নববর্ষে (Bengali New Year) ঘর সাজানোটা (Interior decoration) বাঙালি ঘরের আবহমান রীতি। আমাদের ছোটবেলায় চৈত্র মাসের শেষদিকেই শুরু হয়ে যেত সাফাই অভিযান। বালিশ-তোষক রোদে দেওয়া,বইয়ের তাকে জমে ওঠা ধুলো আর ঘরের কোণে ঝুল পরিষ্কার, ফ্যানের ব্লেড মোছা, রান্নাঘরের তেলচিটে স্ল্যাব ঘষা, চায়ের বয়াম থেকে মশলার কৌটো – কিছুই বাদ যেত না। এই ‘ঝেঁটিয়ে বিদেয় কর’ নামক কর্মযজ্ঞে সামিল হত বাড়ির সকলেই।
নববর্ষের দিন নতুন বিছানার চাদর, বালিশের কভারে ঘর নতুন আনন্দে সেজে উঠত, আমরা ছোটরাও তখন স্কুলের কর্মশিক্ষার বাক্সটা খুলে বসতাম। কাঁথাস্টিচের নক্সাকাটা টেবিল ক্লথ, মোমের পুতুল, চাঁদমালা ইত্যাদি বেরিয়ে পড়ত খাটের তলার বড় ট্রাঙ্ক থেকে। পর্দায় ফেব্রিক রঙে তুলি বুলিয়ে ঘর সাজাতাম।
আর কয়েকদিন পরেই নববর্ষ। আপনারাও এই ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ মেতে উঠতে পারেন। ফিরে যেতে পারেন ছোটবেলার ওয়ার্ক এডুকেশন ক্লাসে। এবারের নববর্ষে বাইরে থেকে দামি দামি জিনিসপত্র কিনে ঘর সাজানোর বদলে অপ্রয়োজনীয় ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে সাজিয়ে তুলুন নিজের বাড়িকে ।
প্লাস্টিকের চামচ দিয়ে ঘড়ি (Wall clock)
উপকরণ- ছোট গোল ঘড়ি, ৩০ টা প্লাস্টিকের চামচ, ফেভিকল, কয়েকটা ছোট আয়না, সোনালী স্প্রে রঙ।
পদ্ধতি – প্লাস্টিকের চামচ নিয়ে ( অর্ধেক চামচ গোটা রাখতে হবে আর বাকি অর্ধেক চামচ মাঝখান থেকে ভেঙে নিতে হবে) স্প্রে রঙ দিয়ে পুরো রঙ করে নিতে হবে।একটা ছোট গোল ঘড়ির চারপাশে ওই একই রঙ দিয়ে স্প্রে করে নিতে হবে। চামচের রঙ ভালো করে শুকিয়ে গেলে গোটা চামচগুলোর নীচের দিকে ফেভিকল লাগিয়ে ঘড়ির চারপাশে গোল করে পিছনদিকে একটু ফাঁক ফাঁক করে লাগিয়ে নিতে হবে। এরপর বাকি অর্ধেক চামচ যেগুলো মাঝখান থেকে ভেঙে রাখা ছিল, সেগুলো নিচের দিকে ফেভিকল লাগিয়ে দুটো লম্বা চামচের মাঝে যে ফাঁকটা আছে, সেখানে লাগিয়ে নিতে হবে। ফেভিকল ভালো করে শুকিয়ে গেলে চামচগুলোর মধ্যে ছোট ছোট আয়না লাগিয়ে নিজের মতো সাজিয়ে নিতে হবে।
প্লাস্টিকের ঢাকনা দিয়ে উইন্ড চাইম (Wind chime)
উপকরণ- প্লাস্টিকের কৌটোর গোল ঢাকনা, এক্রেলিক রং, তুলি (৭,১,০ নং), উল, পুঁতি, পাতলা পিসবোর্ড, পেন্সিল, কাঁচি, কালো মার্কার পেন।
পদ্ধতি- প্লাস্টিকের গোল ঢাকনাকে এক্রেলিক রং দিয়ে ভালো করে রং করে শুকিয়ে নিতে হবে। পিসবোর্ডগুলো মাছের আকারে কেটে নিতে হবে। মাছগুলো রং করে নিন। মাছের রং শুকিয়ে গেলে তার মধ্যে কালো মার্কার দিয়ে সুন্দর করে এঁকে নিতে হবে। এবার গোল ঢাকনার চারপাশ দিয়ে একটু ফাঁক ফাঁক করে ফুটো করে রাখতে হবে এবং মাছের সাইডেও ফুটো করে নিতে হবে। ঢাকনার ফুটো দিয়ে উল ঢুকিয়ে তার মধ্যে ৫/৭ টা পুঁতি লাগিয়ে লম্বা করে মাছের মধ্যে করে রাখা ফুটোর সাথে জুড়ে দিতে হবে। এভাবে প্রত্যেকটা মাছ উল দিয়ে ঢাকনার সাথে জুড়ে নিতে হবে এবং উলগুলো একটু ছোট থেকে বড় এভাবে মাপ করে আটকে নিতে হবে। এরপর ঢাকনার চারপাশে পুঁতি লাগিয়ে নিতে হবে। এবার ঢাকনার উপরেও একটা ফুটো করে তার মধ্যে উল দিয়ে হুক করে ঝুলিয়ে দিতে হবে।
আইসক্রিমের কাঠির টেবিল ল্যাম্প (Table lamp)
উপকরণ- ৩০০ টি আইসক্রিমের কাঠি, ফেভিক্রীল এক্রেলিক রং, তুলি ৭ নম্বর, ফেভিকল, ইলেকট্রিক তার, বাল্ব হোল্ডার, বাল্ব।
পদ্ধতি- প্রথমে আইসক্রিমের কাঠিগুলো ফেভিক্রীল এক্রেলিক রং দিয়ে ভাল করে রং করে নিতে হবে । রং ভাল করে শুকিয়ে গেলে ওই কাঠির উপর ফেভিকল দিয়ে তুলির সাহায্যে পুরো কাঠির মধ্যে আঠা লাগিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে, (এতে কাঠি নষ্ট হয়ে যায়না)। সব কাঠি ভাল করে শুকিয়ে গেলে চারটে করে বিভিন্ন রঙের কাঠি ফেভিকল দিয়ে চৌকো করে জুড়ে নিতে হবে। প্রায় ২০০টা কাঠি এভাবে চারটে করে একসাথে জুড়ে আলাদা আলাদা চৌকো সেট বানিয়ে রাখতে হবে। এবার একটা করে চৌকো সেট নিয়ে ফেভিকল দিয়ে একটা চৌকো কাঠির সেট আরেকটা চৌকো কাঠির সেটের উপর একটু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বসাতে হবে (ছবিতে যেমন আছে)। এভাবে ২০০টা কাঠি একটার উপর আরেকটা জুড়ে নিতে হবে। ল্যম্পের স্ট্যান্ড তৈরি।
এবার বাকি কাঠিগুলো ফেভিকলের সাহায্যে প্রথমে ৮টা কাঠি একটার সাথে একটা জুড়ে কিছুটা ষড়ভুজ আকারে তৈরি করে নিতে হবে। বাকি কাঠিগুলো ওই ষড়ভুজ আকারে তৈরি করা কাঠির উপর একটু ভেতরের দিকে করে একই ভাবে জুড়ে নিতে হবে। এমনভাবে সাজাতে হবে, সেটা নীচের দিকটা চওড়া থেকে উপরে ছোট হতে থাকবে। এভাবে করতে করতে উপরে চারটে কাঠিতে শেষ হবে। ল্যম্পের শেড তৈরি। আগে যে লম্বা স্ট্যান্ড তৈরি করা হয়েছে, তার উপরে শেডটা বসিয়ে দিতে হবে। এবার হোল্ডারে বাল্ব লাগিয়ে ইলেকট্রিক তারের সাথে প্লাগে লাগালে তৈরি আইসক্রিমের কাঠির ল্যম্প শেড।
পিসবোর্ড বাক্স দিয়ে ল্যাম্প শেড (Lamp shed)
আজকাল আমরা সবাই কমবেশী অনলাইনে কেনাকাটা করি, আর সেই কারণেই আমাদের বাড়িতে বিভিন্ন মাপের অনেক বাক্স আসে। সেগুলো ফেলে না দিয়ে ঘর সাজানোর উপাদান করে নিতে পারি।
উপকরণ- পিসবোর্ডের চৌকো বাক্স, এক্রেলিক রং (কালো/যে কোনো কালার), ৭ নং তুলি, সরু ধারালো কাটার/ সরু ছুরি, ইলেকট্রিক তার, বাল্ব ও হোল্ডার।
পদ্ধতি- বাক্সটার নীচের দিক কেটে নিতে হবে। এবার চারদিকে সুন্দর করে এঁকে নিতে হবে (আমি গনেশের মুখ এঁকেছি, নিজের ইচ্ছেমতো এঁকে নেওয়া যাবে ) এই আঁকার উপর দিয়ে আস্তে আস্তে সরু কাটার দিয়ে কেটে নিতে হবে। কেটে নেওয়ার পর বাক্সটাকে পুরো রঙ করে শুকিয়ে নিতে হবে (ভেতরের দিকেও রং করতে হবে)। এরপর বাক্সটার উপরের দিকে গোল করে কেটে নিয়ে তাতে হোল্ডার লাগিয়ে নিতে হবে এবং নীচের দিক থেকে বাল্ব লাগিয়ে ইলেকট্রিক তারের মাধ্যমে ঝুলিয়ে দিতে হবে। তৈরি ঝুলন্ত ল্যাম্প শেড।
ওয়াল পেন্টিং (Wall painting)
সবশেষে বলি, একটা ওয়াল পেন্টিং করতে পারেন বসার ঘরে। বড় দেওয়াল জুড়ে ওই এক রঙা ছবিটা একটা আলাদা মাত্রা এনে দেবে।
উপকরণ- পেন্সিল, তুলি (২,৫ নং), কালো পোস্টার রং
পদ্ধতি- দেওয়ালটা ভাল করে পরিষ্কার করে নিয়ে পুরো দেওয়াল জুড়ে একটা সুন্দর ছবি এঁকে তার আউটলাইনটা তুলি দিয়ে কালো রং (ঘরের দেওয়ালের সঙ্গে মানানসই রঙ) করে নিলে ঘরের সৌন্দর্য কয়েক গুণ বেড়ে যাবে (আঁকাটা ইচ্ছে মতো এঁকে নিতে পারেন)।
ছবি সৌজন্য: লেখক
নৃত্যশিল্পী- ছোটোবেলায় তনুশ্রী শঙ্কর ও পরে মমতা শঙ্করের কাছে তালিম নিয়েছেন। প্রধান শখ রান্নাবান্না, অন্দরসজ্জা আর পোশাক পরিকল্পনা।