সত্যজিৎ রায় ‘নায়ক’ ছবির বহু আগেই উত্তম কুমারকে (Uttam Kumar) ভেবেছিলেন ‘ঘরে বাইরে’-র সন্দীপের চরিত্রে। বিমলার ভূমিকায় সুচিত্রা সেন। নিখিলেশ বসন্ত চৌধুরী। এই ছবি দিয়েই শুরু হতে পারত সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে উত্তম কুমারের পথ চলা। কিন্তু নিজের নায়ক ইমেজের কথা ভেবেই উত্তম ফিরিয়ে দেন সত্যজিৎ রায়ের প্রস্তাব। উত্তমের ঘনিষ্ঠমহল তাঁকে বুঝিয়েছিল সন্দীপের চরিত্রে নেগেটিভ ছাপ আছে, যা উত্তম কুমারের নায়ক ইমেজ শেষ করে দেবে। সরে আসেন উত্তম। বহু যুগ পর আশির দশকে সত্যজিতের সন্দীপ হন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: চেনা মহানায়কের অন্তরালে অন্য উত্তম
উত্তমকুমার, তিনি আমাদের ম্যাটিনি আইডল, তিনি আমাদের মহানায়ক। মহানায়কের সেরা পাঁচটি ছবির নাম যে কোনও বাঙালিকে জিজ্ঞেস করলে সবাই তাঁর পাঁচটি নায়ক ইমেজের ছবির কথাই বলবে। আমরা দর্শকরাই মহানায়ককে খলনায়কের পরিচয়ে কখনও যেতে দিইনি। কিন্তু উত্তমকুমার ছিলেন প্রকৃত অভিনেতা, অভিনয়ের খিদে তাঁর ছিল। তাই তিনি সাতের দশকের পর থেকে খলনায়ক রূপে বেশ কিছু ছবি করেছিলেন। তবে উত্তমকুমারকে বাংলা ছবির ভিলেন বলা চলে না। ভিলেন মানে ছবিতে তাঁর বিপরীতে একজন হিরো থাকবেই। উত্তমকুমার যখন নেগেটিভ চরিত্র করছেন তখন তিনি একাই সেই ছবি জুড়ে থেকেছেন। তখন তিনিই নায়ক, তিনিই খলনায়ক।

খলনায়ক রূপে উত্তম কুমার প্রথম যে ছবিতে দুর্দান্ত অভিনয় করেন সেটি, হরিদাস ভট্টাচার্য পরিচালিত ‘শেষ অঙ্ক’ (১৯৬৩)। এমন কোর্টরুম ড্রামা ছবি বাংলা চলচ্চিত্রে আগে হয়নি। ছবিতে উত্তম কুমারের সঙ্গে অভিনয় করেছেন সেসময়ের নামকরা অভিনেতারা— কমল মিত্র, বিকাশ রায়,পাহাড়ি সান্যাল, উৎপল দত্ত, শর্মিলা ঠাকুর এবং সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। ‘শেষ অঙ্ক’ ছিল সেই যুগের তুলনায় অনেক বেশি হলিউডি ধাঁচের স্মার্ট ছবি। ছবির শুরুতে বোঝাই যায় না উত্তম কুমার আদতে খলনায়ক। উত্তম কুমারের চরিত্রের নাম সুধাংশু। তাঁর প্রথম স্ত্রী কল্পনা ছিল মানসিক রোগের শিকার। কল্পনা আত্মহত্যা করে মারা গেছে, এরপর সোমার (শর্মিলা ঠাকুর) সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ের ঠিক হয়েছে সুধাংশুর। কিন্তু সুধাংশু-সোমার বিয়ের দিন এক সধবা মহিলা এসে হাজির। সেই মহিলা দাবি করেন তিনিই কল্পনা। প্রথমা পত্নী জীবিত থাকলে দ্বিতীয় বিয়ে অবৈধ। আদতে কল্পনা সেজে এসেছিল যে তার নাম সতী (সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়)। তাকে পাঠিয়েছিলেন করঞ্জাক্ষ (বিকাশ রায়), যিনি আদতে একজন গোয়েন্দা মিঃ সমাদ্দার। তাঁকে নিয়োগ করে সুধাংশুর শালা,কল্পনার দাদা দেবেন। দেবেন অনুমান করেছিল কল্পনা আত্মহত্যা করেনি। সুধাংশু সোমাকে বিয়ে করার জন্যই কল্পনাকে হত্যা করে। ছবির শেষে সুধাংশু উত্তমকুমার ভেঙে পড়ে নিজের খুনের দায় স্বীকার করেন। ছবিতে দেবেনের ভূমিকায় তরুণ কুমার আর সুধাংশুর ভূমিকায় উত্তম কুমার, দুই ভাইয়ের এমন হলিউডি ধাঁচের অ্যাক্টিং খুব কম ছবিতেই দেখা গেছে।
‘শেষ অঙ্ক’র পরিচালক হরিদাস ভট্টাচার্য চেয়েছিলেন উত্তম কুমার প্রথম স্ত্রী কল্পনাকে গলা টিপে খুন করছেন এমন দেখানো হবে। কিন্তু উত্তম কুমার খলনায়কের চরিত্র করলেও নিজের চিরনায়ক ইমেজের কথা ভেবে গলা টেপার দৃশ্যটি কিছুতেই করতে চাননি। হরিদাসও উত্তম কুমারের কথা মেনে চলার পাত্র নন। শ্যুটিং বন্ধ হয়ে যায়। হরিদাস আর উত্তম কুমারের সম্পর্ক শেষ হতে বসে। এমন সময় ছবি বাঁচানোর জন্য হাল ধরেন হরিদাসের স্ত্রী বাংলা ছবির ক্লাসিক ডিভা কানন দেবী। তিনি বলেন ছবির বাকি সমগ্র অংশ যখন শ্যুট হয়ে গেছে, এত খরচ করে ছবি তো ফেলে দেওয়া যায় না। যদিও ছবির প্রযোজক কানন দেবী ছিলেন না। কানন স্বামী হরিদাসকে বলেন “উত্তমকে দিয়ে স্ত্রীর গলা টেপানোর দরকার নেই, জোরে চড় মারছে, তাতে স্ত্রী মরে যাচ্ছে এমন দেখানো হোক ও তারপর স্ত্রীর শেষ আর্তনাদ শোনানো হোক।” এই কথায় শেষ অবধি রাজি হন উত্তম কুমার। ছবিতে সেভাবেই দৃশ্যটি দেখানো হয়। ‘শেষ অঙ্ক’ উত্তম কুমারের কেরিয়ারে উন্নতধারার ভিন্ন স্বাদের ছবি হলেও এ ছবি নিয়ে একেবারেই চর্চা করা হয় না। ছবি হিট করেছিল। কিন্তু উত্তম-হরিদাস সম্পর্কে সেই যে চিড় ধরে, তা আর মেটেনি। সুচিত্রা সেন চেয়েছিলেন ‘গৃহদাহ’ ছবি পরিচালনা করুন হরিদাস ভট্টাচার্য। কিন্তু প্রযোজক উত্তম কুমার হরিদাসকে পরিচালক নেননি।

এরপর পীযূষ বসুর ‘দুটি মন’ (১৯৭০) ছবিতে উত্তম কুমার দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেন। একটি ভালো, সৎ চরিত্র আর অন্যটি অপরাধী, ভিলেন। ইতিবাচক আর নেতিবাচক দুই চরিত্রে একই ছবিতে নিজের মুখোমুখি নিজেকে দাঁড় করালেন উত্তম। এই ছবি কখনও চর্চাতেই আসেনি। ‘দুটি মন’, সেকালে ছিল কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। নায়ক ও খলনায়ক দুই উত্তমের বিপরীতে নায়িকার ভূমিকায় ছিলেন নবাগতা সুপর্ণা সেন ও কণিকা মজুমদার।
উত্তম কুমারের খলনায়ক রূপে সবথেকে জনপ্রিয় ছবি পীযূষ বসুর ‘বাঘবন্দী খেলা’। প্রফুল্ল রায়ের ‘প্রথম তারার আলো’ কাহিনি অবলম্বনে এই ছবি নির্মিত। নিজের ইমেজ ভাঙতেই সাতের দশকে উত্তম এ ছবি করেন।
‘প্রথম তারার আলো’র চিত্রসত্ব কেনার জন্য প্রফুল্ল রায়কে ফোন করেন স্বয়ং উত্তম কুমার। এই নামে তাঁর যে কোনও উপন্যাস আছে সেটা প্রফুল্ল ভুলেই গেছিলেন। শেষমেশ তাঁর স্ত্রী স্মরণ করান। পরে উত্তম কুমার তাঁর ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে অন্যান্য প্রযোজক-পরিচালকদের বসিয়ে রেখে, লেখককে পাশের ঘরে আলাদা করে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন ‘প্রথম তারার আলো’র সত্বের জন্য তাঁকে কত টাকা দিতে হবে। উত্তরে প্রফুল্ল বলেন, উত্তম যে টাকা ধার্য করবেন, সেটাই তিনি নেবেন।

‘বাঘবন্দি খেলা’র শুটিং শুরু হওয়ার পর প্রফুল্ল উত্তম কুমারকে বলেছিলেন “এই ছবি চলবে না। বাংলার দর্শক পুরোদস্তুর খলচরিত্রে উত্তমকে গ্রহণ করবে না।” তবু উত্তম এ ছবি করেন। প্রযোজক ছিলেন সংগীতশিল্পী অসীমা ভট্টাচার্য। প্রফুল্লর ভবিষ্যদ্বাণী খাটেনি। বক্স অফিসে সুপারহিট করে ‘বাঘবন্দি খেলা’। ভবেশ ব্যানার্জির চরিত্রটি নিষ্ঠুর খলনায়কের। যে কামুক, চূড়ান্ত স্বার্থপর, ভোগী, নারী পাচারে যুক্ত, অজস্র অবৈধ ব্যবসা চালায়। প্রথম স্ত্রীকে (শমিতা বিশ্বাস) নির্যাতন করে যে বের করে দিয়েছে। দ্বিতীয় স্ত্রীও (সুপ্রিয়া দেবী) তাকে ত্যাগ করেছে। ১২ টুকরো মাংস নিয়ে এসে শুধুমাত্র নিজে খেতে চাওয়া, সন্তানকে ৪ টুকরো দেওয়ায় স্ত্রীর সঙ্গে হুলস্থূলু করে ভবেশ। ভবেশ ব্যানার্জির নীচতা আরও প্রকাশ পায় যখন সে ভোটে দাঁড়িয়ে বড় বড় কথা বলে। যে লোক এককালে পতিতাদের (সুলতা চৌধুরী) গেরস্ত বাড়িতে তুলে এনে বিলাস করা দস্তুর বানিয়েছিল, সেই এখন ভগবান সাজছে। খলনায়ক উত্তমের লিপে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান ‘আয় আয় আসমানী কবুতর’ যেন ভেঙে দেয় উত্তম কুমারের এতদিনের করে আসা সৎ, নিষ্ঠাবান চরিত্রের ইমেজ। ছবির শেষে ভবেশ ব্যানার্জি যখন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাচ্ছে তখনও সে মাথা নীচু করে জেলে যাচ্ছে না। নিজেই নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে। নিজের কাছে নিজের মুক্তি। এ মুক্তি যেন নায়কের মতোই প্রস্থান।
‘আলো আমার আলো’ (১৯৭২) ছবিতে উত্তম ধনী শিল্পপতি নীরেন্দ্র মিত্র, সে গ্রামের মেয়েদের কিডন্যাপ করে এনে ভোগবিলাস করে। এভাবেই তার কাছে এসে পড়ে গরিব ঘরের মেয়ে অতসী সুচিত্রা সেন। কিন্তু অতসীর পবিত্রতায় চরিত্র বদলে যায় এই খলনায়ক উত্তমের। পরপুরুষের বাড়িতে থাকার অপরাধে যখন অতসীর বাবা-মা মেয়েকে ঘরে আর ফিরিয়ে নেয় না, তখন অতসী আশ্রয় পায় নীরেন্দ্রর বুকে। ছবির পরতে পরতে উত্তম যেন খলনায়ক রূপ থেকে বেরিয়ে আসেন নায়কের চেহারায়।
বিজয় বসুর ‘নবরাগ’ (১৯৭১) ছবিতে উত্তম কুমার ঠিক খলনায়ক নন, কিন্তু ধূসর চরিত্র। যে শিল্পপতি মুনাফার আশায় শ্রমিক শ্রেণীর উপর অত্যাচার করে। স্ত্রী সুচিত্রা তাঁদের একমাত্র সন্তানকে বাবার মতো শোষক তৈরি করতে চায় না। উত্তম-সুচিত্রার দ্বন্দ্ব থেকে রোম্যান্সে ফেরার এক পরিণত প্রেমকাব্য ‘নবরাগ’।
১৯৭৬ সালে ‘বহ্নিশিখা’ ছবিতে মিঃ সিনহার চরিত্রে উত্তম কুমারের খল অভিনয়ের কথা বলতেই হয়। ইতিবাচক কাজের আড়ালে থাকা চরিত্রটি আদতে চরম অপরাধমূলক কাজে জড়িত। ‘রৌদ্র-ছায়া’ আর ‘রোদন ভরা বসন্ত’ ছবিতেও নেতিবাচক চরিত্রে উজ্জ্বল উত্তমের অভিনয়। এছাড়াও বারবার ভোগী জমিদারের চরিত্রে উত্তম নায়ক হলেও চরিত্রগুলিতে ছুঁয়ে গেছে খলনায়ক ইমেজ। ‘লাল পাথর’-এর কুমার সাহেব বা ‘স্ত্রী’ ছবির মাধব দত্ত— চরিত্রগুলি একদিকে যেমন খল অন্যদিকে কোথাও যেন সরল, যার জন্য দর্শকের মনে চরিত্রগুলো আলাদা করে জায়গা করে নেয়।

উত্তম কুমার খলনায়ক হিসেবে নিজেকেই নিজে পরিচালনা করেছিলেন ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ ছবিতে। পরিচালক প্রথমে ছিলেন পীযূষ বসু। তিনি আচমকা হৃদরোগে মারা যান। এই পীযূষ বসুই উত্তমকে বারবার খলনায়ক রূপে কাস্ট করেছেন। কিন্তু ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ ছবি রিলিজ করল উত্তম কুমার মারা যাবার পরের বছর, ১৯৮১ তে। এক ব্যভিচারী জমিদার রাজশেখর রায়, স্ত্রীকে ছেড়ে যার প্রতি রাত্রি কাটে বায়না করে আনা নিত্যনতুন বাঈজির সঙ্গে। তবে এইসব ছবির শেষে উত্তম কুমার তাঁর খলনায়ক রূপকে নিজেই নিজে বিসর্জন দিচ্ছেন। ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’র শেষ দৃশ্যে উত্তম কুমারের অভিনয় মনে দাগ কাটে। তিনি তিন দিকে দরজা-যুক্ত বিশাল ঘরে বসে। বাঈজি অপর্ণার চরিত্রে শর্মিলা ঠাকুর এসে উত্তমের কাছে দাবি করেন “আমার স্বামী যাকে আপনি হত্যা করেছেন, আমার মেয়ে যাকে আপনি আমার কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন তাদের ফেরত দিন রাজাবাবু।” স্ত্রী রানি-মা সুপ্রিয়া দেবী এসে বলেন “বহুবার বারণ করেছিলাম তোমায় বাঈজিদের এ বাড়িতে ঢুকিও না, ওরা এ বংশের অভিশাপ, তোমার পূর্বপুরুষদের মতোই তুমি আমার কথা শোননি…” পুত্রবধূ চরিত্রে সুপ্রিয়া-কন্যা সোমা এসে জবাব চান “তাঁর স্বামী শেখর (মিঠুন চক্রবর্তী) কে ফিরিয়ে দিতে।” সব দোষ কবুল করে রাজশেখর রায় দারোগার হাতে ধরা দিয়ে বলেন “আমি এবং আমার পূর্বপুরুষেরা যত অন্যায় যত পাপ করেছি সবের ভাগীদার আমি। খুন আমি করেছি আমায় গ্রেফতার করা হোক।”
‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ র রিলিজ দেখে যেতে পারেননি মহানায়ক কিন্তু খলনায়ক হলেও তাঁকে ঘিরেই এই ছবি। খলনায়ক রূপেই তিনি এ ছবিতে অনবদ্য।
‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ র রিলিজ দেখে যেতে পারেননি মহানায়ক কিন্তু খলনায়ক হলেও তাঁকে ঘিরেই এই ছবি। খলনায়ক রূপেই তিনি এ ছবিতে অনবদ্য।
মহানায়কের মহাপ্রয়াণের পর একটি হিন্দি ছবি রিলিজ করে যাতে তিনি ভিলেনের ভূমিকায়। ‘প্লট নম্বর ৫’, পরিচালনায় যোগেশ সাকসেনা। একের পর এক তরুণী খুন হয়ে চলেছে। সেখানেই এক বাড়িতে থাকে দুই ভাই। যার মধ্যে একজন সঞ্জয়, সে পক্ষাঘাতগ্রস্থ। হুইল চেয়ারে তাঁর ঘোরাফেরা। দেখা যায় সঞ্জয় আদতে একজন সিরিয়াল কিলার। এমন এক নেগেটিভ চরিত্রে উত্তম কুমার হিন্দি ছবিতে আবির্ভূত হন। এই ছবিটিও উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর রিলিজ করে। কলকাতায় কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে তখন চললেও নব্বই শতাংশ বাঙালি এই ছবির নামই জানে না।

উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর রিলিজ করেছিল তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি ‘রাজাসাহেব’। অত্যাচারী, নারীলোলুপ জমিদারের ভূমিকায় উত্তম কুমার। তাঁর লুকটাই নৃশংস করে দিয়েছিলেন পলাশবাবু। কিন্তু ‘রাজাসাহেব’ সেভাবে চলেনি। কারণ হিসেবে পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন “উত্তম কুমার নিজেই রাজি হয়েছিলেন ‘রাজাসাহেব’ ছবিটির খল-চরিত্র করতে। বারবার রোম্যান্টিক নায়কের চরিত্র তাঁর ভালো লাগছিল না। রোজ মাছ ভাত খেলে একদিন দুধ ভাত খেতে ইচ্ছে করতেই পারে। উত্তমদা জানতেন, তিনি অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বা বিকাশ রায়ের মতো ভিলেন হতে পারবেন না। তবু তিনি নিজের নায়কোচিত ঢংয়ে এমনভাবেই খলনায়ক হন যা তুলনাতীত।” কিন্তু ছবিটা দর্শকধন্য হল না। তার কারণ উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর ছবিটি রিলিজ করে। এ প্রসঙ্গে প্রযোজক আর ডি বনশল বললেন “পলাশবাবু বললেন, এখন উত্তম উত্তম চারদিকে চলছে এখনই ছবিটা রিলিজ করি। তার ফল খারাপ হল। মহানায়কের মৃত্যুর পর দর্শক তাঁকে ঈশ্বরের ন্যায় চরিত্রে দেখতে চাইছিল। পজিটিভ রোলের ছবি হলে চলত। কিন্তু নিষ্ঠুর ধর্ষক খলনায়কের ভূমিকায় উত্তম কুমারকে দর্শক নিল না তাঁর মৃত্যুর পর। রাজাসাহেব যদি উত্তম কুমারের জীবিত অবস্থায় রিলিজ হত তাহলে লোকে বলত উত্তম কুমার খলনায়কের ভূমিকায় কী অভিনয়টাই না করেছেন! কিন্তু মৃত্যুর পর যে কোনও মানুষ ভগবান হয়ে যান। খুব মনে পড়ছে যখন উত্তম কুমার মারা গেলেন তখন আমার এক পরিচিত মহিলা তাঁর বত্রিশ বছরের ছেলেকেও হারিয়েছেন। বিধবা পুত্রবধূ, নাতিনাতনি রয়েছে। কিন্তু সেই মা যখন শুনলেন তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে উত্তম কুমারের শেষযাত্রা যাচ্ছে তখন তিনি উত্তম কুমারকে ভগবান দর্শনের মতো দেখতে ছুটলেন। তো এই দর্শকের কাছে তখন খলনায়ক উত্তম কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? ‘রাজাসাহেব’ ১৯৮১ সালে হল-রিলিজ করলে প্রেক্ষাগৃহেও অনেক কটুক্তি ভেসে এল। কেন মহানায়ক এমন খল চরিত্রে! ছবিটি ভুল সময়ে রিলিজে চলল না। কিন্তু উত্তম নিজেই তো নিজেকে ভাঙবার জন্য এই খল চরিত্র করতে সানন্দে রাজি হন। দর্শক খলনায়ক প্রাণকে পজিটিভ রোলে দেখবে কিন্তু উত্তম কুমারকে সহজে তাঁরা ভিলেনে মানতে পারবে না।”

উত্তমকুমার বুঝতে পারছিলেন তাঁর নায়ক হবার বেলা ফুরিয়ে আসছে তাই তিনি নানা ধরণের চরিত্রে নিজেকে সঁপে দিচ্ছিলেন। তবে উত্তমকুমার ছবিতে থাকা মানে তিনিই নায়ক, তাঁকে দেখতেই লোকে হলে ছুটবে। উত্তমকুমার শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘হব ইতিহাস’ ছবির ভিলেন নিশিকান্ত সাহার চরিত্রটি করতে আগ্রহী ছিলেন। তবে কোন প্রযোজক শুভেন্দুর এই ছবি করতেই চাইনি। সবাই বলেছিল যে ছবিতে উত্তমকুমার ভিলেন সে ছবি চলবেনা চলবেনা। অনেক ঝড় পেরিয়ে মেক আপ নিয়ে কদিনের শ্যুটও করেছিলেন উত্তমকুমার কিন্তু অমোঘ মৃত্যু তাঁকে আর সেই ছবি করতে দিলনা। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালক হওয়ার স্বপ্ন ফুরলো। শুভেন্দুর ‘হব ইতিহাস’ আসে অঞ্জন চৌধুরীর পরিচালনার দায়িত্বে। চিত্রনাট্যকার অঞ্জন চৌধুরী এবার পরিচালক। ‘হব ইতিহাস’ নাম পাল্টে হল ‘শত্রু’। উত্তমকুমারের করা চরিত্র নিশিকান্ত সাহার চরিত্রটি করলেন মনোজ মিত্র। আর নায়ক শুভঙ্কর সান্যালের চরিত্রে রঞ্জিত মল্লিক। উত্তমবিহীন যুগে সবথেকে বক্সঅফিস হিট ছবি হল ‘শত্রু’। নায়ক নয়, খলনায়ক হয়েই যে উত্তমকুমার নিজেকে নতুন করে আবিস্কার করতে চেয়েছিলেন তার প্রমাণ উত্তমকুমারের মৃত্যুর পর রিলিজ হওয়া খলনায়ক উত্তমের একাধিক ছবি। যদিও দর্শকের কাছে উত্তমকুমার খলনায়ক হতে পারেননা আজও, তিনি চিরনায়ক।
*তথ্য সহায়ক – ডঃ জ্যোতিপ্রকাশ গুহ, পরিচালক পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
*ছবি সৌজন্য- Wikipedia, লেখক, Youtube
বর্তমান সময়ে বাংলা ছায়াছবি ও বিনোদন জগতের লেখালিখিতে জনপ্রিয় নাম শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। দীর্ঘদিন বাংলা ছবি সংক্রান্ত গবেষণায় ব্রতী রয়েছেন শুভদীপ। তিনি নিয়মিত সাংবাদিকতা করেন। একাধিক সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা। শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'সুরের জাদুকর হেমন্ত' এই সময়ের বেস্টসেলার বই। লতা মঙ্গেশকরের বাংলা গান তৈরির গল্প নিয়ে শুভদীপের লেখা 'গানে গল্পে বাঙালির লতা' বইটি প্রকাশের পথে।