(Uttam Kumar)
হিন্দি ছবি মায়াডোর-এ, দৈনিক পাঁচ সিকে পারিশ্রমিকের পরে নায়কের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনেতার পারিশ্রমিক সাতাশ টাকা। সুযোগ যিনি করে দিয়েছিলেন তাঁর কমিশন বাদ দিয়ে, হাতে এল সাড়ে তেরো টাকার মতো। ১৯৪৮ সালের কথা। (Uttam Kumar)
আরও পড়ুন: নতুন চর্চায় গোবিন্দরামের ব্ল্যাক প্যাগোডা
ও দিকে, ওই সিনেমার চিত্রনাট্য যিনি লিখলেন তিনি নিশ্চয় সাম্মানিক পেয়েছিলেন ভালই। কারণ তিনিই লিখছেন তাঁর আত্মস্মৃতিতে, আমার পঞ্চাঙ্ক-প্রাপ্তির পরেই বাঙালী সাহিত্যিকদের প্রতি চলচ্চিত্র দেবতার মুক্তহস্ত দাক্ষিণ্যের সঞ্চার হয়। একটি কৌতুককর ব্যক্তিগত দৃষ্টান্ত এই, যে ‘নিউ থিয়েটার্স’ ১৯৩৭ সনে ‘মুক্তি’র গল্প-সংলাপ-গানের জন্য আমাকে ৫০০ টাকা দক্ষিণা দেন, তাঁহারাই ১৯৫০ সনে ‘পরিত্রাণ’ চিত্রের মাত্র দুইখানি গানের জন্য আমাকে ওই ৫০০ টাকাই প্রদান করেন। শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়, সর্বত্রই এই বর্ধিত হার প্রবর্তিত হয়। (Uttam Kumar)
সজনীকান্ত দাস এমনটা লিখেছেন বটে, কিন্তু ভবিষ্যতে মহানায়ক যতই জনপ্রিয় হন না কেন, তখন মাইনে তাঁহার সাড়ে তেরো। অন্তত জীবনের প্রথম সিনেমা দৃষ্টিদান-এ। (Uttam Kumar)

উত্তমকুমারের প্রথম অভিনয় নীতিন বসু-র দৃষ্টিদান-এ। কাহিনির মূল রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ছোটগল্প। চিত্রনাট্যে তাকে যথেষ্ট হাঙ্গামা করে দুই ঘণ্টার মতো টানিয়া লম্বা করলেন সজনীকান্ত দাস। আর সেই সিনেমাতেই আবির্ভাব ভবিষ্যতের মহানায়কের। (Uttam Kumar)
আবির্ভাবটা অবশ্যি একটু বাড়িয়ে বলা হল। ভাব-টাব দূর অস্ত্, সিনেমার প্রচারের কোথাও থাকল না ছোটবেলার নায়কের চরিত্রের ওই অভিনেতাটির নাম। ফলে ওই সিনেমায় অরুণকুমারের আসাটা মোটেই অরুণোদয় নয়। সিনেমার যে পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল তাতে পিঁপড়ের অক্ষরেও অরুণ বা অরূপ কোনও কুমারের নামই নেই। (Uttam Kumar)

সেই না-থাকার দুঃখ ছিল উত্তমকুমারেরও। তাঁর অনুলিখিত আত্মজীবনী তাঁরই বয়ানে বলছে, ‘মনে পড়ে ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে আমার পারিশ্রমিক ঠিক হয়েছিল সাতাশ টাকার মতো। তবে পুরো সাতাশ টাকাও আমি পাইনি। মনে আছে সুযোগের খেসারত দিতে হয়েছিল আমাকে। কমিশন দিতে হয়েছিল আমার পারিশ্রমিক থেকে। সব বাদ দিয়ে সেদিন আমি পেয়েছিলাম সাড়ে তেরো টাকার মতো। এতে আমার বিন্দুমাত্র ক্ষোভ ছিল না। আমি তখন পারিশ্রমিকের চাইতে সুযোগ পাবার ব্যাপারটাকে প্রাধান্য দিয়েছি বেশি। …’দৃষ্টিদান’ মুক্তি পেল। আমি এক মহা আনন্দে ভরে গেলাম। তবুও তারই পাশাপাশি আর এক হতাশার আঘাতে আমি রীতিমত কাতর হয়ে পড়েছি। কাগজের পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন বেরুল ‘দৃষ্টিদান’এর। আমি প্রত্যাশা করেছিলাম যে কাগজের পৃষ্ঠায় ছাপার অক্ষরে হয়তো আমি আমার নামটা দেখতে পাব। প্রত্যাশা মিটল না। প্রত্যাশা মিটবার মতো কোনও কাজ তো আমি করিনি। এই বলে আমি মনকে প্রবোধ দিলাম।’ (Uttam Kumar)
কিন্তু কেতকীর নামটা ছিল। কেতকী দত্তের নাম। পরবর্তীকালে নাটকের সুবিখ্যাত অভিনেত্রী কেতকী দত্ত। উত্তমকুমার লিখছেন, ‘মনে আছে সেই ছবির নায়িকা ছিলেন সুনন্দা দেবী। আরও মনে আছে তাঁর ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আজকের নাট্যজগতের স্বনামধন্যা অভিনেত্রী কেতকী দত্ত।’ এইটুকুই লিখেছেন উত্তমকুমার। কোনও ক্ষোভ প্রকাশ করেননি তাঁর নাম-না-থাকা আর কেতকী দত্তের নাম-থাকা নিয়ে। (Uttam Kumar)

অথচ ওই ছবিতে অভিনয়ের জন্য রীতিমতো রিস্ক নিয়েছিলেন উত্তমকুমার। পোর্ট কমিশনার্সের চাকরিটাই তখন ছিল তাঁর একমাত্র সম্বল। সেটা জেনেও, লিখছেন উত্তমকুমার, ‘আমি যেন তার সঙ্গে দিনের পর দিন অন্যায়ের মাত্রা বাড়িয়েই চললাম। বেশ কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে আমি ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে শুটিং শুরু করে দিলাম।’ (Uttam Kumar)
এ দিকে, যে-ডেবিউ তাঁকে নামটুকু পর্যন্ত দিল না তারই জন্য বন্ধ হয়ে গেল প্রেমিকা গৌরীর সঙ্গে দেখা হওয়া। আমার আমি-তে উত্তম লিখছেন, ‘দৃষ্টিদান’ তখন চলছে। এমন সময় আমার জীবনে এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগের পূর্বাভাস দেখা দিল। গৌরী আসছে না। আসা বন্ধ করেছে গৌরী। …শুনলাম ‘দৃষ্টিদান’ দেখতে গিয়েই সেই অঘটন ঘটিয়েছে গৌরী। ছবি দেখতে গিয়েছিল ঠাকুরমার সঙ্গে। ছবি তখন চলছিল। ঠাকুরমা ঠাট্টার স্বরে বলেছিলেন ছবির পর্দায় কয়েকজন শিল্পীকে দেখিয়ে, হ্যাঁ রে, দেখ তো ওদের মধ্যে তোর কাউকে মনে ধরে কী না, কাকে তোর পছন্দ… এ যেন কেঁচো খুঁড়তে সাপ! আসলে যা বেরিয়ে পড়ল তা সাপ নয়, সত্য। তার গায়ে খোঁচা দিলে সে তো ফোঁস করে উঠবেই। গৌরীও সত্য। গৌরী সরল। তাকে প্রকাশ করলে ক্ষতি কী? এই ভাব নিয়ে ঠাকুমার ঠাট্টার জবাবে রূপালী পর্দার বুকে আমাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল গৌরী। তিনি রীতিমত বিস্মিত। …যাচাই করবার জন্য তিনি আবার বলেছিলেন, ও মা! ওই রোগা ফিনফিনে ছেলেটাকে তোর মনে ধরল কী রে! সেই মুহূর্তে সে কথার প্রত্যুত্তরে গৌরী কী বলেছিল আমি জানি না। তবে পরক্ষণে ঠাকুমা, গৌরীর সেই ইঙ্গিতকে নিছক ঠাট্টা বলে ধরে নিতে পারেননি। পরদিন থেকে তাই তিনি গৌরীকে সব সময় নজরে নজরে রেখেছিলেন।’ (Uttam Kumar)

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প থেকে সজনীকান্ত দাসের তৈরি চিত্রনাট্যে নীতিন বসুর পরিচালিত দৃষ্টিদানই ছিল উত্তমকুমার-অভিনীত প্রথম ছবি, যাকে ঘিরে এত গল্প। সে সিনেমার প্রিন্ট আজ হারিয়ে গিয়েছে। (Uttam Kumar)
হারায়নি ডেবিউয়ে নাম-না-পাওয়া অরুণকুমারের উত্তমকুমার হয়ে ওঠার সংগ্রামী ইতিহাসটা।
ডিজিটাল ও মুদ্রিত মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
ছবি সৌজন্য- লেখক
আশিস পাঠক বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের প্রকাশনা ও বিপণন আধিকারিক।
আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতার পাশাপাশি নানা সময়ে যুক্ত থেকেছেন সাহিত্য অকাদেমি, বাংলা আকাদেমি, কেন্দ্রীয় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা বিভাগের নানা প্রকল্পে, নানা পুরস্কারের বিচারক হিসেবে। সংস্কৃতির নানা মহলে তাঁর আগ্রহ, বিশেষ আগ্রহ রবীন্দ্রনাথ ও গ্রন্থবিদ্যায়।