(Radha Krishna)
লালের ধ্যাষ্টামো রং ছুঁয়ে যাচ্ছে যুবতীর গাল। পিরীতিমাখা তার দুই কাজল-আঁখ জুড়ে বইছে বসন্তের হাওয়া। রতিউন্মুখ স্তনের বোঁটা টনটন করে উঠছে, প্রিয় পুরুষটির স্পর্শ পাবে বলে। আর সে পুরুষটিও ভিড়ের মধ্যে খুঁজে চলেছে প্রণয়িনীর কপাল, গাল, ঠোঁট। বন্ধুরা আটকে দিচ্ছে তাদের। চারিদিকে সমাজের নানা বিধি-নিষেধ। পরিবারের কড়া নজর। তা সত্ত্বেও পরস্পরকে রাঙানোর আপ্রাণ চেষ্টায় পাগলপারা হয়ে উঠেছে তারা। ঠিক যেমনটা ঘটত রাধা-কৃষ্ণের হোরি খেলায়। (Radha Krishna)
আরও পড়ুন: বিবাহ রন্ধন: চিঠি কি এসব বোঝে! বেনারসি আসে যায় ওদের বিয়ের কথা হোক…
গোপ-গোপীরা রুদ্ধ করছে দ্বার। কৃষ্ণ ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন ক্ষণে-ক্ষণে। এদিকে তাঁর অপেক্ষায় রাধার প্রায় মূর্চ্ছা যাওয়ার দশা। আসলে, রং খেলার সঙ্গে দু’টি বিষয় অচিরেই জড়িয়ে গেছে। এক, সুপ্ত যৌনতা এবং দুই, রাধা-কৃষ্ণ। এই একটা দিনই রক্ত-মাংসের নারী-পুরুষরা নিজেদের অজান্তেই রাধা-কৃষ্ণ হয়ে ওঠেন। ভক্ত এবং ঈশ্বর দোল খেলেন একসঙ্গে। শ্রী অমরেন্দ্রনাথ রায় সম্পাদিত ‘বাঙ্গালীর পুজা-পার্ব্বণ’-এ ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়-এর লেখায় পাই, “যে তাহাঁকে রঙ মাখাইতে জানে না, সে ভক্ত নহে, সে প্রেমিক নহে…” (Radha Krishna)

প্রকৃতির রঙে রাঙা হয়ে কৃষ্ণ দোল খেলেন আপনমনে। আর তাই হয়তো, ব্রজ থেকে আমাদের পুরুলিয়া — সর্বত্র ভরে যায় রঙিন ফুলে। গোপী হোক বা রাধা, ভক্ত হোক বা দেবতাগণ —ভালোবাসার রঙে তিনি নিজেকে রাঙান। তবে, সহস্র গোপিনী তাঁকে পেয়েও পায় না। তিনি ছুটে যান রাধার নিকটে। প্রেম, যৌনতা ও ভাবের উচ্ছ্বাস শ্রীহরির মুখকে রক্তাভ করে তোলে। রঙের পরত এসে লাগে তাঁর শরীরে। ভক্তরা তাঁকে যে রূপে চায়, তারা তেমনটিই পায়। কিন্তু আগলখোলা, ভানহীন কৃষ্ণকে নিজের ভিতর নিয়ে ক্রীড়ায় মত্ত হতে পারেন কেবল ভানুসূতা। (Radha Krishna)
ঋষি জৈমিনি বলেছেন —
“ফালগুনে মাসি কুর্ব্বীত দোলারোহণমুত্তমম।
যন্ত্র ক্রীড়তি গোবিন্দো লোকানুগ্রহণায় বৈ।”
অর্থাৎ, ফাল্গুন মাসে উত্তম দোলে আরোহণ করো, যেখানে গোবিন্দ লোককে অনুগ্রহ করার জন্য ক্রীড়া করে থাকেন। পদ্মপুরাণ হোক বা গরুড়পুরাণ — সেখানে কৃষ্ণের দোল খেলা খানিক ঈশ্বর ও ভক্তের পারস্পরিক আদান-প্রদান হিসেবেই বর্ণিত হয়। কিন্তু সেই বর্ণনাই রাধা-কৃষ্ণের প্রেম হয়ে ধরা দেয় বিভিন্ন গানে। বাংলার আঞ্চলিক লোকগান হোক বা উত্তর-ভারতের ঠুংরি, সবেতেই কৃষ্ণ আসলে প্রেমিক। নটখট নন্দলালের কেবলই রাধাকে ছুঁতে চাওয়ার বাসনা। বিদূষী শোভা গুটরুর গাওয়া ঠুংরিতে, রাধা কৃষ্ণকে বলছেন, “আঁখিও না ডারো জি গুলাল, নন্দলাল/ আঁখিইয়া বাঁচাউঁ তো, বাহিয়ান গেহাত হো/ বাহিয়ান বাঁচাউঁ তো চোলিয়া তাকাত হো/ম্যায় জান গ্যয়ি তোরি চাল”… রাধার চোখে আবিরের স্পর্শ লাগলে, রাধা চোখ মুছছেন কি মুছছেন না; ওমনি কৃষ্ণ এসে বাহুডোরে আগলাচ্ছে। রাধা নিজেকে রক্ষা করতে গেলে, কৃষ্ণ শ্রীমতির কাপড় ধরে টানাটানি করছেন। অবশ্য, রাধার এই রাগ আসলে কপট, ছল। মনে মনে তিনিও খুশিই হচ্ছেন। চাইছেন, কৃষ্ণ তাঁর গহীনে প্রবেশ করে রং খেলায় মাতোয়ারা হন। এমতি প্রশ্রয়ের প্রকাশ পাওয়া যায়, পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ সৃষ্ট, “সারি ডার গ্যয়ে মো পে রং কি গাগর” ঠুংরিতে। (Radha Krishna)
ফাল্গুন মাসে উত্তম দোলে আরোহণ করো, যেখানে গোবিন্দ লোককে অনুগ্রহ করার জন্য ক্রীড়া করে থাকেন।
(Radha Krishna) খাম্বাজ রাগে বোনা এই গানেরই বাংলা অনুবাদ হল, “কেন ভিজাল রঙে মোরে শ্যাম, বলো না!” চারিদিকে বসন্তের হু-হু হাওয়া। গ্রীষ্মের খরতাপ, বর্ষার নিদারুণ বৃষ্টি-বজ্রপাত নেই। দোল উৎসবে, প্রকৃতি যেন যৌনমিলনের জন্যই চারপাশ সাজিয়ে রাখে। ঢাকার লোকসঙ্গীতে শোনা যায়, “আজ হোলি খেলব শ্যাম তোমার সনে/একেলা পেয়েছি তোমায় নিধুবনে”। রাধার অবশ্য মাঝেমধ্যে দুঃখও হয়, এত ভিড়ের মাঝে তাঁর প্রাণনাথকে না পেয়ে। তখন তিনি গেয়ে ওঠেন, “বসন্ত বাহারা, না মানে জীয়রা, হাঁ মরি মরি/সুখের কালে কথা প্রাণনাথ, মরি, প্রাণ, সই কৃষ্ণ কই/ভেবে না পাই অন্ত”…
ময়মনসিংহের গানে সখীদের সঙ্গে রাধা আবার অন্যরকম ফাঁদ পেতেছেন। তাঁদের পরিকল্পনা, কৃষ্ণকে তাঁরা শাড়ি পরাবেন। “নাকের উপরে কেশর দিব/প্রাণবন্ধুরে আজ রমণী সাজাব। লাল শাডী পরাব, পীত ধডা খসাব/নাগর হয়ে মোহন বাঁশী আমরা বাজাব”। লিঙ্গভেদে, শরীর ঊর্ধ্বে আশ্চর্য যৌনতার দরজা খুলে যাওয়া। আর ভেদাভেদ ছেড়ে স্বয়ং কৃষ্ণও তাঁর শ্রীরাধিকাকে প্রশ্রয় দেন এই বিষয়ে। এ যেন, একবিংশ শতকের ‘বেডরুম রোল-প্লে’-র এক অন্য স্বর। (Radha Krishna)

(Radha Krishna) রাধা-কৃষ্ণের জন্মস্থান এবং বিচরণের প্রাধান্য অনুযায়ী হোরি যদিও মূলত উত্তরপ্রদেশের; কিন্তু, বাংলায় হোলি যে ‘দোল’-এ রূপান্তরিত হয়েছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ হল, বৈষ্ণব ধর্ম। এই ধর্মের ব্যাপক প্রসারের ফলশ্রুতিতে রাধা ও কৃষ্ণের বসন্ত-রাসলীলা এবং হোলি সমন্বিত হয়েছে। শ্রী চৈতন্য দোল খেলতেন উন্মাদ হয়ে। যেন একই অঙ্গে রাধিকা ও কানাইয়ের লীলায় মেতে ওঠার আখ্যান। তাঁর জন্মও হয়েছিল ফাল্গুনী পূর্ণিমায়। শাস্ত্র অনুসারে, বৈষ্ণবীয় উৎসবের শেষ উৎসব হল ‘দোল উৎসব’। বাঙালিদের যেহেতু “কানু ছাড়া গীত নাই”, সে কারণেই তরুণ-তরুণীদের ‘মদনোৎসব’ নিজ স্বভাবে রাধা-কৃষ্ণের দোলের ব্যঞ্জনা দ্বারা আচ্ছাদিত। (Radha Krishna)
স্বামীর গায়ে লেগে থাকা আবিরে সন্ধ্যা রায় রাঙিয়ে নেন নিজেকে। ক্ষণ-মুহূর্তের জন্য যেন রাধা ও কৃষ্ণের মিলন, যা আলোড়ন তোলে প্রতিটি কামাতুর প্রেমিকজনের বুকে।
যে-কোনও শিল্প, সাহিত্য, কবিতায় ‘রং’ এক আশ্চর্য দৃশ্য নির্মাণ করে। দোল মূলত খেলা হয় লাল, সবুজ, গোলাপি এবং হলুদ আবির দিয়ে। এগুলি যথাক্রমে প্রেম, তারুণ্য, কাম এবং আনন্দের কথা বলে। কেবলমাত্র গান নয়, সিনেমাতেও এর বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়। চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের সিনেমা ‘মীনাক্ষী– আ টেল অফ থ্রি সিটিজ’-এ এর অসামান্য ঝলক দেখা যায়। মনের ভাব, পরিস্থিতি অনুযায়ী একেকটি রং সেখানে ধরা দেয় নিজস্ব ছন্দে। আবার, দাদার কীর্তি সিনেমায় সেই বিখ্যাত দোলের গান — “হোলি আয়ি সুখদাই”। এই গানের ভিতর দিয়ে খুলে যায় এক রাস্তা, যেখানে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর দেখা হয় সন্ধ্যা রায় এবং শমিত ভঞ্জর। স্বামীর গায়ে লেগে থাকা আবিরে সন্ধ্যা রায় রাঙিয়ে নেন নিজেকে। ক্ষণ-মুহূর্তের জন্য যেন রাধা ও কৃষ্ণের মিলন, যা আলোড়ন তোলে প্রতিটি কামাতুর প্রেমিকজনের বুকে। ‘মিস্ট্রেস অফ স্পাইসেস’ সিনেমার একেবারে শেষাংশে, ঐশ্বর্য রাইকে নায়ক ডিলান ম্যাকডর্মেট আদরে ভরিয়ে দেন, বিছিয়ে রাখা লাল রঙের শুকনো লঙ্কার উপরে শুয়ে। তাঁদের সেই মিলন দৃশ্য মনে করায় দোলখেলার কথা। (Radha Krishna)

(Radha Krishna) কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’-এ ‘ললিত লবঙ্গ’ পদে রাধা-কৃষ্ণের রং খেলার মধ্যে দিয়ে পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ দেখা যায়। ওড়িশি নৃত্যে এই অভিনয় এক অনবদ্য প্রদর্শন। ‘থাবল চোংবা’ হল একটি বিখ্যাত মণিপুরি নৃত্য যা ‘ইয়াওসাং’ অর্থাৎ হোলি উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হয়। চাঁদের আলোয় তরুণ-তরুণীরা হাতে হাত রেখে এই নৃত্যে মেতে ওঠে। কবি তন্ময় ভট্টাচার্য-র ‘দীপাবলী নাকি শবযাত্রা’ বইটির একটি কবিতার নাম হল, ‘দোলন’। কবিতাটির শেষ তিনটি লাইন এমন — “তুমি আজ রাধারানি। স্নানের একটু আগে নির্লজ্জ ডাকবই—মায়ের বারণ ঠেলে ছুটে এসো, স্মরণীয় ভুল” (Radha Krishna)
আরও পড়ুন: রঙেতে রাঙিয়া রাঙাইলে মোরে
(Radha Krishna) ভাবুন, এই যে নিষেধাজ্ঞা মেনে ছুটে যাওয়া; স্নানের আগে রং দিয়ে পছন্দের নারীকে একান্ত নিজের করে পাওয়া, এই সবই যেন কুবো পাখির নরম বুকের ছইয়ের মতো। এই একটা দিনেই তো প্রেমিক-প্রেমিকার দল পরস্পরকে ভেবে ফেলে রাধা-কৃষ্ণ হিসেবে! সবার আগে রং কেবল তারাই একে অপরকে মাখাবে। এমন আবদারের ঘনঘটা মুঘল চিত্রশিল্পেও দেখা যায়, যেখানে রাধার উর্ধ্ব বসন আলগা হয়ে গেছে, আর কৃষ্ণ শ্রীমতির গ্রীবা ছুঁতে চাইছেন। এমনকি, নিউ দিল্লির মিউজিয়ামে, রাধা-কৃষ্ণর বসন্ত পূর্ণিমার রাতে যৌনমিলনের চিত্রও সংরক্ষিত আছে। বৈষ্ণবীয়, শৈব বা শাক্ত — এই তিনটি ধারার মধ্যে দিয়ে রং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মিশে গেছে। প্রাণাধিক প্রিয় মানুষটিকে ছুঁতে চাওয়ার যে তীব্র কামনা, তা যেন দোলের মধ্যে দিয়েই ধরা দেয় শরীর ও মনে। আসমুদ্রহিমাচল, আমরা নিজেদের লিঙ্গ ভেদাভেদে রাধিকে ও লখাই ভেবে পুলকিত বোধ করি। তাই নয় কি? (Radha Krishna)
তথ্য ঋণ:
শ্রী অমরেন্দ্রনাথ রায় সম্পাদিত, ‘বাঙ্গালীর পুজা-পার্বণ’
পল্লব সেনগুপ্ত – ‘পূজা পার্বণের উৎসকথা’
শ্রী যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি – ‘পূজা পার্বণ’
ডঃ শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য – ‘বাংলার লোক-সাহিত্য, তৃতীয় খণ্ডঃ গীত ও নৃত্য’
কবিতা – তন্ময় ভট্টাচার্য

আত্রেয়ী চক্রবর্তী
আত্রেয়ী চক্রবর্তী। জন্ম ১৯৯২, হাওড়ায়। কবি, ওড়িশি নৃত্যশিল্পী। ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ করলেও, মূলত লেখালেখি করেন বাংলা ভাষায়। প্রকাশিত কবিতার বই - আফজলকে লেখা চিঠি