(Wim Wenders)
দুপুর থেকেই লম্বা লাইন পড়েছিল নন্দন চত্বরে। অনেকদিন পর এত লম্বা লাইন! প্রায় এক্সাইড পর্যন্ত পৌঁছেছিল সেই লাইন। উদ্দেশ্য একটাই, উইম ওয়েন্ডার্স এর ছবি। কলকাতার সিনেমাপ্রেমীদের এই উত্তেজনা দেখে অনেকদিন পর সত্যিই অনেকটা বিশ্বাস পাচ্ছিলাম। (Wim Wenders)
আরও পড়ুন: সুমন মুখোপাধ্যায়ের সাথে ‘আমার থিয়েটারের ভাষা’
প্রায় দু-ঘণ্টা দাঁড়িয়েছিলাম লাইনে। বসন্ত সন্ধ্যা যখন সমাগত, তখনই দেখা পেলাম যুবরাজের। ঢাক বেজে তাঁকে স্বাগত জানানো হল নন্দনের সদর দরজায়। আলোয় মোড়া রাজপথ দিয়ে এগিয়ে গেলেন উইম। কলকাতা নামের এই জনপদ, যার সঙ্গে জড়িয়ে উইমের কৈশোরের নায়ক সত্যজিতের নাম, তা দেখে রীতিমত উত্তেজিত তখন তিনি। চারপাশে সাংবাদিকদের ও সিনেমাপ্রেমীদের ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন তিনি রাজপুত্রদের মতো। অভিবাদন জানালেন এই প্রবল জনজোয়ারকে, যা সিনেমাকে ঘিরে এ শহরে আজও সম্ভব! (Wim Wenders)

নব্য জার্মান সিনেমার অন্যতম নাম উইম ওয়েন্ডার্স। সত্তর দশক থেকে আজ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সিনেমা দুনিয়ার অন্যতম তিনি। এবারের তিন দিনব্যাপী উৎসবে দেখানো হল তাঁর খ্যাতনামা একাধিক ছবি। যেমন,
‘প্যারিস, টেক্সাস’, ‘উইংস অফ ডিজায়ার’, ‘এলিস ইন দ্য সিটি’, ‘কিং অফ দ্য রোড’। তার সঙ্গে ছিল একটি মাস্টার ক্লাসও। প্রথমদিনের সন্ধ্যায় দেখানো হল তাঁর ‘প্যারিস, টেক্সাস’ ছবিটি, ছবির শেষে কিছু কথাও বললেন উইম, যা শুনতেই হয়তো উপস্থিত ছিল এদিনের প্রবল ভিড়। উল্লেখ্য, কলকাতায় এর আগে যতবার আন্তর্জাতিক সিনেমা-দুনিয়ার ঈশ্বররা এসেছেন, ততবার এই ভিড় দেখা গেছে এমনই। তা সে আন্তিনিওনি হোক বা সোলানাসা বা নুরি বিলজে ছিলান। (Wim Wenders)

আজকের দুনিয়ায় যারা সিনেমার মাস্টার, যেমন বেলা তার বা কেন লোচ, তাঁদের সাথেই নাম হয়ে থাকে উইমেরও।
প্রথমেই নন্দন ভরা তাঁর সিনেমাপ্রেমীদের অভিভাবন জানালেন উইম। তারপর তাঁর সিনেমা-জীবন বিষয়ে বললেন দু-কথা। জানালেন, সারাজীবনই নিজের খেয়ালে ছবি বানিয়েছেন তিনি। হলিউড তাঁকে প্রভাবিত করলেও, চেষ্টা করেছেন নিজের ছবির গল্পে হলিউডের সটান শুরু-মধ্য-অন্তের নিয়ম ভাঙতে। কারণ, জীবনের ছন্দ সেভাবে চলে না। বরাবরই মানবতার সপক্ষে কথা বলেছে তাঁর ছবি। অনুভূতিময়তাই তাঁর বিষয়। তাই প্রতিটি ছবিতেই কোনও না কোনওভাবে ভেসে ওঠে পিতা-পুত্র সম্পর্ক, নর-নারী সম্পর্ক তথা শিশুদের নিষ্পাপ মুখ। (Wim Wenders)

উইমের প্রতিটি ছবিতেই যেন এই পরম্পরা অব্যাহত।
মানুষের সম্পর্ক, মানুষের নিঃসঙ্গতা তাঁকে ভাবিয়েছে আজীবন। এ প্রসঙ্গে মনে পড়তে পারে বার্গম্যানের কথা।
তাঁর ছবিতেও বারেবারে ধরা পড়েছে ব্যক্তি মানুষের একান্ত গোপন সম্পর্ক, তার মুখ। মুখের বয়স। উইম হয়তো সেই দর্শনের দিকে যেতে চান না বরং তাঁর ছবি দৈনন্দিনের রোজনামচার ভেতরে পিতা-পুত্রের কথাবার্তা।
মানুষের রোজকার জীবনের নিঃসঙ্গতা। অনেকটা একই কারণে গত বছরের ফেস্টিভ্যালে তাঁর ‘পারফেক্ট ডেজ’ ছবিটিও বহুল প্রশংসিত। (Wim Wenders)
মাস্টারক্লাসেও সে কথাই স্বীকার করলেন উইম। বললেন,
ছেলেবেলায় আর পাঁচটা শিশু যেমন চায়, তেমনই পিতার মতো হতে চাইতেন তিনি। তাই চিকিৎসক পিতার মতোই চিকিৎসাবিদ্যায় আগ্রহ ছিল তাঁর। পরে তা বদলে সিনেমার প্রতি প্রেম তৈরি হয়। কারণ, সিনেমা এমন এক ফর্ম যেখানে শিল্পের সমস্ত ফর্ম এসে মিশে গেছে। সিনেমার মায়া তাঁকে তাই টানতে থাকে ক্রমশ। পরবর্তীতে তাঁর ছবিজীবনেও একের পর এক ইমেজ এসে ধরা দেয় আমরা দেখব। কোথাও শূকররা ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাঠে তো কোথাও নগর বন্দরের ব্যস্ততার লং শট তো কোথাও ছাদে মেলে রাখা কাপড় দেখে সুখী কোনও এক ঘরের আদল ভেসে ওঠা…
(Wim Wenders)

উইম এদিন বলছিলেন তাঁর ছবিজীবনের নানা অভিজ্ঞতা ও গল্পের কথা। তাঁর বিখ্যাত কোনও শুটিংয়ে ক্যামেরাম্যানের সাথে ঘটা কোনও অজানা মজার ঘটনা বা কোনও বিশেষ শট নিতে কীভাবে তাঁকে প্রস্তুতি নিতে হয়েছে, জানাচ্ছিলেন অকপটে। শেষে দর্শকদের সঙ্গে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে, এক দর্শকের প্রশ্নে উঠে এল ডিজিটাল এই সময়ের কথা। ক্রমাগত তথ্যের ব্যাপকতার এই যুগে আদৌ কি সিনেমার কোনও ভবিষ্যৎ আছে? (Wim Wenders)

মেন্ডেস স্বীকার করে নিলেন এই সংকট। বললেন, তাঁদের জীবনে সিনেমার যা ভাবনা ছিল তা থেকে অনেকটাই সরে এসেছে আজ এই মাধ্যম। এই সংকটকে অস্বীকার করে লাভ নেই।
শেষদিন নন্দনে উইমের আরও কয়েকটি ছবি দেখানো হল। ছুটির দিন না হলেও, এ দিনও সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের ভিড় ছিল ভালই। গত দু-দিন উইম-আবহে উত্তপ্ত কলকাতার আমেজ এদিনও টের পাওয়া গেল ভরপুর। নিজের সিনেমা নিয়ে উইমের বলা কথাগুলোই যেন ধরা দিল পরপর তাঁর ছবিতে পর্দায়। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত একটানা সিনেমা দেখে বেরিয়ে মনে হল দশমীর আমেজ। ফাঁকা নন্দন চত্বরে বসন্তের হাওয়া আর ছড়ানো পলাশ ফুল দেখে মনে পড়ল, দু-দিন আগে থইথই নন্দন চত্বরে এই ফুলের পাশ দিয়েই হয়তো হেঁটে গিয়েছেন এ-গ্রহের সিনেমাদুনিয়ার অন্যতম এক মাস্টার, উইম ওয়েন্ডার্স! (Wim Wenders)
ছবি সৌজন্য: ম্যাক্সমুলার ভবন
পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।