(Prafulla Roy)
বাংলার সাহিত্যজগতে আবার ইন্দ্রপতন! পরিণত বয়সেই পাঠকদের রিক্ত করে চলে গেলেন প্রফুল্ল রায়। যুগান্তর গোষ্ঠীর একমাত্র জীবিত সাহিত্যিক এবং অবসরপ্রাপ্ত সাংবাদিক ছিলেন তিনি। তাঁর প্রস্থানের সঙ্গে একটা যুগের অবসান তো হলই আর আমাদের আকর্ষণ কমে গেল কথাসাহিত্যের প্রতি। পূর্ব পার্বতীর যাত্রা অবশেষে থামল। ভদ্র, শান্ত এবং স্বল্পভাষী মানুষটির সান্নিধ্যে যাওয়া এবং আলাপ-পরিচয় এর সুযোগ হয়েছিল, বছর ছয়েক আগে ত্রিধারা সার্বজনীন দুর্গোৎসবের সৌজন্যে। ওঁরা বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে পুজোর আগে এক শারদীয়া সাহিত্য সংখ্যা প্রকাশ করেন। (Prafulla Roy)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: আপনজন, মৃণাল মুখোপাধ্যায়
ওঁদের সাধারণ সম্পাদক, কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ এবং রাজ্যের বিধায়ক দেবাশিস কুমারের অনুরোধে প্রত্যেক বছর জুন মাস নাগাদ ফোনে কথা বলে সময় করে টালিগঞ্জের রিজেন্ট ডাকঘর সংলগ্ন, হেমন্ত এপার্টমেন্টের ফ্ল্যাটে যেতে হত পুজো সংখ্যার লেখার জন্য, প্রফুল্ল রায়কে তাগাদা দিতে। লজ্জা আর ভয় দুটোই সঙ্গী ছিল, কারণ ওঁর মতো একজন প্রবাদপ্রতিম লেখককে আমার মতো একজন সাধারণ সাংবাদিক তাগাদা দিচ্ছে! এটা আমার চোখে বিশেষ শোভনীয় মনে হত না। (Prafulla Roy)

তাও কর্তব্যের খাতিরে যেতেই হত। কোনওদিনও তাঁর মধ্যে বিরক্তির ভাব দেখিনি। ত্রিধারার থেকে গেছি শুনে বিনীতভাবে বলতেন, ‘আর কয়েকটা দিন সময় দিন, দিন পনেরো পরে ফোন করবেন, বলে দেব লেখাটা নিতে কবে আসবেন।’ প্রতিবারই ফ্ল্যাটের ভিতরে গিয়ে বসতে বলতেন, চা খাওয়ার প্রস্তাবে আমি চার রসে বঞ্চিত শুনে বেশ অবাকই হতেন! আমার সম্পাদনা করা “কাছে রবে” বইটি ওঁকে উপহার দিয়ে ধন্য হয়েছিলাম। বইটি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বিষয়ক। বইটি হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে বলেছিলেন, ‘আমি তো ওঁর নামের বাড়িতেই থাকি।’ (Prafulla Roy)
পরের বছর আবার যখন ওঁর বাড়িতে লেখার তাগাদা দিতে গেলাম, একটু অবাকই হলাম। আমাকে দেখেই বললেন, ‘হেমন্তবাবুর বইয়ের লেখক তো’। ভাবছিলাম এক বছর পরেও উনি কীভাবে আমাকে মনে রেখেছেন! লেখার বিষয়ে সব সময় উৎসাহ দিতেন, বলতেন, ‘লেখা ছেড়ো না কোনও দিনও।’ (Prafulla Roy)

ওঁর সাহিত্য নিয়ে কত যে জনপ্রিয় ছায়াছবি তৈরি হয়েছে বলার নয়। যাত্রীক গোষ্ঠীর ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘অসীমা ভট্টাচার্য প্রযোজিত, ‘বাঘবন্দী খেলা’, তপন সিংহ পরিচালিত হিন্দি টেলিফিল্ম, ‘আদমি অউর ঔরত’, শতাব্দীর কন্যার অন্তর্গত ‘চাপিয়া’, শেখর দাস পরিচালিত, ‘ক্রান্তীকাল’, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর পরিচালনায়, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ ইত্যাদি। (Prafulla Roy)
তাঁর লেখায় সংগ্রামরত মানুষকে আমরা দেখতে পাই, বিভিন্ন লেখায় আন্দামানের শিকড়হীন মানুষ, উত্তর পূর্বের আদিবাসী এবং বিহারের শোষিত মানুষ বারে বারে এসেছেন আলোর সামনে। (Prafulla Roy)

মনে পড়ে সম্ভবত ২০২৩ সালে ত্রিধারার পুজোসংখ্যয় একটি বড় গল্প লিখেছিলেন। লেখাটি নিয়ে গাড়িতে আসার সময় গল্পটা পড়ার লোভ সামলাতে পারিনি। টালিগঞ্জ থেকে দেশপ্রিয় পার্ক, দূরত্ব খুবই কম কিন্তু তার মধ্যেই সম্পূর্ণ গল্পটা পড়া শেষ করে ফেলেছিলাম। স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য কলহের পরিণতি কিন্তু মিলনন্তক দৃশ্যর ভেতর দিয়েই শেষ হয়েছিল। ওই গল্পটার মধ্যে দিয়ে ওঁর অনুভূতিপ্রবণ মনের পরিচয় পাওয়া যায়। অবিভক্ত বাংলায় ১৯৩৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জন্ম আর দ্বিখণ্ডিত বাংলার এপারে ভরা বর্ষার মধ্যাহ্নে ছুটি নিলেন সব ব্যস্ততার থেকে। (Prafulla Roy)
আসন্ন পুজোসংখ্যার পাতাগুলো আর ভরে উঠবে না ওঁর সৃষ্টির মাধ্যমে, তবু রেখে গেলেন যা, বাঙালি পাঠকদের সমৃদ্ধ করার পক্ষে যথেষ্ট। আর ব্যক্তিগত স্মৃতি, স্নেহ, ভালবাসা ধরে রেখে দিলাম মনের এক কোণে। শেষ যাত্রার শরিক হতে মন চাইল না। একদিন সাহস করে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘লিফ্ট ছাড়া চারতলার ওপরে ফ্লাট কিনলেন কেন?’ উত্তরে মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘এখন আর ভুল সংশোধনের সময় নেই।’ সেই চারতলার ডানদিকের ফ্ল্যাটের দরজা ধরে হাসিমুখের ছবিটাই মনের মধ্যে ধরে রেখে দিতে চাই শেষদিন পর্যন্ত। (Prafulla Roy)
ছবি সৌজন্য- লেখক
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।