লন্ডনে তখন সবে লকডাউন শেষ হয়েছে। আর লকডাউন খতম হতেই মাসওয়েল হিলের সবকটা চুল কাটার দোকানে ভারচুয়াল লাইন; মাসখানেকের ওপর জমে ওঠা বাবুইবাসা চুলে ছাঁট না পড়লে শরীর হাঁসফাঁস করে – তাই মুখে মাস্ক, ধরাচূড়ো পরে অস্বস্তি নিয়েও নাপিতের ছুরি কাঁচির তলায় বসে পড়বার জন্যে নাম লেখাতেই হল।
উত্তর লন্ডনের এই হালকা পাহাড়ি, মনোরম সবুজ পাড়া দুরন্ত শীতে জবুথবু হয়ে আছে; ওক্সফ্যাম এর পুরনো বই এর গন্ধের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ডব্লু মার্টিনের প্রাচীন রোস্ট কফি মেশিনের শব্দ আর পাড়ার ফুলের দোকানের পাশে হাতে ‘বিগ ইস্যু’ নিয়ে বসে থাকা ভাবলেশহীন ক্ষুধার্ত মানুষ। হ্যাম্পস্টেড বুচারের কাচের শার্সির ওপারে ঝোলানো বিশাল মাংসের ঠ্যাং পেরিয়ে, এভরিম্যান সিনেমার পাশ ধরে হেঁটে আমার চুল কাটার সেলুনে পৌঁছলাম। একশো বছরেরও ওপর ধরে, ভয়ানক স্প্যানিশ ফ্লু এর সময় থেকে করোনার আতঙ্কের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ফোরটিস গ্রিন রাস্তার কোনে; যেন এক মূর্তিমান কেশ উৎসবের প্যান্ডেলের মতো, কেশর ফুলিয়ে ! – “New Country Barbers”
গ্রিক দেশ থেকে স্বপ্নসন্ধানে আসা জনের প্রপিতামহের ক্ষুর হাতে নিয়ে প্রপৌত্র ড্যানিয়েল তার সিস্টিন চ্যাপেলে যেন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন; সেই ট্রাডিশান সমানে চলছে। ঘচাংফু – চুল ঝরে যাচ্ছে, দাড়ি সজ্জিত হচ্ছে, শিরা – উপশিরায় আরক্ত হচ্ছে সম্পর্ক; কমা, সেমিকোলোনের মতো চেয়ারে ক্ষণস্থায়ী উপস্থিতিও ফুলে ফলে পল্লবিত হচ্ছে রোজ।
কাচের দরজা পেরিয়ে ঢুকলেই গত পাঁচবছর ধরে আলবেনিয়া থেকে আসা জনি এক বিরাট হাসির সঙ্গে আমন্ত্রণ জানায় – “হ্যাল্লো ডক্তর, হাউ আর ইউ?’, পাশ থেকে অশীতিপর বৃদ্ধ জন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করে – জানিনা কেন, হয়ত আমাদের দেশের প্রথার মতোই ডাক্তারদের সম্মান জানানোর অভ্যাসে। ওপাশ থেকে গ্রীক দেশীয় আর এক তরুণ নাপিত জর্জিওস চুল কাটতে কাটতে কাঁচি তুলে – “ডক্তর, ডক্তর” – “লকডাউন ওভার।“ আলোয়, উষ্ণতায় ভেসে মনে হল যেন কোনও আত্মীয়ের বাড়ি প্রবেশ করলাম। টুপি কোট খুলে, কোভিড জামাকাপড় পরে চেয়ারে বসতেই জনির প্রশ্ন – ইন্ডিয়াতে মা কেমন আছেন ডক্তর? কবে আবার দেশে যাচ্ছ?
হাসপাতালের কী খবর? আমার রোগীরা সব ঠিক তো? ভ্যাক্সিন নেব কি নেব না?
ঝটপট চুল কেটে বিদায় করে দেবার জন্যে যেন কোনও তাড়া নেই; দেনা-পাওনার বাজারী সম্পর্কের বাইরে এক সামাজিক বন্ধনের মতোই নিবিড়, চুল কাঁচির অন্তরঙ্গতা। চেয়ারে বসতে না বসতেই শরীর থেকে যেন অনেক ভার নেমে গেল। সামনের বড় বেলজিয়ান আয়নায় নার্সিসাসের মতো তেরিয়ে তেরিয়ে দেখতে ইচ্ছে হলনা। মাথা নিচু করে, পুরনো সেরামিকের সিঙ্কে নিজেকে সমর্পণ করে দিলাম, গভীর শান্তিময়তায়।

জনি গরম জলে হাত ডুবিয়ে, চুলে সুগন্ধী শ্যাম্পু লাগিয়ে বিলি করতে করতে কুশল প্রশ্ন আর কথা চালিয়ে যেতে থাকল – আর প্রতি মুহূর্তে আমার শরীর মনের পরতে পরতে জমে থাকা গুমোট অশান্তি, বছরভরা স্ট্রেস যেন মোমের মতো গলে পড়তে থাকল। চোখ বুঁজে আছি আরামে, দূর থেকে যেন ভেসে আসছে জনির টুক্রো টুক্রো কথা, হাসি – তার দেশের গল্প, গরম আলবেনিয়ান লিভারের গল্প, ওর পোলিশ বউ আর ছেলেমেয়েদের নার্সারি নিয়ে থাকার গল্প, ওদের ব্রিটিশ হয়ে বড় হয়ে ওঠবার গল্প… এর মধ্যে কোথায় যেন করোনার বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস আর প্রতিদিনের মৃত্যুর আশঙ্কা হঠাৎ হারিয়ে গেল!
ব্লো ড্রায়ারের শব্দে চোখ খুললাম, পরিপাটি ছাঁট – সামনে পিছনে সুনিপুণ কারিগরি। জনি চক্চকে চোখে প্রশ্ন করে – “What do you think, doctor?”
সবাইকে সম্ভাষণ জানিয়ে বেরিয়ে আসার সময় মনে হল – আমার সামনে যখন ভেঙে পড়া ছেলেমেয়েরা চিকিৎসার জন্যে আসেন, আমার ক্লিনিক ঘরে ঢুকে, তারাও কি এমনই আত্মীয়তা অনুভব করেন? তারাও কি আমার সামনে বসে এমনই উষ্ণতায় স্পর্শিত হন? জনির মতো আমিও কি তাদের মানবিক, আন্তরিক সম্ভাষণে আপন করে নিতে পারি? মনোবিদের ছুরি কাঁচি চালাবার আগে, তাদের কি আমিও এক বিশ্বাসের জমিতে একসাথে দাঁড় করাতে পারি? সেই সব মনোরোগী মানুষেরা কি আমার দরজা পেরিয়ে ঢুকতে ভীত হন? চেয়ারে বসতে স্বস্তিবোধ করেন? আমার ঘরে কি শুধুই ওষুধ আর থেরাপির ভিড়? নাকি জানালায় রোদ্দুরের মতো, হাসি আর আন্তরিক আলাপচারিতার বাতাস ছুঁয়ে থাকে আমার risk assessment আর mental state evaluation এর কাঁচি চালাবার শব্দের সঙ্গে? জনির হাতের স্পর্শে আমার শরীর মুহূর্তে শীতল হয়; আমি মনোবিদের পেশাগত দূরত্বে দাঁড়িয়ে কি আমার সামনের আশাহত মানুষদের ছুঁয়ে দেখতে ভুলে যাই?
একশো বছরের পুরনো দোকান থেকে বেরিয়ে এসে, আমার নাপিত, আমার শিক্ষক, আমার মনোবিদ জনিকে কুর্নিশ জানালাম।
*ছবি লেখকের সংগ্রহ থেকে
ডঃ অমিতরঞ্জন বিশ্বাসের জন্ম, বেড়ে ওঠা কলকাতায়। ১৯৯৭ সাল থেকে লন্ডনের বাসিন্দা। পেশায় চাইল্ড নিউরো সায়কায়াট্রিস্ট এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। কিন্তু প্রবাসযাপন বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি শেকড়ের টান। ছেলেবেলা থেকেই নিয়মিত বাংলা নাটক, নাচ, সিনেমা, সাহিত্যের সঙ্গে বসবাস। হোমাপাখি নাটকের রচয়িতা যার মঞ্চায়ন করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্বয়ং। সৌমিত্রর সঙ্গে তৈরি করেছেন 'ব্রিজ' নামে চলচ্চিত্র যা একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত। প্রকাশিত হয়েছে দুটি কবিতার বই।
9 Responses
Osadharon laaglo Amit da .. Bangalaay na likhe paarlaam na…. Ekta odhbhut ushnota onubhob korlaam ….
It made me stand face to face with myself
মন ছুঁয়ে গেল। মুগ্ধতা। 🙏
পড়তে পড়তে emotional হয়ে গেলাম।কতো সুন্দর লিখেছ। Human relations has been established greatly. অনেক শুভেচ্ছা
অসাধারণ লাগল,খুব সুন্দর লাগল লেখাটা। পরিস্কার ছবির মত দেখতে পেলাম সব কিছু যেন।
আপনিও জনির মতোই আন্তরিক, মানবিক ও উষ্ণ । আপনার কাছে চিকিৎসার জন্য আসা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সুস্থ হয়ে ওঠার পথে বা সুস্থ হয়ে উঠে আপনার জন্য তাদের মনোভাব ও অনুভূতি যেভাবে এঁকে ও লিখে প্রকাশ করেন, তাতেই বোঝা যায় একথা ।
মানুষের কথা জানতে সবসময়ই ভালো লাগে । মাসওয়েল পাড়ার New CountryBarbers এর আলবেনীয় মালিক তরুণ নাপিত জনি, তার সহকর্মী গ্রিক তরুণ নাপিত জর্জিওস এর আন্তারিকতার কথা জেনে ভালো লাগল । তাদের জন্য ভারত থেকে উষ্ণ ভালোবাসা পাঠালাম । আপনার জন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ।
অনবদ্য… পড়তে পড়তে পুরো ছবি চোখের সামনে যেন ভেসে উঠলো… মুগ্ধতা র রেশ রয়ে গেল… শ্রদ্ধা ও প্রণাম আপনাকে…
নরসুন্দরদের একটা ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে, যেটা বোধহয় পৃথিবীর সব প্রান্তেই এমন ভাবে অনুভব করা যায়। তাদের ব্যবহারের আন্তরিকতায় আর মাথায় হাত ছোঁয়ানোর জাদুতে ঘুম এসে যায়। নিশ্চিন্ত ভারমুক্ত ঘুম।
Osomvob akta sundor lekha porlam… Stti ki Amra ato ta sosti dite pari amader samner Manus k?? Jani na… Tobe lekha ta pore amon prosno korar jayga ta toiri holo… Khub Valo thakben…susto thakben…