(Bhaiphota)
তোমার এখন বয়েস হয়েছে, এক জায়গায় বসে থাকবে, অমন ছুটে ছুটে আর পাহাড়ে যাবে না কখনও। বুঝলে?
আশি বছরের ভাইকে ফোঁটা দিতে এসে বকুনি দিচ্ছেন চার বছরের বড় দিদি। ভাইটিও গোপাল বালক নয়, ওই বয়সে রোগশয্যায় শুয়েও তাঁর উত্তর, না, কক্ষনও আর ছুটে ছুটে যাব না; বসে বসে যাব এবার থেকে। (Bhaiphota)
আরও পড়ুন: রক্তকরবী: বইয়ের শতবর্ষ, নাটকের নয়
তার পরে দিদি যত বলেন ছুটে ছুটে পাহাড়ে না-যাওয়ার কথা, ভাই তত বলেন বসে বসে যাওয়ার কথা।
ভাই রবীন্দ্রনাথ, দিদি তাঁর ছোড়দিদি বর্ণকুমারী দেবী।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর আগের বছরও সেই ছোড়দিদি এসেছেন ফোঁটা দিতে। এসে তাঁর মনে হয়েছে ভাইয়ের এমন অসুখ, ওই বয়সেও কালিম্পং গিয়ে। তাই ওই বকুনি। (Bhaiphota)
তবু, যমের দুয়ারে কাঁটা পড়েনি। পরের বছর, ১৯৪১-এ ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। সেই শোক বয়ে বেড়াতে হয়েছে বর্ণকুমারীকে, ১৯৪৩-এ মৃত্যু পর্যন্ত। (Bhaiphota)
“লেখালেখি বা পত্রিকা-সম্পাদনা কোনওটাই করেননি বর্ণকুমারী। সংসারটাই করেছেন একমনে। রাঁধতে পারতেন চমৎকার, সেলাই করতে পারতেন, গানও জানতেন।”
স্মৃতির পটে জীবনের যে-সব ছবি আঁকা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের, তার মধ্যে ছিলেন বর্ণকুমারীও। ছিলেন এক সুখী বালিকার মতো, স্কুলে যাঁকে যেতে হত না। জীবন-স্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন নিজের সেই দুঃখের কথা,
ছোড়দিদি আমাদের সঙ্গে সেই একই নীলকমল পণ্ডিতের কাছে পড়িতেন। কিন্তু পড়া করিলেও তাঁহার সম্বন্ধে যে বিধান, না করিলেও সেইরূপ। দশটার সময় আমরা তাড়াতাড়ি খাইয়া ইশকুল যাইবার জন্য ভালোমানুষের মতো প্রস্তুত হইতাম— তিনি বেণী দোলাইয়া দিব্য নিশ্চিন্তমনে বাড়ির ভিতরদিকে চলিয়া যাইতেন। দেখিয়া মনটা বিকল হইয়া যাইত। (Bhaiphota)

বড় মেয়ে সৌদামিনীর পরে আর কোনও মেয়েকেই দেবেন্দ্রনাথ স্কুলে পাঠাননি। সিপাহী বিদ্রোহের বছরে জন্ম দেবেন্দ্রনাথের এই সবচেয়ে ছোট মেয়েটির। দেবেন্দ্রনাথ তখন পশ্চিম-প্রবাসী। বর্ণকুমারীর বিয়ে হয়েছিল কবি রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ছোট ভাই, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে, রবীন্দ্রনাথের তখন আট বছর বয়স, বর্ণকুমারীর বারো। বিয়ের তারিখ ৩ নভেম্বর ১৮৬৯। বিয়ের সবিস্তার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল সে কালের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়। (Bhaiphota)
লেখালেখি বা পত্রিকা-সম্পাদনা কোনওটাই করেননি বর্ণকুমারী। সংসারটাই করেছেন একমনে। রাঁধতে পারতেন চমৎকার, সেলাই করতে পারতেন, গানও জানতেন। উপাসনা সমাপ্ত করে দেবেন্দ্রনাথের লেখা ব্রহ্মসংগীত গাইতে ভালবাসতেন। (Bhaiphota)
আরও পড়ুন: উত্তমকুমারের প্রথম অভিনয়
আর পারতেন অভিনয় করতে। কবির বৌঠান কাদম্বরী দেবী যখন বিয়ে হয়ে প্রথম এলেন ঠাকুরবাড়িতে তখন সেই রহস্যময় বউঠানের কাছে যেতে পারেন না রবীন্দ্রনাথ এই ছোড়দি বর্ণকুমারীরই তাড়ায়। সেই কাদম্বরীই ঠাকুরবাড়ির উঠোনে অভিনয় করলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাটক ‘এমন কর্ম আর করব না’। পরে তারই নাম হয় অলীকবাবু। প্রথম ইউরোপ যাত্রার আগে রবীন্দ্রনাথ সে-নাটকে নায়কের ভূমিকায় নামেন। কাদম্বরীরও সেটাই প্রথম অভিনয়। আর সে নাটকেই পিসনি বা প্রসন্নদাসীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বর্ণকুমারী। (Bhaiphota)
ইন্দিরা দেবী তাঁর ‘সংগীতস্মৃতি’ প্রবন্ধে লিখছেন, ‘কী স্বাভাবিক অভিনয় করতেন বর্ণপিসিমা। এখন মনে পড়ে, প্রথম দৃশ্যে তিনি দাসীদের মতো মাটিতে বসে হাঁটু তুলে হাতের উপর মাথা রেখে সকালবেলা বসে আছেন আর বাইরে থেকে গদাধর দরজা ঠেলতেই মাথা তুলে বলে উঠলেন, “দরজা ঠেলে কে ও? ওমা, গদাধরবাবু যে। বড়োমানুষের মোসাহেব, দশটা বাজতে না বাজতেই ঘুম ভাঙল?” (Bhaiphota)
তার পরেও ঠাকুরবাড়ির বহু নাটকে তিনি ছিলেন উপদেশক।
“সেদিন দিদির সঙ্গে তাঁর এই কথা রোগশয্যায় যেন উৎসবের আমেজ এনে দিল। গুরুদেব বললেন, দেখি, তোমার পা-দুটি তুলে ধরো উপরে, নয়তো প্রণাম করব কি করে?”
সেসব স্মৃতিই হয়তো ছিল সেই শেষ ভাইফোঁটার দিনে। সে দিনের ভারি সজল একটা ছবি এঁকেছেন রাণী চন্দ, গুরুদেব বইয়ে,কয়দিন খুবই আশঙ্কায় কাটল। ধীরে ধীরে ভালোর দিকে মোড় ঘুরতে লাগল। গুরুদেব সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন। তখনো তাঁকে বিছানায় উঠিয়ে বসাবার অবস্থা আসেনি। ভ্রাতৃদ্বিতীয়া এল। গুরুদেবের এক দিদিই জীবিত তখন—বর্ণকুমারী দেবী। তিনি এলেন ভাইকে ফোঁটা দিতে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। গৌরবরন একখানি শীর্ণহাতের শীর্ণতর আঙুলে চন্দন নিয়ে গুরুদেবের কপালে কাঁপতে কাঁপতে ফোঁটা কেটে দিলেন। দুজন দুপাশ হতে ধরে রেখেছি বর্ণকুমারী দেবীকে। ফোঁটা কেটে তিনি বসলেন বিছানার পাশে চেয়ারে। ভাইয়ের বুকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। খুব রাগ হয়েছে দিদির ভাইয়ের উপরে। কালিম্পঙে গিয়েই তো ভাই অসুস্থ হয়ে এলেন, নয়তো হতেন না- এই ভাব দিদির। (Bhaiphota)

ভাইকে বকলেন, বললেন, দেখো রবি, তোমার এখন বয়েস হয়েছে, এক জায়গায় বসে থাকবে, অমন ছুটে ছুটে আর পাহাড়ে যাবে না কখনো। বুঝলে? গুরুদেব আমাদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন, বললেন, না, কক্ষনো আর ছুটে ছুটে যাব না; বসে বসে যাব এবার থেকে। সকলের খিলখিল হাসিতে ঘর ভরে উঠল। দিদি যত বলতে লাগলেন, না রবি, যা বলছি শোনো, ছুটে ছুটে আর কোথাও যাবে না তুমি। গুরুদেব ততই বলছেন, না, বসে বসেই যাব। (Bhaiphota)
আরও পড়ুন: নতুন চর্চায় গোবিন্দরামের ব্ল্যাক প্যাগোডা
সেদিন দিদির সঙ্গে তাঁর এই কথা রোগশয্যায় যেন উৎসবের আমেজ এনে দিল। গুরুদেব বললেন, দেখি, তোমার পা-দুটি তুলে ধরো উপরে, নয়তো প্রণাম করব কি করে? দিদি বললেন, থাক, এমনিতেই হবে, তোমাকে আর পেন্নাম করতে হবে না কষ্ট করে। ব’লে ভাইকে আরো আরো আদর করে আরো বুঝিয়ে দুপাশে দুজনের হাতে হাতের ভর রেখে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে গেলেন। (Bhaiphota)
ভাইফোঁটার করুণ রঙিন এই ছবিটি আজও অমলিন হয়ে আছে রবীন্দ্রস্মৃতিসমগ্রে।
ডিজিটাল ও মুদ্রিত মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
আশিস পাঠক বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের প্রকাশনা ও বিপণন আধিকারিক।
আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতার পাশাপাশি নানা সময়ে যুক্ত থেকেছেন সাহিত্য অকাদেমি, বাংলা আকাদেমি, কেন্দ্রীয় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা বিভাগের নানা প্রকল্পে, নানা পুরস্কারের বিচারক হিসেবে। সংস্কৃতির নানা মহলে তাঁর আগ্রহ, বিশেষ আগ্রহ রবীন্দ্রনাথ ও গ্রন্থবিদ্যায়।