‘সৈর কর দুনিয়াকি গাফিল জিন্দগানি ফির কঁহা/ জিন্দগী গর কুছ রহি তো নৌজবানী ফির কঁহা’ – হে অবুঝ মানুষ, দুনিয়া ভ্রমণ কর, জীবন আর ফিরে পাবে না। জীবন যদিও কিছুটা থাকে, যৌবন তো আর থাকবে না। ‘খুদরাইকা নতিজা’ গল্পে এই কথা বলেছিল বাজিন্দা।
আরও পড়ুন: বিপ্লবী শান্তি-সুনীতি, বিস্মৃতির শতবর্ষ পরে
বয়স তখন ১০ বছর। রানিকিসরায়ের আপার প্রাইমারি মাদ্রাসায় দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠল কেদার। হাতে পেল মৌলবী ইসমাইলের বই। তাতেই ছিল নওয়াজিন্দা-বাজিন্দার গল্প ‘খুদরাইকা নতিজা’। বাজিন্দার এই কথা একেবারে মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল কেদারের। এই শায়েরিই হয়ে উঠেছিল তার জীবনদর্শন— প্রকৃত অর্থেই দর্শন— সব কিছু দু’ চোখে ভরে দেখা, অন্তর দিয়ে দেখা।
তবে বাজিন্দার শায়েরি পড়ার আগেই দাদুর কাছে গল্প শুনে শুনে ভ্রমণকে ভালোবেসে ফেলেছিল কেদার। আজমগড়ের পন্দহা গ্রামে দাদুর বাড়িতেই জন্ম কেদারের। কেদারের দাদু তথা মাতামহ রামশরণ পাঠক ছিলেন পল্টনের সিপাহি। দশ-বারো বছর পল্টনে থেকে চলে এসেছিলেন গ্রামে। কত ছোট বয়স থেকে দাদুর কাছে গল্প শোনার শুরু তা বলতে পারে না কেদার। খাওয়াদাওয়ার পর কখনও দাদুর কোলে বা কাঁখে, কখনও পাশে বসে গল্প শোনা হত। আর সেই গল্পের মধ্যে বেশিটাই থাকত ভ্রমণের গল্প। এই গল্প শুনতে শুনতেই সেই ছোট বয়সেই কামঠি, অকোলা, বুলধানা, ঔরঙ্গাবাদ, বোম্বাই, শিমলা, কোচিন-সহ প্রায় গোটা পঞ্চাশেক জায়গার নাম জেনে ফেলেছিল কেদার। দাদুর কাছ থেকেই কেদার শুনেছিল অজন্তা, ইলোরা, ঔরঙ্গাবাদের গুহাগুলোর কথা। এভাবেই ভূগোল বিষয়টাকে ভালোবেসে ফেলেছিল কেদার।

আজমগড়ের গ্রাম ছাড়িয়ে দূরে যাওয়ার সুযোগ কেদারের জুটে গিয়েছিল মাত্র ন’বছর বয়সেই। উপলক্ষ্য, তার উপনয়ন। ঠিক হল উপনয়ন অনুষ্ঠান হবে বিন্ধ্যাঞ্চলে। ১৯০২-এর এপ্রিল। বিন্ধ্যাঞ্চল আসা-যাওয়ার পথে বারাণসীতে কিছু দিন কাটাতে হয়েছিল ঈশ্বরগঙ্গীর মঠে, পন্দহার মতো গাঁ থেকে একেবারে বারাণসীর মতো অত বড় শহরে। বিশাল চওড়া গঙ্গা, তার কত ঘাট। কেদারের কাছে একেবারে অন্য দুনিয়া। একদিন সকালে ন’বছরের ছেলেটি কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেল মঠ থেকে। মঠ থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তা, সেখান থেকে সোজা চকবাজার। ফেরার সময় কেদার দেখল কাকা হন্তদন্ত হয়ে আসছেন। কাকা জানালেন, বাড়ির লোকেরা সবাই চিন্তা করছে— “বারাণসীর মতো ‘রাঁড়-ষাঁড়-সিঁড়ি-সন্ন্যাসীঅলা’ শহরে এক দেহাতি ঘরছাড়া ছেলের জন্য চিন্তা হবে না?”
এত দিন যেটা দাদুর কাছে ভ্রমণের থিওরিটিক্যাল পড়াশোনা ছিল, সেটারই প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস হল বারাণসীর পথে। কেদারের কথায়, “এক অর্থে আমার সাহসপূর্ণ যাত্রার ক-খ এখান থেকেই শুরু হয়েছিল।” আর কয়েক মাস পর থেকেই মাথায় ঢুকে গেল বাজিন্দার বলা শায়েরি। কালক্রমে পাক্কা ‘ঘুমক্কড়’ হয়ে গেলেন কেদার। হয়ে উঠলেন বহুবর্ণময়, স্বয়ংশিক্ষিত পরিব্রাজক, সতত ভ্রাম্যমাণ।

কেদার মানে কেদারনাথ পাণ্ডে তথা রাহুল সাংকৃত্যায়ন (Rahul Sankrityayan)। রাহুল তখন নিজামাবাদ মিডল স্কুলের ছাত্র। ১৯০৭-এর গোড়ার দিক। বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। বাজিন্দার সেই শায়েরি রাহুলের মনে রং ধরালো। ঘরে কিছু চাল-আটা ছিল। সেগুলো বেচে মিলল দেড়-দু’ টাকা। সেটাই পকেটে নিয়ে চলে এলেন ফরিহা স্টেশনে। টিকিট কাটলেন বারাণসীর। কারণ ওটাই তো তখন একমাত্র পরিচিত জায়গা ছিল ১৪ বছরের কিশোরের। বারাণসী পৌঁছলেন, কিন্তু সেই ঈশ্বরগঙ্গীর মঠে গেলে চলবে না। পরিচিত জনদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে যে। তাই মঠের কাছেই জগেসরনাথ মন্দিরে আশ্রয় নিলেন। সংস্কৃত পড়ে এমন অনেক ছাত্র ওখানে থাকত। তাই অনেকেরই প্রশ্নের উত্তরে রাহুল বললেন, তিনি সংস্কৃত পড়তে এসেছেন।
এর পরই একটা দোটানা শুরু হল। বাজিন্দা তো তাঁকে এতদূর এনেছে। কিন্তু এর পর কী হবে? হাতের পয়সাও তো শেষের মুখে। শেষ পর্যন্ত ফিরে চলার সিদ্ধান্ত। রাতের ট্রেনে ফরিহা পৌঁছে বাকি রাতটা স্টেশনে কাটিয়ে দাদুর ভয়ে পন্দহা নয়, বাবার গ্রাম কনৈলার পথ ধরলেন রাহুল। ‘ঘুমক্কড়’ হওয়ার পথে এভাবেই এক দম এগিয়ে থাকলেন।

আবার একটা সুযোগ জুটে গেল বাজিন্দা হওয়ার। সাংসারিক কাজে এক বিরাট ত্রুটি তাঁকে ‘ঘুমক্কড়’-এর পথে ফের নিয়ে গেল। গৃহত্যাগ করার এই ঘটনাকে রাহুল তাঁর ‘মেরি জীবন-যাত্রা’য় ‘প্রথম উড়ান’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
বারাণসী থেকে ফিরে আসার মাসদুয়েক পরের ঘটনা। দিদিমা গত হয়েছেন, দাদু একা। তাই কিছু সাংসারিক কাজের দায়িত্ব বর্তেছে রাহুলের উপরে। মাখন গলিয়ে ঘি বানানো হয়েছে। অন্ধকার ঘর। তারই মধ্যে সেই ঘি আন্দাজে বয়ামে রেখে, গামলা দিয়ে ঢাকা দিয়ে রাহুল নিশ্চিন্তে ঘুমোতে গেলেন। পরদিন সকালে দেখলেন সেরদুয়েক ঘি সারা মেঝেতে ছড়িয়ে। দাদু দেখলে তো বাড়ি মাথায় করবেন। এই আতংকেই আবার সাহসী হতে বাধ্য হলেন রাহুল। বলদ বিক্রির বাইশ টাকা ছিল। সেই টাকা সম্বল করে বেরিয়ে পড়লেন অনিশ্চিত পথে। আবার গেলেন বারাণসী। হাতে যা টাকা ছিল, তাতে মোগলসরাই-বিন্ধ্যাঞ্চলও ঘোরা হল। কয়েকটা দিন কেটে গেল। টাকা ফুরিয়ে আসছে। এর পর কী করবেন? বাড়ি ফিরে যাওয়া যাবে না। অনেক অপরাধ— ঘি বরবাদ করা, বাইশ টাকা নিয়ে পালানো এবং সেই টাকা বাজে খরচ করা। তা হলে একটাই পথ— অচেনা পথে আরও এগিয়ে চল। সাব্যস্ত করলেন, কলকাতা চলে যাবেন। সন্ধের ট্রেন ধরে সকালে পৌঁছে গেলেন হাওড়া স্টেশন।

‘প্রথম উড়ান’-এ রাহুলের (Rahul Sankrityayan) কলকাতায় বাস মাস-চারেকের। সে দিন হাওড়া স্টেশনে নেমে রাহুলের মনে হল এটাই তো একটা বিশাল মেলা। রাহুল ভেবেছিলেন কলকাতা শহরটা নিশ্চয়ই আর-একটা বেনারসের মতো হবে। কিন্তু স্টেশন থেকে বেরিয়ে তো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। হাওড়ার পুলে জনসমুদ্র। সামনে গঙ্গার ঘাটে মানুষের মেলা। ও-পারে প্রাসাদনগরীর অট্টালিকা দৃশ্যমান। বিহ্বল, বিভ্রান্ত রাহুল ভেবে পান না কী করবেন। ফিরে এলেন স্টেশনে। বসে থাকলেন তৃতীয় শ্রেণির প্রতীক্ষালয়ে। এখানেই কিছুক্ষণ পরে আলাপ হল মহাবীর প্রসাদের সঙ্গে। দেশোয়ালি মহাবীর কলকাতায় এসেছে কিছু দিন হল। থাকে জোড়াসাঁকোয় মাসিক আট আনা ভাড়ার বাসায়। ও কেন কলকাতায়? মহাবীরের কাছে প্রশ্নের উত্তর কোনোদিনও পাননি রাহুল, তবে পেয়েছেন মাথা গোঁজার ঠাঁই। সেই জোড়াসাঁকোয়। এভাবেই হাওড়া স্টেশনে জুটে গেল আরও দু’জন। একজন জৌনপুর থেকে আসা সমবয়সি আর অন্যজন আরা থেকে আসা বছর-তিরিশের এক যুবক।
গৃহত্যাগী চারটি মানুষ কলকাতায় তৈরি করে নিলেন ‘কমিউন’। ‘আমার’ নয়, সব ‘আমাদের’। যার কাছে যা টাকাপয়সা ছিল, তা সকলের হয়ে গেল। ঠিক হল, যার যেমন রোজগার হবে, সবই খরচ করা হবে সকলের জন্য। কাজের খোঁজে মহানগরে চক্কর চলতে থাকল রাহুলের। কখনও চিৎপুর, কখনও ধর্মতলা, কখনও বা খিদিরপুর, কখনও বা নিমতলা। দেওয়ালে সাঁটা বাংলা ইস্তাহার দেখতে দেখতে রাহুল কখন যেন বাংলা বর্ণমালাও শিখে ফেললেন। এভাবেই কখনও জোড়াসাঁকোয়, কখনও বা খিদিরপুরের কুলিবাজারে এবং শেষে বৃদ্ধ বিন্দাপ্রসাদ পাঠকের আশ্রয়ে। পাঠকজি তাঁকে সন্তানের মতো দেখতেন। রাহুলকে ইংরেজি পড়ানো শুরু করলেন এবং শেষ পর্যন্ত ভর্তি করে দিলেন বিশুদ্ধানন্দ সরস্বতী বিদ্যালয়ে। ইতিমধ্যে বাড়ির সঙ্গে চিঠি চালাচালি হয়েছে। দাদু ফিরে আসার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন, টাকা পাঠাচ্ছেন। ‘ঘুমক্কড়’ রাহুলের মনও উতলা। শেষ পর্যন্ত পাঠকজিই একদিন হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে তুলে দিয়ে এলেন রাহুলকে।

মাঝখানে বছরদুয়েক কীভাবে যেন কেটে গেল। আবার নিজামাবাদের স্কুলে ভর্তি হলেন রাহুল। মিডল স্কুলের পরীক্ষার পর দু’ সপ্তাহও কাটেনি, ‘ঘুমক্কড়’ মনটা আবার চেগে উঠল। ‘সৈর কর দুনিয়াকি গাফিল’ মন্ত্রটা তাঁকে তিষ্ঠোতে দিল না। আবার গন্তব্য কলকাতা। বিন্দাপ্রসাদ পাঠকজি তো আছেন। কলকাতায় পাঠকজির সাহায্যে একটা-না-একটা কাজ জুটে যাচ্ছিল রাহুলের। শেষ পর্যন্ত মাস আটেক কাটিয়ে আবার বাড়ির পথে।
কলকাতা যাওয়ার আগে রাহুল তাঁর বাবার সঙ্গে গিয়েছিলেন উমরপুরের পরমহংসবাবার কাছে। ফিরে এসে পরমহংসবাবার কুটিরে নিয়মিত যাওয়া শুরু করলেন রাহুল। পরমহংসবাবার সেবা করতেন হরিকরণবাবা। তাঁর কাছে হিন্দি বেদান্ত-সহ নানা গ্রন্থ পড়া হল। ইতিমধ্যে রাহুল দিনে তিন বার স্নান করে আহ্নিক করছেন, সারা দিনে এক বার খাচ্ছেন, ধর্মগ্রন্থ পড়ছেন আর পরমহংসবাবা ও হরিকরণবাবার সৎসঙ্গে রয়েছেন।
দু’-তিন বছর আগে হরিকরণবাবা বদরীনাথ গিয়েছিলেন। সেই গল্প করেছিলেন রাহুলের কাছে। আর বলেছিলেন এক বালকরূপী যোগীর কথা, যাঁর সঙ্গে হরিকরণবাবার সাক্ষাৎ হয়েছিল দেবপ্রয়াগের কাছে। হরিকরণবাবার কাছে শুনে মনে হয়েছিল সেই যোগী যেন দ্বিতীয় ধ্রুব। মনের মধ্যে ঝড় তুললো বৈরাগ্যের আঁধি। তার সঙ্গে বদরীনাথ যাত্রার কাহিনি আর তপস্বী ধ্রুবর প্রতি টান। রাহুল আবার পথে। পরনে ধুতি-কোট, সঙ্গে গামছা, বগলে কুশের আসন। এভাবে তো রাহুল প্রায়ই যান পরমহংসবাবার কুটিরে। কেউ খুব একটা নজর করল না। আগের দুই উড়ানে পকেটে টাকা ছিল। এবার সম্বল চাণক্যের প্রার্থনা-শ্লোক, কা চিন্তা মম জীবনে যদি হরির্বিশ্বম্ভর গীয়তে (যদি আমি বিশ্বম্ভর শ্রীহরির গুণকীর্তন করি তাহলে আমার জীবনে আর চিন্তা কী!)। হিমালয়ের পথে চললেন রাহুল। বয়স তখন ১৭ বছর।

শুরু হল রাহুল সাংকৃত্যায়নের (Rahul Sankrityayan) বিরামহীন পরিক্রমা। একাধিক মহাদেশে ৫২ বছরের অবিরাম পর্যটন। তিনি লিখেছেন, “বৈরাগ্য, জ্ঞানলিপ্সা আর ভ্রমণতৃষ্ণার ভূত আমার ওপর সওয়ার হয়েছিল।” রাহুল বিশ্বাস করতেন জীবন চলমান, আপাতদৃষ্টিতে তা এক জায়গায় থিতু বলে মনে হলেও আদতে তা নয়। তাঁর জীবন এক অবিরাম যাত্রার কাহিনি।
রাহুল সাংকৃত্যায়নের বহুমুখী পরিচয়। কিন্তু তাঁর সব কিছু পরিচয়কে ছাপিয়ে যায় তাঁর ভবঘুরে চরিত্র, একজন ‘ঘুমক্কড়’। তাই তো তিনিই লিখতে পারেন ‘ঘুমক্কড় শাস্ত্র’। বিশ্ব পর্যটন দিবসে এই অনন্য মানুষটির প্রতি রইল অনন্ত শ্রদ্ধা।
তথ্যসূত্র:
রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘মেরি জীবন-যাত্রা’ ও অন্যান্য গ্রন্থ
ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons, Flickr, Wikipedia
পেশায় সাংবাদিক। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন ডেপুটি নিউজ এডিটর। বর্তমানে খবর অনলাইন ও ভ্রমণ অনলাইনের অন্যতম কর্ণধার। ক্যালকাটা জার্নালিস্টস ক্লাবের মুখপত্র ‘সাংবাদিক’-এর মুখ্য সম্পাদক।