প্রথম পর্বে লিখেছিলাম যে অস্ট্রিয়ায় এসে আমি মোজার্ট-বিথোভেনে ডুবে গিয়েছি। ক্লাসিক্যাল মিউজিক শুনতে খুব ভালো লাগলেও ভিতরের ব্যাকরণ কিছুই জানি না আমি। সব কিছু জানবার কী দরকার? সকালবেলায় Mozartplatz-এ এসেছি। বড় খোলা চত্বরের মাঝখানে মোজার্টের (Mozart) বিশাল স্ট্যাচু। চারিদিকে সারি সারি মিউজিয়াম, চার্চ। মোজার্টের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে (১৮৪২), ওঁর সৃষ্টির বিশালতার কথা ভেবেই বোধহয় এত উঁচুতে স্ট্যাচুটা বানানো হয়েছিল। নীচ থেকে ওঁর মুখ দেখা যায় না। এই চত্বরেই পৃথিবী-বিখ্যাত জালৎস্বুর্গ (Salzburg) সংগীত সম্মেলনের জন্ম হয়েছিল, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক উৎসবের রূপ নেয়। নানা দেশের অগুনতি মানুষ মোজার্টের জন্মস্থানে এই সংগীত সম্মেলনে এসে, ওঁর কাজকে ছুঁয়ে যান। আমি ভিডিওতে দেখেছি, খুব ম্যাজিকাল। এর জন্য আগস্ট মাসে আসতে হবে, এবার হল না।

সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এই চত্বরে বসে নানা দেশের মানুষের আনাগোনা দেখছি। দলে দলে ছাত্র-ছাত্রীরা আসছে আর মাটিতে বসে কীসব নোটস নিচ্ছে। ভাষা একবর্ণ না বুঝলেও মনে হচ্ছে ‘Outdoor History’ ক্লাশ হচ্ছে। শহর জুড়ে নানা বয়েসি ছাত্রেদের ঘুরতে দেখেছি। এরা মিউজিয়ামে ঢুকছে না। ব্যাপারটা কী? অনেক খুঁজে ভাঙা ভাঙা ইংরিজি বলতে পারে এমন একজনকে জুটিয়ে ফেললাম। এই ভদ্রমহিলা বেলজিয়াম থেকে এসেছেন। ওঁর স্বামী ইতিহাসের শিক্ষক, স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে সামার ট্রিপে এসেছেন। মিউজিয়ামে টিকিটের বড্ড দাম, তাই বাইরে থেকে ক্লাশ নিচ্ছেন। “প্রত্যেক বছর এখানেই আসেন?” “আমার স্বামী ছাত্রদের নিয়ে আসেন। এবার আমি ওদের সাথে বেড়াতে এসেছি।” “জালৎস্বুর্গ কেন?” “পাহাড়ের মধ্যে এমন চমৎকার শহর। একটু বাইরের দিকে সস্তায় ভালো থাকবার ব্যবস্থা। তাছাড়া, ইতিহাসের সঙ্গে সুরের এমন ঠাসাঠাসি সহবস্থান কোথায় পাবেন?” ভাষা বিভ্রাটে ঠিক না বুঝলেও, মহিলা বোধহয় এটাই বলতে চাইলেন।
আমরাও এখানে একটাই মিউজিয়াম দেখব ঠিক করেছি। না হলে সত্যিই পকেট পরিষ্কার।

জালৎস্বুর্গ (Salzburg) মিউসিয়ামে ঢুকে একটা নতুন তথ্যে আটকে গেলাম। ধর্মস্থানে মানুষ তীর্থে যায়। আপনারা কি শুনেছেন যে কোনও মানুষের জন্য লোকেরা তীর্থযাত্রায় আসে? আমি তো শুনিনি। এটাই হয়েছিল ১৮২৯-এ। ভিনসেন্ট নোভেলো আর তাঁর স্ত্রী ম্যারি, এই দুই মোজার্ট-ভক্ত লন্ডন থেকে মোজার্টের দেশ অস্ট্রিয়ায় পাড়ি দিয়েছিলেন। তখনও পর্যটন-কেন্দ্রিক বিদেশযাত্রা চালু হয়নি। আজকের মতন ভ্রমণটা এমন জলভাত ছিল না। মোজার্ট যেখানে থেকে কাজ করেছেন তাঁরা সেখানে ছুটে গেছেন। মোজার্টের বোন মারিয়া, স্ত্রী কন্সট্যানযের সাথে দেখা করেছিলেন। আরও অনেক সমসাময়িক মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে এই দম্পতি মোজার্টের সম্পর্কে নানা অজানা, একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য যোগাড় করেন। ভিনসেন্ট লিখেছিলেন “আমরা মোজার্ট টুরিস্ট। এটা আসলে আমাদের Mozart Pilgrimage।” বহু পরিশ্রমে, অনেক ভালোবাসা, আর শ্রদ্ধায় তিলে তিলে যে ডাইরিটা তিনি লিখে ফেলেছিলেন, কীভাবে যেন তা খোয়া যায়। প্রায় ১০০ বছর পরে, আবার রহস্যময়ভাবে সেই ডাইরিটা পাওয়াও যায়। তাই আমরা এঁদের তীর্থযাত্রার কাহিনি জানতে পারলাম। “Mozart Pilgrimage – The Travel Diary। Vincent and Mary Novello”— বইটা ছাপা হয়েছে, যা আজকের মোজার্ট গবেষকদের জন্য একটা মূল্যবান গাইড। আমাজনে হার্ড কপির দাম দেখলাম কেনেডিয়ান ১৯০০ ডলার দাম!

মিউজিয়াম থেকে বাইরে এসে দেখি গোটা ১৫ ছেলে-মেয়ে জুটেছে। মনে হচ্ছে, এই চত্বরটা সব সময় জমজমাট থাকে। এদের টেবিলে প্লাস্টিকের ক্যাপসিকাম, টম্যাটো, ভুট্টা, বেগুন গড়াগড়ি যাচ্ছে। পাশে একটা প্লাস্টিকের অর্ধদগ্ধ কুকুর রাখা। খুব অস্বস্তি লাগছে। আবার কৌতূহলও হচ্ছে। ইংলিশ জানে এমন একজন ছেলেকে পাকড়াও করলাম। সে খুব সিরিয়াস। ওরা সবাই PeTA-এর মেম্বার। আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসেছে। “PeTA কী করে?” আমার অজ্ঞতায় ছেলেটা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে, মুখটা ভীষণ গম্ভীর করে বলল যে, “PeTA আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। সব দেশেই আমাদের শাখা আছে। আমরা animal cruelty-এর বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করি। আপনি কি নিরামিষাশী? না হলে দয়া করে ১০০% নিরামিষাশী হয়ে যান। দুধ, ডিম, মাংস খাওয়া ছেড়ে দিন। নিরাপরাধ পশুদের আর অত্যাচার করবেন না। এটা কিন্তু আপনার স্বাস্থের জন্যও মঙ্গল।” যাঃ বাবা!
সকাল থেকে এত কিছু জেনে ফেলে, মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সৌরভকে বলাতে ও বলল, “তোমার খিদে পেয়েছে, আমারও। চলো ঐ কাফেতে ঢুকি।” অস্ট্রিয়ার ডেসার্ট, পেস্ট্রি খুব বিখ্যাত। দুকাপ কফি, স্ট্রুডেল আর কেক অর্ডার দিয়ে দুজনে প্যাটিওতে বসলাম। আমাদের পিছনে পাহাড়ের মাথায় দারুণ সুদর্শন Hohensalzbug ফোর্ট। পাহাড় বেয়ে ফেনিকুলারে চড়ে টুরিস্টরা উপরে ফোর্ট দেখতে চলেছে। রাতে ওখানে মোজার্ট কনসার্ট আছে। মধ্য দুপুরে রোদের তেজ বেড়েছে। পাহাড় থেকে মাঝে মাঝে ঠান্ডা হাওয়ার ঝলক আসাতে গরমটা সহনীয়। বেশ লাগছে একটা ঝলমলে দিনে ইতিহাস গায়ে জড়িয়ে বসে থাকতে। চত্বরে কেউ বাজাচ্ছে। মোজার্ট (Mozart) কি? এই রে বিপদে ফেললেন, কার কম্পোসিশান বলতে পারব না। তবে সদ্য-ফোঁটা জুঁই-এর মতন সতেজ।

মাত্র ১৫ মিনিটের হাঁটা পথে গেট্রিডেগেস। অস্ট্রিয়ার প্রথম পর্বে লিখেছিলাম যে গেট্রিডেগেসের একটা ভাড়া বাড়িতে মোজার্টের ১৭৫৬-এ জন্ম। মাত্র ৩৫ বছরের জীবনের প্রায় ২০টা বছর মোজার্ট জালৎস্বুর্গে কাটিয়েছেন। কিন্তু জীবদ্দশায় এই শহর তাঁকে যোগ্য সম্মান দেয় নি। বরঞ্চ এখানে অপমানিত হয়ে তিনি ভিয়েনায় চলে গিয়েছিলেন। সেই গল্প আগে আপনাদের বলেছি। ভিয়েনায় গিয়ে তিনি শিল্পী হিসাবে পূর্ণ হলেন। আর বিস্ময়কর দ্রুততায়, একের পর এক কালজয়ী সুর সৃষ্টি করেছেন। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, জালৎস্বুর্গের উদীয়মান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের কিছু মোজার্ট-ভক্ত আবার মোজার্টকে নিয়ে এই শহরে হইচই ফেলে দিলেন। তাঁরাই এই চত্তরে স্ট্যাচুটা বানিয়েছিলেন। এই সময় থেকে মোজার্টকে ঘিরে এই শহরে যে আর্ট কালচারের নব জাগরণ হোল, তা আজও চলছে। জালৎস্বুর্গের অলিতে গলিতে, দোকানে, টুরিস্ট স্পটে, কনসার্টে সর্বত্র। সুপরিকল্পিত মিডিয়া প্রচারের মাধ্যমে এই শহর “Mozart City” হয়ে উঠেছে। দেশ বিদেশের টুরিস্টরা সেই আকর্ষণেই জালৎস্বুর্গের আসে। যাক দেরীতে হলেও, খুব দেরী হয় নি। শহরবাসীদের উদ্যোগে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছেন । সব চেয়ে বড় কথা হোল যে দুই ভক্তের “Mozart Pilgrimage” স্বপ্ন পূর্ণ হয়ে, আজ আমাদের মতন সাধারণ পর্যটকরাও তাঁদের পথ ধরে এই শহরে আসছেন।
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Flickr
কাকলির জন্ম এবং পড়াশুনা কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান স্নাতকোত্তরের ছাত্রী, পেশায় রিসার্চ ফেসিলিটেটর। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি, কলেজ, ফাউন্ডেশানে রিসার্চ স্ট্র্যাটেজি এবং গ্রান্ট ডেভালেপমেন্টের কাজ করেন। বর্তমানে তিনি কানাডার ক্যালগেরি শহরের অধিবাসী। ঘুরেছেন নানা দেশ, ভালবাসেন সৃষ্টিশীল কাজ। লেখা তাঁর বহুদিনের ভালোবাসা। তার লেখায় ছুঁয়ে থাকে প্রকৃতি, প্রেম, পূজা আর মানুষের কাহিনি; কিছু গভীর অনুভবের আর অনুপ্রেরণার উপলব্ধি। গল্প ছাড়াও লেখেন প্রবন্ধ আর ভ্রমণ কাহিনি। তাঁর বেশ কিছু লেখা দেশ, সাপ্তাহিক বর্তমানে এবং অন্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।