(Window)
আমার জানলা দিয়ে যায় না দেখা ইসলামাবাদ
তবু দেখি আমি রোজ আমার পাশের বাড়ির ছাদ
একটা হলদে শাড়ি শুকোচ্ছে আজ মোজার রংটা নীল
আজ পৃথিবীটা বড়ই রঙিন (Window)

অঞ্জন দত্তের এই গান শুনতে শুনতে, চোখের নোনা হাওয়া ছাপিয়ে বিভিন্ন দৃশ্য ভাসে কেবল। আজকাল, দ্রুত বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর মানচিত্র। ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে ‘গাজা’ নামক একটি দেশ। আর, বিস্ফোরণে ভেঙে পড়া এক স্কুলবাড়ির আধখাওয়া জানলার গায়ে জনৈক ছাত্রী চকখড়ি দিয়ে লিখে রাখছে আগামীর পড়াশোনা। বদল ঘটছে সারা বিশ্বে। বদল ঘটছে আমাদের শরীরে, মনে, চরিত্রে। হিংস্র হয়ে উঠছে বেশিরভাগ মানুষ। তার মধ্যে জনাকয়েক হা-হুতাশ করছে এমন বীভৎসতায়। নানা মানসিক সংকীর্ণতা সরিয়ে রেখে শরীরের বাঁকবদল ঘটছে। সমাজ ও প্রশাসনিক স্তরে বদলি হচ্ছে সততার। হাতবদল হচ্ছে টাকা, ক্ষমতা, কর্মক্ষেত্রের। বদল, বদলানো, বদলি— ‘বদলি’ বলতে কী বুঝি আমরা? বুঝি, চাকরিতে বদলি, ভাড়াবাড়ি, দেশ থেকে আরেক দেশ কিংবা সম্পর্কের বদলি। (Window)
আরও পড়ুন: বিবাহ রন্ধন: চিঠি কি এসব বোঝে! বেনারসি আসে যায় ওদের বিয়ের কথা হোক…
কবি জ্যোতির্ময় বিশ্বাস তাঁর ‘শোনা কথা’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘ভাড়াবাড়ি ছাড়তে গিয়ে/ শেষের ক’দিন সিঁড়িতে/ আমাদের পা ভারী হয়ে আসে/ আমরা তো তবু দেশভাগ দেখিইনি’
এই কবিতাটি পড়লেই, ‘জানালা’ সিনেমার কথা মনে পড়ে। চিত্রপরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত-র এই সিনেমায় বিমল এবং মীরা তাঁদের সম্পর্কের নানান চড়াই-উৎরাই পেরোয় কেবলমাত্র একটি জানলাকে কেন্দ্র করে। বিমলের ছোটবেলার ভগ্নপ্রায় স্কুলের এক ভেঙে যাওয়া জানলা, ছেলেবেলার স্মৃতি থেকে নস্ট্যালজিয়া, মানসিক টানাপোড়েন থেকে সম্পর্কের সমীকরণ, কতকিছুর সাক্ষী সে! বিমল অতি আবেগ থেকে অত্যন্ত দামি একটি নতুন জানলার অর্ডার দেয়। কিন্তু রাজনৈতিক, সামাজিক ও বিভিন্ন কারণে সেই নতুন জানলার কোনও হিল্লে হয় না। এক কাবাড়িওয়ালা, হাটে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে জানলাটিকে বেচার জন্য নিয়ে যায়। কিন্তু খদ্দের জোটে না বলে, সেই দামি জানলাটিকে একটি গাছের গায়ে হেলান দিয়ে, বসিয়ে রেখে চলে যায়। হাট ভাঙার পরে তখন চারিদিক নিঃস্তব্ধ। বিকেল গড়িয়ে নির্জন আঁধার নামছে। তার মাঝে জানলাটি দাঁড়িয়ে আছে একা। তার কোনও যাওয়ার জায়গা নেই। নৈঃশব্দ্যের আওয়াজ ধীরে ধীরে মিশে যায় উড়তে থাকা শুখা পাতার খসখসানিতে। একটি সাপ চলে যায় জানলাটির সামনে দিয়ে। সাপটি যেন কালের যাত্রাধ্বনি রচনা করা পথিকমাত্র। আর জানলা? সে একা দাঁড়িয়ে থাকে নো-ম্যানস ল্যান্ডের শূন্যতার প্রতীকী হয়ে।(Window)
এও কি এক ব্যক্তিগত দেশভাগ নয়! জানলা এখানে নিজেই এক চরিত্র।
এও কি এক ব্যক্তিগত দেশভাগ নয়! জানলা এখানে নিজেই এক চরিত্র। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আমার ভালবাসা/ যেন সেই আল-ভেঙে-যাওয়া খেতের মতো/ অনেকদিন হল চাষি যাকে ফেলে দিয়ে গেছে চলে”। এ বোধহয় ওই জানলার আত্মকথন।(Window)
The leaves fly over the window and utter a
word as they pass
To the face that leans from the darkness,
intent, with two dark-filled eyes
That watch for ever earnestly from behind
the window glass –(D.H.Lawrence)

জেন অস্টিন-এর ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ উপন্যাসে, মিস্টার ডার্সি এবং এলিজাবেথের ভুল বোঝাবুঝির পরে, ডার্সি যখন আসল ঘটনা লিখে তাঁকে চিঠি দিতে আসে, সেই দৃশ্যে জানলার কোনও উল্লেখ ছিল না। কিন্তু, সেই উপন্যাস অবলম্বনে, ডেভিড ম্যাথিউ ম্যাকফ্যাডিয়েন এবং কিরা নাইটলি অভিনীত ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ চলচ্চিত্রে, একই দৃশ্যের উপস্থাপন ঘটে একটি ঘরের মধ্যে। কিরা নাইটলি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন একা। জানলা দিয়ে আলো এসে পড়েছে সারা ঘরে। ধীরে ধীরে আলো কমছে এবং জানলা এখানে নায়িকার মনের অবস্থার বার্তা বহন করছে। ডার্সি চিঠি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর, এলিজাবেথের হুঁশ ফিরতে তিনি জানলা দিয়ে তাকান, ডার্সির ঘোড়া তখন দৌড়ে চলেছে বহুদূর। ক্যামেরায় জানলাটি ধরা পড়ে ক্যানভাসের ফ্রেমের মতো, যা ভেদ করে আসন্ন কালসমূহ দেখতে পাচ্ছেন এলিজাবেথ। (Window)
এই দৃশ্যে ফরাসি চিত্রশিল্পী অঁরি মাতিসের ‘উইন্ডো’ সিরিজের একের পর এক চিত্রের কথা মনে পড়ে। ফোভ ঘরানার এই তুখোড় শিল্পীর ছবিতে জানলা ধরে রাখে বিভিন্ন গল্প। আর ঠিক এই মুহূর্তেই সিনেমা ও চিত্রশিল্প মিশে যায় জানলার হাত ধরে। হয়ে ওঠে স্বয়ংসম্পূর্ণ চরিত্র, যার চোখ দিয়ে নিত্যদিনের জীবনকে ছেঁকে নিই আমরা।
‘জানালা’ শব্দে আমাদের মাথায় ধাক্কা দিয়ে যায় ‘ডাকঘর’-এর অমলের চরিত্রটি। সে অসুস্থ। সারাদিন জানলার ওপাশে থাকা বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে। দইওয়ালার সঙ্গে তার কথোপকথন তো আমাদের সকলের কাছে অতিচর্চিত। কিন্তু আলাদা করে মনে দাগ কাটে, অমল এবং সুধার কথোপকথনের দু’টি লাইন—
অমল– আমাকে ভুলে যাবে না? আমার নাম অমল। মনে থাকবে তোমার?
সুধা– না, ভুলব না। দেখো, মনে থাকবে। (Window)

এবং শেষ দৃশ্যে সুধা রাজকবিরাজকে অনুরোধ করে যাতে তিনি অমলকে বলেন যে, সুধা তাকে ভোলেনি। এই সূক্ষ্ম অনুভূতির সরলরেখা বাঁধা পড়ে আছে একই জানলার দুই-পারে।
ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ সিনেমার দু’টি দৃশ্য এক্ষেত্রে আলোচ্য।
এক, নায়িকা রাধিকা যখন বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন, তখন তাঁর হাতভর্তি গয়না, আঙুলের গায়ে লেগে থাকা নবোঢা-আলাপে আঁকা আলতার পরত। ট্রেনের জানলায় তাঁর ডানহাতটুকু দেখা যায় কেবল। একাই যেন নিংড়ে নিচ্ছে নতুন জীবনের কাঁচামিঠে ওস্। (Window)
দুই, সিনেমার একেবারে শেষ দৃশ্যে আবার ট্রেনের জানলায় রাধিকার হাত দেখা যায়। তাঁর স্বামীর প্রয়াণ ঘটেছে হঠাৎই। হাতের সাজ বলতে, একখানি শ্রীহীন রূপোর বালা। কিন্তু এইবার, ফ্রেমে আরেকটি পুরুষের হাত দেখা যায়। সম্ভবত, রাধিকার প্রয়াত স্বামীর কাল্পনিক হাত। একটা গোটা সিনেমায় ঘটে গেছে কতকিছু। এই নিত্যদিনের সাংসারিক প্রতিশ্রুতি আসলে, সুধার ফুল নিয়ে আসার প্রতীক্ষারই অঙ্গ! অমলের সেই জানলা থেকে, ট্রেনের কাচের জানলা, সম্পর্ক থমকে গেছে কোনও অজানা দিগন্তরেখায়। বদল ঘটছে সবকিছুর। (Window)
আরও পড়ুন: রঙেতে রাঙিয়া রাঙাইলে মোরে
কেবল বদলাচ্ছে না জানলার স্থবিরতা। বাসা বদলে যায়, চেয়ার বদলে যায়। বদলি হয় দায়-দায়িত্বের। কিন্তু জানলা? তার আর বদলি হয় না! কেবল পাতা ওড়ে। কখনও বা লালরঙা পাপড়ি। বৃষ্টির জলে ভিজে যায় পাল্লা, রেলিং, পর্দা, জ্যোৎস্নার মতো কাচ। (Window)
জানালার কাচে বাতাস ধাক্কা দিচ্ছে
হন্যে বাতাস পালটে দেবার ইচ্ছে
বলছে বাতাস, ‘আয়রে পালটে আয়’
দেখতে দেখতে সবই পালটে যায়।

ইরানিয়ান চিত্র পরিচালক জাফর পানাহি-র ‘ক্লোজড কার্টেন’ সিনেমায়, একজন চিত্রনাট্যকার কাস্পিয়ান সাগরের ধারে একটি ভিলায় প্রায় লুকিয়েই তাঁর কুকুরের সঙ্গে থাকা শুরু করেন। ইসলামে যেহেতু কুকুর পোষা নিষিদ্ধ, তাই তিনি তাঁর কুকুরটিকে লুকিয়ে রাখেন এবং নিজের মাথা কামিয়ে, পরিচয় বদলে, সারা ভিলা জুড়ে পর্দা টাঙিয়ে রাখেন, যাতে কেউ না দেখতে পায়। এরপরেই প্রবেশ ঘটে, মেলিকা চরিত্রটির। সেই মেয়ে বিধ্বংসী। কেবলই বলে, খুলে দাও সব পর্দা, ভেঙে দাও সব লোহার গেট। সিনেমার একটি দৃশ্যে, মেলিকা যখন টেনে-হিঁচড়ে পর্দাগুলো খুলতে শুরু করে, তখন বোঝা যায় যে, এতক্ষণ ধরে যা রাতের আবহ বলে ভাবা হচ্ছিল, তা আসলে ঝকঝকে রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনেরবেলা। কবীর সুমনের ‘জানালার কাচে’ গানটি এই দৃশ্যের সঙ্গে সোনালি ধানখেতের তির্যক আলোর মতো মিশে যায়। স্থান-কাল-প্রকারভেদে জানলা যে আসলে আস্ত রাজনৈতিক চরিত্র, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সে কেবলই বলে, ভাঙো, ভেঙে দাও যত বিধিনিষেধ, ভণ্ডামি। (Window)
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে, ‘স্ত্রী’ সিনেমার সেই বিখ্যাত গান, ‘খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার/এই তোমাদের পৃথিবী/এর বাইরে জগৎ আছে/তোমরা মানো না/তোমরা নিজেও জানো না’— প্রশ্ন করে মেয়েদের চেতন নিয়ে।
তবে, জানলার সঙ্গে নারীমনের বিভিন্ন কৌণিক সমীকরণ দেখিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়, তাঁর পরিচালিত ‘চারুলতা’ সিনেমায়। চারু সারাদিন জানলা দিয়ে মানুষের আনাগোনা দেখত। এমনকি, তাকে স্ক্রিনে দেখানোর সময়, সত্যজিৎ রায় যেভাবে জানলার ব্যবহার করেছেন, তা আসলে সামাজিক স্টিরিওটাইপ ভেঙে চারুর মুক্তির আস্বাদ। ওই জানলাই হল তার বহির্বিশ্বের সঙ্গে একমাত্র সংযোগ। অমলের প্রবেশের আগমুহূর্তে জানলা দিয়ে ধেয়ে আসা ঝড় এবং অমলের প্রস্থান পরবর্তী চিঠি পাওয়ার দৃশ্যে ঝোড়ো হাওয়ার ধাক্কায় জানলা খুলে যাওয়ার যে স্পর্ধা, তা সুস্পষ্টভাবে নারীমনের জটিলতা ও দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে, ‘স্ত্রী’ সিনেমার সেই বিখ্যাত গান, ‘খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার/এই তোমাদের পৃথিবী/এর বাইরে জগৎ আছে/তোমরা মানো না/তোমরা নিজেও জানো না’— প্রশ্ন করে মেয়েদের চেতন নিয়ে। আচ্ছা, তারা কি সত্যিই জানে না? জানে বলেই তো, বিশ্ববন্ধু পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর, চারু জানলার সামনে এসে দাঁড়ায়। অমলকে মনে মনে হারিয়ে, তার মুখে খেলা করে নানা অভিব্যক্তি, মানসিক চাপানউতোর। তারপর, সে এক লহমায় জড়িয়ে ধরে অমলকে। জানলা হল নারীমনের সেই অবলম্বন, যাকে আঁকড়ে মেয়েরা তাদের টুকরো টুকরো চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা ইচ্ছে ভাসিয়ে দেয় চোখের জলকে সঙ্গী করে। (Window)

রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে আধুনিক বাংলা গানে ‘জানালা’ শব্দটি বহুল ব্যবহৃত। কিন্তু তা বেশিরভাগই জানলা-সর্বস্ব হয়ে ওঠা গান নয়। এক্ষেত্রে, বাংলা ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ সম্পাদিত ‘আমার দক্ষিণখোলা জানলা’ গানটি নিঃসন্দেহে এক দৃষ্টান্ত। ঋত্বিকা সাহানির গাওয়া এই গান, বুকের ভিতর ছেঁচে আমাদের দাঁড় করিয়েছিল এক নরম, ঘোরলাগা ঋতুর মধ্যে, যার রেশ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরেও কাটবে না। ‘মাঘের এই অন্তরঙ্গ দুপুরবেলায়’— আমরা চাইলেও ভরা বৈশাখে এমন গান শুনতে পারব না। কারণ, এই গানের জানলা আপনা থেকেই রুদ্ধ থাকবে। ঋত্বিকা গাইছেন, “আমার উত্তরখোলা জানলায়/বাড়ে বয়স/যা-কিছু স্মৃতিসত্তা কাঁপে দারুণ”। (Window)
দখিনা হাওয়া থেকে দক্ষিণখোলা জানলার এই যাত্রা নতুন করে চিনতে শিখিয়েছিল, দুপুরবেলা একান্ত হতে পারে। গানের মাঝে ঋত্বিকা ইন্দো-ওয়েস্টার্ন স্টাইলে একটি আলাপ গেয়েছিলেন, যা শুনলে মনে হয়, চারপাশের জানলাগুলোর পাল্লা খুলে গেছে
সালটা সম্ভবত ২০০১ বা তার আশেপাশে; নব্বইয়ের মাদকতা থেকে বাঙালি তখনও বেরিয়ে আসেনি। সেই সময়ে, ইটিভি বাংলা চ্যানেলে প্রতি রবিবার বিকেলে, ‘শুধু তোমারই জন্য’ টেলিফিল্ম হত। অভিনয় করতেন ঊর্মিমালা বসু, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, অপরাজিতা আঢ্য, সব্যসাচী চক্রবর্তী, কৌশিক সেন, যীশু সেনগুপ্ত, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। তেমনই একটি এপিসোডে, নায়িকা জাপানিজ কিমোনোর মতো কাফতান পরে দোলনায় দুলছেন। আর তার শান্ত কুটিরের মতো দু’চোখে, খোলা চুল এসে ঝাপটা দিচ্ছে ক্রমাগত। ব্যাকগ্রাউণ্ডে বাজছে, “তাই দক্ষিণখোলা জানলায়/ মাঘের এই একান্ত দুপুরবেলায়/ যা-কিছু প্রিয় ভাললাগা মনে পড়ে যায়/ এক দমকা হাওয়ায়”। দখিনা হাওয়া থেকে দক্ষিণখোলা জানলার এই যাত্রা নতুন করে চিনতে শিখিয়েছিল, দুপুরবেলা একান্ত হতে পারে। গানের মাঝে ঋত্বিকা ইন্দো-ওয়েস্টার্ন স্টাইলে একটি আলাপ গেয়েছিলেন, যা শুনলে মনে হয়, চারপাশের জানলাগুলোর পাল্লা খুলে গেছে; তারা মুক্তি দিতে চাইছে বেপরোয়া পর্দাদের। (Window)
বইয়ের ক্ষেত্রে ‘উইন্ডো কাট’ বলে একটি বিষয় আমরা সকলেই জানি। তার সঙ্গে অবশ্য চিরাচরিত জানলার কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু, মলাটের ছোট্ট ‘উইন্ডো কাট’ রহস্য বাড়িয়ে দেয় পুস্তানির চরিত্রের। বাইরে থেকে যা দেখছি, পাতা উলটে দেখা যায় তা অন্যকিছুই। যেভাবে, জানলার দৃষ্টিকোণ এবং বাইরে থেকে জানলা দেখার দৃষ্টিভঙ্গি একটা বিন্দুতে এসে আঘাত করে, ঠিক তেমন করে এখানেও জানলার ধারণা প্রবেশ করে বইয়ের সৌন্দর্যায়নে। (Window)
জানলা— জাতীয়তাবাদ, ধর্ম, জাত, প্রেম, ব্যথা, বিরহ, ঘোর, পরাবাস্তবতার মিশেলে এক চিরকালীন বিষয়, যার কোনও বদলি হয় না। আসলে, আমরা নিজেদের ভিতরে একটা আস্ত জানালা বয়ে বেড়াই, যা আমাদের নতুন করে বাঁচার স্পর্ধা জোগায়।
জানলা— জাতীয়তাবাদ, ধর্ম, জাত, প্রেম, ব্যথা, বিরহ, ঘোর, পরাবাস্তবতার মিশেলে এক চিরকালীন বিষয়, যার কোনও বদলি হয় না। আসলে, আমরা নিজেদের ভিতরে একটা আস্ত জানালা বয়ে বেড়াই, যা আমাদের নতুন করে বাঁচার স্পর্ধা জোগায়। বোঝায়, শত হানাহানির পরেও বসতি গড়ে ওঠে। জানলা পাঠ পড়িয়ে যায়, জীবন শেষ না হওয়ার। লিওনার্ড কোহেনের গান মনে পড়ে এক্ষেত্রে—
হোয়াই ডু ইউ স্ট্যান্ড বাই দ্য উইন্ডো? (Window)
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘চরাচর’ সিনেমার শেষ দৃশ্যই হয়তো এর উত্তর। লখিন্দরের ঘুম ভাঙে একটা ছোট্ট ঘরের মধ্যে। তার চারিদিকে অনেক পায়রা উড়ছে, দানা খুঁটে খাচ্ছে, দু-একটি এসে বসছে তার সুঠাম বাহুর আদরে। লখিন্দরের পিছনে এবং ডানদিকে ছোট্ট দু’টি জানলা দেখে মনে পড়ছে ভ্যান গঘের ছবির ইম্প্রেশন। জানলার নীল ও হলুদের সম্মিলিত আঁচড় জন্ম দিয়েছে এক পরাবাস্তবতার। লখিন্দর থাকে একটি গ্রামে, অথচ সে পাল্লা খুলে দেখল, তার সামনে এক বিশাল সমুদ্র যার কিনার থেকে ঝাঁকেঝাঁকে পাখি উড়ে যাচ্ছে, ঢেউয়ের সফেদ ফেনা ডানায় মেখে… (Window)

আত্রেয়ী চক্রবর্তী
আত্রেয়ী চক্রবর্তী। জন্ম ১৯৯২, হাওড়ায়। কবি, ওড়িশি নৃত্যশিল্পী। ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ করলেও, মূলত লেখালেখি করেন বাংলা ভাষায়। প্রকাশিত কবিতার বই - আফজলকে লেখা চিঠি