(Mahalaya)
সত্তরের দশকের শৈশবে, ফিলিপস রেডিওতে বাজছে, “মহালয়া“। মা একরকম ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলে দিয়েছে। ভোর চারটে। (Mahalaya)
শরতের ভোরের কলকাতায় তখনও চাদর গায়ে দিতে হত। অনেকটা শুনে, প্রায় ঘুমিয়ে গেছি। আধোঘুমে-জাগরণে শুনতে পাচ্ছি মহিষাসুরকে বধ করছেন দেবী। অপার্থিব কণ্ঠে, সংস্কৃতে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্বর তখন সপ্তম ছাড়িয়ে গেছে। (Mahalaya)
“গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় মধু যাবৎ পিবাম্যহম্।
ময়া ত্বয়ি হতেঽত্রৈব গর্জিষ্যন্ত্যাশু দেবতাঃ।।” (Mahalaya)
তার পরের মুহূর্তে, কণ্ঠ অনেক নীচে, দীর্ঘদিনের অনুশীলনে একেবারে রপ্ত, সুর করে বাংলায় বলে চলেছেন:
“দেবতাগণ সানন্দে দেখলেন, দুর্গা মহিষাসুরকে শূলে বিদ্ধ করেছেন আর খড়্গনিপাতে দৈত্যের মস্তক ভূলুণ্ঠিত।” (Mahalaya)

সংস্কৃতির অচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে নয় দশক পরে, সেই ধ্বনি আজও অনুরণিত হয়ে চলে কোটি শ্রোতার শ্রবণে, “আশ্বিনের শারদ প্রাতে”। এ যেন, “Nostalgia in reverse”। এক স্বর, এক কণ্ঠ, এক রেন্ডিশন চাই। পৌত্তলিক কামনার মতো। নেশার মতো। পুজোর বার্তা এসে পৌঁছয় ঘরে, বাইরে।
সত্তরের শেষের এক সময়, মহানায়ককে দিয়ে প্রোগ্রাম সঞ্চালন করা হয়। না, শ্রোতারা গ্রহণ করেননি সে অনুষ্ঠানকে। (Mahalaya)
এখনও মহালয়ার দিন, ঠিক সকালে ঘুম ভেঙে যায়। বালিশের পাশে মোবাইলটা টেনে নিই। ইন্টারনেটে খুঁজে চালিয়ে দেওয়া হয়, “বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ”। শুধু ওঁর অংশটুকুই। তথ্য প্রযুক্তি আমাদের অধিকার দিয়েছে যতটুকু ইচ্ছে ততটুকু শোনার। ছোটবেলায় যে মাঝের গানগুলো ভাল লাগত তা নয়, কিন্তু অপেক্ষা করতাম গানের পর সেই বলিষ্ঠ কণ্ঠের। সেযুগের বিখ্যাত সব গায়কেরা গান করতেন। তবুও সেই কণ্ঠস্বর, সেই সংস্কৃত উচ্চারণ, সেই আকুতি, সেখানে ম্লান হয়ে যায় শিল্পীদের গান। (Mahalaya)
“প্রোগ্রাম শুরু হয় সেই তিরিশের দশকে, লাইভ। এখন ইন্টারনেটে পাওয়া যায় দুটো অনুষ্ঠানের রেকর্ড। ১৯৭৩ আর ১৯৬৬ র ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’।”
শুনে শুনে খানিকটা মুখস্ত হয়ে গেল। কিন্তু শক্ত সংস্কৃত শব্দে বাঙালি জিভ আটকে যেত। মানে বোঝা যায় না। ওই যেখানে এসে শুরু হয়, “ইয়া দেবী, সর্বভূতেষু”, সে জায়গাটা ছোটো থেকে কণ্ঠস্থ হয়ে যায়। মানে বোঝা যায়। ইস্কুলে তখন অঙ্কের মাষ্টারমশাই যারাই ক্লাস নিতেন, প্রায় চিৎকার করে পড়াতেন। হয়তো সেইজন্যই, যা পড়াতেন তার কিছু ভগ্নাংশ, ছাত্রদের মাথায় প্রবেশ করত। বীরেন বাবুর কণ্ঠের প্রভাব কয়েক জেনারেশনের বাঙালিদের ছোটবেলা থেকে মাথায় প্রবেশ করে যায়, এবং এখনও তার প্রভাব কমেনি। (Mahalaya)
প্রোগ্রাম শুরু হয় সেই তিরিশের দশকে, লাইভ। এখন ইন্টারনেটে পাওয়া যায় দুটো অনুষ্ঠানের রেকর্ড। ১৯৭৩ আর ১৯৬৬ র ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’।
বহুপ্রচলিত ১৯৭৩ ভার্সন শুরু হচ্ছে শঙ্খধ্বনি দিয়ে, যার পর “যা চণ্ডী…”, সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হয়।
অন্যদিকে ১৯৬৬ ভার্সনের শুরুতে শঙ্খধ্বনির পর “যা চণ্ডী…”, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র একক আবৃত্তি করেছেন। আমার অবশ্য সে ভার্সন শোনা হয়নি। (Mahalaya)

বাংলা, সংস্কৃতর এক অদ্ভুত যুগলবন্দী। অসাধারণ এক বাচনভঙ্গি। আবেগ মথিত। গলা কখনও উঠছে, কখনও নামছে। প্রথম যখন “জাগো মা” বলেন, তখন গলায় ক্রন্দন পুঞ্জিভূত। বাংলায় বলে আকুতি। আকুতির বোধহয় বিদেশী ভাষায় কোনও সমার্থক শব্দ নেই। (Mahalaya)
“একমাত্র একটি কণ্ঠস্বর আজও দেশ, কাল, সময় পার করে ধ্বনিত হয়। বীরেন ভদ্রের জন্য একটি নমস্কার রইল।”
চণ্ডীপাঠের উচ্চারণ “যা দেবী সর্বভূতেষু”, যখন হিন্দি ভাষীদের কণ্ঠে শ্রবণ করি, তখন দেখি আবেগবর্জিত এক রেন্ডিশন। চণ্ডীপাঠ বা বেদপাঠ বিশুদ্ধ মন্ত্র। সেখানে আবেগ থাকতে পারে না। গ্রামাটিক্যাল শুদ্ধ এক রেন্ডিশন। বিশুদ্ধ, জ্ঞান গম্ভীর। বীরেনবাবুর শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণ একেবারে আবেগ মথিত। সঙ্গীতের ব্যাকরণ মেনে নয়। তাঁর নিজস্ব স্টাইল। (Mahalaya)
শ্রীচৈতন্যদেব জ্ঞানচেতনার সঙ্গে ভক্তি চেতনাকে যুক্ত করেন। বাঙালি সেই ভক্তিবাদকে সাগ্রহে গ্রহণ করে। সেখানে পূজা, প্রেম, ভক্তি সব এক হয়ে যায়, চেতনায় এবং অবচেতনায়। তাই বীরেন ভদ্রের কণ্ঠে যখন ক্রন্দন ঝরে পড়ে, তখন বাঙালিকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দেয়। (Mahalaya)

‘Birendra Krishna Bhadra and Mahila Majlish in the early Calcutta Radio Station, 1929- 1938’, historian Indira Biswas recounts how the orthodox section of the society disapproved of a non Brahmin (Kayastha) Bhadra reciting the Chandipath. To pacify these detractors, Bhadra issued a statement, “Ami path kori na, ami pujo kori (I don’t recite, I worship).”’ (Mahalaya)
এ যেন ভগবতের সমর্থারতির আত্মনিবেদন। চৈতন্যদেবের সমর্পণ। সেখানে পূজার অধিকার সবার।
সেই তিরিশের দশক থেকে সারা বিশ্বে রেডিওতে, চলচ্চিত্রে, গ্রামোফোন রেকর্ডে অনেক অনেক কণ্ঠ ধ্বনিত হয়েছে। একমাত্র একটি কণ্ঠস্বর আজও দেশ, কাল, সময় পার করে ধ্বনিত হয়। বীরেন ভদ্রের জন্য একটি নমস্কার রইল। (Mahalaya)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। কাজের ক্ষেত্র তথ্যপ্রযুক্তি। কিছুদিন স্মার্ট সিটিতে কাজ করেছেন। আড্ডাবাজ মানুষ। বইপড়া আর সিনেমা দেখা নেশা। কাজের সুত্রে সলিউশন ব্লুপ্রিন্ট, স্পেক্স, প্রপোজাল ইত্যাদি অনেক লিখেছেন। ইদানিং বাংলায় প্রবন্ধ, গল্প, ফিল্ম রিভিউ লেখার একটা চেষ্টা চলছে।