আজ নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ। আগামী বৃহস্পতিবারে ‘থ্যাংকস গিভিং হলিডে’। খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানানোর উৎসব। চার দিনের ছুটিতে পারিবারিক সম্মেলনে পক্ষী ভোজন। রাম পাখির বদলে টার্কি। এদেশে ঔপনিবেশিক আমলের ঐতিহ্য অনুযায়ী নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার হল ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’। (Thanksgiving Day)
এদেশে ঔপনিবেশিক আমলের ঐতিহ্য অনুযায়ী নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার হল ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’।
ক্রমশ এদেশের অভিবাসী সমাজে ও ঐ দিনটি সারা বছরের পালা-পার্বনের তালিকায় ঢুকে গেছে। ঘরে ঘরে টার্কি ও আনুষঙ্গিক নিয়ে জবর খাওয়া-দাওয়া। ‘ভোজ কয় যাহারে’। গুরুবারে গুরু ভোজন শুরু করার আগে এক মিনিটের ঈশ্বর ভজন। ঐ, ধন্যবাদ জ্ঞাপন আর কি। (Thanksgiving Day)

সবাই যে রাতারাতি সাহেব হয়েছিলাম, তাও নয়। শাকাহারী ভারতীয়রা তো টার্কি ডিনারের স্বাদ, গন্ধই জানে না। তা বলে সহিংস সম্প্রদায় কেন বঞ্চিত হবে ভোজনে? দেশে থাকতেই বালিহাঁস, পাতিহাঁস খেয়ে যারা হাঁসের বংশ উজাড় করেছে, তারা বিদেশে এসে টার্কির মাংস খেয়ে দেখবে না?
তাছাড়া, বাড়িতে ছোট ছেলে মেয়েদের ব্যাপারও আছে। তাদের চোখে মেঘ করিলে মোদের চোখে আসে জ…ল। (Thanksgiving Day)
আরও পড়ুন: অপুর ঠিকানা…[১] [২] [৩] [৪]
সে কোন কালের ঘটনা। ‘থ্যাংকস গিভিং হলিডে’র পরে স্কুলে গিয়ে একটি ছোট্ট মেয়ের কি দুঃখ। তখনও তাদের বাড়িতে টার্কি ঢোকেনি। পাঁচ বছরের মেয়ে বাড়িতে ফিরে কেঁদে কেঁদে বলেছিল – টিচার জিজ্ঞেস করলো কে কে হলি-ডে তে গ্র্যান্ড মা’র বাড়ি গিয়েছিলে? সবাই হাত তুললো। আমি তুললাম না। টিচার জিজ্ঞেস করলো – কে কে টার্কি রেস্ট করার সময় কিচেনে হেল্প করেছো? সবাই হাত তুললো। আমি তুললাম না। আমার গ্র্যান্ড মা’র বাড়ি নেই। আমি টার্কি খাইনি। (Thanksgiving Day)
দেশে থাকতেই বালিহাঁস, পাতিহাঁস খেয়ে যারা হাঁসের বংশ উজাড় করেছে, তারা বিদেশে এসে টার্কির মাংস খেয়ে দেখবে না?
সেই ছোট্ট মেয়ের কান্না দেখে পরের বছর থেকে তার মা টার্কি রান্না করা শুরু করেছিলেন। সেই ট্র্যাডিশন আব্জও চলছে। ভদ্রমহিলা এখন নিজেই গ্র্যান্ড মা। তাঁর ছেলে মেয়েরা সপরিবারে থ্যাংকস গিভিং ডিনার খেতে আসে। সঙ্গে নানারকম স্ন্যাক্স, ওয়াইন, পামকিন পাই, ডেসার্ট নিয়ে আসে। এরকমই হয় বহু বাড়িতে। (Thanksgiving Day)
প্রতি বছর লক্ষ্মীবারে পক্ষী ভোজন হয় বটে, তবে বুধবার থেকেই ছুটির মেজাজ বোঝা যায়। এয়ারপোর্টে লম্বা লাইন। ট্রেন-স্টেশনে প্রচন্ড ভিড়।
প্রতি বছর লক্ষ্মীবারে পক্ষী ভোজন হয় বটে, তবে বুধবার থেকেই ছুটির মেজাজ বোঝা যায়। এয়ারপোর্টে লম্বা লাইন। ট্রেন-স্টেশনে প্রচন্ড ভিড়। হাইওয়েতে প্রত্যাশিত যানজট। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা বাড়িতে আসছে। মধ্যবয়স্ক লোকজন সপরিবারে বৃদ্ধ বাবা, মায়ের বাড়িতে যাচ্ছে। নয়তো তাঁরা আসছেন। সুপার বাজারে শেষ মুহূর্তেও কাঁচা টার্কি কেনার হুড়োহুড়ি। নিমন্ত্রিতের সংখ্যা অনুযায়ী কেউ কিনছেন পঁচিশ পাউন্ড ওজনের পাখি। কেউ কিনছেন ছোট এগারো পাউন্ডের টার্কি। সবই মুন্ডচ্ছেদের পরে সাফ-সুতরো অবস্থায় প্ল্যাস্টিকের ব্যাগে সিল করা। ডিপ ফ্রিজে ঢোকালে সেই হিম শরীর কে নরম করতে রেফ্রিজারেটরে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা লেগে যায়। তারপরেও ছোট গদার মতন একজোড়া ঠ্যাং পেটের সঙ্গে সেঁটে বসে থাকে। (Thanksgiving Day)

টার্কি রোস্ট আর অন্যান্য পদাবলী তৈরী করার বিশদ বিবরণ দিয়ে কাজ নেই। তবে প্রথম দিকে পাখির ওজন সম্পর্কে সঠিক আন্দাজ না থাকায়, ‘উদবৃত্ত আতঙ্কে’ ভুগেছি।
বাড়িতে আড়াই জন মিলে ওই ঢাউস পাখির মাংস শেষ করা যায়? বক-রাক্ষস নাকি? পরের বারে দুঃসম্পর্কের আত্মীয় স্বজন ডেকেও বোঝা নামাতে পারিনি। কারণ তারাও মহাউৎসাহে আনুষঙ্গিকের নাম করে মাংসের চপ, ফ্রায়েড রাইস, নুডলস নিয়ে হাসি হাসি মুখে ঢুকেছে। (Thanksgiving Day)
থ্যাংকস গিভিং মানেই নাকি সবাই কিছু একটা রান্না করে আনবে। আমি কেক বেক করে রাখি, তো এক আত্মীয়া স্বরচিত “পামকিন পাই” নিয়ে ঢোকেন।
থ্যাংকস গিভিং মানেই নাকি সবাই কিছু একটা রান্না করে আনবে। আমি কেক বেক করে রাখি, তো এক আত্মীয়া স্বরচিত “পামকিন পাই” নিয়ে ঢোকেন। হলদে রঙের পাকা কুমড়োর গ্যাদগ্যাদে মিষ্টি। স্ন্যাক্স আর সাইড-ডিশ এর চাপে গোদা পাখির ভগ্নাংশ পড়ে থাকে। ছেলে-মেয়েরা যতই টার্কি টার্কি করে অস্থির হোক, ও মাংসের স্বাদ কিছু আহামরি নয়। (Thanksgiving Day)
টার্কির টুকরো দিয়ে স্যুপ। কখনও নুডলস দিয়ে টার্কি চাওমেন। কোনও কিছু পদের হয়নি। আসলে সদ্য বেক করার পরে প্রথম দিনে যা স্বাদ ও গন্ধ থাকে, পরে আর তেমন থাকে না।
ভুল করে জটায়ু মার্কা মস্ত পাখি কিনে কম পন্ডশ্রম গেছে আমার? লেফট-ওভার নিয়ে কাকস্য পরিবেদনা। প্রায় মশলাবিহীন সাদাটে মাংসের ঢ্যাবলা তিন দিন ধরে কেউ খাবে না বুঝে স্যান্ডউইচে চালিয়েছি। খানিক চটকে নিয়ে চপ বানিয়েছি। টার্কির টুকরো দিয়ে স্যুপ। কখনও নুডলস দিয়ে টার্কি চাওমেন। কোনও কিছু পদের হয়নি। আসলে সদ্য বেক করার পরে প্রথম দিনে যা স্বাদ ও গন্ধ থাকে, পরে আর তেমন থাকে না। নেহাত ঘোর মাংসাশী, না হলে ঐ ফ্যাকাশে মাংস বার বার খাওয়া অসম্ভব। (Thanksgiving Day)
নেহাত ঘোর মাংসাশী, না হলে ঐ ফ্যাকাশে মাংস বার বার খাওয়া অসম্ভব।
বাঙালির ঘরে ঘরে এরকম অভিজ্ঞতার পর ক্রমশ ‘থ্যাংকস গিভিং’ ডিনারের মেনু কিছু বদল করা হল। একজন আবিষ্কার করলেন নতুন ধরনের স্টাফিং বা পুর। সেদ্ধ মুসুর ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, আদাবাটা দিয়ে চটকে নিয়ে পাখির পেটের খোলের মধ্যে ঠুসে দিতেন, সঙ্গে প্রচুর মাখন ও গোলমরিচ।
রোস্ট করার পরে দিব্যি খেতে হয়েছিল। ‘থ্যাংকস গিভিং হলিডে’ মানে চারদিন ধরে. সপরিবারে, সবান্ধবে ছুটি উপভোগ। খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা, বেড়াতে যাওয়া। বড় শহরে গিয়ে নাটক বা অপেরা দেখা। দল বেঁধে ক্রিসমাস শপিং। (Thanksgiving Day)
‘থ্যাংকস গিভিং হলিডে’ মানে চারদিন ধরে. সপরিবারে, সবান্ধবে ছুটি উপভোগ। খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা, বেড়াতে যাওয়া।
লক্ষ্মীবারের পরদিন “ব্ল্যাক ফ্রাইডে” হচ্ছে বছরের সবচেয়ে বড় “সেল-ডে” অন-লাইন শপিং এর সুবিধে সত্ত্বেও, ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’তে নামী-দামী শো-রুম আর শপিং মল-এ আগের রাত থেকে ক্রেতার লাইন শুরু হয়ে যায়। তবে বৃহস্পতিবারে দোকান বাজার সব বন্ধ থাকে। আগে রেস্তোরাঁ-ও বন্ধ থাকত। টার্কি ডিনার খেতে হলে আগে থেকে কোনও বাড়িতে নেমন্তন্ন নিতে হত। একবার ঐ রাতে ফ্লোরিডা যাচ্ছিলাম। প্লেনে টার্কি ডিনার দিয়েছিল। তখন ডোমেস্টিক ফ্লাইটে অনাহারী থাকতে হত না। (Thanksgiving Day)

এদেশে বহুদিন পর্যন্ত “থ্যাংকস গিভিং হলিডে”-তে টার্কি ডিনার ছিল পারিবারিক উৎসব। ইদানিং শুরু হয়েছে টেক-আউট টার্কি ডিনার। শুধু ছোট্ট সংসারে যে কেনা খাবার আসছে তা কিন্তু নয়, বড় বড় পারিবারিক জমায়েতেও টেক আউট রোস্ট টার্কি আর সাইড ডিশ অর্ডার দিয়ে বাড়িতে সাজিয়ে গুছিয়ে পার্টি হচ্ছে। বাড়ির মস্ত ডাইনিং টেবল ঘিরে সবাই সিট-ডাউন ডিনার করবে। সাবেকি ডিনার সেট আর রূপোর কাঁটা-চামচ, ছুরি দিয়ে টেবল সাজানো থাকবে। (Thanksgiving Day)
সাবেকি ডিনার সেট আর রূপোর কাঁটা-চামচ, ছুরি দিয়ে টেবল সাজানো থাকবে।
দিদিমার আমলের টেবল ক্লথ, ন্যাপকিনের সেট, দাদুর ওয়াইন গ্লাস ইত্যাদি দিয়ে ট্র্যাডিশন বজায় রাখা আর কি?
কেনা খাবারেও নতুনত্ব এসেছে। চিংড়ি মাছ আর পেঁয়াজ কলির কুচো দিয়ে টার্কির পেটের মধ্যে স্টাফিং থাকছে। সঙ্গে কর্ন ব্রেড, সুইট পোট্যাটো, ক্যাসারোল, গ্রেভি আর ম্যাশড পোট্যাটো। বেকড গ্লেজড হ্যাম, ক্র্যানবেরী-ওয়ালনাট চাটনি, হলুদ স্কোয়াশের স্যুফলে, পাস্তা, স্যালাড, ম্যাক্রনি অ্যান্ড চীজ, আইসক্রীম ইত্যাদি নিয়ে দীর্ঘ পদাবলী। (Thanksgiving Day)
কেনা খাবার দিয়ে পার্টি করার ব্যাপারে অধিকাংশ মহিলাই সহমত। তাঁদের যুক্তি আমাদের মা, ঠাকুমা ও দিদিমারা রান্নাঘরে যত সময় কাটাতেন, আমাদের পক্ষে তা সম্ভব নয়। সে যুগে বাইরের খাবারের এত চল ছিল না বলেই তাঁদের এত পরিশ্রম করতে হত। উপায় থাকলে এতখানি সময় বাজার করা, রান্না করার জন্যে পরিশ্রম করবে কেন? একরাতের ডিনারের পর্ব করতে যা খাটতে হয়, ছুটির আনন্দই মাঠে মারা যায়। (Thanksgiving Day)
আরও পড়ুন: জন্মশতবর্ষে সুচিত্রা মিত্র
তা সত্ত্বেও পুরোনো ট্র্যাডিশন বজায় আছে। প্রতিবছর এখনও চল্লিশ শতাংশ পরিবারে বাড়িতেই টার্কি রোস্ট করা থেকে অন্যান্য খাবার তৈরী করা হয়। (Thanksgiving Day)
একবার আমাদের পরিচিত এক বাঙালি ডাক্তার তার বউয়ের গজগজানি শুনে বলেছিল- আমি স…ব করবো। টার্কি নিয়ে এত টেনশন কিসের? বউ বাধা দেয়নি। ‘থ্যাংকস গিভিং’-এর আগের রাতে ডাক্তার সুপার মার্কেটে গিয়ে পঁচিশ পাউন্ড ওজনের টার্কি কিনে আনলো। (Thanksgiving Day)
বরফ জমাট পাখি কিনে এনে সোজা ডিপ ফ্রিজে ঢোকালো। বউ টের পায়নি। কারণ ডাক্তার, বললো- বেসমেন্টের ফ্রিজে রেখেছি। পরদিন অর্থাৎ পার্টির সকালবেলা তাকে কিচেন সিংকে রাখলো। এদিকে সন্ধ্যে নাগাদ পার্টি শুরু হবে। অন্তত পাঁচ ঘন্টা লাগবে ওভেনে বেক করার জন্য। (Thanksgiving Day)
যে কোনও ভাবে ডি-ফ্রস্ট করা যাবে। ডাক্তার ঠান্ডা, গরম জলের কল খুলে দিতে সিংক উপচে মেঝেতে জল গড়াচ্ছে।
এদিকে বরফ আর গলে না। গোদা পাখি হিম দেহ নিয়ে কিচেন সিংকে পড়ে আছে। অত বড় মাইক্রোওয়েভ ছিল না, যে কোনও ভাবে ডি-ফ্রস্ট করা যাবে। ডাক্তার ঠান্ডা, গরম জলের কল খুলে দিতে সিংক উপচে মেঝেতে জল গড়াচ্ছে। বাড়িতে হুলস্থুল! (Thanksgiving Day)
ছোট ছেলে, মেয়ে দুটোও বাবার ওপর রেগে যাচ্ছে। ডাক্তারের বউ এর মাথায় হাত। কখনই বা পাখিটা নরম হবে। কখনই বা মালমশলা মাখিয়ে ভেজানো হবে। আর কখনই বা তার পেটের মধ্যে স্টাফিং পুরে গায়ে, পায়ে মোটা সুতো বেঁধে ওভেনে ঢোকানো হবে?
ডাক্তার আসলে সার্জন। ভেবেছিল ডাইনিং টেবলে লম্বা প্লেটের ওপর রোস্ট টার্কিকে পেড়ে ফেলে নিপুণ হাতে ছুরি চালাবে। স্লাইসিং কাকে বলে দেখিয়ে দেবে। অন্যান্য বছর শুধু তো সেটুকুই করতো। এবছর বউ এর চ্যালেঞ্জ নিয়ে কি ঝামেলা হল!
শেষপর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে ডাক্তার গিন্নি ছুটলো একটা স্পেশাল ফুড মার্কেটে। প্রি-কুকড টার্কি কিনে এনে গরম করে মান আর পিত্তি রক্ষা হলো। সার্জন অবশ্য ডিনার টেবিলে নিপুণ হস্তে ছুরি চালিয়ে অতিথিদের লক্ষ্মীবারে পক্ষীভোজন করিয়েছিল।
ডাক্তার আসলে সার্জন। ভেবেছিল ডাইনিং টেবলে লম্বা প্লেটের ওপর রোস্ট টার্কিকে পেড়ে ফেলে নিপুণ হাতে ছুরি চালাবে। স্লাইসিং কাকে বলে দেখিয়ে দেবে।
‘থ্যাংকস গিভিং ডিনার’-এর প্রচলন যে ঔপনিবেশিক আমলেই আরম্ভ হয়েছিল, তা নয়। তখন হয়ত জাঁক-জমক এদেশে বেড়েছিল। কিন্তু পিলগ্রিমরা এদেশে এসেছিল প্রায় চারশো বছর আগে। অত্যাচার ও ধর্মীয় অনাচারের কারণে বিক্ষুব্ধ ঐ পৃথক ধর্ম-সম্প্রদায় ইংল্যান্ডের প্রতি আস্থা হারিয়ে আমেরিকায় চলে আসে। সঙ্গে আরও কিছু লোক পালিয়ে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল নতুন দেশে স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকা। আমেরিকায় আসার পরে প্রথম ও প্রধান সমস্যা হয়েছিল তাদের খাদ্য সংকট। না ছিল অর্থবল, না ছিল পৃষ্ঠবল।
সেই সময় স্থানীয় আদিবাসীরা তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। আমেরিকান-ইন্ডিয়ানদের সহায়তায় ব্রিটিশ পিলগ্রীমরা চাষবাস, পশু পালন ইত্যাদি করে খাদ্যসংকট দূর করেন। আমেরিকার জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পর, জীবনযাপনে নতুনভাবে স্বাচ্ছন্দ্য আসার কারণে ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করেন। শীতের আগে সে বছরের ফসল খামারে তোলার পর ধন্যবাদ জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ঈশ্বর এবং আদিবাসীদের নিমন্ত্রণের আয়োজন করেন। সেখান থেকে হলো ‘থ্যাংকস গিভিং’ ডিনারের সূচনা। সেদিনের খাদ্য তালিকায় ছিল ঝলসানো বুনো টার্কি, ভুট্টা সেদ্ধ, ক্রানবেরী ফলের চাটনী আর পাকা কুমড়োর মিষ্টি ‘পাই’।
আরও পড়ুন: দেশান্তরের স্বজন
চারশো বছরেও মূল তালিকায় বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। শুধু বিভিন্ন যুগে অভিবাসী সমাজের খাদ্য রুচির প্রভাবে নতুন নতুন পদের সংযোজন হয়েছে। ইটালিয়ানরা পাস্তা এনেছে। জার্মানরা গ্লেজড হ্যাম এনেছে। আমেরিকায় দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ টার্কির পেটের মধ্যে কাঁকড়া, চিংড়ির বর্ণসংকর- ক্র ফিশের পুর ভরেছে।
একবার লুইসিয়ানার নিউ অর্লিয়েন্স শহরের বিখ্যাত পাড়া ‘ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারের’ সি-ফুড রেস্তোরাঁয় ‘থ্যাকংস গিভিং’ ডিনারে সেই সুখাদ্য খেয়েছিলাম। আমরা বাঙালিরা কোনও বাড়িতে ‘সাইড ডিশ’ বলতে ঘুগনি রেখেছি। পাস্তা যদি জায়গা পায়, খাস্তা কচুরি কেন নয়? আমাদের শহরে ‘বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠে’ ‘থ্যাংকস গিভিং’ উপলক্ষে মাদ্রাজী, গুজরাটি, মারাঠী মেম্বাররা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে, শ্রীরামকৃষ্ণকে নিবেদন করে লুচি, তরকারি আর ধোকলা খায়। আমরা সহিংস বলে সেখানে ‘থ্যাংস গিভিং’ ডিনারে যাইনা।
বেকড গ্লেজড হ্যাম, ক্র্যানবেরী-ওয়ালনাট চাটনি, হলুদ স্কোয়াশের স্যুফলে, পাস্তা, স্যালাড, ম্যাক্রনি অ্যান্ড চীজ, আইসক্রীম ইত্যাদি নিয়ে দীর্ঘ পদাবলী।
আগামী বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর কানেটিকাটে গ্রেনীচ শহরে মেয়ের বাড়িতে আমেরিকার ট্র্যাডিশান্যাল টার্কি ডিনারে যাবো। তার শাশুড়ি ‘ভেজিটেরিয়ান’ হলেও ডিম খান। আমি বেশ গরগরে করে ডিমের ডালনা রেঁধে নিয়ে যাই। মেয়ের শ্বশুর লম্বা ছুরি নিয়ে টার্কির শব ব্যবচ্ছেদ করেন। তারপর টেবিলে সুগন্ধি মোমবাতি জ্বালিয়ে, করুণাময় ঈশ্বরকে ছোট্ট ধন্যবাদ দিয়ে শুরু হয় ‘লক্ষ্মীবারে পক্ষীভোজন’।
ছবি সৌজন্যে: The Explorer, Flickr
দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।