Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

বালি যাত্রির ডায়রি (পর্ব ২)

অভিষেক খান

ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২০

Ulundanu Temple
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

তৃতীয় দিন প্রাতরাশ সেরেই বেরিয়ে পড়লাম নিওমানের সাথে। আজ অনেকটা পথ পেরিয়ে যাব বালির উত্তর ভাগে। ডেনপাসার শহর ছাড়িয়ে প্রথমে এসে হাজির হলাম এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। সুসজ্জিত প্রশস্ত মঞ্চ, সামনে শতাধিক দর্শক বসার গ্যালারি। এখানে দেখব ‘বারং’ নৃত্য, বালির অন্যতম প্রাচীন এক নৃত্যরীতি। বালিতে হিন্দু ধর্ম আসার অনেক আগে, এখানকার মানুষ বিশ্বাস করতেন অতীন্দ্রিয় শক্তিতে আর শক্তির আরাধনার জন্য বিভিন্ন পশুকে রূপক হিসেবে কল্পনা করে নিতেন। এমনই এক কাল্পনিক প্রাণী ছিল ‘বারং’, দেখতে ছিল সাদা কেশরে ঢাকা লালমুখো এক সিংহের মতো। শুভ আত্মা ‘বারং’-এর প্রধান শত্রু ছিল দুষ্ট আত্মা ‘রাংদা’। এই দুই শুভ-অশুভর লড়াই এর নৃত্যরূপ হল ‘বারং’। 

বারং  নৃত্যের একটা বৈশিষ্ট্য  হল এর আবহসংগীত। এই আবহসংগীতে ব্যবহৃত মূল বাদ্যযন্ত্রটি হল গ্যামেলান। বালির স্বতন্ত্র এই যন্ত্রটিকে বলা চলে অনেকগুলি বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে তৈরী একটি জটিল পার্কাশন যন্ত্র। এর যথার্থ বর্ণনাটি দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, “এর বাদ্যসংগীত আমাদের সঙ্গে ঠিক মেলে না। আমাদের দেশের জলতরঙ্গ বাজনা আমার কাছে সংগীতের ছেলেখেলা বলে ঠেকে। কিন্তু সেই জিনিসটিকে গম্ভীর, প্রশস্ত, সুনিপুণ বহুযন্ত্র মিশ্রিত বিচিত্র আকারে এদের বাদ্যসংগীতে যেন পাওয়া যায়। …ঘন্টার মতো শব্দে একটা মূল স্বরসমাবেশ কানে আসছে, তার সঙ্গে নানাপ্রকার যন্ত্রের নানারকম আওয়াজ যেন একটা কারুশিল্পে গাঁথা হয়ে উঠছে।” বালির বিভিন্ন  নৃত্যশৈলী নিয়েও রবীন্দ্রনাথের পর্যবেক্ষণটি শোনানোর লোভ সামলাতে পারলাম না, “এ দেশে উৎসবের প্রধান অঙ্গ নাচ। এখানকার নারকেলবন যেমন সমুদ্র-হাওয়ায় দুলছে তেমনি এখানকার সমস্ত দেশের মেয়ে পুরুষ নাচের হাওয়ায় আন্দোলিত। …এখানকার যাত্রা অভিনয় দেখেছি, তার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত চলাফেরায়, যুদ্ধে-বিগ্রহে, ভালোবাসার প্রকাশে, এমনকি ভাঁড়ামিতে, সমস্তটাই নাচ।”

এগিয়ে চললাম উবুদ প্রদেশের দিকে। বালির সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা চলে এই উবুদকে। অলিতে গলিতে ছড়িয়ে হস্তশিল্পের দোকান। কাঠের শিল্পসামগ্রী, পাথরের মূর্তি, রুপোর গয়না, আর্ট গ্যালারি, বাটিক প্রিন্টের কাপড় – কি নেই সেখানে। 

উবুদ ছাড়িয়ে খানিকটা যাবার পরে আমরা পৌঁছলাম ইন্দোনেশিয়ার বিখ্যাত লুওয়াক কফি ফার্মে। কুয়ালালামপুর থেকে বালি আসার বিমানের মধ্যে প্রথম চোখে পড়ে লুওয়াক কফির বিজ্ঞাপন।  সঙ্গে ছিল একটি সিভেট তথা ভামের ছবি। রহস্যটা তখন বুঝিনি। ফার্ম-এর তরুণী গাইডটির মুখে এর কাহিনী শুনে তাজ্জব হওয়ার পালা। এশিয়ান পাম সিভেট (স্থানীয় ভাষায় লুওয়াক) বাগানের গাছ থেকে কফির দানা খায় আর তারপর তার মলের সাথে অর্ধপাচিত সেই দানাগুলি বেরিয়ে আসে অবিকৃত অবস্থায়। সেই দানাগুলিকেই ফার্মে এনে যথোপযুক্ত পদ্ধতিতে তৈরি হয় এই কফি। দাম শুনলে অবশ্য কফি খাওয়া মাথায় উঠবে, কেজি প্রতি প্রায় ৮০০ ডলার!

কফি ফার্ম দেখে এগিয়ে পড়লাম বালির পাহাড়ি উপত্যকা বেদুগুল-এর উদ্দেশে। সাগর থেকে পাহাড়ের এই যাত্রাপথটি সবুজে সবুজ। অনুচ্চ পাহাড়গুলির গায়ে ধাপ চাষ, খেত-লাগোয়া কৃষক পরিবারের ছোট ছোট বাড়ি। মনোরম ঠান্ডা আবহাওয়া। ছোট্ট দ্বীপটি কত যে বৈচিত্র্যে ভরা। বেদুগুল উপত্যকার প্রধান আকর্ষণ উলুনদানু মন্দির। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত বিশাল হ্রদ বেরাটান, তারই তীরবর্তী মন্দির উলুনদানু। এখানে রয়েছে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর-এর নামাঙ্কিত তিনটি মন্দির। বিভিন্ন স্তরে নির্মিত চূড়াবিশিষ্ট মন্দিরগুলিকে বলা হয় মেরু। উলুনদানু শব্দটির অর্থ হলো ‘হ্রদের উপর’। হ্রদের মাঝে ছোট্ট একটি দ্বীপে রয়েছে ১১টি স্তর বিশিষ্ট বিষ্ণু মন্দির আর ৩টি স্তরের শিব মন্দির। বালির মন্দির প্রাঙ্গনগুলিতে আরেকটি স্থাপত্যের কথা উল্লেখ না করলেই নয়, সেটি হলো এক বা একাধিক দ্বিখণ্ডিত দরজা, স্থানীয় ভাষায় ‘কান্ডি বেন্টার’। পূরাণ মতে, পশুপতি শিব মহামেরু পর্বতকে দুভাগ করে দুই হাতে করে নিয়ে আসেন বালি দ্বীপে। ডান হাতের অংশটির নাম হয় আগুঙ পর্বত আর বাঁ হাতের অংশটি পরিচিত হয় বাটুর পর্বত নামে। এই দুই পর্বতই যেন দ্বিখণ্ডিত দরজার দুটি অংশ। সময়ের সাথে সাথে পরিশীলিত হয় এই ধারণা। এখন এই দুই অংশকে বলা হয় পুরুষ ও প্রকৃতি। আবার কেউ বলেন এ হলো ভালো আর মন্দের সহাবস্থানের রূপক। ভারতবর্ষ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরবর্তী এক দ্বীপে মন্দির নির্মাণের নেপথ্যের পুরাণের গল্প শুনতে রোমাঞ্চ লাগে বৈকি। 

ইতিহাস বলছে, সপ্তম শতাব্দীতে বালি দ্বীপে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যে আসতে শুরু করে; বীজ বপন হয় হিন্দু ধর্মের। ডালপালা মেলতে মেলতে সূচনা হয় হিন্দু রাজার শাসন ব্যবস্থার। মোটামুটি পনেরোশ শতক পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার জাভা ও বালি দুই দ্বীপেই ছিল হিন্দু আধিপত্য। এরপর মূল জাভা দ্বীপে শুরু হয় ইসলামীকরণ। পুরোহিত সম্প্রদায়, শিল্পী, বুদ্ধিজীবিরা ধর্মান্তর এড়াতে জাভা থেকে চলে আসতে থাকেন বালিতে। পাল্টাতে থাকে দ্বীপ রাষ্টের জনবিন্যাস। ইতিমধ্যেই অবশ্য শুরু হয়ে যায় ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের আনাগোনা, ক্রমশ যা রূপ নিতে থাকে উপনিবেশীকরণের। প্রায় সাড়ে তিনশো বছর ধরে ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, ফরাসি, ইংরেজ শাসন শেষে, ১৯৪৫ সালে স্বাধীন হয় ইন্দোনেশিয়া। জন্মলগ্ন থেকে ইসলামি দেশ হলেও, বালি দ্বীপটি কিন্তু বজায় রাখে তার হিন্দু ঐতিহ্য ও ধর্মাচরণ। আর সারা পৃথিবী আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে দেখে, কিভাবে রামায়ণ, মহাভারতের মতো হিন্দু মহাকাব্য একটি ইসলামি রাষ্ট্রের সংস্কৃতিতে, জীবনচর্যায় মিলেমিশে যায়। যে কটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হাজির ছিলাম, সর্বত্রই একই দৃশ্য – হিজাব পরা নারী তার ফেজটুপি পড়া সঙ্গীর সাথে বসে উপভোগ করছে হনুমানের লংকাকান্ড, বারং দেবতার তাণ্ডব নৃত্য। এক ধর্মনিরপেক্ষ দেশের প্রতিনিধি হয়েও মনে মনে কুর্নিশ জানালাম এ দেশের মুক্তমনা নাগরিকদের।  

Lembongan
লেম্বংগান দ্বীপ। ছবি তুলেছেন অভিষেক খান। 

আমাদের পাঁচদিনের সফরের শেষ দুটি দিন বরাদ্দ ছিল নিখাদ প্রকৃতিদর্শন আর অবসরযাপনের জন্য। বেছে নিয়েছিলাম বালি দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত থেকে ১১ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট দ্বীপ লেম্বংগান। নিওমানকে বিদায় জানিয়ে, যাত্রা শুরুর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই লঞ্চ এসে ভিড়ল সাদা বালির সৈকতঘেরা দ্বীপটিতে। এর পরের দুদিন ধরে কেবল সমুদ্র দর্শন আর হাতের থলি উপচে ওঠা ঝিনুক আর প্রবাল-খন্ড দেখে অবাক হওয়া।  গীতবিতান বলছে, জাভার সমুদ্রযাত্রাতেও কবি লিখছেন গান। সৈকতের অদূর দিয়ে ভেসে যায় ছোট-বড় নৌকো-জাহাজ। মনে গুনগুনিয়ে যায় সেই সুর, ‘সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায়, বিদেশী নায়ে’। দেশ, কালের গন্ডি ছাড়িয়ে থেকে যায় শুধু সুর, বুনতে থাকে এক অদৃশ্য অলৌকিক মায়াজাল।  

চার কিলোমিটার দীর্ঘ আর তিন কিলোমিটার প্রশস্ত লেম্বংগানের অর্ধেক উপকূল জুড়ে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। পরের দিন সে অরণ্য ঘুরে দেখার ব্যবস্থা হয়ে গেল। চার আসনের ছোট্ট স্পিডবোট, ক্যাপ্টেন ছেলেটির পেটানো চেহারা আর রসিক হৃদয়। স্নরকেলিং করাতে সমুদ্রে নিয়ে যেতে যেতে মুচকি হেসে বলল, “নো মানি, বাট মেনি হানি”, ভাবার্থ – পকেট গড়ের মাঠ, কিন্তু সে মাঠেও হাওয়া খেতে আসে সুন্দরীর দল! নাম জিজ্ঞেস করতে জানাল, ‘কেতুত’। এ অঞ্চলে নামকরণের পদ্ধতিটি বেশ মজাদার। বড় ভাই ‘গেদে’, মেজ ‘মাদে’, সেজ ‘নিওমান’ আর ছোট ‘কেতুত’; ‘ন-দা’, ‘রাঙাদা’, ‘ফুলদার’ মতোই – তফাত হচ্ছে এগুলো কিন্তু নাম, কোনো আদুরে ডাক নয়। ইচ্ছে ছিল দেখার, শহরের কোনো চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে ‘গেদে’ বলে হাঁক ছাড়লে ক-গন্ডা ‘গেদে’ এসে হাজির হয়। সাহসে কুলোয়নি!

দেখতে দেখতে ফেরার দিন এসে গেল। কটা দিনের ভ্রমণে এই ছোট্ট দ্বীপভূমি কত যে বৈচিত্র্যে পূর্ণ করে দিয়ে গেল অভিজ্ঞতার ভান্ডার। হাতে ধরে শিখিয়ে দিল সভ্যতার, অপার শান্তি আর সমন্বয়ের পাঠ। ভিন্ন ধর্মে, গ্রামে-শহরে, মানবে-প্রকৃতিতে – সর্বত্রই সমন্বয়ের অন্তর্লীন প্রবাহ। ঘরে ফিরে, প্রতি প্রত্যূষে যখন পূর্ব দিগন্তে নতুন ভোরের দিকে তাকাবো, চেতনায় ফিরে ফিরে আসবে, দিগন্তের ওপারে সূর্যের মতো আলোকময়, পটে আঁকা এক দেশ – বালি দ্বীপ।

তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী | মন তথ্য-ভারাক্রান্ত হলেই, ‘আপন হতে বাহির হয়ে’ বাইরে দাঁড়ানো | লৌকিক পৃথিবী, অলৌকিক প্রকৃতির সান্নিধ্যে পুনরাবিস্কার – দিনগত পাপক্ষয়, রাজনীতি আর যুদ্ধের বালখিল্যপনাটাই শেষ সত্য নয় | শেষমেশ ঘুরে ফিরে আসে তিনটি শব্দ –‘ভালোবাসা, পৃথিবী, ঈশ্বর’ |

Picture of অভিষেক খান

অভিষেক খান

তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী | মন তথ্য-ভারাক্রান্ত হলেই, ‘আপন হতে বাহির হয়ে’ বাইরে দাঁড়ানো | লৌকিক পৃথিবী, অলৌকিক প্রকৃতির সান্নিধ্যে পুনরাবিস্কার – দিনগত পাপক্ষয়, রাজনীতি আর যুদ্ধের বালখিল্যপনাটাই শেষ সত্য নয় | শেষমেশ ঘুরে ফিরে আসে তিনটি শব্দ –‘ভালোবাসা, পৃথিবী, ঈশ্বর’ |
Picture of অভিষেক খান

অভিষেক খান

তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী | মন তথ্য-ভারাক্রান্ত হলেই, ‘আপন হতে বাহির হয়ে’ বাইরে দাঁড়ানো | লৌকিক পৃথিবী, অলৌকিক প্রকৃতির সান্নিধ্যে পুনরাবিস্কার – দিনগত পাপক্ষয়, রাজনীতি আর যুদ্ধের বালখিল্যপনাটাই শেষ সত্য নয় | শেষমেশ ঘুরে ফিরে আসে তিনটি শব্দ –‘ভালোবাসা, পৃথিবী, ঈশ্বর’ |

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস