গান্ধীজী যখন অনশনে বসেছিলেন তখন তাঁকে নিয়ে যিনি গান শুনিয়েছিলেন তিনি অরুন্ধতী দেবী (arundhati devi)। অবশ্য তখন তিনি পরিচিত ছিলেন অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায় নামে। গান দুটি ছিল ‘যদি তোর ডাক শুনে’ আর ‘আমায় ক্ষম হে ক্ষম’। গান্ধীজির মৃত্যুর পরে অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ৩১ জানুয়ারি আকাশবাণীতে অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গে অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রিয় মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন তাঁর আর এক প্রিয় মানুষ গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে দিয়ে। গান গাইতে গিয়ে সেদিন তাঁর গলা বারে বারে বুজে আসছিল। ওপার বাংলার থেকে মাত্র বারো বছর বয়সে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। আশ্রমের শিক্ষক অজিত চক্রবর্তী ছিলেন অরুন্ধতী দেবীর পিসেমশাই। তাঁর মাধ্যমেই যোগাযোগ। ছিল অসাধারণ গানের গলা। অন্যান্য গান জানা থাকলেও রবীন্দ্রসঙ্গীত জানা ছিল না।
ওদিকে আবার শান্তিনিকেতনে তখন নিয়ম গান শিখতে হলে পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষা দিতে হবে আবার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে। কী করা যায়! ত্রাণকর্তা হিসেবে এগিয়ে এলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার। দু’টো গান শিখলেন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। সেদিনই বিকেলে আশ্রমে নাট্যঘরে কবির সামনে গানের পরীক্ষা দিতে গিয়ে গাইলেন ‘এবার উজাড় করে লও হে আমার’। আরও একটি গান গাওয়ার পরে আর একটি গান গাইতে বললে কিশোরী গায়িকা জানালেন, আর তো রবীন্দ্রসঙ্গীত জানা নেই। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে শেখা গানে কী নিখুঁত সুর! মুগ্ধ হলেন রবীন্দ্রনাথ।
শুরু হল গান শেখা। লাল পলাশ আর লাল মাটির দেশে এক নতুন যাত্রার সূচনা। সতীর্থদের মধ্যে ছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র প্রমুখ। গান শিখেছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, সুরসাগর প্রমুখের কাছে। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গান রেকর্ড করেছিলেন। অরুন্ধতী দেবী কখনও গেয়ে পারিশ্রমিক নিতে চাইতেন না, এমনকী আকাশবাণী দিলেও নয়। আসলে রবীন্দ্রনাথের গান ছিল তাঁর কাছে পবিত্র এক সাধনার বিষয়। গানের পাশাপাশি শান্তিনিকেতনে ছবি আঁকাও শুরু করেছিলেন। শান্তিনিকেতনের বাইরে বিশেষ বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন আকাশবাণীর জনপ্রিয় সংবাদপাঠিকা নীলিমা সান্যাল। কণ্ঠে গান ছিল, তবুও আবার এক নতুন ভূমিকায় তাঁকে দেখা গেল। এলেন চলচ্চিত্র জগতে। ১৯৫২ সালে নিউ থিয়েটার্স প্রযোজিত নতুন ছবির কথা ভাবেন পরিচালক কার্তিক চট্টোপাধ্যায়। ইচ্ছে এই ছবিতে নতুন অর্থাৎ নবাগত এবং নবাগতা কোনও নায়ক-নায়িকাকে নিয়ে ছবি করবেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে পাওয়া গেল এক নতুন জুটিকে। নেওয়া হল পরীক্ষা। পাশ করে ছবিতে অভিনয় করলেন বসন্তু চৌধুরী এবং অরুন্ধতী দেবী। প্রথম ছবিতেই পেলেন সাফল্য। বাংলা চলচ্চিত্র জগত পেল এক নতুন এবং অনন্যসাধারণ অভিনেত্রীকে, যাঁর মধ্যে রূপের সঙ্গে আভিজাত্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছিল। অরুন্ধতী দেবী অভিনীত ছবির তালিকা দীর্ঘ।

বৈচিত্র্যময় সব চরিত্রের মধ্যে বিচরণ করেছেন দীর্ঘ অভিনয় জীবনে। কখনও ঝিন্দের বন্দির রাণী কস্তুরি, কখনও জতুগৃহের মাধুরী আবার কখনও ভগিনী নিবেদিতা। প্রতিটা চরিত্রে তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল। ওঁর ছবির তালিকায় রয়েছে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘চলাচল’, ‘পঞ্চতপা’, ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’, ‘কালামাটি’, ‘হারমোনিয়াম’, ‘শশীবাবুর সংসার’, ‘ন্যায়দণ্ড’, ‘ছেলে কার’, ‘বিচারক’, ‘জন্মান্তর’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘কিছুক্ষণ’ ইত্যাদি। কথাসাহিত্যিক বনফুলের গল্প অবলম্বনে নির্মিত অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের কেরিয়ারের প্রথম ছবি হল ‘কিছুক্ষণ’। অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়ের কেরিয়ারে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি হল পরিচালক-অভিনেতা সুশীল মজুমদারের নির্মিত ‘পুষ্পধনু’। চলচ্চিত্র নির্মাতা তপন সিংহ বলেছিলেন, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ছবিতে অরুন্ধতীর নির্বাক অভিনয় সকল দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। ছবিতে ওঁর নীরবতার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে অসংখ্য সংলাপ।

‘জতুগৃহ’-তে উত্তমকুমারের বিপরীতে তাঁর অভিজাত্যপূর্ণ অভিনয়ের সঙ্গে মিশে ছিল রোম্যান্টিসিজম। একদম অন্য গোত্রের ছবি ‘ভগিনী নিবেদিতা’য় প্রকাশ পেয়েছিল সিস্টারের জীবনদর্শন আর কর্ম। সেই চরিত্রকে কী অনায়াসভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন অরুন্ধতী দেবী, যা ভাবলে অবাক লাগে। প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের ‘বিচারক’ ছবির শেষ অংশে তাঁর চরিত্রায়নে ফুটে উঠেছিল এক আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব। ‘শশীবাবুর সংসার’ ছবির পার্শ্বচরিত্রে তাঁর অভিনয়ের বলিষ্ঠতা এক মাত্রা যোগ করেছিল ছবির চিত্রনাট্যে। অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায় বা অরুন্ধতী সিংহ-র বৈচিত্র্যপূর্ণ সব চরিত্রের অভিনয়শৈলী নিয়ে আলোচনা যতই করব, ততই এই লেখার কলেবর বৃদ্ধি পাবে। তাই এবার আসা যাক ওঁর চলচ্চিত্র নির্মাণের কথায়।
শোনা যায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গান রেকর্ড করেছিলেন। অরুন্ধতী দেবী কখনও গেয়ে পারিশ্রমিক নিতে চাইতেন না, এমনকী আকাশবাণী দিলেও নয়। আসলে রবীন্দ্রনাথের গান ছিল তাঁর কাছে পবিত্র এক সাধনার বিষয়। গানের পাশাপাশি শান্তিনিকেতনে ছবি আঁকাও শুরু করেছিলেন।
কথাসাহিত্যিক বিমল করের ‘খড়কুটো’ উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৬৭ সালে অরুন্ধতী দেবী নির্মাণ করেন বিয়োগান্তক রোম্যান্টিক ছবি ‘ছুটি’। এই ছবির জন্য তিনি নির্বাচন করেছিলেন এক নতুন জুটিকে। মৃণাল মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিনী মালিয়ার অভিনয় মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী রণেন আয়ন দত্তর আঁকা ছবির পোস্টার আর ছবির একটি বিশেষ দৃশ্যে স্বপ্ন সম্পর্কিত কথোপকথনই জানিয়েছিল নায়ক-নায়িকার অদৃষ্ট। ছবিটি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার ছাড়াও পেয়েছিল একাধিক ‘বিএফজে’ পুরস্কারও। সেরা পরিচালকের পুরস্কারও জিতে নিয়েছিলেন অরুন্ধতী দেবী। ছবিটাও তো সুপার-ডুপার হিট হয়েছিল। পরের ছবি রবীন্দ্রনাথের ‘মেঘ ও রৌদ্র’।

এই ছবিটি তেমন জনপ্রিয়তা না পেলেও সেটি যে অত্যন্ত উচ্চমানের হয়েছিল, সে কথা অনায়াসেই বলা যায়। দুটি ছবিরই সংগীত পরিচালনা করেছিলেন অরুন্ধতী দেবী স্বয়ং। আরও পরে পরিচালনা করেন ছোটদের ছবি লীলা মজুমদারের কাহিনী অবলম্বনে ‘পদিপিসীর বর্মি বাক্স’। এই ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করেন ছায়াদেবী। দুঃখের বিষয় হল এই যে অমন সুন্দর একটা ছবির মূল প্রিন্টটি ঠিক থাকলেও সাউন্ড সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের দেশে চলচ্চিত্র সংরক্ষণের ভাল ব্যবস্থা আজও হল না। আর বাংলা ছবির ক্ষেত্রে তো ‘সংরক্ষণ’ শব্দটা ব্যবহার না করাই ভাল। অরুন্ধতী দেবীর চতুর্থ পরিচালিত ছবি ‘দীপার প্রেম’। এটি তেমনভাবে বক্স অফিস পায়নি।

অরুন্ধতী দেবীই সম্ভবত ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম মহিলা পরিচালক। প্রথম স্বামী চিত্রনির্মাতা প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিচ্ছেদের পরে তিনি নতুন জীবন শুরু করেন প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র নির্মাতা তপন সিংহর সঙ্গে। এই প্রসঙ্গে তপন সিংহ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, “বার্লিন শহরের এক পার্কে এক দীর্ঘ ও নির্জন সন্ধ্যায় অরুন্ধতী আর আমি বসেছিলাম। অরুন্ধতী গাইলেন, ‘পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে’।” রবীন্দ্রনাথের এই গানের পরের ইতিহাস অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায় হলেন অরুন্ধতী সিনহা। সঙ্গীত শিল্পী, অভিনেত্রী এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা অরুন্ধতী দেবীর কাজ নিয়ে কোনও মূল্যায়ন হবে কী না জানি না, তবে তাঁর গানের সংকলনের বিষয়টি ভেবে দেখলে ভাল হয়। অন্যদিকে বহুদিন ধরেই ‘ছুটি’ এবং ‘মেঘ ও রৌদ্র’ ছবি দুটি দূরদর্শন বা অন্য কোনও বৈদ্যুতিক চ্যানেলে দেখা যায় না। বাজারে ছবি দুটির কোনও ডিভিডি ও সিডি পাওয়া যায় না। ছবি দুটির প্রযোজক সংস্থা বিষয়টি ভেবে দেখে অরুন্ধতী দেবীর জন্মশতবর্ষে ছবিগুলি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করলে দর্শকরা উপকৃত হবেন।
ছবি সৌজন্য: লেখক
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।