(Sherlock Holmes) পূ্র্ব ইউরোপের ৬ জানুয়ারির শীতের সকাল। লাটভিয়ার রাজধানী রিগার জনপথ। সেই রাজপথ ধরে চলেছে বড় থেকে শুরু করে শিশু আর কিশোরদের এক অত্যাশ্চর্য্য মিছিল। মিছিলের সবাই আর্থার কোনান ডয়েলের অমর সৃষ্টি শার্লক হোমস আর তাঁর সঙ্গিসাথীদের সাজে সেজেছে। মহাধূমধাম করে হোমসের জন্মদিন পালন করা চলছে রিগায়। বিশ্বজুড়ে হোমস ভক্তরা যে বেকার স্ট্রিটের বাসিন্দা আধুনিক গোয়েন্দাদের আদি গুরুর জন্মদিন পালন করেন এ তারই এক ঝলক মাত্র। (Sherlock Holmes)

হোমসের সাজে রিগার সেই মিছিলের সামনেই রয়েছে পাইপ মুখে ওভারকোট পরা একজন, হোমসের বিখ্যাত লাঠিটা হাতে নিয়ে। পাশেই রয়েছে ছায়াসঙ্গী ডাক্তার জন ওয়াটসন। রয়েছে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে হোমসের বন্ধু ইন্সপেক্টর লেসট্রেড। রয়েছে তার বিখ্যাত গাড়ি নিয়ে রহস্যময়ী আইরিন অ্যাডলারও। রয়েছন ২২১ বি বেকার স্ট্রিটে হোমস-ওয়টসনের বাড়িওয়ালি মিসেস হহাডসন। হোমস কাহিনির অন্যান্য চরিত্রেরাও চলেছে সেই শোভাযাত্রায়। আর শুধু কি মিছিল? সঙ্গে বাজছে ড্রাম, বেজে চলেছে বাঁশি। তারই তালে তাল মিলিয়ে মহাসমারোহে সেই মহামিছিল চলেছে রিগার প্রাণকেন্দ্র লিভু স্কোয়ারের দিকে। রাস্তার দু’পাশে উৎফুল্ল জনতা হাত নাড়ছে। মিছিলের চরিত্ররা মাঝে মধ্যে দর্শকদের সঙ্গে করমর্দন করছে, অতি উৎসাহীদের সঙ্গে সেলফি নেওয়া হচ্ছে দেদার। (Sherlock Holmes)

পুরো উৎসবে মেতে উঠেছে রিগা। আর এই উৎসবে শুধু রিগা নয়, পড়শি সব ইউরোপীয় দেশ থেকেও এই হোমস জন্মোৎসবে ভক্তরা হাজির। লাতভিয়া ন্যাশনাল আর্ট মিউজিয়াম থেকে বস্তুত এই উৎসবের সূচনা। ভোর থেকেই শীত উপেক্ষা করে সেখানে ভক্তদের বিশাল লাইন। কে কোন চরিত্রের পোষাক পরে মিছিলে হাঁটবে তা আয়োজকদের কাছে নথীভুক্ত করার লাইন। এত উৎসাহের অবশ্য কারণও আছে। মুখ্যত লাতভিয়ায় ব্রিটিশ দূতাবাস আয়োজিত এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহনকারীদের জন্য বিভিন্ন বিভাগে পুরস্কার আছে। যেমন সেরা হোমস, সেরা অন্য চরিত্ররা, সেরা জেন্টলম্যান, সেরা গোঁফ আর দাড়ি।
কেন ১৮৫৪? (Sherlock Holmes)
আরও পড়ুন: কেন থমকে গেল কমলার হোয়াইট হাউজ অভিযান
ভুবনখ্যাত গল্পের গোয়েন্দা চরিত্র উইলিয়াম শার্লক স্কট হোমসের জন্ম ১৮৫৪ (মতান্তরে ১৮৫৩) সালের ৬ জানুয়ারি বলে মানেন বিশ্বজোড়া ভক্তকূল।
কিন্তু ১৮৫৩ বা ১৯৫৪ কেন? আর্থার কোনান ডয়েল তো তাঁর কোনও কাহিনিতেই সৃষ্ট অমর চরিত্রের জন্মবছর সম্বন্ধে খোলসা করে কিছুই বলেননি। কেবলমাত্র স্ট্র্যান্ড ম্যগাজিনের ১৯১৭ সালের সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত ‘হিজ লাস্ট বাউ’ গল্পে শার্লককে লেখক স্যর আর্থার ইগনাসিয়াস কোনান ডয়েল বছর ষাটেকের বলে উল্লেখ করেছেন। গল্পটির পটভূমি ১৯১৪। অর্থাৎ অঙ্কের হিসাবে শার্লকের জন্মসাল ১৮৫৪ হচ্ছে। (Sherlock Holmes)
আরও পড়ুন: ডিপফেক-মানবসভ্যতার মারিয়ানা ট্রেঞ্চ?
সূত্র আরও একটা আছে। প্রলয় বসু তাঁর ‘গোয়েন্দা রহস্যের সন্ধানে’ বইতে লিখছেন, ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত হোমসের প্রথম কাহিনির নাম ছিল ‘আ ট্যাঙ্গালড স্কিন’আর তাতে গোয়েন্দার নাম শেরিনফোর্ড হোমস, যার বয়স ৩৩ বছর। অর্থাৎ গোয়েন্দাপ্রবরের জন্ম ১৮৫৪ সাল। পরে এই উপন্যাসের নাম পাল্টে হয় ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’, শেরিনফোর্ডও শার্লক রূপে আবির্ভূত হন। ব্যস, এই জোড়া সূত্র থেকেই যত হিসাব নিকেশ। তবে শেরিনফোর্ডের অবলুপ্তির সঙ্গেই তাঁর বয়সের উল্লেখেরও অন্ত হয়। তাই একমাত্র ভক্ত ছাড়া আমজনতা পাঠকের কাছে ‘হিজ লাস্ট বাও’এর সূত্রই সবেধন নীলমণি। (Sherlock Holmes)
মজার কথা হল এই কাহিনির হিসাবমতো চললে স্বয়ং হোমস স্রষ্ট্রা কোনান ডয়েল বয়সে তাঁর সৃষ্টির চেয়েও পাঁচ/ছয় বছরের ছোট। এডিনবরাতে আর্থার ইগনাশিয়াস কোনান ডয়েলের জন্ম ১৮৫৯ সালের ২২শে মে। উল্লেখ্য কোনান ডয়েলের জন্মদিন ‘শার্লক হোমস দিবস’ হিসাবে পালন করে ভক্তকূল। (Sherlock Holmes)
কেন ৬ই জানুয়ারি? কারণ বিশ্বজোড়া ‘হোমসিয়ান’দের স্থির বিশ্বাস ১৮৫৪ সালের ৬ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেছিলেন (মতান্তরে ১৮৫৩) বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় গোয়েন্দা উইলিয়াম শার্লক স্কট হোমস। অর্থাৎ আজ থেকে পাক্কা ১৭০/১৭১ বছর আগে। (Sherlock Holmes)
অগস্ট আন্দোলন কিংবা মধ্যবিত্তের এগিয়ে আসার গল্প
বেকার স্ট্রিট ইরেগুলার্স
এই ভক্তকূলের মধ্যে প্রথমেই করতে হয় ক্রিস্টোফার মর্লির নাম। এই মার্কিন সাংবাদিক সাহিত্যিক মর্লির উৎসাহেই চালু হয়েছিল শিল্প সাহিত্য নিয়ে নির্ভেজাল এক আড্ডা, যার নাম থ্রি আওয়ার্স অফ লাঞ্চ ক্লাব। সেটাই ক্রমে হয়ে দাঁড়াল হোমস ভক্তদের আদি অকৃত্রিম ক্লাব ‘বেকার স্ট্রিট ইরেগুলার্স’। বলাই বাহুল্য লন্ডনে হোমসের বাসস্থান ২২১বি, বেকার স্ট্রিটের নামেই এই নাম। সঙ্গী আফগান যুদ্ধ ফেরত সেই ডাক্তার জন হ্যামিস ওয়াটসনকে নিয়েই এখানে বাস হোমসের। ১৯৩৪ সালে নিউইয়র্কের ক্রিস্ট সেলার্স রেস্তোঁরায় হয়ে গেল এর প্রথম সভা। মূলত মার্লোর উৎসাহেই হোমসের এই জন্মদিন পালনেরও সূত্রপাত। সেই ক্লাব এখনও বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। এখনও পর্যন্ত ৭০১জন সদস্য হয়েছেন এই ক্লাবে। এমনকি এই সদস্য তালিকায় রয়েছেন বিশ্বখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক আইজ্যাক অ্যাসিমভও। (Sherlock Holmes)

প্রথম দিকে সদস্যরা বছরে একবার ডিনারে মিলিত হতেন। তখন সেখানে অনেকেই হোমসকে নিয়ে তাঁদের লেখা প্রবন্ধ পড়তেন। এইরকম ভাবেই চলছিল। ১৯৪৪ সালে ক্লাবের তৎকালীন ক্লাব প্রধান এডোয়ার্ড স্মিথ এই সব লেখা সম্পাদনা করে ‘প্রোফাইল বাই গ্যাসলাইট’ নামে এক বই বার করলেন। এরই হাত ধরে বছর দুয়েক বাদে ১৯৪৬ সালে ক্লাবের পত্রিকা বেকার স্ট্রিট জার্নাল আত্মপ্রকাশ করে। বহু ঝড় ঝাপটা সামলে তা আজও ত্রৈমাসিক হয়ে প্রকাশিত হয়ে চলেছে।
অবশ্য বেকার স্ট্রিট ইরেগুলার্স নামের পিছনে অন্য এক কাহিনিও রয়েছে। বেকার স্ট্রিটের একপাল বখাটে ছেলে ছিল আসলে হোমসের ইনফর্মার। উইগিনস নামে ছোঁড়া ছিল তাদের পাণ্ডা। দিনে এক শিলিং পেলেই তারা হেন খবর নেই যে তা জোগাড় করতে পিছপা হত। ওয়াটসন এদের বিদ্রুপ করে ‘বেকার স্ট্রিট ইরেগুলার্স’ বললে কি হবে স্বয়ং হোমস তাদের প্রশ্রয় দিতেন, আদর করে বলতেন, এরা হল ‘দ্য বেকার স্ট্রিট ডিভিশন অফ ডিটেভটিভ পুলিশ ফোর্স’। (Sherlock Holmes)
আরও পড়ুন: ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিদেশনীতি ও সমকালীন বিশ্ব
হোমসিয়ানা
বাংলাতেও ‘বেকার স্ট্রিট ইরেগুলার্স’ এর প্রভাব এসে পড়েছিল। ১৯৮৩ সালে গোয়েন্দা গল্প তথা হোমস চর্চার জন্য সুকুমার সেনের উদ্যোগে ‘হোমসিয়ানা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সন্তোষকুমার ঘোষ, সমরেশ বসু, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুভদ্রকুমার সেন, বাদল বসু, দেবীপদ ভট্টাচার্য, অরুন কুমার মিত্র, দিলীপ কুমার বিশ্বাস আর রঞ্জিৎ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সংঘের সদস্য। নাম কেন ‘হোমসিয়ানা’? সুকুমার সেন ছড়ায় এর উত্তরও দিয়েছেন-
‘মানবজ্ঞানের কৌতুহলী,
শার্লক হোমসের চেলা
হোমসিয়ানা নাম দিয়ে তাই
বন্ধু পাঁচের খেলা।’ (Sherlock Holmes)
প্রলয়বাবু অবশ্য হোমসিয়ানা নামের আরও একটা ব্যাখা হাজির করেছেন। তাঁর মতে, হোমসিয়ানা আদতে হোমস আর ‘রামসিয়ানা’ শব্দদুটির মিশেল। রামসিয়ানা শব্দ বাংলায় রাম সেয়ানাও বলা যায় যার অর্থ অতি চালাক। ব্রিটিশ আমলে রামসিয়ানা নামে এক ঠগীর দলও ছিল। (Sherlock Holmes)

হোমসিয়ানার প্রথম বৈঠক হয় ১৯৮৩ সালের ৭ অগস্ট, এক শনিবার নষ্টচন্দ্রের তিথিতে। ক্লাবের সদস্যরা বেছে বেছে নষ্টচন্দ্রের তিথিতে কেনই বা বৈঠকে বসলেন? সুকুমারবাবুর সহাস্য যুক্তি, নষ্টচন্দ্রের তিথি হল আদতে চোরদের দিন। কথিত আছে কৃষ্ণও এই রাতে চৌর্য্যবৃত্তিতে বেরিয়েছিলেন। তাই চোরদের ধরার জন্য গোয়েন্দারা তো এমন দিনই বাছবেন। সেই ভেবেই হোমসিয়ানাও নষ্টচন্দ্রের তিথিতে গোয়েন্দা গল্পের চর্চায় বসল। নিয়মিত বৈঠকে চলতে লাগল গোয়েন্দা গল্প পাঠ আর চর্চা করে। বছর চারেক বাদে ১৯৮৭ সালে, হোমসের আত্মপ্রকাশের শতবর্ষে হোমসিয়ানা প্রকাশ করল হোমসের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য ‘পাঞ্চজন্য’ যাতে লিখলেন সুকুমার সেন, সমরেশ বসু, আনন্দ বাগচী, রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায় আর সুভদ্র কুমার সেন। অবশ্য তারপর একের পর এক সদস্যের মৃত্যু ‘হোমসিয়ানা’কে বিলুপ্ত করে দিল। তবে হোমসিয়ানা বাংলায় হোমস চর্চায় মুন্সিয়ানারও প্রতীক হয়ে রইল। (Sherlock Holmes)
আর্থার কোনান ডয়েল হোমস চরিত্রটাই সৃষ্টি করলেন কেন?
১৮৮৪ সাল থেকে ডয়েল লেখায় সময় দিতে শুরু করলেন। তার আগের বছরই ডাক্তারি পাশ করে সাউথসিতে চেম্বার খুলে বসেছেন। আর তার বছর দুয়েক পর ১৮৮৫ সালে বিয়ে করলেন তার এক রুগীর বোন লুইসি হকিন্সকে। (Sherlock Holmes)
এই সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ডয়েলের বিভিন্ন গল্প বেরিয়েছে। কিন্তু জম্পেশ একখানা উপন্যাস না লিখলে যে সাহিত্যিক মহলে কল্কে পাওয়া মুশকিল তা ডয়েল ভালই জানতেন। তাই লিখতেও শুরু করলেন ‘দ্য ফার্ম অফ গার্ডেলস্টোন’ নামে এক উপন্যাস। কিন্তু কিছুটা লেখার পরই বুঝলেন এই লেখা মোটেই তাঁর মৌলিক লেখা হচ্ছে না। বরং অবচেতন মনে তাঁর সব প্রিয় লেখকদের অনুকরণ করছেন তিনি। অথচ তিনি চান একশো ভাগ মৌলিক লেখা। (Sherlock Holmes)
আরও পড়ুন: ফেসবুকের অক্সিজেন ও কলকাতার জেগে ওঠা
কী করা যায়? গোয়েন্দা কাহিনি লিখলে কেমন হয়? কেন এ কথা ভাবলেন? শার্লটি মন্টেগু তাঁর ‘ক্রিয়েটিং শার্লক হোমস’ বইতে জানিয়েছেন, আর্থার কোনান ডয়েল সময় পেলেই বই নিয়ে বসে যেতেন। তার মধ্যে প্রচুর গোয়েন্দা কাহিনিও ছিল। কিন্তু সেগুলোর গল্পের প্লট ছিল যেমন জোলো তেমনি চরিত্রগুলো নড়বড়ে। যেভাবে গোয়েন্দারা রহস্যমোচন করতেন তা ছিল ডয়েলের কাছে সবচেয়ে বিরক্তিকর। কাকতালীয় কিছু ঘটনা বা অপরাধীদের অপরাধ কবুল করা অথবা অপরাধীদের ভুলভ্রান্তি-মোটামুটিভাবে এই তিন রাস্তায় রহস্যমোচন করত গোয়েন্দারা। এই থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়ের জায়গায় মগজাস্ত্র প্রয়োগ করার মতো গল্পের প্লট আর ক্ষুরধার বুদ্ধির গোয়েন্দার অভাব অনুভব করলেন ডয়েল। বুঝলেন এই রকম গোয়েন্দা কাহিনি লিখতে পারলে সেটা (জটায়ুর ভাষায়) ‘সেলিং লাইক হট কচুরিজ’ হবে।
প্রলয় বসু অন্য এক পারিপার্শিকতার কথাও এনেছেন। (Sherlock Holmes)
ডয়েল যেসব কল্পিত রহস্যভেদীদের পছন্দ করতেন, রাতের পর রাত গোগ্রাসে যাদের কীর্তিকাহিনি পড়তেন তার মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন ফরাসী লেখক এমিল গাবোরিয়র সৃ্ষ্ট গোয়েন্দা মসিঁয়ে লেকক আর মার্কিন লেখক এডগার অ্যালান পোয়ের গোয়েন্দা দ্যুঁপ। এর মধ্যে লেককের চরিত্র ফরাসি পুলিশের হয়ে একসময় কাজ করা ভিদকের অণুপ্রেরণায় করা। এই ভিদকের একটা দলও ছিল যারা পুলিশের হয়ে নজরদারি আর মাঝে মধ্যে গোয়েন্দাগিরিও করত। ইংরেজরা আবার প্রথাগত ধ্যানধারণায় চলতে বেশি পছন্দ করে। ফলে এই ধরনের’পুলিশ না হয়েও বকলমে পুলিশ’ ব্যাপারটা ঠিক তাদের পছন্দ নয়। ডয়েল তাই বেকার স্ট্রিটের এই বোহেমিয়ান অথচ তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাধারী শার্লক হোমসকে নিয়ে এলেন যার পরিচয় ‘কনসালটিং ডিটেকটিভ’, যিনি পুলিশে তাঁর পেশাগত পরিষেবা দেন। আবার এই পরিষেবা যে লেককের মতো ‘না পুলিশ’ এর চেয়ে ভাল সেটা বোঝাতে ‘সাইন অফ ফোর’এ ওয়াটসনের সঙ্গে কথাবার্তায় ফরাসী গোয়েন্দাকে ‘মিজারেবল বাঙ্গলার’ বা ‘ভীষণ আনাড়ি’ বলালেন হোমসকে দিয়ে। (Sherlock Holmes)
আরও পড়ুন: সিরিয়ার ঘূর্ণাবর্ত: এবার কি ইজরায়েল-তুর্কি সংঘাত?
১৮৮৭ সালে ‘বিটনস ক্রিসমাস অ্যানুয়ালে’ প্রকাশিত হল প্রথম হোমসকাহিনি ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’। বছর তিনেক বাদে ১৮৯০ সালে লিপিনকট মান্থলি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হল দ্বিতীয় হোমস কাহিনি ‘দ্য সাইন অফ দ্য ফোর’। অসাধারন কাহিনি দুটো কিন্তু প্রথমে তেমন সাড়া পায়নি পাঠক মহলে। বরং ১৮৯১ এর জুন মাসে স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে তৃতীয় হোমস কাহিনি ‘আ স্ক্যান্ডাল ইন বোহেমিয়া’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে চিত্রটাই পাল্টে গেল। হোমস কাহিনির জয়যাত্রা শুরু হল। (Sherlock Holmes)
এটা কেন হল? কাহিনি হিসাবে প্রথম দুই হোমস আখ্যান অতি উচ্চ মানের। তাহলে হঠাৎ তৃতীয় কাহিনি থেকেই পাঠক চিত্ত জয় শুরু হল কেন? প্রলয়বাবুর মতে, প্রথম আর দ্বিতীয় গল্পের মধ্যে ৩রা এপ্রিল ১৮৮৮ থেকে ১৩ই ফেব্রুয়ারি ১৮৯১ এর মধ্যে পূর্ব লন্ডনের অপেক্ষাকৃত অস্বচ্ছল হোয়াইট চ্যাপেল এলাকায় ১১ জন মহিলার হত্যাকাণ্ড ঘটে। এটাই ‘হোয়াইট চ্যাপেল মার্ডার’এর সিরিয়াল কিলিং। এর মধ্যে অন্তত ৫জন মহিলা খুনের সঙ্গে উঠে এসেছে ‘জ্যাক দ্য রিপার’ এর নাম। কিন্তু বহু অনুসন্ধান করেও এইসব খুনের কোনও কিনারা করা যায়নি।
প্রলয়বাবু লিখছেন, “জনগনের কাছে বার্তা পৌঁছাল, সমস্ত ক্ষমতার ব্যবহার করেও রাষ্ট্র সবসময় অপরাধীর নাগাল পায় না। সুতরাং প্রয়োজন একজন অতিমানব। তাই জন্ম নিল শার্লক হোমস।” (Sherlock Holmes)
গুরু, তুমি ছিলে বলেই আমরা আছি
রজনী সেন রোড থেকে বেকার স্ট্রিট কতদূরে? হ্যারিসন রোডের তিনতলার ফ্ল্যাট থেকেই বা তার দূরত্ব কতটা? মানচিত্রে হয়তো কয়েক হাজার মাইল ভৌগোলিক দূরত্ব দেখাবে, কিন্তু পাঠকের মন তো তা পার করে এক লহমায়। আর ঠিকঠাক করে বললে বাংলায় ফেলুদা, ব্যোমকেশ বা কিরীটি কিকিরারা পাঠকের মনোজগতে যে জায়গা করেছেন, তার আদি সূত্র তো ওই লন্ডনের ২২১ বি বেকার স্ট্রিটের এক আপাতদৃষ্টিতে অগোছালো বৈঠকখানায় এক আধা বাউণ্ডলে পাইপমুখো গোয়েন্দা আর তার আফগান যুদ্ধ ফেরত ডাক্তার স্যাঙ্গাৎকে নিয়েই।
সেই যে বেকার স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে ফেলুদা বলেছিল, “গুরু, তুমি ছিলে বলেই আমরা আছি।” এ যে শুধু সেই ছয় ফুট দুই ইঞ্চির রজনী সেন রোডের বাসিন্দার একার কথা নয় তা স্পষ্ট হয়ে যায়, তোপসের মুখ দিয়ে স্বয়ং স্রষ্টা সত্যজিৎই যখন বলছেন, “বিশ্বের গল্প সাহিত্যে যত চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে খ্যাতিতে যে শার্লক হোমস নাম্বার ওয়ান সেটা ফেলুদা অনেকবার বলেছে।” (Sherlock Holmes)

হোমস বিশেষজ্ঞ মুহিত হাসান দিগন্ত বলেন “আসলে কে হোমস? তিনি কি নেহাতই ডাঃ ডয়েলের তৈরি এক কাল্পনিক চরিত্র? না গ্যাসবাতি জ্বলা, ঘোড়ায় টানা বোগী-ব্রুহ্যামে চড়া, কুয়াশাচ্ছন্ন লন্ডনের ২২১ বি, বেকার স্ট্রিটে বাস করা রক্তমাংসের এক গোয়েন্দা? শত শত গবেষকের হাজার হাজার গবেষণাপত্রতেও এ তর্ক মেটেনি। এখানেই তিনি অন্য সব গোয়েন্দাদের থেকে আলাদা, জীবন্ত। কিন্তু হোমসকে নিয়ে সত্যিকারের গবেষণা বিদেশে যত হয়েছে, ভারতে তার কণামাত্র হয়নি।” (Sherlock Holmes)
সত্যিই বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে হোমসের চেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র আর কেউ হয়েছে বলে জানা নেই। হোমসের কথায়, “ইটস এলিমেন্টরি, ওয়াটসন।” সত্যিই তাই। কার সাধ্য বেকার স্ট্রিট বাসিন্দার ধারেকাছে আসে?
বছর সত্তর আগে ক্রিস্টোফার মর্লি ছড়া লিখেছিলেন,
“হাড়ভাঙা খাটুনি আর রাজ্যের চিন্তা-রাগ,
লাভ নেই অ্যাসপিরিন বা জিনে।
কিই বা হবে মদ কিনে?
একমাত্র দাওয়াই ডয়েলের এক দাগ।”
তাই প্রত্যেক ৬ জানুয়ারি সেই দাওয়াই নেওয়ার কথা মনে করিয়ে আসছে, ভবিষ্যতেও এর অন্যথা হবে বলে মনে হয় না। (Sherlock Holmes)
তথ্যসূত্রঃ
ক) দ্য শার্লক হোমস বুক-পেঙ্গুইন রান্ডম হাউস (২০১৫),
খ) আর্থার অ্যান্ড শার্লক-কোনান ডয়েল অ্যান্ড ক্রিয়েশন অফ হোমস-মাইকেল সিমস (ব্লুমসবেরি, ২০১৭),
গ) কোনান ডয়েল ফর দ্য ডিফেন্স-মা্র্গালিট ফক্স (রান্ডম হাউস, ২০১৮),
ঘ) ক্রিয়েটিং শার্লক হোমস-শার্লোটি মন্টাগু (চার্টওয়েল বুকস),
ঙ) গোয়েন্দা রহস্যের সন্ধানে- প্রলয় বসু (খড়ি প্রকাশনী ২০২০)
চ) আর্থার কোনান ডয়েল-জীবন ও সাহিত্য-প্রসাদ সেনগুপ্ত (প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরি, ২০০৯),
ছ) হোমসনামা-কৌশিক মজুমদার (বুক ফার্ম, ২০১৮)
মূলত শিল্প বাণিজ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাংবাদিকতায় ব্যপ্ত বিগত তিন দশক। তবে সুযোগ পেলে ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়া বা অন্য ধরনের লেখাতে প্রাণের আরাম খোঁজার চেষ্টাও চলে