(National Doctor’s Day)
১ জুলাই National Doctor’s Day.
১৯৯১ সালে ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের জন্ম(ও মৃত্যু) দিনে তাঁর স্মরণে তাঁরই হাতে তৈরি সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশন, সমাজের প্রতি চিকিৎসকদের কর্তব্যকে স্বীকৃতি দিতে এই দিনটিকে নির্দিষ্ট করে। স্বভাবতই এটি ডাক্তারদের প্রাপ্তির দিন। দীর্ঘ চল্লিশ বছরের পেশাজীবনে এই দিনটায় তাই, মনটা একটু চাই চাই করে। পরিচিতজনের কাছ থেকে শুভেচ্ছা, সেরে ওঠা রোগীর থেকে অভিনন্দন, দু’তিনটে কাগজের কার্ড, বিশ পঁচিশটা ই-কার্ড, ওষুধের কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ ছোকরাদের থেকে ফুলের গুচ্ছ, বাংলা সন্দেশ বা ইংরেজি মিষ্টি (মঞ্জিনিস কেক), সঙ্গে দাঁত কিড়মিড় আড়ালে রাখা মিঠে হাসি (কারণ তাকে ওই একটা সকালেই বাইকে দৌড়ে হয়তো পঁচিশ জন ডাক্তারকে এই হাসি বিতরণ করতে হবে), এইসব সংগ্রহ করে দিনের শেষে পরিতৃপ্তির ঢেকুর তোলা, এই রুটিনেই চলে বিশেষ দিনটি। অন্তত চলত। ২০২৪ এর ৩০ জুন অবধি। যতক্ষণ না পরম বন্ধু নিখিলের কাছ থেকে সেবারের পয়লা জুলাইয়ের শুভেচ্ছাটা এল। (National Doctor’s Day)
আরও পড়ুন: স্পন্ডিত স্পন্দনে শিহরিত ঘাড় ও কোমর
নিখিল আমার ইস্কুলের বন্ধু, যে এতদিনেও শত্রু হয়ে উঠতে পারেনি। ভাল মানুষ, সঞ্চয়ী মানুষ। সেই ইস্কুলজীবন থেকেই দেখা, বন্ধুদের পিকনিকে নিজের চাঁদাটা পাঁচবারের মধ্যে অন্তত দু’বার ঠিক ডজ করে বেরিয়ে যেত। এই কিছুদিন আগেও টোটো চেপে দু’জনে গেলাম এক বন্ধুর বাড়ি, কিন্তু ভাড়াটা এল একটা পকেট থেকে। তবে হ্যাঁ, মানতে হবে ইতিহাসের অধ্যাপক তথা ছাত্র হিসেবে নিজের বিষয়টায় বিপুল পাণ্ডিত্যের মালিক হয়েছে। আর তাতে ভর করে ইতিহাসের পেট থেকেই একটা জিনিস বের করে পয়লা জুলাই তা উপহার দিয়ে, এক ঐতিহাসিক থাপ্পড় দিল যেন আমাকে। (National Doctor’s Day)
নিখিলের দেওয়া প্রায় দশ ইঞ্চি বাই ছয় ইঞ্চির খামটাকে দেখে অবাক লেগেছিল। খুলতে ভেতর থেকে বেরোলো এক ছবি। এক মুঘল মিনিয়েচার পেন্টিংয়ের প্রিন্ট, যা কিনা বিশ্ববিশ্রুত সংগ্রাহক স্যার নাসের ডেভিড খলিলি-র সংগ্রহ থেকে পাওয়া ১৬৪০ সালের একটি ছবি। তাতে দেখানো হচ্ছে দুই হাকিম পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে (Duel) রত, তাঁদের অস্ত্র বিষের শিশি। (National Doctor’s Day)

খলিলি সংগ্রহ।
ঠিক কীভাবে ওই যুদ্ধ লড়া হচ্ছে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত না থাকলেও, দুই প্রতিদ্বন্দ্বী চিকিৎসকের মনে পরস্পরের প্রতি যে ঘৃণার বিষ জমে আছে, তার চিত্রাঙ্কনে সেই সময়ের শিল্পীও পিছিয়ে থাকেননি। বড়ই লজ্জার ব্যাপার। চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত মানুষদের পারস্পরিক সম্পর্কের অন্ধকার দিকের এই ছবি ওই বিশেষ দিনে উপহার দিয়ে নিখিল যেন বুঝিয়ে দিল, যতই ‘নোবেল প্রফেশন’-এর মলাট পড়িয়ে এইদিন তোমাদের পিঠে হাত বোলানো হোক না কেন, তোমরাও কিছু দেবতার সন্তান নও। আর পাঁচটা পেশাজীবী মানুষের মতোই পেশাগত ষড়রিপুর শিকার তোমরাও। (National Doctor’s Day)
তবে এই দেখে মুঘল আমল ও চিকিৎসকের আন্তঃসম্পর্ক সম্বন্ধে আজকের আর জি কর পরবর্তী (কিংবা আগেও) আবহে শাসক আর চিকিৎসকদের প্রেমের খেলা সেদিনও চালু থাকার ভুল ধারণা করবেন না। বস্তুত, প্রাচীন হিন্দু ও মুসলমান শাসিত ভারতে, চিকিৎসকেরা এক বিশিষ্ট অবস্থানেই বিরাজ করতেন। মুঘল আমলের ইতিহাস পড়লে জানা যায় এই সময়ে চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপর লেখা বইয়ের সংখ্যা বিজ্ঞানের অন্য শাখাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। নিচের পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ-

ওই ছবির গল্পটা জানতেন না ইউডোরা ব্রাউন অ্যালমন্ড। আমেরিকার জর্জিয়ানিবাসী এই ভদ্রমহিলা কোনওভাবে ঋণী ছিলেন কোনও চিকিৎসকের কাছে। কৃতজ্ঞতায় এতটাই আপ্লুত ছিলেন, যে চিকিৎসকদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য বছরের একটি দিন নির্দিষ্ট করার অনুরোধ রাখেন তিনি, তাঁর কাউন্টির প্রশাসনের কাছে। কাউন্টি তাঁর অনুরোধে সাড়া দিয়ে প্রস্তাবের সমর্থনে তাঁদের সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁদের সভার কার্যবিবরণীতে লেখা হয়,
“…Whereas, the Auxiliary to the Barrow County Medical Society wishes to pay lasting tribute to her Doctors, therefore, be it resolved by the Auxiliary to the Barrow County Medical Society, that March 30, the day that famous Georgian Dr. Crawford W. Long first used ether anesthesia in surgery, be adopted as ‘Doctors’ Day,’ the object to be the well-being and honor of the profession, its observance demanding some act of kindness, gift or tribute in remembrance of the Doctors”. (National Doctor’s Day)
“চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত মানুষদের পারস্পরিক সম্পর্কের অন্ধকার দিকের এই ছবি ওই বিশেষ দিনে উপহার দিয়ে নিখিল যেন বুঝিয়ে দিল, যতই ‘নোবেল প্রফেশন’-এর মলাট পড়িয়ে এইদিন তোমাদের পিঠে হাত বোলানো হোক না কেন, তোমরাও কিছু দেবতার সন্তান নও। আর পাঁচটা পেশাজীবী মানুষের মতোই পেশাগত ষড়রিপুর শিকার তোমরাও।”
দিনটাকে ৩০ মে নির্দিষ্ট করার প্রস্তাবটিও ছিল ইউডোরার। এক চিকিৎসকের আবিষ্কৃত পদ্ধতির প্রয়োগে অস্ত্রোপচারকালীন যন্ত্রণার উপশম হচ্ছে যেদিন, মানুষ এক প্রাণান্তকর কষ্টের হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছে, সেই দিনটাই চিকিৎসকদের অবদানকে স্মরণ করার উপযুক্ত দিন, এমনটাই মনে হয়েছিল ইউডোরার। সেটা ছিল ১৯৩৩ সাল। (National Doctor’s Day)
পুরো আমেরিকা জুড়ে এই মনোভাব চারিয়ে যেতে সময় লেগেছিল নয় নয় করে সাতান্নটা বছর। শেষে ১৯৯০ সালে জর্জ বুশের সরকার ওই দিনটাকে আমেরিকার জাতীয় চিকিৎসক দিবস হিসেবে নির্দিষ্ট করে। বহু কু-কাজের নায়ক জর্জ বুশের এটি একটি ভাল সিদ্ধান্ত। সেনেটের সভার কার্যবিবরণীতে লেখা হয় –
WHEREAS society owes a debt of gratitude to physicians for the contributions of physicians in enlarging the reservoir of scientific knowledge increasing the number of scientific tools, and expanding the ability of health professionals to use the knowledge and tools effectively in the never ending fight against disease… (National Doctor’s Day)
Resolved by the Senate and House of Representatives of the United States of America in Congress assembled, That;
March 30, 1991, is designated as “National Doctors’ Day”;

একটা গল্প বাকি রয়ে গেল। জাতিসংঘের ঘোষণায় বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ২৩৮টি দিন কোনও না কোনও বিষয়ের বিকাশের জন্যে নিবেদিত। তাতে টুনা মাছের সুস্বাস্থ্যের কামনা করে ২মে কে World Tuna Day বা বিশ্বজুড়ে আলুর উচ্চফলনের আশা প্রকাশ করে ৩০মে কে World Potato Day ঘোষণা করা হলেও, চিকিৎসকদের মঙ্গল কামনার কোনও দিন খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনও। সারা পৃথিবীতে চিন, অস্ট্রেলিয়া, কিউবা, ইরান, প্রমুখ ২১টি দেশে ডক্টর’স ডে পালন হলেও, জাতিসংঘ এখনও এই বিষয়ে মনস্থির করে উঠতে পারেনি। কী জানি, নিখিল সেখানেও ওই ছবির প্রতিলিপি কখনও পাঠিয়েছিল কী না! (National Doctor’s Day)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
চিত্র ঋণ- ডাঃ ভাস্কর দাস
ডাঃ ভাস্কর দাস পেশায় অস্থিশল্য চিকিৎসক। নেশা ফোটোগ্রাফি, লেখালেখি। ভ্রমণ ও বাংলার অতীত কৃষ্টি ও সংস্কৃতির খোঁজ প্রিয় বিষয়।
লেখা প্রকাশিত দেশ, হরপ্পা, কৃত্তিবাস, সাপ্তাহিক বর্তমান, ইত্যাদি পত্রিকায়। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচ। ২০২২ সালে ভ্রমণআড্ডা সংস্থার 'কলম' সম্মান প্রাপক।