মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়
(Horror Story)
তোমরা অনেক আশ্চর্য ঘটনা কানে শুনেছ, কিন্তু আমি চোখে দেখেছি এক অত্যাশ্চর্য অদ্ভুত ঘটনা। তখন আমার বয়স অল্প- বোধ হয় তেরো-চোদ্দো।
বৃন্দাবন, ডাক নাম বিনু, ছিল আমার সবচেয়ে ভালোবাসার বন্ধু। এক ক্লাসে পড়তাম, দিনরাত একসঙ্গে থাকতাম, সে ছাড়া আর কারও সঙ্গে খেলতে, কথা-কইতে আমার ভালো লাগত না। আমাদের কাছেই ছিল তাদের বাড়ি।
তখন আমরা নতুন তাস খেলতে শিখেছি। বিনু সেবার একদিনের জন্য মামার বাড়ি গিয়ে বিস্তি খেলা শিখে এসেছিল। এসেই সে আমায় ওই খেলা শিখিয়ে দিল। দু জনেই নতুন খেলিয়ে, কিন্তু বিনু দু-চার বাজি খেলেই পাকা ওস্তাদ হয়ে উঠল। আমি প্রায় প্রতি হাতেই তার কাছে হারতাম। কোথায়ই বা তাকে জিতেছি? স্কুলের লেখাপড়ার প্রাইজে, খেলাধূলার প্রাইজে সে বরাবরই আমায় হারিয়ে এসেছে। এমন কী নিমন্ত্রণ খেতে বসেও কোনওদিন তাকে জিততে পারিনি-সে বরাবর আমার চেয়ে বেশি খেয়েছে। এক এক সময় সন্দেহ হত আমার মায়ের স্নেহটিও বুঝি সে আমার চেয়ে বেশি করে জিতে নিল। কিন্তু এতে আমার দুঃখ ছিল না। কারণ তাকে যে আমি সত্যিই ভালোবাসতাম। (Horror Story)
আমরা দুজনে পায়রার খোপের মতো একটুখানি জায়গায় বেশ নির্জনে নিশ্চিন্তে মুখোমুখি বসে মনের সুখে অবিরাম গলগল করতে পারতাম।
রোজ সন্ধ্যার পর স্কুলের পড়া শেষ করে, খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়ে আমরা দুই বন্ধুতে আমাদের সদরবাড়ির পশ্চিম কোণে ভাঙা নহবতখানার নিচের অন্ধকার ঘরটায় লুকিয়ে বসে তাস খেলতাম। এই ঘরটায় পুরাকালে কে থাকত জানি না। এ বাড়ি যখন জমজমাট ছিল, তখন হয়তো কর্তাদের সানাইওয়ালারা এইখানেই বসবাস করত। এখন এখানে দিনে রাতে কারও পায়ের ধুলো পড়ে না-এক চুপিচুপি আমাদের ছাড়া। এই ঘরটা আমাদের দুই বন্ধুর ভারি মনের মতো ঘর ছিল-এর মধ্যে বাড়ির ভেতরকার তাড়াহুড়া এসে পৌঁছতে পারত না; আমরা দুজনে পায়রার খোপের মতো একটুখানি জায়গায় বেশ নির্জনে নিশ্চিন্তে মুখোমুখি বসে মনের সুখে অবিরাম গলগল করতে পারতাম। আমাদের ছুটির দিনগুলো নির্বিঘ্নে নিবিড় আনন্দে কাটত-এই ঘরখানির কোলে মাথা রেখে শুয়ে। বিনু নিজের হাতে ওই ঘরের একটি কোণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখত। এর কোনও আভরণ ছিল না-এর সমস্ত অভাব ও দৈন্যকে আমরা আমাদের অন্তরের আনন্দ দিয়ে ঢেকে রেখেছিলাম। নইলে সেই কঙ্কালসার জীর্ণ অন্ধকার কোটরের মধ্যে আমাদের কচি দুটো প্রাণ কিছুতেই তিষ্ঠতে পারত না। (Horror Story)

বিনু মামার বাড়ি থেকে একজোড়া তাস সংগ্রহ করে এনেছিল-বোধ হয় তার মামাদের আড্ডার পরিত্যক্ত তাস। তাস জোড়াটা ছিল খুবই পুরনো-ভদ্রসমাজে নিতান্তই অচল। সম্ভবত তাই এত সহজে সে বেচারা ওস্তাদ খেলোয়াড়দের কড়া হাতের কঠিন চাপড় থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে বিনুর ছোট্ট নরম হাতখানিতে এসে পড়বার সৌভাগ্য পেয়েছিল। বেচারাকে যে অনেকদিন ধরে অনেক চড়চাপড় সইতে হয়েছে সে তার চেহারা দেখলেই বোঝা যেত। কিন্তু কোন গুরুতর অপরাধে তার কানগুলো যে এমন নির্দয়ভাবে কাটা গিয়েছিল এবং কেনই বা তার বুকের উপর আঁচড় টেনে টেনে এমন ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে তা আমরা বুঝতে পারতাম না। এ তার কোন পাপের শাস্তি? -কে জানে! (Horror Story)
তাঁর এই জীর্ণ-শীর্ণ চেহারা দেখে আমাদের কেমন মায়া করত; সেইজন্যে তার উপর জোরজবরদস্তি করতে পারতাম না। একে নিয়ে অতি সন্তর্পণে খেলতাম-আস্তে আস্তে তুলতাম, আস্তে আস্তে ফেলতাম, ভাঁজতাম খুব আলগা হাতে। খেলা শেষ হয়ে গেলে ধীরে ধীরে গুছিয়ে একখানি রুমাল মুড়ে তুলে রাখতাম অতি যত্নে। সত্যি বলছি এই তাসকে এত ভালোবাসতাম আমরা যে এর বদলে নতুন ঝকঝকে তাস কিনে আনতে আমাদের লোভটুকু পর্যন্ত হয়নি কোনওদিন। এই তাসের ছবি দেখে আমার মনে হত-এরা যেন এককালে এই বাড়িরই মানুষ ছিল, এখন তাস হয়ে গেছে। তোমরা হেসো না; এর হরতনের গোলামটিকে আমার মনে হত ঠিক যেন বুড়ো ঠাকুরদার দরোয়ান এ! এর ফোঁটা-ওয়ালা তাসগুলোও যেন কেমন একরকমের। (Horror Story)
এক একদিন বিনুর সঙ্গে খেলতে খেলতে প্রদীপের ঝাপসা আলোয় এর আটা-নওলা-দওলার রঙিন ফুটকিগুলোর দিকে চেয়ে চেয়ে হঠাৎ আমার চোখ কেমন ধাঁধিয়ে যেত-মনে হত আমি যেন তাদের ওই ফুটকিগুলোর ফাটলের মধ্যে দিয়ে কতদূর চলে গেছি-সে যেন কতকালের আগেকার কোনখানে! যারা অনেক কাল আগে এখানে ছিল যেন তাদের কাছে! সেখানে কী দেখতাম, কী শুনতাম মনে নেই কিন্তু সেসব দেখে-শুনে কেমন তন্ময় হয়ে যেতাম। হঠাৎ বিনুর ডাকে আবার ফিরে আসতাম। সে ধমক দিয়ে বলত- “কী বসে বসে ভাবছিস? খেল না!” আমি অমনি তাড়াতাড়ি যাহোক একখানা তাস ফেলে দিয়ে খেলায় আবার মন দিতাম। কিন্তু বুকটা কেমন ছমছম করতে থাকত। মনে হত এ নিশ্চয় যাদুকর তাস!
এ সেই আদ্যিকালের বদ্যি বুড়োর হাতের গুণ করা তাস! এ তাস ছুঁতে বুক ছমছম করত, কিন্তু তবু ভালোবাসতাম বিনুর দেওয়া এই তাস জোড়াটাকে।
বিনুকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম- “এই তাস নিয়ে তোর মামার বাড়িতে কারা খেলতরে বিনু?” বিনু বলেছিল-“শুনেছি দাদামশাই খুব পাকা খেলিয়ে ছিলেন; কেউ নাকি তাঁকে তাস খেলায় হারাতে পারত না। লোকে হিংসে করে বলত, সে তাঁর খেলার গুণ নয়, তাসের গুণ! তিনি তাস গুণ করতে জানতেন। বোধ হয় এ তাঁরই আমলের তাস।” বিনুর দাদামশাইকে আমরা চোখে দেখিনি; তার মামাদেরই দেখতাম খুব বুড়ো! উঃ, তাহলে না জানি তিনি কত বুড়ো! এ সেই আদ্যিকালের বদ্যি বুড়োর হাতের গুণ করা তাস! এ তাস ছুঁতে বুক ছমছম করত, কিন্তু তবু ভালোবাসতাম বিনুর দেওয়া এই তাস জোড়াটাকে। (Horror Story)
এই তাস নিয়ে বিনু গম্ভীর মুখে রোজ আমার সঙ্গে খেলত। তাকে খেলায় জিততে পারতাম না বলে সে প্রায়ই হাসতে হাসতে বলত-“জানিস মল্লি, এ আমার দাদামশাইয়ের গুণ করা তাস! এ তাস হাতে থাকলে কেউ আমায় জিততে পারবে না-তুইও না!”
আমাদের আড্ডা ঘরের দেওয়ালে গোরুর চোখের মতো একটা সরু কুলুঙ্গিতে ছোট্ট একটি তেলের প্রদীপ জ্বলত-আমাদের বসবার কোণটুকু আলো করে; বাকি ঘরটা অন্ধকারের আবছায়ায় পড়ে থাকত-কালো চাদর মুড়ি দিয়ে। খেলা জমে উঠত, সঙ্গে সঙ্গে রাতের অন্ধকারও জমে উঠত। একে একে বাড়ির প্রদীপ সব নিডে যেত, ঘরের পাশে সরু গলির পথটা ক্রমে নির্জন হয়ে আসত। চৌধুরিবাড়ির দোতলার জানলা থেকে যে এক ফালি সরু আলো এসে অন্ধকার গলির উপর পড়ত, ক্রমে সেটুকুও অস্ত যেত। গলির ফাঁকটা ভরাট হয়ে উঠত জমাট অন্ধকারে। আর সেই কালো পাথরের মতো অন্ধকারের উপর দিয়ে মাঝে মাঝে শুনতাম কে যেন পায়চারি করছে লাঠি হাতে খড়ম পায়ে-খট-খটাস! খট-খটাস। (Horror Story)
তার এই ধমকানিতে আমার চটকা ভাঙত। আর সঙ্গে সঙ্গে চারদিকের ওই বিশ্রী শব্দগুলোও যেন ভয়ে ভয়ে চুপ করে যেত।
তার পরেই খুব দূর থেকে একটা খেঁকি কুকুর বুক ফেটে কাতরে উঠত-কেই-কেই! আর অমনি ঝুলের ঝালর ও মাকড়সার জাল দিয়ে ঘেরা আমাদের ঠাকুরদার আমলের পুরোনো ঠাকুরদালানের কালপ্যাঁচা ও চামচিকে-বাদুড়গুলো অন্ধকারের মধ্যে কখন হুহুস্ কখন হিসহিস শব্দে তাদের বাচ্চাগুলোকে সাবধান করে দিত এবং মাঝে মাঝে ফটফট করে হাততালির আওয়াজে কাকে যেন আমাদের ঘরের দিকে তাড়িয়ে দিত। ওই বুঝি সে এল! এই ভাবতে ভাবতে আমার সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে আসত। হাতের তাস মাটিতে নামত না! বিনু ধমক দিয়ে বলত- “কী করছিস? খেল না!” তার এই ধমকানিতে আমার চটকা ভাঙত। আর সঙ্গে সঙ্গে চারদিকের ওই বিশ্রী শব্দগুলোও যেন ভয়ে ভয়ে চুপ করে যেত। তা যদি না হত তাহলে বোধ হয় ঘর থেকে ছুটে আমি বাবার কাছে পালিয়ে যেতাম, কিছুতেই বিনুর সঙ্গে খেলতাম না। (Horror Story)
সেদিন খেলা আরম্ভ করতেই হঠাৎ খুব জোরে ঝড় বৃষ্টি এলু। একটা ঝড়ের দমকা আমাদের কোলের তাসগুলোকে উলটে পালটে ভেস্তে দিয়ে ঘর থেকে খানিকটা ঝুল ও ধুলো উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। বিনু বলল- “মল্লি, দরজা-জানালাগুলো বন্ধ করে দে!” আমি উঠে জানালাগুলো বন্ধ করতে লাগলাম। পশ্চিমের জানালাটায় হাত দিতেই কে যেন সজোরে আমার হাতে একটা ঝাঁকানি দিয়ে সেকহ্যান্ড করে চলে গেল। আমি তাড়াতাড়ি হাতটা ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে নিলাম-কিছু বুঝতে পারলাম না। বুকটা ধুকধুক করতে লাগল।
খেলতে বসেই সে বাজি জিতলাম। আশ্চর্য কান্ড! যা কখনও হয়নি, তাই হল। বিনুও অবাক। সে একটু বেশি করে মন দিয়ে খেলতে বসল। কিন্তু পরের বাজিও জিততে পারল না। আমার কেমন সন্দেহ হল-এলোমেলো ঝড় এসে তাসের যাদুটা উড়িয়ে নিয়ে গেল নাকি! (Horror Story)
(Horror Story) আমি ক্রমাগতই জিততে লাগলাম। কিন্তু আমার কেমন মনে হচ্ছিল এ জেতায় আমার কোনও বাহাদুরি নেই। প্রতিবারেই এমন তাস আসছিল যে খেললেই পিঠ পাওয়া যায়। কে যেন ম্যাজিক করে ভালো ভালো তাসগুলো বেছে বেছে আমার হাতে তুলে দিচ্ছে। বিনু বার বার হেরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল-“আজ আমার পড়তা খারাপ পড়ল দেখছি!” তার এই দীর্ঘশ্বাসটি আমার বুকে গিয়ে বাজল! আমি চঞ্চল হয়ে উঠলাম। আমার মন কেঁদে বলতে লাগল-“আমি জিত চাই না, বিনু জিতুক।” আমি ফন্দি করে বিনুকে জিতিয়ে দেবার জন্যে হাঁকুপাঁকু করতে লাগলাম; কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। আজকের ওই ঝড়ে কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে গেছে! (Horror Story)
বিনু ফেলল হরতনের বিবি, তাকে সেই পিঠটা দেবার জন্য আমি তাড়াতাড়ি খেললাম গোলাম, কিন্তু পিঠ তোলবার সময় দেখা গেল গোলামটা চেহারা বদলে সাহেব হয়ে গেছে। কাজেই পিঠটা আমাকেই নিতে হল। পরের হাতে আমি খেললাম চিঁড়ের দশ। আমি জানতাম বিনু এ দশ 1. ফোঁটার লোভ কিছুতেই ছাড়তে পারবে না, সে নিশ্চয় গোলাম দিয়ে পিঠটা নেবে। বিনু ফেললও গোলাম, কিন্তু আমার দশখানা হঠাৎ দু’ফোঁটা চুরি করে কেমন করে যে আটা হয়ে গেল আমি কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। (Horror Story)
আমি অবাক; বিনু বাজি হেরে গোঁ হয়ে বসে রইল।
রাগ হলে বিনুর বড় বড় চোখ দুটো আরও বড় হয়ে উঠতে দেখেছি, কিন্তু আজ যেন অস্বাভাবিক রকম বড় হয়েছে বলে মনে হতে লাগল। সে বারের খেলাতে তার হাতের ফ্রাই ইসকাবনের দশখানার উপর চিঁড়ের সাতা পাশিয়ে দিতে গিয়ে যখন সেটা রঙের সাতার তুরুপ হয়ে গেল, তখন তার সেই হঠাৎ বড়-হয়ে যাওয়া চোখ দুটো কেমন একরকমভাবে বিস্ফারিত করে সে আমার দিকে চাইল যে সে চাহনিতে আমার সর্বশরীর ঝিমঝিম করে এল। (Horror Story)
কড়িকাঠের খোপে খোপে চড়াই পাখিগুলো গল্প শেষ করে শুয়ে পড়েছে। চারদিক নিস্তব্ধ নিঝুম। হাতের তাসগুলোর দিকে চেয়ে দেখি সাহেব বিবিদের চেহারা ঘুমে জড়িয়ে আসছে।
(Horror Story) বিনুকে ভয়ে ভয়ে বললাম “ভাই, আর খেলে কাজ নেই, চলো যাই।” বিনু সে কথা কানেই তুলল না। ক্রমে রাত গভীর হয়ে এল। মনে হল বাড়ির সবাই ঘুমিয়েছে। আমাদের এ ঘরখানারও যেন ঘুম ধরেছে-এর দরজা জানালা ইট কাঠ ঘুমে ঢুলছে।
প্রদীপের আলোটা থেকে থেকে কেবল হাই তুলছে। কড়িকাঠের খোপে খোপে চড়াই পাখিগুলো গল্প শেষ করে শুয়ে পড়েছে। চারদিক নিস্তব্ধ নিঝুম। হাতের তাসগুলোর দিকে চেয়ে দেখি সাহেব বিবিদের চেহারা ঘুমে জড়িয়ে আসছে। ক্রমে মনে হল সমস্ত পৃথিবীটাই যেন ঘুমের ঝোঁকে দুলছে-ঝুম ঝুম ঝুম ঝুম! আমিও তার সঙ্গে দুলতে লাগলাম- ঝুম ঝুম ঝুম ঝুম! (Horror Story)
হঠাৎ চটকা ভাঙল চৌধুরিবাড়ির ঘড়ির শব্দে-ঢং! সেই শব্দ অন্ধকারের ঘুম ভাঙাতে ভাঙাতে অনেক দূর চলে গেল। ও কী? ও কীসের শব্দ? কড়িকাঠের কাছে ওই কোণের গর্ত থেকে কে এমন বিশ্রী সুরে নিশ্বাস টানছে হুউউউসসস! হুউউসস! আমি চমকে উঠে বিনুকে জিজ্ঞাসা করলাম-“ও কীসের শব্দ ভাই?” (Horror Story)
বিনু কথা কইল না। শুধু তাস থেকে চোখ তুলে কড়ি কাঠের দিকে চাইল, আর আমার মনে হল তার সেই ড্যাবডেবে চাহনিটা চোখ থেকে ঠিকরে বেরিয়ে কড়িকাঠের অন্ধকার কোণে এঁটে রইল-জ্বলজ্বল করে চেয়ে আমার দিকে। বিনুকে আমি কান্নার সুরে বললাম-“ভাই আমার বড় ঘুম পেয়েছে।” বিনু বলল-“আচ্ছা, আর দু-হাত খেল।” আমি চমকে উঠলাম— তার গলা শুনে। কী গম্ভীর আওয়াজ! এ তো কোনও রকমে এই দুহাত খেলা এখন শেষ করতে পারলে বাঁচি! কোনও দিকে কান দেবার, কোনও দিকে চোখ দেবার আমার আর সাহস হচ্ছিল না। ইচ্ছা হচ্ছিল এই তাস দিয়ে চোখ কান ঢেকে ফেলি। আমি খুব চোখের কাছে তাস এনে একমনে খেলতে লাগলাম। (Horror Story)
বাঁ হাতের তাসের সারি থেকে চট করে হরতনের গোলামটা তুলে নিয়ে হরতনের নওলার উপর ফেলতে গিয়ে দেখি-সামনে নওলা নেই; বিনুও নেই। অ্যাঁ!
সে হাত বিনু খেলেছিল রঙের নওলা। আমার হাতে গোলাম ছিল, কিন্তু পিঠ নেবার ইচ্ছা ছিল না। কী করে লুকোলে বিনু সেটা ধরতে পারবে না ভাবছি, বিনু বলে উঠল সেই রকম বিষম ভারী গলায় ঘর কাঁপিয়ে-“গোলামটা আছে তো?”
ভয় হল ধরা পড়ে গেছি। বাঁ হাতের তাসের সারি থেকে চট করে হরতনের গোলামটা তুলে নিয়ে হরতনের নওলার উপর ফেলতে গিয়ে দেখি-সামনে নওলা নেই; বিনুও নেই। অ্যাঁ! বুকটা ধক করে উঠল। এ পাশ ও পাশ চেয়ে দেখি শুধু বিনু নয়, একখানি তাসও নেই। (Horror Story)
বোঁ করে মাথাটা ঘুরে গেল। চোখে অন্ধকার দেখলাম! গা হাত পা ঝিম-ঝিম করতে লাগল। ঘরের চার কোণ থেকে চারটে বিকট হাসি খিলখিল শব্দে ছুটে বেরিয়ে গেল। আর উপরের নহবতখানা থেকে ঢাক ঢোল কাঁশি বাঁশি সব এক সঙ্গে বেজে উঠল। আমি কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে শুয়ে পড়লাম। মনে হল আমার হাত পায়ের সমস্ত খিল যেন আলগা হয়ে গেছে-উঠে হেঁটে পালাবার আর উপায় নেই। (Horror Story)
আমার কান্না আসতে লাগল-বিনু-আমার বিনু কোথায় গেল? উপর থেকে ভাঙা কাঁশিখানা ফাটা আওয়াজে বলতে লাগল-কই না না! আমি খুব চেঁচিয়ে ডাকলাম-বিনু, বিনু! কিন্তু আমার গলার স্বর মুখ দিয়ে না বেরিয়ে পেটের ভেতর চলে গেল-ঘুরতে ঘুরতে, গোঁ-গোঁ শব্দে!
আরও পড়ুন: পেয়ারা গাছের নীচে: লীলা মজুমদার
একবার আশা হল বিনু হয়তো বাইরে গেছে-এখনই আসবে। কিন্তু বাঁ হাত থেকে ডান হাতে তাসটা নিয়েছি মাত্র-এই এতটুকু সময়ের মধ্যে সে এতবড় ঘর পেরিয়ে বাইরে গেল কেমন করে? হয়তো আমি অন্ধকারে দেখতে পাইনি। তাই হবে। এই মনে করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম, কিন্তু গিয়ে দেখি-একী যেমন খিল বন্ধ করেছিলাম, ঠিক তেমনই আছে। (Horror Story)
তবে? তবে সে কেমন করে বাইরে গেল? হঠাৎ মনে হল বিনু আমাকে ভয় দেখাবার জন্যে এই ঘরের মধ্যে লুকিয়ে নেই তো? কিন্তু কোথায় লুকোবে? ঘর যে ফাঁকা। আসবাবের মধ্যে মাত্র একটা ভাঙা আলমারি। তার পিছনে বড়জোর আঙুল পাঁচেক জায়গা। তার মধ্যে একটা মানুষ থাকতে পারেনা। তবু সেখানটা একবার দেখলাম। ঘরের একোণ ওকোণ এধার ওধার প্রদীপ ধরে দেখলাম তন্নতন্ন করে। কিন্তু সে কোথাও নেই-কোথাও নেই! (Horror Story)
(Horror Story) কতক্ষণ পড়ে পড়ে কেঁদেছিলাম জানি না। যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম, তখনও কান্নার জলে চোখ আমার ঝাপসা। রাত তখন নিশুতি। চারদিক নিঝুম। কেউ কোথাও নেই। কেবল আমাদের তিনমহল প্রকান্ড বাড়িখানা দেখলাম ভয়ঙ্কর আতঙ্কে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে; যেন তার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠেছে! চৌধুরিদের চৌতলার চিলের ছাদটা আমাদের দিকে এতখানি গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল- “কী হল রে, কী হল? কোথায় গেল?” পশ্চিম কোণের ঢ্যাঙা সুপুরিগাছটা কিছু না বলে শুধু ডিঙি মেরে আকাশের দিকে মুখ তুলে ইসারায় দেখিয়ে দিল-আমাদের বাড়ির ঠিক মাথায় একটা মস্ত বড় কালো পাখি তাসের মতো নানা রঙে চিত্র-বিচিত্র করা ডানা মেলে মেঘের ধার দিয়ে অন্ধকারে ভেসে চলেছে-কাকে ঠোঁটে নিয়ে! তাই দেখে চারিদিক থেকে চাপা গলায় সবাই বলে উঠল- “আ হা হা!” অমনি আমার বুকের ভিতরটা করে উঠল- “আহাহা! বিনুকে ওরা ভেলকি বাজিতে উড়িয়ে নিয়ে গেল!” (Horror Story)
হঠাৎ কানে এল তাস পেটার শব্দ-চটাস-চটাস। এত রাত্রে এখানে অন্ধকারে তাস খেলে কে? মুহূর্তের মধ্যে আমার চলা বন্ধ হয়ে গেল।
ভাবতে ভাবতে আমার চোখের সামনের থেকে যেন সব একে একে মুছে আসত লাগল, পায়ের তলা থেকে পৃথিবীটা ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল। আমি যেন একটা অতল অন্ধকারের মধ্যে ডুবতে লাগলাম-পলে পলে, তালে তালে। তারপর মনে পড়ে অন্ধকারে চেনা পথ ধরে বাড়ির ভিতরের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কানে এল তাস পেটার শব্দ-চটাস-চটাস। এত রাত্রে এখানে অন্ধকারে তাস খেলে কে? মুহূর্তের মধ্যে আমার চলা বন্ধ হয়ে গেল। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলাম। (Horror Story)
বারান্দার পশ্চিম কোণে ঘুরঘুটে অন্ধকারের মধ্যে আমাদের খাজনাঘর। দিনের বেলা এর সামনে দিয়ে যেতে আমাদের গা ছমছম করে, সে জন্য এদিকটা আমরা কেউ মাড়াতাম না। আমাদের বিশ্বাস যত রাজ্যের ভূতপ্রেত ওইখানে বাসা বেঁধে মনের সুখে ঘরকন্না করছে। আমরা ওই মহলটা তাদের ছেড়ে দিয়েছিলাম। সেখানে কস্মিনকালে সকাল সন্ধ্যায় আলো গঙ্গাজল পড়ত, না-ঝাঁটাও কেউ দিত না। এই খাজনাঘর যে কতকালের তা কেউ জানে না-বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে পুরনো এই জায়গাটা। শোনা যায়, ঠাকুরদাদার যিনি ঠাকুরদাদা ছিলেন তাঁর আমলে জমিদারির খাজনা এলে এই ঘরে গচ্ছিত রাখা হত-মাটির তলায় একটা চৌখুপির মধ্যে। সরু সুড়ঙ্গের মতো এই ঘর। সামনে মোটা মোটা লোহার গরাদে-দেওয়া খাঁচার মতো দরজা-পিতলের শিকল দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো। সামনে দাঁড়ালে একটা স্যাঁতসেঁতে পচা গন্ধ নাকে আসে, আর চোখে পড়ে কালিঝুলি-মাখা একটা অন্ধকারের কুণ্ডলী-দিনরাত ঘূর্ণির মতো ঘুরছে! (Horror Story)
এই ঘর কতকাল যে খোলা হয়নি তার ঠিক নেই। খোলবার দরকারই হয়নি। কারণ বহুদিন হল আমাদের সে জমিদারি নেই; তার খাজনাও আর আসে না। ঠাকুমার মখে গল্প শুনেছি, আমার ঠাকুরদাদার যিনি দাদামশাই ছিলেন তাঁর অগাধ টাকা ছিল-একটা রাজা রাজড়ার তেমন থাকে না। কিন্তু তিনি ভারি কৃপণ ছিলেন। একটি পয়সাও কাউকে প্রাণ থাকতে দিতে পারতেন না-এমনকী নিজের ছেলেমেয়েকেও নয়। তিনি কেবল টাকার পর টাকার রাশ জমা করে চলতেন। লোকে টাকা খরচ করে নাম কেনে, তিনি টাকা না খরচ করার বাহাদুরিতে লোকের কাছে খেতাব পেয়েছিলেন! টাকার উপর তাঁর এমন মায়া ছিল যে, পাছে মারা যাবার পর তাঁর টাকা খরচ হয়ে যায় এই ভয়ে তিনি তাঁর যথাসর্বস্ব যখের হাতে সমর্পণ করে যান-যার কাছ থেকে একটি কাণাকড়িও বার হবার জো নেই! (Horror Story)
তিন দিন তাঁর কাঁপুনি ছিল; সাত দিন তাঁর মুখে রা ছিল না। কেন যে এমন হল, কেউ জানে না। তিনি নিজেও কিছু বলেননি; কারও সাহসও হয়নি জিজ্ঞাসা করতে।
এই যখের কাহিনী একটা মস্তবড় গল্প! কেমন করে একটি সুন্দর নয় বছরের ছেলেকে মেঠাই ও খেলনার লোভ দেখিয়ে তার বাপ মায়ের কাছ থেকে চুরি করে আনা হয়, কেমন করে তাকে লাল চেলির গরদ পরিয়ে, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে ওই অন্ধকার খাজনাঘরের তলায় বন্ধ চৌখুপির মধ্যে- যেখানে কেবল ঘড়াঘড়া টাকা সাজানো আছে, আর কিছু নেই, আর কেউ নেই-না বাপ, না মা, না আলো, না বাতাস- সেখানে একলাটি বসিয়ে রেখে, তারপর ওই চৌখুপিতে ঢোকবার পথটা দশ মন পাথর দিয়ে চিরদিনের মতো বুজিয়ে দেওয়া হয়, সে কথা শুনতে শুনতে আমার চোখে জল আসত-বুক দূরদূর করত; আমার ঠাকুরদাদার সেই পাষণ্ড ঠাকুরদাদার উপর রাগ হত। ঠাকুরমা বলতেন- “আহা, ওই সুন্দর নয় বছরের ছেলেটি কত কেঁদেছে, বাবা বাবা করে বুক ফেটে কত চেঁচিয়েছে, তেষ্টায় একফোঁটা জলের জন্য ছটফট করেছে, তবু কেউ তাকে ওই চৌখুপির দরজা খুলে দেয়নি।” শুনে আমার গলা কাঠ হয়ে আসত। (Horror Story)
তার পর খিদে তৃষ্ণায় ভয়ে কাতরাতে কাতরাতে বেচারা কখন যে হাঁপিয়ে মরে গেছে, সে হয়তো নিজেই বুঝতে পারেনি। এখন সে যখ হয়ে আছে-ওইখানে বসে বসে কেবল টাকার ঘড়া আগলাচ্ছে। কারও সাধ্য নেই যে ওই টাকা সেখান থেকে নিয়ে আসে! আমার ঠাকুরদাদার বাবা নাকি একবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বেশি দূর যেতে হয়নি; মেজের পাথরে একটি মাত্র সাবলের ঘা দিতেই তিনি গোঁ-গোঁ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তিন দিন তাঁর কাঁপুনি ছিল; সাত দিন তাঁর মুখে রা ছিল না। কেন যে এমন হল, কেউ জানে না। তিনি নিজেও কিছু বলেননি; কারও সাহসও হয়নি জিজ্ঞাসা করতে। সেই থেকে ওই ঘরের দিকে আর কেউ যায় না। মনে হল ওই খাজনাঘর থেকেই যেন তাসখেলার শব্দ পেলাম। যদিও ওদিকে যেতে বুক দূরদূর করতে লাগল, কিন্তু বিনুর জন্যে না গিয়ে পারলাম না, যদি সে ওখানে থাকে যদি সে আমায় দেখতে পেয়ে ছুটে আসে! (Horror Story)
বুকটা দু হাতে চেপে খাজনাঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। লোহার গরাদ-দেওয়া দরজা দিনের বেলা শিকল দিয়ে বাঁধা থাকে কিন্তু এখন দেখলাম খোলা। অন্ধকারে চোখে কিছু দেখা গেল না, কিন্তু কানে শোনা গেল-কারা দুজন যেন দরজার দু-ধার থেকে সজোরে ছুটে এসে মাথায় মাথা অনবরত ঠোকাঠুকি করছে-দুম, দুম, দুম! আমার কেমন মনে হল যেন এইখানকার এই অগাধ সম্পত্তি এই যখের ধন-কে নেবে তাই নিয়ে দুই ভূতের লড়াই চলছে। (Horror Story)
আবার শুনলাম- “তুই কিচ্ছু খেলতে পারিস না! মল্লি তোর চেয়ে ঢের ভালো খেলে।” বিনু আমায় ডাকত মল্লি বলে।
(Horror Story) আমি এক মনে এদের লড়াইয়ের তাল গুনছি, হঠাৎ বিনুর মতো কার গলা পেলাম। সে বলছে-“বিবির চেয়ে রঙের গোলাম বড়।” আর একজন কে সরু গলায় বলে উঠল-“দূর বোকা, তা কখনও হয়? গোলাম হল সাহেব বিবির চিরকেলে কেনা গোলাম; হলই না হয় সে রঙ মেখেছে!”
গোড়ায় গোড়ায় আমিও একদিন বিনুকে বলেছিলাম-“গোলাম কেন বিবির চেয়ে বড় হবে বিনু?” বিনু বলেছিল-“এই রকম যে নিয়ম।” আজও আবার সেই কথা উঠেছে। এও তাহলে আমাদের মতন নতুন খেলিয়ে দেখছি।
আবার শুনলাম- “তুই কিচ্ছু খেলতে পারিস না! মল্লি তোর চেয়ে ঢের ভালো খেলে।” বিনু আমায় ডাকত মল্লি বলে। মনে হল, আমার যখন নাম করছে, এ তখন নিশ্চয় বিনু! বিনুর গলায় আমার নাম শুনে ওই ঘরের মধ্যে ছুটে যাবার জন্যে আমার প্রাণটা আকুলি ব্যাকুলি করতে লাগল, কিন্তু পারলাম না। ভয় হল, পাছে ওই দুটো পাগলা ভূতের মাথা ঠোকাঠুকির মধ্যে পড়ে থেঁতলে যাই! আমি চুপ করে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। (Horror Story)
হঠাৎ অন্য লোকটা চেঁচিয়ে উঠল-“অ্যাঁ, হরতনের গোলাম কোথায় গেল? হরতনের গোলাম! ভারি আশ্চর্য! এই ছিল, এই নেই! চোখের পাতা ফেলতে না ফেলতেই উড়ে গেল?”
আমার ভারি হাসি পেল-ওই যাদু-করা তাস এদের সঙ্গেও যাদু খেলছে দেখছি! বিনু বলে উঠল- “হরতনের গোলাম? সে তো মল্লির হাতে।” আমি নিজের হাতের দিকে চেয়ে দেখি-সত্যই তো সেই হরতনের গোলাম, যা দিয়ে বিনুর নওলার পিঠ নিতে গিয়েছিলাম, সেখানা আমার হাতেই রয়েছে। তো!
অন্য লোকটা বলে উঠল-“কই হ্যায়-মল্লিবাবুকো পকড় লে আও!” সেই শুনে আমি তাড়াতাড়ি হরতনের গোলামখানা খাজনাঘরের ভিতর ছুড়ে দিয়ে এক ছুটে নিজের শোবার ঘরে পালিয়ে এলাম। ঘরে এসেও ভয়ে বুকটা ধকধক করতে লাগল— এই বুঝি সে এসে আমায় জাপটে ধরে নিয়ে যায়! আমি পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাদর মুড়ি দিয়ে মড়ার মতো পড়ে রইলাম। খানিকক্ষণ কেউ এল না, তারপর কে একজন খসখস শব্দে বারান্দা দিয়ে চলে গেল-বোধ হয় আমার ঘর চিনতে পারল না। (Horror Story)
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। নিশ্চিন্ত হয়ে পাশ ফিরতে যাচ্ছি, এমন সময় কে আবার তড়াক করে লাফিয়ে আমার বিছানায় উঠল। আমি ভয়ে কাঠ! যে এল, সে খানিক বিছানার এদিক ওদিক ঘুরে-ঘুরে আমার গা ঝুঁকে শুঁকে বেড়াতে লাগল। তারপর আমার মাথার কাছে এসে মুখঢাকা চাদরখানা ধরে সজোরে টানতে লাগল-মুখ খুলে দেখবে। ওরে বাবারে! আমি প্রাণপণে চাদরখানা আঁকড়ে রইলাম, কিছুতেই মুখ খুলতে দিলাম না। তারপর সে পায়ের দিকে গেল। তার নিশ্বাসের হাওয়ায় আমার পা দুখানা ঠান্ডা হিম হয়ে এল। আমার পা ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাবে না তো? ভয়ে পা গুটিয়ে নেবার চেষ্টা করলাম, পারলাম না। খনিকক্ষণ চুপ করে রইল, বোধ হয় কী ভাবল, তারপর আমার পাশে এসে ধূপ করে শুয়ে পড়ল। সর্বনাশ! এখন করি কী! কিন্তু ঠিক সেই সময় আমার পুষি বেড়ালটা ম্যাঁও শব্দে ডেকে উঠতেই, সে তড়াক করে বিছানা থেকে লাফিয়ে পালিয়ে গেল। (Horror Story)
পুষিকে কাছে পেয়ে আমার ভয় অনেক ভেঙে গেল। তখন আবার বিনুর ভাবনা এল-তাহলে সত্যিই কী বিনুকে ওরা ওইখানে-ওই চৌখুপির মধ্যে নিয়ে গেল! সেখান থেকে সে পালিয়ে আসবে কী করে? এই সব ভাবছি, হঠাৎ কে কানের কাছে মুখ এনে খুব চুপিচুপি ডাকল-“মল্লি ভাই, মল্লি! বিনুর কাছে যাবে? বিনুর কাছে।”
আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম-বিনুর কাছে যাবার জন্যে বুকটা লাফিয়ে উঠল। কিন্তু ভারি ভয় হতে লাগল-যদি আর ফিরে আসতে না পারি? সে তখন বলল- “ভয় কী! চলো না! বিনু তোমার জন্যে বড় কাঁদছে।”
বিনুর কান্নার কথা শুনে আমার বুক ফেটে যেতে লাগল। আমি ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলতে লাগলাম-“ওগো তোমার দুটি পায়ে পড়ি, বিনুকে এবার ফিরিয়ে এনে দাও- বিনুর জন্যে আমার বড্ড মন কেমন করছে।” (Horror Story)
আমার কান্না শুনে সে চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় দেখলাম, একটা মস্ত পাগড়িওয়ালা চেহারা-ঠিক যেন হরতনের গোলাম।
এই হরতনের গোলামটিকে তাসের মধ্যে সবচেয়ে আমি বেশি ভালোবাসতাম। আমাদের বাড়িতে যে বুড়ো থুরথুরে দারোয়ান ছিল-ঠাকুরদাদার আমলের, তাকে খুব ছেলেবেলায় দেখেছিলাম, অল্প অল্প তার চেহারা মনে পড়ে। কিন্তু বেশ মনে আছে রোজ সকালে সে একটি করে রসমুন্ডি আমায় খাওয়াত। কী মিষ্টি লাগত সে রসমুন্ডি! এখন যেন তার স্বাদ মুখে লেগে আছে। আমার মনে হল, এই হরতনের গোলাম যেন সেই বুড়ো দারোয়ান-এখন তাসের ছবি হয়ে গেছে। সে বোধ হয় আমার কান্না দেখে লাঠি হাতে বিনুকে খুঁজে আনতে গেল। আবছায়ার মতো মনে পড়ে ছেলেবেলায় আমার পুষি বেড়ালটা হারিয়ে যেতে, আমার কান্না দেখে, সে এমনি করে একদিন তাকে খুঁজে আনতে বেরিয়েছিল। (Horror Story)
ভাবতে ভাবতে আমার শরীর এলিয়ে আসতে লাগল, চোখের পাতা জড়িয়ে আসতে লাগল, কপালে যেন কে নরম ঠান্ডা হাত বুলিয়ে দিল।
কতক্ষণ গেল; ঘরের ঘড়িটা টকটক শব্দ করতে করতে কতদূর চলে গেল। মনের মধ্যে কত ভাবনা এল গেল-তবু বিনু এলনা। হায়, সে কি আর আসবে? ওই ভয়ঙ্কর চৌখুপি ঘর-যার সামনে দুটো ভীষণ ভূত মাথা ঠোকাঠুকি করছে অনবরত, সেখান থেকে বিনুকে কে উদ্ধার করে আনবে? ভাবতে ভাবতে আমার শরীর এলিয়ে আসতে লাগল, চোখের পাতা জড়িয়ে আসতে লাগল, কপালে যেন কে নরম ঠান্ডা হাত বুলিয়ে দিল। আর অমনি এক নিমেষে মনে হল, আমি যেন একখানা তাসের ওপর শুয়ে কোথায় চলেছি- হাওয়ার সঙ্গে ভেসে ভেসে! (Horror Story)
তাসখানা ভাসতে ভাসতে এসে আমায় একটা চারদিক আঁটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে নামিয়ে দিল। দেখলাম সেই অন্ধকারে বসে দুজন এক মনে তাস খেলছে। বিনু আর একটি ছোট ছেলে-সুন্দর দেখতে, থোকা থোকা কোঁকড়া চুল চাঁদের মতো কপালের উপর ছড়িয়ে পড়েছে। ঠিক যেন বিনুর ছোট ভাইটি। বিনু তার সঙ্গে খেলতে লাগল, আমার দিকে একবার চেয়েও দেখল না। আমার ভারি রাগ হল-হিংসেও হল। এরই মধ্যে দুজনের এত ভাব! আমি মুখ গোঁ করে রইলাম। (Horror Story)
ছেলেটি একবার তাস থেকে মুখ তুলে মিষ্টি সুরে জিজ্ঞাসা করল— “এ কে, বিনু?”
বিনু গম্ভীর গলায় বলল— “ও মল্লি!” সে বলল— “বেশ হল। আমরা তিনটি ভাইয়ে কেমন একসঙ্গে এইখানে থাকব!”
আমি রেগে চিৎকার করে উঠলাম— “না, না— আমি এখানে কিছুতেই থাকব না!”
অমনি হরতনের গোলাম এসে আমায় পিঠে করে তুলে নিল। বিনু সেটার উপর লাফিয়ে চড়তেই সেখানা ভারি হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। মজা দেখে ছেলেটা খিলখিল করে হেসে উঠল। (Horror Story)
আমি ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম। চারদিক থেকে অন্ধকারগুলো ছুটে এসে আমাদের সামনে তালগোল পাকিয়ে পথ আটকে দাঁড়াল! যেন আমরা পালাতে না পারি।
(Horror Story) বিনু বলল-‘দাঁড়া, আমরা তিন জনেই এক সঙ্গে যাব।”- বলে সে ছেলেটির কানে কানে কী বলল। ছেলেটি বলল- “চলো, যাই।” কিন্তু উঠে দাঁড়াতে গিয়েই ধূপ করে পড়ে গেল। দিনরাত এক জায়গায় বসে থেকে থেকে তার পা অসাড় হয়ে গেছে। বিনু তাকে কোলে করে তুলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তাসগুলোকে কী বলল, তারা ফরফর করে উড়ে এসে পাখির মতো ডানা ছড়িয়ে দাঁড়াল। আমরা উড়তে যাচ্ছি, এমন সময় কড়িকাঠ থেকে দুটো কালো চামচিকে এসে তাসগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর দুই দলে যা যুদ্ধ।-আঁচড়াআঁচড়ি, কামড়াকামড়ি! আমি ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম। চারদিক থেকে অন্ধকারগুলো ছুটে এসে আমাদের সামনে তালগোল পাকিয়ে পথ আটকে দাঁড়াল! যেন আমরা পালাতে না পারি। ছেলেটি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল- “বিনু, দেখেছিস তো, এরা অমায় যেতে দেবে না! তোরা কেন প্রাণে মরবি? পালা!” বিনু বলল-“না ভাই, তোকে ছেড়ে কিছুতেই যাব না।” চামচিকে দুটো তাই শুনে ফ্যাঁস করে উঠল। এমন সময় হরতনের গোলামটা ছুটে গিয়ে একটা চামচিকের পেটে সজোরে এক ঘুষি বসিয়ে দিল। চামচিকেটা তার ধারাল নখ দিয়ে হরতনের গোলামখানাকে আঁকড়ে ধরে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল, আর সেই ফাঁকে অন্য তাসগুলো আমাকে নিয়ে উড়ে পালাল। বিনু আর সেই ছেলেটি দেখলাম সেই ঝটাপটির মধ্যে হিমসিম খাচ্ছে। আমি তাসের উপর থেকে হাত বাড়িয়ে বিনুকে ডাকতে লাগলাম- “বিনু, আয় আয়!” বিনু আমার দিকে ফিরেই চাইল না; ছেলেটাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রইল। আমার কান্না পেতে লাগল! তাসগুলো উড়তে-উড়তে এসে আমাকে বিছানায় ফেলেই উড়ে গেল-বোধ হয় বিনুদের উদ্ধার করতে। তারপর কী হল জানি না! (Horror Story)

“মল্লি! মল্লি”
আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ঝড়ের মতো ধাক্কা দিয়ে কে ঘরের মধ্যে ঢুকল। সকালের আলোয় ঘরটা আলো হয়ে উঠল। মনে হল যেন একটা প্রকান্ড দুঃস্বপ্ন কেটে গেল। আমি ছুটে গিয়ে দুই হাতে বিনুর গলা জড়িয়ে ধরলাম-“বিনু, এসেছিস ভাই, এসেছিস?”
সে বলল— “আসব না তো কী! তুই স্টুপিড এত বেলা অবধি ঘুমচ্ছিস কেন?”
আমি বললাম— “কখন এলি ভাই!”
সে বলল— “অনেকক্ষণ! তোকে ডেকে ডেকে আমার গলা চিরে গেল।
তোর আজ হয়েছে কী? চোখ অমন রাঙা কেন?” আমার ধাঁধা লাগল।
বিনু তো সবই জানে, তবে এমন আশ্চর্য হচ্ছে কেন?
আমি আমতা আমতা করে বললাম— “কাল রাত্রে তুই খেলতে খেলতে হঠাৎ অমন অন্তর্ধান-“
সে বাধা দিয়ে বলল— “আমি কেন অন্তর্ধান হতে যাব? তুইতো খেলা ফেলে চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলি।” (Horror Story)
আমার আরও ধাঁধা লাগল। একী ঘুমের ঝোঁকে সবই স্বপ্নের মতো দেখলাম! কিন্তু এত যে কান্ড, সে সবই স্বপ্ন? ইচ্ছা হচ্ছিল আগাগোড়া সব কথা বিনুকে খুলে বলে হেঁয়ালিটা পরিষ্কার করে নিই, কিন্তু পারলাম না। দিনের আলোয় কথাগুলো এমন অদ্ভুত বোধ হতে লাগল যে বলতে লজ্জা হল। আমার ভূতের ভয়ের জন্যে বিনু যা আমায় ঠাট্টা করে! (Horror Story)
বিনু বলল— “কী ভাবছিস? চল বাইরে যাই।”
আমরা দুই বন্ধুতে আমাদের সেই বাইরের ঘরে গিয়ে দেখি-ঘরময় তাস ছড়ানো; সমস্ত দেহ তাদের ক্ষত বিক্ষত। তাদের বুকের উপর কে যেন মনের আনন্দে ধারালো নখ দিয়ে কেবল আঁচড়ের পর আঁচড় টেনেছে।
বেশ বোঝা গেল রাত্রের মধ্যে খুব একটা মারামারি কাণ্ড হয়ে গেছে। আমি সভয়ে বিনুর দিকে চেয়ে বললাম-“বিনু দেখছিস!”
বিনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“আমারই জন্যে তাসগুলো গেল!” (Horror Story)
“আঁ! তোমারই জন্যে? তার মানে?-সেই চৌখুপি ঘর থেকে তোমাকে উদ্ধার করবার জন্যে? তা হলে তো সবই ঠিক!” কিন্তু বিনুর মুখ দেখে কিছু বুঝতে পারলাম না। একটু ইশারা পাবার আশায় আমি বিনুকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম-“কী করে এমন হল বিনু!” বিনু কোনও জবাব দিল না, শুধু আঙুল দিয়ে ভাঙা আলমারিটা দেখিয়ে দিল। (Horror Story)
সে কোথায় আছে আমি জানি। সে আছে, সেইখানে- সেই চারদিক বন্ধ চৌখুপির মধ্যে, যেখানে সেই নয় বছরের সুন্দর ছেলেটি চিরদিন একা অন্ধকারে বসে আছে।
আমি আলমারি খুলতেই একরাশ আরশোলা ফরফর করে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল। তারপর ডানা মেলে উড়ে অন্ধকার কোণের একটা গর্ত দিয়ে কোথায় চলে গেল- বোধ হয় মাটির তলা দিয়ে সেই চৌখুপির মধ্যে। আমি হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলাম।
বিনু বলল-“তাসগুলো কুড়ো!”
আমি তাসগুলো কুড়িয়ে, গুছিয়ে দেখি সবই আছে, কেবল একখানা
নেই- সেই হরতনের গোলাম!
তবে?
এই তো ঠিক মিলছে! সেই হরতনের গোলাম-যাকে নিয়ে কাল রাত্রে ওই সমস্ত অদ্ভুত ঘটনার উৎপত্তি-সে নেই কেন? সে গেল কোথা? (Horror Story)
সে কোথায় আছে আমি জানি। সে আছে, সেইখানে- সেই চারদিক বন্ধ চৌখুপির মধ্যে, যেখানে সেই নয় বছরের সুন্দর ছেলেটি চিরদিন একা অন্ধকারে বসে আছে। কালকের সব কাণ্ড বিনু নিশ্চয় ভুলে গেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে তার আর কিছুই মনে নেই। তার যে ঘুম! এমন তো আমারও এক একদিন’ হয়। রাতের ঘটনা স্বপ্ন দেখার মতো সকালে সব ভুলে যাই। কাল রাত্রে আমি যদি ঘুমিয়ে পড়তাম, তা হলে আমিও হয়তো সব ভুলে যেতাম। আজ সকালে উঠে অবাক হয়ে ভাবতাম-তাই তো হরতনের গোলাম বেচারা গেল কোথায়? (Horror Story)
বানান অপরিবর্তিত
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।