মৃত্যুঞ্জয়: আপনি?
সৌবীর: আমি সৌবীর – সৌবীর মিত্র। আমার বাবা সুশান্ত মিত্র –
মানসী: ও হ্যাঁ হ্যাঁ! আসুন আসুন ভেতরে আসুন।
(সৌবীর মানসী কে প্রণাম করে)
সৌবীর: আমাকে আপনি বলবেন না মাসিমা।
মানসী: আহা থাক থাক।
(সৌবীর মৃত্যুঞ্জয়কেও প্রণাম করে)
মৃত্যুঞ্জয়: ঠিক আছে। ঠিক আছে। বাকিরা কোথায়?
সৌবীর: বাকিরা? ওহ না না, আর কেউ নেই। আমি একাই এসেছি। কেন, কোনও অসুবিধে করলাম?
মানসী: না না, অসুবিধে করবে কেন? আসলে, আমরা ভাবছিলাম বোধহয় বিকেলে –
সৌবীর: হ্যাঁ বিকেলেই আসার কথা ছিল। কিন্তু সকালে হাতে খানিকটা ফাঁকা সময় পেয়ে গেলাম, তাই চলে এলাম। (শ্যামলীকে লক্ষ্য করে) আপনি নিশ্চয়ই শ্যামলী? নমস্কার।
(শ্যামলী নমস্কার করে)
সুজয়: আমি তাহলে আসি মেসোমশাই।
মৃত্যুঞ্জয়: না না, তুমি যাবে কেন? বসো। সৌবীর তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। এ হল সুজয়। এই পাড়াতেই থাকে। আমাদের বাড়ির ছেলেই বলতে পার।
সৌবীর: নমস্কার। পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে এই হার্দিক সম্পর্ক, আত্মীয়ের মতো ঘনিষ্ঠতা, এই ব্যাপারটা খুব মিস করি। ছোটবেলায় আমি প্রায় সারাটা দিন আমার পাশের বাড়ির দাস জেঠিমার বাড়িতেই কাটাতাম। কোনওদিন মনে করিনি ওটা আমার বাড়ি নয়, ওদের সঙ্গে আমার কোনও রক্তের সম্পর্ক নেই।
মানসী: তুমি বসো সৌবীর। আমি তোমাদের জন্য চা করে আনি। তুমি চা খাবে তো?
সৌবীর: হ্যাঁ নিশ্চয়ই খাব। লাল চা – দুধ চিনি ছাড়া। তবে সঙ্গে আর কিছু আনবেন না কিন্তু মাসিমা। সকালে মা প্রচুর জলখাবার খাইয়ে দিয়েছে। পেটে একদম জায়গা নেই।
মানসী: ঠিক আছে। তুমি বস, আমি আসছি।
(মানসী বেরিয়ে যায়)
সৌবীর (শ্যামলীকে): আপনি বসুন। আপনি তো কোনও কথাই বলছেন না।
শ্যামলী: আপনি আগে বলে নিন। আমি পরে বলব।
সৌবীর (হো হো করে হেসে ওঠে): আমি কথা বলতে থাকলে আপনি কিন্তু কথা বলার কোনও সুযোগই পাবেন না। আমার ওই একটা বদভ্যাস – কথা বলা। বলতে শুরু করলে অনর্গল বলে যাব, থামব না।
মৃত্যুঞ্জয়: বেশ তো বল না। তোমার কথা শুনতে আমাদের বেশ লাগছে। আমি ভাবিনি তুমি এত ঝরঝরে বাংলা বলতে পারবে।
সৌবীর: বাংলা কেন বলতে পারব না? বাংলার মতো ভাষা কটা আছে বলুন? ওটা কোনওদিন ভুলতে পারব? বাংলা সাহিত্য, বাংলা কবিতা – এসব তো আমাদের রক্তে বইছে। চাইলেও ভুলতে পারব না।
মৃত্যুঞ্জয়: বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর
সৌবীর:
অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে ব‘সে আছে
ভোরের দোয়েল পাখি– চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ
জাম–বট–কাঁঠালের–হিজলের–অশ্বত্থের ক‘রে আছে চুপ;
ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে;
মৃত্যুঞ্জয়: বাঃ অপূর্ব! তুমি কবিতা চর্চা কর?
সৌবীর: ওই আমার একটা নেশা – কবিতা পড়া। দেশে এলেই আমি যত পারি কবিতার বই কিনে নিয়ে যাই। ওদেশে অবসরে কবিতাই আমার একমাত্র সঙ্গী।
মৃত্যুঞ্জয়: তাহলে তুমি নিশ্চয়ই কবিতাও লেখো? কি ঠিক বলেছি কিনা?
সৌবীর: এক কালে লিখতাম। তারপর বিদেশে গেলাম – প্রথমে পড়াশোনার চাপ, তারপর ব্যবসায় চব্বিশ ঘণ্টা ব্যস্ততা। কবিতা সব কেমন কর্পূরের মতো কোথায় উপে গেল। (থেমে) তবে জীবনানন্দ কিন্তু ঠিক কথা বলেননি মেসোমশাই।
মৃত্যুঞ্জয়: কোন কথা?
সৌবীর: বাংলা সুন্দর, কিন্তু পৃথিবীর রূপও কিন্তু অসাধারণ। জীবনানন্দ ওই রূপ দেখলে হয়ত এই কবিতা আর লিখতেন না। নাসায় আমার এক সহকর্মী বন্ধু আছেন – মহাকাশচারী – ইংরেজিতে যাদের বলা হয় এস্ট্রোনট। ও আমাকে বলেছিল, সৌবীর, স্পেস শাটল এর জানালা দিয়ে যখন পৃথিবীকে প্রথম দেখলাম, আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এত সুন্দর আমাদের পৃথিবী? ওই অপূর্ব নীল গোলক আমাদের – হোম? হোম শব্দটার বোধহয় কোনও সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ হয়না, তাইনা? ঘর, বাসস্থান, এগুলো ঠিক হোমের প্রতিশব্দ নয়। জন আমাকে বলেছিল, ওই দৃশ্য আমাকে চিরদিনের মতো পাল্টে দিয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি, আমার দেশ কেবল আমার হোম নয়, এই পৃথিবীই আমার হোম। ওই রূপ দেখলে জীবনানন্দ হয়ত লিখতেন, পৃথিবীর মুখ আমি দেখিয়াছি, বাংলার রূপে মজিয়া রব না আর।
শ্যামলী: আপনি নাসায় কাজ করেন?
সৌবীর: না নাসায় ঠিক নয়। আমার কোম্পানি নাসার কনট্রাক্টর। ওদের কিছু কাজ আমরা করি।
শ্যামলী: আপনি আমাকে মঙ্গল গ্রহে যাবার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?
সৌবীর: মঙ্গল গ্রহে? কেন?
সুজয়: সেকি? আপনি জানেন না? আর মাত্র দশ দিন, তারপরই তো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
(সৌবীর হো হো করে হেসে ওঠে)
সুজয়: আপনি হাসছেন? আপনাদের দেশের বিজ্ঞানীরাই বলছে – পৃথিবীর ধ্বংস একেবারে নিশ্চিত।
সৌবীর: আমি বোধহয় শুনেছি গুজবটা। তবে এগুলি নিতান্তই গুজব। প্রতিবছরই কেউ না কেউ এই রকম উদ্ভট দাবি করে।
সুজয়: আপনি বলছেন এসব মিথ্যে? নাসা বাছা বাছা কিছু মানুষকে মঙ্গলে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে না? রাশিয়া করছে না? ইউরোপ করছে না?
সৌবীর: না। মঙ্গলে মানুষ পাঠনোর মতো পরিকাঠামো বা প্রযুক্তি, কিছুই তৈরি হয়নি। হয়ত হবে, কোনও একদিন, অদূর ভবিষ্যতে।
মৃত্যুঞ্জয়: কি? বলেছিলাম কিনা?
শ্যামলী: যাহ্! সুজয়দা, তাহলে কি হবে?
সুজয়: আমি বিশ্বাস করিনা। পৃথিবী ধ্বংস হবেই – আপনি লিখে রাখুন। শ্যামলী, দশ দিন বাদে যদি তুই আমি বেঁচে থাকি, তাহলে আমার নামে কুকুর পুষিস।
সৌবীর: আপনি ঠিকই বলেছেন। পৃথিবী ধ্বংস হবেই। এবং আমরাই পৃথিবীকে ধ্বংস করব। তবে ব্যাপারটা হয়ত দশ দিনে হবে না, হয়ত দশ হাজার বা দশ লক্ষ বছর লাগবে। যদি না আমরা কোনও প্রতিকারের ব্যবস্থা করি।
সুজয়: দেখুন মশাই, অত বড় বড় চিন্তা আমরা করতে পারি না। ওই একটা গান আছে না, আঃ বল না শ্যামলী – হেমন্ত মুখার্জির – ওই সিংহ দুয়ার –
শ্যামলী (গেয়ে ওঠে): খিড়কি থেকে সিংহ দুয়ার, এই আমাদের পৃথিবী।
সুজয়: ঠিক ঠিক! এই আমাদের পৃথিবী। ওটা ধ্বংস হয়ে গেলেই আমাদের পৃথিবী ধ্বংস।
শ্যামলী: এতক্ষণে একটা ঠিক কথা বলেছ সুজয়দা। এই আমাদের পৃথিবী। এর বাইরে সব কিছুই মহাশূন্য –
সৌবীর:: তাহলে কিন্তু আমি আপনাকে মঙ্গল গ্রহে নিয়ে যেতে পারি শ্যামলী। আপনি যদি আমার সঙ্গী হন।
(শ্যামলী চুপ করে থাকে)
সুজয়: বেশ, তাই যা শ্যামলী। আমি চলি – বাড়িতে মা দুশ্চিন্তা করছে।
শ্যামলী: দাঁড়াও সুজয়দা। আমি দুঃখিত সৌবীর। আমার এই পৃথিবী ছেড়ে মঙ্গলে আমি যেতে পারব না। এই পৃথিবীটাই যে আমার হোম। আর এই হোমে আমার সঙ্গী – এই পাগলটা।
(শ্যামলী সুজয়ের হাত ধরে)
সৌবীর: বেশ। আমি আপনার পৃথিবী থেকে আপনাকে দূরে সরিয়ে রাখব না। আপনারা আপনাদের পৃথিবী গড়ে তুলুন – ভালবাসায় আনন্দে! তবে মনে রাখবেন, দূরে মঙ্গলগ্রহে আপনার এক বন্ধু রয়েছে – যে রোজ তার জানলা দিয়ে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার ফেলে আসা পৃথিবীটার দিকে – তার হোমের দিকে। আপনারা সবাই ভাল থাকবেন। নমস্কার।
(সৌবীর বেরিয়ে যায়। সবাই সেই দিকে চেয়ে থাকে। চা জলখাবার নিয়ে মানসী প্রবেশ করে।)
মানসী: কী হল? সৌবীর কোথায়?
মৃত্যুঞ্জয়: ও চলে গেছে।
মানসী: ওমা কেন? তোমরা কিছু বলেছ নাকি ওকে।
শ্যামলী: না মা, কেউ ওঁকে কিছু বলে নি।
মৃত্যুঞ্জয়: আসলে ও ভিনগ্রহের মানুষ। এই পৃথিবীর টানে বার বার ফিরে ফিরে আসে। এই পৃথিবীটাকে বড্ড ভালবাসে – ও চায়না কারও পৃথিবী ধ্বংস হোক।
মানসী: কি যে সব বল বুঝি না। এতগুলো লুচি ভাজলাম। খেয়ে যাও সুজয়।
সুজয়: না মাসিমা। আমি এখন চলি। অনেক বেলা হয়ে গেছে। মা অপেক্ষা করছে। খুব দুশিন্তায় আছে। মাকে গিয়ে বলি – পৃথিবী ধ্বংস হচ্ছে না – অন্তত এখন নয়।
(সুজয় বেরিয়ে যায়)
মানসী: সব পাগলের দল। (মৃত্যুঞ্জয়কে) তুমি চান করে এস। খেয়ে নাও। আমি আরও কয়েকটা লুচি ভাজি।
(মানসী বেরিয়ে যায়। মৃত্যুঞ্জয় আবার পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে বসে। শ্যামলী পাশে এসে দাঁড়ায়। )
শ্যামলী: বাবা, তুমি রাগ করনি তো?
মৃত্যুঞ্জয়: রাগ করব কেন? বরং তুই এটা না করলেই হয়ত দুঃখ পেতাম।
শ্যামলী: আচ্ছা বাবা, সত্যি যদি দশ দিন বাদে পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যায়, তোমার কোনও আফসোস থাকবে না?
মৃত্যুঞ্জয়:: থাকবে তো। অনেক আফসোস থাকবে। কত কী দেখার ইচ্ছে ছিল। আঙ্কর ভাটের মন্দির, মাচু পিচুর ভগ্নস্তূপ, ইস্টার দ্বীপপুঞ্জের দৈত্যের মাথাগুলো, গালাপাগসের প্রাচীন কচ্ছপ – কত কি। জানি কোনওদিন দেখা হবে না, তবু ইচ্ছেটা থাকবে। সত্যি, পৃথিবীটা বড় সুন্দর রে শ্যামলী। (পাণ্ডুলিপির দিকে তাকিয়ে, একটু হেসে) তবে এই বইটা না বেরলে, আরও বেশি আফসোস হবে।
শ্যামলী: নিশ্চয়ই বেরবে। খুব প্রশংসা পাবে, তুমি দেখ। (থেমে) বাবা, তোমার এই বইটা বেরলে সৌবীর কে এক কপি পাঠিও।
মৃত্যুঞ্জয়: হ্যাঁ পাঠাব। বড় ভাল কবিতা বলে ছেলেটা। (থেমে) জীবনানন্দের আর-একটা কবিতা মনে পড়ছে জানিস।
পান্ডুলিপি কাছে রেখে ধূসর দ্বীপের কাছে আমি
নিস্তব্ধ ছিলাম ব‘সে;
শিশির পড়িতেছিলো ধীরে–ধীরে খ‘সে;
নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি
উড়ে গেলো কুয়াশায়, — কুয়াশার থেকে দূর–কুয়াশায় আরো।
তাহারি পাখার হাওয়া প্রদীপ নিভায়ে গেলো বুঝি?
অন্ধকার হাৎড়ায়ে ধীরে–ধীরে দেশলাই খুঁজি;
যখন জ্বালিব আলো কার মুখ দেখা যাবে বলিতে কি পারো?
কার মুখ? —আমলকী শাখার পিছনে
শিঙের মত বাঁকা নীল চাঁদ একদিন দেখেছিলো তাহা;
এ–ধূসর পান্ডুলিপি একদিন দেখেছিলো, আহা,
সে–মুখ ধূসরতম আজ এই পৃথিবীর মনে।
তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,
পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,
মানুষ র‘বে না আর, র‘বে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখন
সেই মুখ আর আমি র‘বো সেই স্বপ্নের ভিতরে।
(আলো নিভে যায়।)
সমাপ্ত
ছবি সৌজন্যে: Unsplash
সুদীপ্ত ভৌমিক একজন প্রতিষ্ঠিত নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা। ওঁর নাটক অভিবাসী জীবনের নানা দ্বন্দ ও সংগ্রামের কথা বলে। সুদীপ্তর নাট্যদল একতা (ECTA) উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিমবঙ্গের নাট্যপ্রেমীদের কাছে এক পরিচিত নাম। ভাষানগর পুরস্কার, নিউ জার্সি পেরি এওয়ার্ড নমিনেশন, সিএবি ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস এওয়ার্ড ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত সুদীপ্ত ড্রামাটিস্ট গিল্ড অফ আমেরিকার পূর্ণ সদস্য। ওঁর পডকাস্ট স্টোরিজ অফ মহাভারত অ্যাপল আইটিউনস-এ শ্রেষ্ঠ পডকাস্টের স্বীকৃতি পেয়েছে।