(Swapan Gupta)
স্বপন গুপ্ত মানেই একজন নীরব, ভদ্র রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধক। অল্প বয়সেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন। তবে তা জনপ্রিয়তায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। মানুষের কাছে পৌঁছেছিলেন আর সবার মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন নিজের কণ্ঠের জোরে। সদাহাস্যময় সুরের মানুষটির গান প্রথম শুনি আমার বাবার অফিসের রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে, পরিচয় হয়েছিল অনেক বছর পরে সাংবাদিকতার সূত্রে। (Swapan Gupta)
স্বপনদার সঙ্গে আমার বাবা ও মায়ের পরিচয় অনেকদিনের। ওঁদের কাছেই স্বপনদার গানের কথা প্রথম শুনেছিলাম। সত্তরের দশকের শেষের দিকে স্বপনদা থাকতেন দক্ষিণ কলকাতার সাউথ এন্ড পার্কের একটি বাড়িতে, সেই বাড়িতে বাবা-মা মাঝে মাঝেই যেতেন। তখন কখনও কখনও রেডিওতে অনুরোধের আসরে স্বপনদার গান শুনতাম। ওঁর গান শুনে মাঝে-মধ্যে মনে হত দেবব্রত বিশ্বাস গাইছেন। দৃষ্টিশক্তিহীনতা ওঁকে চার দেয়ালের মধ্যে বেঁধে রাখতে পারেনি! (Swapan Gupta)
আরও পড়ুন: তাঁর হাতে মরণ বাঁচন
দেশে এবং বিদেশের শ্রোতারা ওঁর গান শোনার জন্য একাধিকবার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। একটা জিনিস দেখতাম যে দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া বিভিন্ন গান শ্রোতারা স্বপনদার কাছে শুনতে চাইতেন! তার মানে এই নয় যে স্বপন গুপ্তর গাওয়া কোনও গান জনপ্রিয় হয়নি বা ওঁর নিজস্ব কোনও গায়কী ছিল না। যে সংবাদপত্রে আমি কর্মরত ছিলাম, সেই কাগজের জন্য স্বপনদার একটা সাক্ষাৎকার নেওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। (Swapan Gupta)

আমার এক দাদাকে সেই কথা জানিয়েছিলাম। তাঁর সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছিল, কারণ তার কয়েক বছর আগেই আমার বাবা গত হয়েছিলেন আর মাও কলকাতা দূরদর্শন থেকে অবসর নিয়েছিলেন, খুব একটা বেশি যোগাযোগ কারুর সঙ্গেই ছিল না। স্বপনদাকে যোগাযোগ করার কোনও নম্বরও আমাদের জানা ছিল না। আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে দাদা একদিন তাঁর যোধপুর পার্কের ফ্ল্যাটে স্বপনদাকে আমন্ত্রণ জানান। ওঁরও স্বপনদার সঙ্গে অনেকদিনের বন্ধুত্ব ছিল। সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে স্বপনদাও একদিন সন্ধ্যাবেলা চলে এলেন। দিনটা আগে থেকেই জানা ছিল। ওঁর আসার কিছুটা আগেই আমি দাদার বাড়িতে চলে যাই। হাসি-খুশি, সহজ-সরল মানুষ! (Swapan Gupta)
“একদিন বাড়িতে যেতে বললেন। একদিন ফোন করে ওঁর সঙ্গীতজীবনের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে রবীন্দ্রসদনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন আমাদের সবাইকে।”
প্রথমে পরিচয়, বাবা এবং মায়ের কথা বলাতে একেবারেই চিনতে পারলেন। অনেক পুরোনো স্মৃতিচারণ করলেন। সাক্ষাৎকার পর্বে ইনফর্মালভাবেই সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন। পছন্দের কিছু গান শোনার আবদার করতে কোনও বিরক্তি প্রকাশ না করেই প্রতিটি গান পুরোটা গেয়ে শোনালেন! এরপরেও অনেকক্ষণ গল্প চলল। যাওয়ার সময় যোগাযোগ করার জন্য নম্বর আদান-প্রদান করলেন। ওঁর কাছেই শুনলাম ততদিনে ওঁরা সাউথ এন্ড পার্কের পুরোনো ঠিকানা ছেড়ে ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছেন তারাতলায়। (Swapan Gupta)

একদিন বাড়িতে যেতে বললেন। একদিন ফোন করে ওঁর সঙ্গীতজীবনের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে রবীন্দ্রসদনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন আমাদের সবাইকে। খুব আনন্দ করে গেলাম, অনুষ্ঠান দেখলাম, ওঁর গান শুনলাম এবং আমাদের সংবাদপত্রে অনুষ্ঠান সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করলাম সংস্কৃতির পাতায়। (Swapan Gupta)
আরও পড়ুন: প্রিয় গান ও দ্বিজেনদা
আমার দাদার একটা বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে স্বপনদা এবং বৌদি যাবেন বলে ঠিক করলেন। আমাকে ফোন করে বললেন ওঁকে যদি তারাতলার ফ্ল্যাট থেকে তুলে নিয়ে যাই, ভাল হয়। অনেক টানাপোড়েনের পর কলকাতা বইমেলা ততদিনে স্থানান্তরিত হয়েছে বিধাননগরের সেন্ট্রাল পার্কে। নির্ধারিত দিনে ওঁর বাড়ি থেকে নিয়ে গেলাম বইমেলায়। ওঁর দৃষ্টির সমস্যার জন্য মনে হয়েছিল গাড়িটি যদি মেলা প্রাঙ্গনে ঢোকানো যায় তাহলে স্বপনদার পক্ষে খুব সুবিধে হয়। ফোন করলাম পাবলিশার্স গিল্ডের সভাপতি সুধাংশুশেখর দে কে। স্বপনদার কথা শুনে উনি তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা করে দিলেন। (Swapan Gupta)
বইমেলায় যাওয়ার সময় আমার ছোট্ট ন্যানো গাড়ির সামনের আসনে বসে খুব প্রশংসা করলেন ন্যানো গাড়ি সম্পর্কে। বলেছিলেন, ‘শুনেছি গাড়িটা দেখতে ছোট কিন্তু এখন গাড়িতে চড়ে দেখছি ভেতরে অনেকটা জায়গা! বসতে কোনও অসুবিধেই হচ্ছে না! তাছাড়া গাড়ির পিক আপটাও বেশ ভাল!’ (Swapan Gupta)
“ওঁর চলে যাওয়ার সংবাদ পেয়েও যেতে মন চায়নি। মনে হয়েছিল ওঁর হাসিমুখে গাওয়া ‘কাছে ছিলে দূরে গেলে, দূর হতে এস কাছে’ গানটি শোনার মুহূর্তটাকে যত্ন করে মনের এক কোণে রেখে দেব।”
সেদিন অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথেও অনেক গল্প হয়েছিল। পরের বছর মে মাসে আমার মাতামহ কবি-গীতিকার অমিয় বাগচীর লেখা একটি গানের সিডির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ অনুষ্ঠানে ওঁকে আমন্ত্রণ করতেই উনি চলে এসেছিলেন! সেইদিন ওঁর আশাতে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। ওইদিনের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন অগ্রগামী পরিচালক গোষ্টির অন্যতম পরিচালক জয়ন্ত ভট্টাচার্য, শঙ্করলাল ভট্টাচার্য, জহর সরকার, বিশিষ্ট তালবাদ্য শিল্পী শুভেন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। (Swapan Gupta)

একবার আমার বিশেষ পরিচিত আমলা সুনীল মিত্রর অনুরোধে ওঁর বাড়ির সরস্বতী পুজোয় স্বপনদাকে বলেছিলাম কয়েকটা গান গাইতে। আমার সঙ্গে গিয়ে সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন! স্বপনদাকে নিয়ে একটা মনখারাপ করা স্মৃতি আজও আমার মনের মধ্যে রয়ে গেছে, সেটা হল কলকাতা দূরদর্শনের তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রধান অরুণাভবাবুকে অনেক অনুরোধ করেছিলাম স্বপনদাকে নিয়ে একটা ভাল অনুষ্ঠান করতে কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল দৃষ্টিশক্তিহীন শিল্পীদের নিয়ে কোনও অনুষ্ঠান করাতে ওঁর খুব অনীহা ছিল! (Swapan Gupta)
জানি না এটা ওই সরকারি চাকুরের কোনও সাইকোলজিক্যাল সমস্যা কী না! একজন বিশিষ্ট তালবাদ্য শিল্পীর কাছে শুনেছিলাম ঠিক এই একই কারণে উনি নাকি বেহালা ব্লাইন্ড স্কুলের অনুষ্ঠানও কভার করতে দিতেন না! যাইহোক স্বপনদার বয়েস হলেও মোটামুটি সুস্থই ছিলেন কিন্তু কর্কট রোগে ওঁর শরীরে বাসা বাঁধল। মাঝে করোনাকাল হওয়াতে যোগাযোগ একদমই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। (Swapan Gupta)
ওঁর চলে যাওয়ার সংবাদ পেয়েও যেতে মন চায়নি। মনে হয়েছিল ওঁর হাসিমুখে গাওয়া ‘কাছে ছিলে দূরে গেলে, দূর হতে এস কাছে’ গানটি শোনার মুহূর্তটাকে যত্ন করে মনের এক কোণে রেখে দেব। (Swapan Gupta)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।
