(World Tea Day)
উত্তরবঙ্গ!
আমার উত্তরবঙ্গ ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ সেভাবে কোনওদিন হয়নি!
হিমালয় এবং তার পাদদেশের অপূর্ব সৌন্দর্য, ঘন জঙ্গল, চা বাগান কোনওকিছুই আমি দেখিনি! খানিক মিথ্যা বললাম! বাগান-বস্তি জীবনের দারিদ্রের ফাঁক গলে যতটা দেখা যায় ততটা আমি দেখেছি! গত ১০ বছর ধরে লাগাতার দার্জিলিং পাহাড় আর তরাই ডুয়ার্সের চা-বাগান গুলোতে নিয়মিত যাতায়াত করেছি! (World Tea Day)
ছবি বদলের ছবি: সপ্তর্ষি রায় বর্ধন
প্রচুর মেডিক্যাল ক্যাম্প করেছি। চা বাগানের বস্তিগুলো, তার মানুষ, তাদের জীবন বা জীবন যুদ্ধ দেখেছি বারবার!
২৫০ টাকা রোজ বেতনে আট ঘণ্টা ধরে কাজ করা চা-শ্রমিকদের দেখেছি আমি! চা-ভর্তি ঝুড়ির ভারে ঝুঁকে যাওয়া কোমর, সেই কোমরের ব্যথা আমি প্রতিবার দেখেছি! ওষুধ লিখেছি! আর বলেছি ভারী বোঝা না বইতে! ঝুঁকে কাজ না করতে!
যদিও জানতাম এর কোনওটাই তাদের পক্ষে মানা সম্ভব নয়! যেভাবে বাগানের ছেলেমেয়েদের পক্ষে সম্ভব নয়, চা বাগানের ওই অল্প বেতনে কাজ করে চা বাগানে টিকে থাকা! সবাই বাগান ছাড়ছে! দেশের কোনও দূর প্রান্তে কোনও হটেল বা শপিং মলে কাজ নিচ্ছে! (World Tea Day)

বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মা চা বাগানে কাজ করে, দারিদ্র সঙ্গে নিয়ে সুদিনের অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছে! অসুস্থ হলে আপনজনের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। এই শেষ না-হওয়া অপেক্ষা আছে, সঙ্গে আছে অনিশ্চয়তা! বাগান আজ খোলা, তো কাল বন্ধ! পাতা তোলার মরশুমে মালিক আসে পরিযায়ী পাখির মতো, ফসল তুলে নিয়ে যায়। ফেলে রেখে যায় বেকারত্ব আর আবার বাগান খোলার অপেক্ষা! (World Tea Day)
কোনও কোনও বাগানে এই অপেক্ষা আজও শেষ হয়নি। তেমন বাগানেও আমি গেছি! ওরা যত্ন করে চা ফুলের ভাজা দিয়ে ডাল – ভাত খায়িয়েছে আমাদের। ওখানকার রোগা-রোগা পেট-মোটা বাচ্চারা, বন্ধ বাগানের চা-গাছ গুলো কতটা লম্বা হতে পারে তা দেখিয়েছে। সত্যিই গাছগুলো বেশ লম্বা ছিল! বাগান খোলার অপেক্ষা যতটা লম্বা- প্রায় ততটাই! (World Tea Day)
ওই গাছ, শ্রমিকদেরই লাগানো। যত্ন নিয়ে শ্রমিকরাই ওদের বড় করে তোলে। তবে শ্রমিকরা কখনই গাছের মালিক হতে পারে না!
ওই গাছ, শ্রমিকদেরই লাগানো। যত্ন নিয়ে শ্রমিকরাই ওদের বড় করে তোলে। তবে শ্রমিকরা কখনই গাছের মালিক হতে পারে না! এমনকি মালিক বাগান বন্ধ করে চলে গেলেও নয়! ওই গাছের পাতা তোলার অধিকার ওদের নেই। দেশের আইন এই অধিকার মালিকদের জন্যই বরাদ্দ করে রেখেছে। দেশের ব্যাঙ্ক মালিকদেরই টাকা ধার দেয়, সেই টাকায় তারা মালিক হয়। (World Tea Day)
প্রচুর দামে চা রপ্তানি করে বিদেশে। তারপর লোকসানের অজুহাতে বাগান বন্ধ করে। ঋন খেলাপি করে। আবার সরকারের কাছে ঋন চায়। অনেক ক্ষেত্রে সরকার দেয়ও। তবে এই মালিকরা শ্রমিকদের বকেয়া বেতন আর দেয় না। পিএফ, গ্রাচুইটি এর টাকা লোপাট হয়ে যায়। সেগুলো কখনই আর পাওয়া যায় না। চুরি যাওয়া এই টাকার দাবীতে শ্রমিকরা যদি বেঁকে বসে, সেই বাগান আর খোলে না। সেই বাগানের কারখানাতে বর্ষাকালেও আগুন লেগে যায়। (World Tea Day)

কারখানা পুড়ে যায়! সাথে পুড়ে যায় এক ভীষণ সম্ভাবনা! শ্রমিক পরিচালিত বাগানের সম্ভাবনা! সৃষ্টির উপর স্রষ্টার মালিকানার সম্ভাবনা। শুরু হয় কর্মহীন জীবন। কর্মহীন আর অধিকারহীন। কর্মরত থাকলেই শ্রমিকরা চা বাগানের মধ্যে থাকার অধিকার পায়। কাজ না করলে আইনত ওই বাগানে থাকার অধিকার তার নেই। তবুও তারা থাকে। সরকার ওইটুকু ছাড় তাদের দেয়। যদিও ট্যুরিজমের বাড়বাড়ন্তের এই সময়ে কতদিন এই ছাড় তারা পাবে- তা বলা মুশকিল। (World Tea Day)
এইভাবেই অধিকারহীনভাবে বেঁচে থাকে তারা। ছোট ছোট টেম্পোতে ভরে এক বাগান থেকে অন্য বাগানে যেতে দেখা যায় তাদের। বেশ খানিকটা কম বেতনে বেশ খানিকটা বেশি কাজ করে তারা। রাতে তারা বাড়ি ফিরে আসে। তাদের জ্বর হয়, কাশি হয়, কোমরে- ঘাড়ে ব্যথা হয়। তাদের দেখি আমি। কিছুদিনের ওষুধ দিই। (World Tea Day)
তাদের প্রেসার হয়, সুগার হয়। আমি ওষুধ দিই। কিছুদিনেরই দিতে পারি। ওষুধ শেষ হলে তারা অপেক্ষা করে। বেশ কয়েক মাস পরে আবার গিয়ে কিছুদিনের ওষুধ দিই। ওষুধের অভাবে অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপের কারণে পক্ষাঘাত না হয়ে গিয়ে থাকলে তারা নিজেরাই এসে ওষুধ নিয়ে যায়।
তাদের প্রেসার হয়, সুগার হয়। আমি ওষুধ দিই। কিছুদিনেরই দিতে পারি। ওষুধ শেষ হলে তারা অপেক্ষা করে। বেশ কয়েক মাস পরে আবার গিয়ে কিছুদিনের ওষুধ দিই। ওষুধের অভাবে অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপের কারণে পক্ষাঘাত না হয়ে গিয়ে থাকলে তারা নিজেরাই এসে ওষুধ নিয়ে যায়। নাহলে আমি তাদের বাড়িতে যাই ওষুধ পৌঁছে দিতে। (World Tea Day)
এভাবেই আমার চা বাগানে সময় কাটে। ইদানীং বাগানে টিবির প্রকোপ খুব বাড়ছে। তার ওষুধ সরকার দেয়। কখনও কখনও ওষুধের যোগান না থাকলে একটু সমস্যা হয়। নাহলে তারা ওষুধ খেতে ভুলে না। তবে এখন টিবির জীবাণু একটু বেশিই বেয়াড়া। ওষুধে সারে না। এই বেয়াড়া জীবানু বাগানের বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ। সরকার আশা করি এই পরিস্থিতির জন্য বিশেষ ব্যাবস্থা নেবে। নাহলে শহুরে বাবুরাও এই জীবানুর কবলে পড়বে। (World Tea Day)

বাগানে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি সংক্রান্ত কিছু গবেষণাপত্রের ব্যাপারে, আগের থেকেই জানতাম। তার প্রমান প্রতিবার আমি পেয়েছি। বন্ধ বাগান গুলোতে অপুষ্টির মাত্রা অতিরিক্ত। সঙ্গে আছে মানসিক অবসাদ আর নেশাগ্রস্ততা। যদিও অস্বাভাবিক নয়। তবুও দেখে কষ্ট হয়। অন্য বাগানে গিয়েও কষ্ট খুব একটা লাঘব হয় না। (World Tea Day)
সরকার গত কিছু বছরে অন্য জায়গার মতোই উত্তরবঙ্গের জন্য একাধিক মেডিক্যাল কলেজ গড়ে তুলেছে। জেলা হাসপাতাল গুলোরও খানিক উন্নতি সাধন হয়েছে। তবে চা শ্রমিকদের ভরসা অর্জনে এগুলো ভীষণভাবে ব্যর্থ। হাসপাতালের কর্মচারীদের সঙ্গে ভাষাগত পার্থক্য বা অন্য অনেক কিছুই এর জন্য দায়ী হতে পারে। তবে সরকারি হাসপাতালের প্রতি অনাস্থা আমি বারবার দেখেছি। হাসপাতাল পরিচালনকারীরা এই বিষয়টিতে যত্নশীল হলে বহু মানুষ উপকৃত হবে। (World Tea Day)
মানুষ উপযুক্ত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাক। সরকার সে ব্যাবস্থা করুক। সরকারের পক্ষেই তা করা সম্ভব। আমরা নিতান্তই ক্ষুদ্র। তার উপর আমাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত জ্ঞানও অতি অল্প।
মানুষ উপযুক্ত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাক। সরকার সে ব্যাবস্থা করুক। সরকারের পক্ষেই তা করা সম্ভব। আমরা নিতান্তই ক্ষুদ্র। তার উপর আমাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত জ্ঞানও অতি অল্প। তার থেকেও অল্প আমাদের ওষুধ কেনার ক্ষমতা। (World Tea Day)
কয়েকটা রোগের কিছু ওষুধই আমাদের কাছে থাকে। তা দিয়ে অসুখ আর অসুখের কারণ- দুটোকেই নির্মূল করা সম্ভব নয়।অসুখের সাথে সাথে অসুখের কারণও নির্মূল হোক! আমরা প্রাণ খুলে পাহাড়ের আর ডুয়ার্সের সৌন্দর্য উপভোগ করার অবকাশ পাই, আজ বিশ্ব চা দিবসে, এইটুকুই চাওয়া। (World Tea Day)
ডাক্তার, মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ। শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত।