(Lakshmi Puran)
দাম্পত্যজীবনে টুকটাক ঝগড়া-বিবাদ হবে না, তাও কি হয়? জানেন তো, লক্ষ্মী আর জগন্নাথের মধ্যেও একবার ঝগড়া বেধেছিল, আর ভাইকে ইন্ধন জুগিয়েছিলেন দাদা বলরাম! এর ফলে, লক্ষ্মীছাড়া হয়ে দুই ভাইয়ের সে কী দুরবস্থা! শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক কবি বলরাম দাস তাঁর ‘লক্ষ্মী পুরাণ‘ নামে ওড়িয়া কাব্যে সে কাহিনি লিখে রেখেছেন। আজও উড়িষ্যার ঘরে ঘরে পাঠ হয় লক্ষ্মী-পুরাণ। আসুন, আজ কোজাগরী পূর্ণিমার দিন, আজ লক্ষ্মীর গল্পটি আরও একবার পড়া যাক। (Lakshmi Puran)
দিনটা ছিল বৈশাখ মাস, শুক্লা দশমী তিথি, বৃহস্পতিবার। পুরীধামে সেদিন লক্ষ্মীব্রত উদযাপন-তিথি। জগন্নাথের অনুমতি নিয়ে সুসজ্জিতা লক্ষ্মী বেরিয়েছেন নগর-ভ্রমণে। কিন্তু, কী দুঃখের কথা বলুন তো! সেদিন সমস্ত শ্রীক্ষেত্র জুড়ে কোনও ঘরে লক্ষ্মীপূজার আয়োজন নেই। একমাত্র চণ্ডালপাড়ায় গিয়ে দেবী দেখলেন, শ্রীয়া চণ্ডালিনী শুদ্ধাচারে লক্ষ্মীব্রত পালন করছে। তার ঘরে পদার্পণ করে, তাকে বর দিয়ে লক্ষ্মী ফিরে চললেন বড় দেউলে। (Lakshmi Puran)
আরও পড়ুন: মহিষাসুরমর্দিনী: বাংলার আগমনী-আলো
এদিকে, ভাসুরঠাকুর বলরাম, লক্ষ্মীর এহেন কাজ দেখে ফেললেন৷ রেগে আগুন হয়ে তিনি ভাইকে আদেশ দিলেন, “লক্ষ্মীকে পরিত্যাগ কর! সে চণ্ডালের ঘরে গিয়ে স্নান-শৌচ ছাড়াই মন্দিরে ফিরে আসছে। ঘরের বধূ আজ হয়েছে চণ্ডালিনী, তাকে ত্যাগ কর।” (Lakshmi Puran)
জগন্নাথ মিনতি করলেন, “দাদা, এবারের মতো না হয় প্রায়শ্চিত্ত-শোধনকর্মে লক্ষ্মীকে জাতে তুলে নেওয়া যাক? পুনর্বার একই অপরাধ হলে তখন না হয়…!” কিন্তু বলরামের এক গোঁ, “হয় লক্ষ্মীকে তাড়াতে হবে, নয়তো লক্ষ্মীকে চাইলে স্ত্রী-পুরুষে থাকো গিয়ে চণ্ডালপাড়ায়।” অগত্যা, ছোট ভাইকে মেনে নিতে হল দাদার আদেশ। (Lakshmi Puran)

বড় দেউলের সিংহদ্বারে এসে লক্ষ্মী দেখলেন, পথ রুদ্ধ, দুই ভাই প্রহরায়। জগন্নাথ জানালেন, লক্ষ্মী এসেছেন চণ্ডালিনী হয়ে, তাঁর আর বড় দেউলে ঠাঁই নেই। লক্ষ্মী অপরাধ স্বীকার করলেন না, আত্মসমর্থনে অটল রইলেন। বলরাম ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, “কানাই, তোর হাতে কি সুবর্ণের বেত নেই? এই দুষ্টাকে প্রহার করে বিতাড়িত কর।” এবার লক্ষ্মীর ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। ভাসুরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ আলাপ না করার উৎকল-দেশীয় সহবৎ তিনি ভঙ্গ করলেন না, কিন্তু স্বামীর কাছে একের পর এক প্রশ্ন রাখলেন। লক্ষ্মী জানতে চাইলেন, “স্ত্রীহত্যা (পূতনা বধ), গোহত্যা (অরিষ্ট বধ), পরস্ত্রীরমণ (রাসলীলা) আদি কর্ম কোন ধর্মশাস্ত্রমতে সৎকর্ম হয়, বলো তো? শবরের উচ্ছিষ্ট ফল তোমরা দুই ভাই খেয়েছ, তোমরা বুঝি জাতিচ্যুত নন?” (Lakshmi Puran)
যাওয়ার আগে, তিনি শাপ দিয়ে গেলেন, “এই অপমানের দণ্ডরূপে তোমরা শ্রীভ্রষ্ট হবে! ভিক্ষার অন্নটুকুও তোমাদের মিলবে না! এই চণ্ডালিনী যবে অন্ন দেবে, তবে অন্ন পাবে দুই ভাই।”
অপমানিতা লক্ষ্মী ভবিষ্যতে বাপঘরের সম্বলরূপে জগন্নাথের দিতে চাওয়া অলঙ্কারগুলিও নিলেন না। নিরাভরণ রূপে তিনি একা পথে নামলেন। যাওয়ার আগে, তিনি শাপ দিয়ে গেলেন, “এই অপমানের দণ্ডরূপে তোমরা শ্রীভ্রষ্ট হবে! ভিক্ষার অন্নটুকুও তোমাদের মিলবে না! এই চণ্ডালিনী যবে অন্ন দেবে, তবে অন্ন পাবে দুই ভাই।” (Lakshmi Puran)
এক নারীর অপমান-যাপনের সঙ্গিনী হলেন আরও একদল নারী। গৃহ থেকে গৃহিণীর বিতাড়ন দেখে মুদুসুলির (নারী পরিচারিকা) দল লক্ষ্মীকে অনুসরণ করলেন, তাঁর সহায় হলেন। লক্ষ্মী বাপের বাড়ি গেলেন না, কারণ পিতা সমুদ্রদেব সম্ভবত তাঁকে আবার পতিগৃহে ফিরে যেতে জোর করবেন। নিজস্ব নারীসংঘ নিয়ে মোহনার বাঁকে বিশ্বকর্মার নবনির্মিত প্রাসাদে অধিষ্ঠিতা হলেন লক্ষ্মী। (Lakshmi Puran)

শ্রীক্ষেত্রে রাত নামল। এইবার শুরু হল লক্ষ্মীর প্রত্যাঘাতের পালা। প্রথমে তিনি নিদ্রাদেবীকে পাঠিয়ে দুই ভাইকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করলেন, তারপর অষ্টবেতালকে পাঠালেন বড় দেউলের সমস্ত সম্পত্তি হরণ করে আনার জন্য। ভাণ্ডারের ধনরত্ন, রন্ধনশালার হাঁড়িকুড়ি বাসনকোসন, খাদ্যের সম্ভার সব তারা কেড়ে আনল। এমনকী নিদ্রাগত দুই ভাইকে ধরাধরি করে খাটিয়ায় শুইয়ে, তুলে আনল গজদন্তের পালঙ্কটিও। বড় দেউল হল শ্রীহীন, লক্ষ্মীছাড়া। (Lakshmi Puran)
পরদিন সকাল হতে দুই ভাই পড়লেন মহা বিপদে। আর কোনও উপায় না দেখে দরিদ্র ব্রাহ্মণের বেশে নগরে ভিক্ষায় বেরলেন তাঁরা। কিন্তু হায়, লক্ষ্মীর রোষে যে আজ ভিক্ষাও মেলে না। জোটে শুধু লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অপমান। শেষ অবধি নিজেদের ভুল বুঝে দুই ভাই চললেন সমুদ্রের তীরে, বাপঘর থেকে লক্ষ্মীকে ফিরিয়ে আনার আশায়। সেখানে দেখা হল হরপার্বতীর সঙ্গে, শিবের কথা মতো দু’জনে চললেন মোহনার বাঁকে, অন্ন বিতরণে উদারচিত্ত নতুন ভবনে, দুটি অন্নের আশায়। কিন্তু বলরামের অহংকার তখনও ঘোচেনি। চণ্ডালের গৃহ শুনে তিনি বললেন, “সিধে দাও, দুই ভাই স্বপাকে আহার করব।” সেইমতো ব্যবস্থাও হল, কিন্তু লক্ষ্মীর ইঙ্গিতে অগ্নিদেব রন্ধনের উপযুক্ত তাপটুকুও দিলেন না চুলোয়। রাগ করে, ক্ষুধায় ক্ষিপ্ত বলরাম বললেন, “জাতি যায় যাক, আজ তবে চণ্ডালের অন্নই খাব।” (Lakshmi Puran)
“সমাজবিধির ভয়ে নায়কের পত্নীত্যাগ রামায়ণে আছে, সেই কাহিনিতে দেখি সীতার নির্বিরোধ আত্ম-অপসারণ। কিন্তু লক্ষ্মীপুরাণের এই নতুন কাহিনিতে লক্ষ্মী তেজোদৃপ্তা, স্বতন্ত্রা, মহীয়সী।”
এইবার সুগৃহিণী লক্ষ্মী পাক করে পাঠালেন বিবিধ আহারের সম্ভার। তৃপ্ত দুই ভাই লক্ষ্মীর হাতের রান্না চিনতে পারলেন, অনুতাপ জাগল তাঁদের মনে। তখন বলরামের ইঙ্গিতে জগন্নাথ অন্দরমহলে গিয়ে লক্ষ্মীর কাছে মার্জনা চাইলেন, মানভঞ্জন করে অনুরোধ করলেন, ফিরে চলো শ্রীমন্দিরে। এক শর্তে রাজী হলেন লক্ষ্মী। তিনি বললেন, “শ্রীমন্দিরের মহাপ্রসাদ ভক্ষণের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ-চণ্ডালের ভেদ রাখা চলবে না, উভয়েই উভয়ের হাত থেকে খাবে।” সেই দাবি মানা হল। মহাসমারোহে লক্ষ্মী পুনর্বার প্রবেশ করলেন পতিগৃহে। সমস্ত সম্পদ ফিরিয়ে দিয়ে গেল অষ্টবেতাল, আবার শুরু হল লক্ষ্মীনারায়ণের সুখের সংসারযাত্রা। (Lakshmi Puran)

সমাজবিধির ভয়ে নায়কের পত্নীত্যাগ রামায়ণে আছে, সেই কাহিনিতে দেখি সীতার নির্বিরোধ আত্ম-অপসারণ। কিন্তু লক্ষ্মীপুরাণের এই নতুন কাহিনিতে লক্ষ্মী তেজোদৃপ্তা, স্বতন্ত্রা, মহীয়সী। অকারণ অপরাধের আরোপ তিনি স্বীকার করেন না, প্রতিবাদ করেন, প্রশ্ন তোলেন। ক্ষমাভিক্ষা, আশ্রয়-প্রার্থনার নতি নয়, পতিগৃহ ত্যাগ করে তিনি একা পথে নামেন, পতির দয়ার দান সম্বলটুকুও অনায়াসে তুচ্ছ করে ফেলে যান। পিতৃগৃহে আশ্রয় চান না, তাঁকে অনুসরণ করে আসা নারীবাহিনীকে নিয়ে নিজেই স্বতন্ত্রভাবে স্বপ্রতিষ্ঠ হন। এমনকি, অন্যায় আচরণের প্রত্যাঘাতও করেন নির্মমভাবে। শেষে, যাঁরা তাঁকে নিরাশ্রয় করবেন ভেবেছিলেন, সেই দুটি পুরুষই আশ্রয়হীন হয়ে পথে নামেন, এবং লক্ষ্মী স্বয়ং হয়ে ওঠেন তাঁদের আশ্রয়। অতঃপর, সগৌরবে সসম্মানে লক্ষ্মীর পুনঃপ্রবর্তন। (Lakshmi Puran)
আরও পড়ুন: আরন্ধের রাঁধাবাড়া কি বর্ষাশস্যের থ্যাংক্সগিভিং?
অনেকে একপেশে দৃষ্টিতে ক্রমাগত বলে আসছেন, ভারতীয় সনাতন ধর্ম-সংস্কৃতি ব্রাহ্মণ-শাসিত আর পুরুষতান্ত্রিক। লক্ষ্মীপুরাণ তাঁদের চোখের সামনে একটি অত্যুজ্জ্বল ব্যতিক্রম। জন্মভিত্তিক, সুতরাং আপাত-ভাবে পরিবর্তন-অযোগ্য ক্ষমতার ছক এখানে উলটে যায়। উচ্চবর্ণ পুরুষের আধিপত্যের দম্ভকে অবদমিত করেন এক নারী— পরিবারতন্ত্র যাঁকে চণ্ডালিনী বলে চিহ্নিত করেছিল, তিনি। হেজিমনি আর সাব-অল্টার্নের পারস্পরিক অবস্থান এখানে অনায়াসে উলটে দেন আশ্চর্য নায়িকা। তিনি লক্ষ্মী। তিনি পত্নী। তাঁকে ছাড়া, গৃহ হয় শ্রীহীন, পুরুষ হন লক্ষ্মীছাড়া। তাঁকে পেলে, সমস্ত কিছুতে ফের শ্রী জেগে ওঠে। (Lakshmi Puran)
কেবল উৎকলে কেন, আমাদের বাংলার ঘরে ঘরেও এরকমই লক্ষ্মী ছেলে, লক্ষ্মী মেয়েরা দেখা দিক! অন্যায় আর অপমান সহ্য করতে করতে ফুরিয়ে যাওয়া নয়, আমাদের ভবিষ্যতে আসুক উজ্জ্বল আত্মপ্রতিষ্ঠার দিন। তবেই না লক্ষ্মীলাভ! (Lakshmi Puran)
তথ্যসূত্র:
‘লক্ষ্মী পুরাণ: শ্রীয়া-চণ্ডালিনী’।
পূর্বাঞ্চলীয় অনুবাদ কেন্দ্র, সাহিত্য অকাদেমি। সংকলন: খগেশ্বর মহাপাত্র।
অনুবাদ: কৈলাস পট্টনায়ক।
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে সাম্মানিক বাংলা সহ স্নাতক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ও এম ফিল, বর্তমানে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, কলকাতায় পিএইচডি গবেষণারত।