। বিপ্লবী দিনেশ মজুমদার এই মেয়েদের লাঠি ও ছোরা খেলা শেখাতেন। স্বামী বিবেকানন্দের ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন সংযোগ রক্ষাকারী নেতৃত্ব। (Kalpana Dutta)
“মনোরঞ্জন রায়ের কাছে তিনি দাবি করেন, মাষ্টারদার সঙ্গে দেখা করার। ‘সময় হলে তিনিই ডাকবেন’- মনোরঞ্জন রায়ের সহজ উত্তর। “
কল্পনা দত্ত ১৯২৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতায় এসে বেথুন কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ‘ছাত্রীসংঘ’-এ যোগ দেন। সেই সময় মাস্টারদা সূর্য সেনের নির্দেশে তাঁর বিশ্বস্ত অনুগামী পূর্ণেন্দু দস্তিদার ‘ছাত্রীসংঘ’ থেকে মহিলা বিপ্লবী সংগ্রহে আসতেন, যাঁরা মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েছে, বিল্পবে আত্মাহুতি দিতে পারবে। কল্পনা ও প্রীতিলতা এলেন, পূর্ণেন্দু দস্তিদারের সান্নিধ্যে। সুশ্রী, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, শান্ত, দৃঢ়চেতা, অকুতোভয়, ঝরঝরে ইংরেজি বলা কল্পনা চলে যায় চট্টগ্রাম, তাঁর জন্মভিটায়। কল্পনা জন্মেছিলেন চট্টগ্রাম জেলার শ্রীপুর গ্রামে ১৯১৩ সালেই। সেই নিজের গ্রামে ফিরে এলেন বুকের মধ্যে দেশকে স্বাধীন করার আগুন নিয়ে। বয়স তখন তাঁর ১৮ বছর। তখনও মাষ্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। গল্প শুনেছেন মাস্টারদা সম্পর্কে অনেক। সেই মাস্টারদা তাঁকে ডেকেছেন। মাস্টারদার নির্দেশে সব কাজ গোপনে একের পর এক হয়ে চলেছে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে দেখা করা সহজ নয়। (Kalpana Dutta)
কল্পনা দত্তের সঙ্গে মাষ্টারদার প্রথম দেখা হয় ১৯৩১ সালের জুন মাসে চট্টগ্রামের এক প্রত্যন্ত অজানা গ্রামে।
“গভীর রাতে পুলিশের নজরদারি এড়িয়ে কল্পনা চলে যেতেন গ্রামের গোপন ডেরায়। প্র্যাকটিস হত রিভলবার ছোঁড়ার। সেখানেই একদিন যোগাযোগ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের সঙ্গে।”
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন-এর সংগ্রাম সংঘটিত হয়। কল্পনা দত্ত তখন বিপ্লবী কাজে সক্রিয়। গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করার কাজে যুক্ত হন। লুণ্ঠন করা অস্ত্র গোপনে সরিয়ে রাখতেন কল্পনা। নিজের বাড়িতেও রাখতেন। রাতের অন্ধকারে পুরুষের ছদ্মবেশে তিনি চলে যেতেন এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। তখনও তিনি সূর্য সেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ পাননি। কিন্তু নির্দেশ পেতেন। বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায় তখন কল্পনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন মাষ্টারদার। মনোরঞ্জন রায়ের কাছে তিনি দাবি করেন, মাষ্টারদার সঙ্গে দেখা করার। ‘সময় হলে তিনিই ডাকবেন’- মনোরঞ্জন রায়ের সহজ উত্তর। (Kalpana Dutta)
১৯৩১ সালের জুন মাস। গরম কাল। সেই সময় এল। গোপন ডেরায় গিয়ে কল্পনা বিস্মিত! ধূতি-পাঞ্জাবী পরে এক রোগা মানুষ। মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। তীক্ষ্ণ চোখ। ছোট-খাটো এই মানুষটিকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে বৃটিশ গোয়েন্দা ও পুলিশ। মাস্টারদার থেকে নির্দেশ এল, সরাসরি মুখোমুখি। কলকাতা থেকে ডিনামাইট তৈরির মাল-মশলা নিয়ে যেতে হবে চট্টগ্রামে এবং বাড়িতে গোপনে তৈরি করতে হবে গান-কটন্। কল্পনা জেলে থাকা অনন্ত সিং এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। (Kalpana Dutta)
“ছেলেদের পোশাক পরে রওনা হলেন কল্পনা। গোয়েন্দারা নজর রাখছিল। কল্পনা গ্রেফতার হয়ে যান। প্রীতিলতা একা দশ-বারো জনকে নিয়ে আক্রমণ করে ইউরোপীয়ান ক্লাব।”
জেলের খবর যেমন পৌঁছে দিতেন মাস্টারদার কাছে, আবার মাস্টারদার নির্দেশ পৌঁছে দিতেন জেলের ভেতরে। জেলে কল্পনা পৌঁছে দিতেন গোপনে ডিনামাইট। পরিকল্পনা ছিল ডিনামাইট ফাটিয়ে জেলের পাঁচিল উড়িয়ে বন্দিদের উদ্ধার করা। কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার আগেই গোয়েন্দা আবিষ্কার করে ফেলে ডিনামাইট। কল্পনা গ্রেফতার হয়। প্রমাণাভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কল্পনা নজরবন্দি হয়ে পড়েন। তাঁর গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত হয়। শহরের বাইরে যেতে পারেন না। পুলিশের অনুমতি সাপেক্ষে চট্টগ্রাম কলেজে বিএসসি-তে ভর্তি হন কল্পনা। কলেজ আর বাড়ি যাতায়াতটুকুই শুধু অনুমতি। পুলিশের কড়া নজরদারি। (Kalpana Dutta)
গভীর রাতে পুলিশের নজরদারি এড়িয়ে কল্পনা চলে যেতেন গ্রামের গোপন ডেরায়। প্র্যাকটিস হত রিভলবার ছোঁড়ার। সেখানেই একদিন যোগাযোগ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের সঙ্গে। দু’জনেই বেথুন কলেজ। দু’জনেই ‘ছাত্রীসংঘ’। আলাপ পরিচয় থাকলেও ছিল গোপনীয়তার ‘মন্ত্রগুপ্তি’। চট্টগ্রাম পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। দিন স্থির। দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুই তরুণীর উপর কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তার আগে কল্পনাকে জরুরি তলব মাষ্টারদার। (Kalpana Dutta)
“ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার মৈত্রী সংগঠনের অগ্রনী ভূমিকা নিয়ে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ রাশিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।”
ছেলেদের পোশাক পরে রওনা হলেন কল্পনা। গোয়েন্দারা নজর রাখছিল। কল্পনা গ্রেফতার হয়ে যান। প্রীতিলতা একা দশ-বারো জনকে নিয়ে আক্রমণ করে ইউরোপীয়ান ক্লাব। সবাই জীবন নিয়ে ফিরে এলেও আহত প্রীতিলতা পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মৃত্যু বরণ করেন। (Kalpana Dutta)
কল্পনা দত্ত প্রমাণাভাবে জেল থেকে ছাড়া পান এক মাস পর। মাষ্টারদার নির্দেশ কল্পনা দত্ত আত্মগোপনে চলে যান। চট্টগ্রামে তখন মিলিটারি তল্লাশি চলছে ব্যাপক। গৈরালা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে মাষ্টারদা সহ অন্য বিপ্লবীদের সঙ্গে আত্মগোপন করে আছেন কল্পনা। ১৯৩৩ সাল। ১৬ ই ফেব্রুয়ারি রাতে, মিলিটারি ঘিরে ফেলল সেই বাড়ি। চলল গুলির লড়াই। মাষ্টারদা সহ কয়েকজন বিপ্লবী ধরা পড়লেন। কল্পনা পাশের ডোবায় পড়ে লুকিয়ে থেকে পালাতে পারলেন। গ্রামে গ্রামে মিলিটারি তল্লাশি বেড়ে গেল। নেমে এল অত্যাচার। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কল্পনা ও সহযোদ্ধারা। ১৯৩৩ সালেই ১৯ মে, চট্টগ্রামের সমুদ্রের কাছে গাহিরা গ্রামে এক গোপন ডেরায় কল্পনা দত্ত, তারকেশ্বর দস্তিদার, মনোরঞ্জন দত্ত সহ বেশ কয়েকজন বিপ্লবীদের উপর চলল মিলিটারিদের অবিশ্রান্ত গুলি বর্ষণ। কল্পনা, তারকেশ্বর দস্তিদার ও অন্যান্য বিপ্লবীদের গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় ধরা পড়লেন। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মাস্টারদা সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি হল। (Kalpana Dutta)

নিদারুণ নির্যাতনে কল্পনা হারাননি তাঁর মানসিক শক্তি। ৬ বছর পর ১৯৩৯ সালের মে মাসে কল্পনা দত্তের কারামুক্তি ঘটে। এক বছর পর তিনি আবার স্নাতকে অঙ্ক বিষয় নিয়ে বিএসসি পাশ করেন বেথুন কলেজ থেকে। ১৯৪১ সাল অবধি তিনি ছিলেন গৃহবন্দী। তারপর কল্পনা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। দিল্লিতে চলে যান। যোগাযোগ হয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা পি.সি.যোশীর সঙ্গে। ১৯৪৩ এ বিবাহ। চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। (Kalpana Dutta)
মহিলা সংগঠন ও কৃষক সংগঠন গড়ে তোলেন তিনি। বৃটিশ বিরোধী এবং জমিদার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৫০ সালে স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউটে চাকরি নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। পরে আবার দিল্লি। ভারতের নারী আন্দোলনের প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন। ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার মৈত্রী সংগঠনের অগ্রনী ভূমিকা নিয়ে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ রাশিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৫ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি, কল্পনা দত্ত (জন্ম ২৭ জুলাই ১৯১৩) দিল্লিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মানুষের স্বাধীনতা ও স্বাধীকার রক্ষার লড়াই জীবনের শেষ দিন অবধি করে গেছেন বিপ্লবী কল্পনা দত্ত। (Kalpana Dutta)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত
তথ্য সূত্র:
১। সূর্য সেন চট্টগ্রাম সশস্ত্র বিপ্লব ও স্বাধীনতা সংগ্রাম, সম্পাদনা অমলেন্দু দে।
২। স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী, কমলা দাশগুপ্ত
৩। অগ্নীযুগ, সম্পাদনা শৈলেশ দে, ১৯৭৮।
আঞ্চলিক ইতিহাস ও বিস্মৃত বাঙালি রজত চক্রবর্তীর চর্চার প্রিয় বিষয়। বর্তমান পত্রিকা, ভ্রমণআড্ডা, হরপ্পা, পরম্পরা, মাসিক কৃত্তিবাস, নতুন কৃত্তিবাস ইত্যাদি নানা পত্রিকায় তাঁর লেখালেখি দেখা যায়। পঞ্চাননের হরফ, গৌরপ্রাঙ্গনের গোরা, আশকথা পাশকথা, পান্থজনকথা তাঁর উল্লেখযোগ্য বই। বাংলার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের খোঁজে 'ধুলো মাটি বাংলা' প্রকাশিতব্য।