এক কোটি মানুষের ভিড়ের মধ্যে একটি একলা মেয়ে? এও সম্ভব? হ্যাঁ, মেয়েটির নাম যদি হয় নবনীতা দেব সেন, তবে সম্ভব হতে পারে বৈকি! এলাহাবাদে বক্তৃতা দিতে গিয়ে ফিরতি পথে তিনি একাই ঘুরে আসতে পারেন প্রয়াগরাজের পূর্ণকুম্ভ থেকে। কীভাবে? কেন, ওই যে, এক কোটি মানুষ, আর নিজের দেশের প্রতি ভরসায়৷ নবনীতা বলছেন, “শিক্ষিত মেয়েদের একা ভ্রমণের পক্ষে এত নিরাপদ, এত সুসভ্য সমাজ আমাদের এই গরীব দেশটির তুলনায় পৃথিবীতে আর একটাও আছে কী না জানি না।” নবনীতা যখন বলছেন, তাঁর কথার দাম আছে অনেক, কারণ এই বিপুলা পৃথিবীর অনেক দেশেই তিনি ভ্রমণ করেছেন সানন্দে। তবে, তাঁর কথার দাম বজায় রাখার দায় কিন্তু আমাদেরই, অর্থাৎ এই গরীব দেশের মানুষদের। (Nabaneeta Dev Sen)
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ও গানে রথ-প্রসঙ্গ : উৎসব চৌধুরী
বিপদের সম্ভাবনা কি ছিল না? আলবাত ছিল। একে তো তাঁর হাঁপানির ধাত, তার ওপর সবে তখন ব্রঙ্কাইটিস থেকে উঠেছেন, তার ওপর সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে বাঁ পা মচকে ফুলে আছে, তার ওপর হাই প্রেসার যখন তখন মাথা চাড়া দেয়, বিপদ কি আর একটা? তবে আরও একটা মারাত্মক বিপদ হচ্ছে তিনি “অল্পবয়সী মেয়ে”, এই বিপদটি মনে করিয়ে দিলেন নবনীতার মা রাধারাণী দেব। কিন্তু না, বিচিত্র ও বিবিধ বিপদের সম্ভাবনাকে গায়ে না মেখে কুম্ভমেলার পথে পা বাড়ালেন নবনীতা।

বিপদ কি তাও আসেনি? সে তো আসবেই। কুম্ভমেলার ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতেই নবনীতা খেয়াল করলেন, প্রবল জনারণ্যের সুযোগ নিয়ে একটি হাত তাঁকে ক্রমাগত উত্যক্ত করছে। ভাবছে তিনি নিরুপায়, তিনি বোধহয় আত্মরক্ষায় অপারগ। দু-একবার রাম-চিমটি কেটেও লাভ হল না। প্রবল স্নায়ুযুদ্ধ করতে করতে একসময় নবনীতা সেই মালিকের-নাম-না-জানা হাতটিকে খপ করে চেপে ধরলেন, এবং অনুচ্চ কিন্তু স্পষ্ট গলায় ইংরেজিতে বললেন, “যদি এবার চেঁচিয়ে উঠি, আপনি কিন্তু খুন হয়ে যাবেন। এই ভিড় আপনাকে এখুনি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবে।” বলে, হাতটি ছেড়ে দিলেন। ব্যাস, গণপ্রহারের ভয় দেখাতেই কাজ হলো, হাতের মালিক আর দুঃসাহস দেখাতে রাজি হলেন না। কথাটা যথাসাধ্য নিচু গলায় বললেও ভিড়ের মধ্যে দু-চারজন শুনেছেন, পাশ থেকে এক মহিলার কণ্ঠে হিন্দিতে ‘জানওয়ার’ জাতীয় শব্দ পাওয়া গেল। নবনীতা বুঝলেন, তিনি একা নন, অনেক মেয়েই এ জাতীয় অসভ্যতার শিকার। কিন্তু, হঠাৎ ইংরেজিতে হুমকি দিলেন কেন নবনীতা? তিনি বলছেন, “ইংরেজিতে বললুম কেন না আমার কেমন মনে হল এই কুৎসিত লোভাতুরতা নির্ঘাৎ আমাদের ‘শিক্ষিত মধ্যবিত্ত’ লক্ষণ।” একটি বাক্যে বিশেষ এক শ্রেণীর অন্তর্নিহিত অশালীনতাকে উন্মোচিত করে দিলেন তিনি।
তবে, অন্যরকম অস্বস্তিও এসেছে। একা একটি মেয়ে কুম্ভে চলেছে, সঙ্গে পরিবার-পরিজন কেউ নেই, একথা জেনেই ধাবায় তাঁর ছোঁয়াচ বাঁচাতে সসম্ভ্রমে সামনে থেকে উঠে যান দুই প্রৌঢ়।
তবে, অন্যরকম অস্বস্তিও এসেছে। একা একটি মেয়ে কুম্ভে চলেছে, সঙ্গে পরিবার-পরিজন কেউ নেই, একথা জেনেই ধাবায় তাঁর ছোঁয়াচ বাঁচাতে সসম্ভ্রমে সামনে থেকে উঠে যান দুই প্রৌঢ়। তাঁদের মনে হয়, এই মেয়ে নির্ঘাৎ স্বর্গের অপ্সরা-বৃত্তি নারীদেরই একটি মানবী সংস্করণ হবে! আবার সেই একই ধাবায় লাল্লন আর লতিফ, নবনীতার গাড়ির ড্রাইভার আর তার বন্ধু তাদের সদ্য পাওয়া এই দিদিটিকে নিজেদের খরচায় পরোটা-মাংস, মটর পনীর, টমাটর-তরকা, দাল ইত্যাদি এলাহি ভোজ খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দিদি রুটি-তরকা আর চা ছাড়া আর কিছু খেতে না চাওয়ায় তারা মনঃক্ষুণ্ণ হয়। দিদি খাটিয়ায় বসতে গেলে তাঁকে ছারপোকার উপদ্রবের কথা শুনিয়ে তক্তপোশে বসতে বাধ্য করে দুই ভাই। দোকানি কাচের গ্লাসে দিদিকে চা দিতে এলে ধমকায়, কেন, কাপ নেই? নবনীতা ভাবেন, স্টেট গেস্ট অর্থাৎ রাজকীয় অতিথি হওয়ার চাইতেও বড় সম্মান পেলেন তিনি। ভাবেন, “আমার জীবনে ঈশ্বরের কৃপার সত্যি শেষ নেই।”
ভারতীয় জনতা এক অদ্ভুত মিশ্র মানসিকতার মানুষ। তাঁবুতে এক নাম-না-জানা মাসিমা নবনীতার সিঁথিতে সিঁদুর থাকা সত্ত্বেও গায়ে এয়োতির লক্ষণ, হাতে শাঁখা-পলা-লোহা ইত্যাদি স্বামীর মঙ্গলকামনার চিহ্ন না থাকায় প্রশ্নমুখর হয়ে ওঠেন, তাঁর অতিরিক্ত ‘জাজমেন্টাল’ এবং কৌতূহলী স্বভাবে নবনীতা অস্বস্তিবোধ করেন। কিন্তু অল্প পরেই এই একলা মেয়েটির খাওয়া-দাওয়ার জোগাড়ের জন্য তিনি ব্যস্ত হয়ে বলে ওঠেন, “ভাল কলা খাবে? আমাদের কাছে চিড়ে, গুড়, কলা সব আছে। তোমাকে দুটি দিই? মুখখানা তো একদম শুকিয়ে গেছে। খোকা চিড়ের পুঁটলিটা বের কর তো।” কোনওক্রমে তাঁকে নিবৃত্ত করেন নবনীতা।

আবার, ত্রিবেণীসঙ্গমে স্নানের সময় তাঁর আরেকটি অযাচিত বন্ধু জুটে যায়, সেই ভটচায্যি মশায়ও তাঁকে এইভাবে একা আসার জন্য তিরস্কার করতে ছাড়েন না, এটা-সেটা প্রশ্নও করেন। নবনীতার স্বামী বিলেতে রয়েছেন শুনে ভটচায্যি বলেন, সে কি, স্বামীর যত্ন-আত্তি ছেড়ে নবনীতা এখানে কেন? নবনীতা বলেন, “তাঁকে যত্ন-আত্তি করার লোক সেখানে আছে।” মুহূর্তে ব্যাপার বুঝে যান ভটচায্যি মশায়। নবনীতার স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ এবং উক্ত স্বামীদেবতাটির জীবনে দ্বিতীয় নারীর আগমনের কথা বুঝে নিতে একটুও সময় লাগে না তাঁর৷ এবং, তিনি বলে ওঠেন, “দেখুন, ভগবান আছেন৷ একদিন আপনার দুঃখ তিনি নিশ্চয়ই ঘোচাবেন। এই পুণ্যতীর্থে দাঁড়িয়ে আমি আপনাকে বলে দিলাম। আপনি সেদিন দেখে নেবেন। আপনার মনোবাঞ্চছা পূর্ণ হবেই।” নবনীতা চুপ করে যান৷ মনে মনে ভাবেন, এ কেবল ভারতবর্ষেই সম্ভব। “যাকে জানিনে চিনিনে তারই জন্য বুকটা ফাটিয়ে ফেলি। যেমন প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে অন্যকে উত্যক্ত করতে আমাদের জুড়ি নেই, তেমনই অন্তর থেকে মধু ঢেলে অন্যের ঊষর জমি আবাদ করাও আমাদের পক্ষে স্বাভাবিক।” হ্যাঁ, এটাই আমাদের দেশ, এঁরাই আমাদের দেশের মানুষ।
তৃপ্ত হও হে আমার পূর্বপুরুষসকল, হে পূজনীয় মাতৃপিতৃগণ! তিন ভুবন জুড়ে তৃপ্ত হও তোমরা আমার ভালোবাসায়।
এই মহাকুম্ভের অগণিত মানুষের মিলনমেলার মাঝে ত্রিবেণীসঙ্গমে ডুব দিলেন নবনীতা। অঞ্জলিতে জল নিয়ে বললেন, “আগচ্ছন্তু মে পিতর ইমং গৃহ্নন্তু অপো’ঞ্জলিম্। আব্রহ্মভুবনাল্লোকা দেবর্ষি পিতৃ মানবা:।।” বললেন, “তৃপ্ত হও হে আমার পূর্বপুরুষসকল, হে পূজনীয় মাতৃপিতৃগণ! তিন ভুবন জুড়ে তৃপ্ত হও তোমরা আমার ভালোবাসায়।”
তাই, বাড়ি ফেরার পর নবনীতার মা তাঁকে বললেন,
প্রয়াগসঙ্গমটাকে বুকের মধ্যে ধরে রেখে দিতে৷ অমৃতকুম্ভ একবার হাতে এলে, নিজে থেকে ছুঁড়ে না ফেলে দিলে কেউ তো কেড়ে নিতে পারবে না!
এই অমৃতটিই তো “…সৃষ্টির শেষ রহস্য, ভালোবাসার অমৃত।”
তথ্য ঋণ: ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে’, নবনীতা দেব সেন।
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে সাম্মানিক বাংলা সহ স্নাতক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ও এম ফিল, বর্তমানে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, কলকাতায় পিএইচডি গবেষণারত।