বয়স বাড়ার ওই এক ঝামেলা! যার যা নেই, সেটাই যেন বেশি করে করতে মন চায়। ছোটবেলা, মেজোবেলা, পরিণতবেলা পার করে, এখন এই পড়ন্ত বেলায় সেই হু হু যেন আরও বেড়েছে। জ্যান্ত গলার গান শুনতে শুনতে যান্ত্রিক গান যেমন আর শুনতে ইচ্ছে করে না, তেমনি ছবির পর্দায় নূতন, উত্তমকুমার, সঞ্জীবকুমার বা বলরাজ সাহানীদের ‘মতো’দেরও আর দেখতে ইচ্ছে করে না। সেরকমই আবার পুরনো সময়ের সূত্রে পাওয়া নতুন কিছু দেখলেই মন উসখুস করে বলে ওঠে, ‘নিকুচির একশেষ! আমাদের সময় এত ‘মাতন’ ছিল না, বরং যা কিছু মাতামাতি বাড়িতেই ছিল’।
আবার গুমরে গুমরে শুধু যে চুপ মেরে যাব তাও নয়। নানাভাবে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখে লিখে একেবারে বরবাদ করে দেব এখনকার এই সময়টাকে। বাচ্চাগুলো তাতে আরও আরও অসহিষ্ণু হয়ে ভাববে, ‘চুলোয় যাক টেপজামা পরা পয়লা বৈশাখ, চুলোয় যাক ঘরে ঘরে হাতপাখার বাতাস-টানা শুভেচ্ছা বা ‘মধ্য দুপুর – পায়ের নূপুর’ মার্কা সেই যৌবনের রোমান্স! কে বলেছে চিল্ড বিয়ারে সেই স্বাদ নেই, বা অনলাইনে আনানো ফিশ প্ল্যাটারের সঙ্গে মাটির গ্লাস-সহ আম-পুদিনার শরবতে! টেপজামার বদলে নামী ব্রান্ডের লিনেন-টপের সঙ্গে বাহারি ছিটের কটন শার্টসই বা কম কিসে! কিংবা, বন্ধুদের ডেকে অর্ডারি পান্তাভাত আর আলুমাখার সঙ্গে কুচোচিংড়ি আর পোস্তর বড়া? গান-আড্ডা-হুল্লোড়ে কিছুক্ষণের মাতন সে তো ভালোই।’
পয়লা বৈশাখ তো আসলে একটা ছুটির দিন! বিদেশ-বিভুঁই বা নিজের ঘরে নস্টালজিয়ায় ভুগে একা একা না কাটানোই তো ভাল! ক্ষতি কী যদি সেদিন নতুন শাড়ির বদলে বিছানায় একখানা নতুন শীতলপাটিই বিছোতে ইচ্ছে করে! নতুন গামছা দিয়ে সেদিন গা-হাত-পা না মুছে বরং স্কুটি চালানোর সময় ধুলো বা রোদ থেকে বাঁচতে তা না হয় স্টাইল করে মাথাতেই জড়ানো রইল! মনে পড়ল, আরে, আমার ছোটবেলায় দেখা ধীরেনদা বা প্রফুল্ল ‘চাষার’ সেই স্টাইলটাই তো এখন প্রখ্যাত ফ্যাশন -আইকন বিবি রাসেলের মাথায় ফিরে এসেছে!
আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: বুড়ি! থুড়ি থুড়ি: ‘দিও রঙিন করি’
যে সব পালা-পার্বণের স্মৃতি আমাদের মনে, তার মূলে ছিল ধর্মীয় লোকাচার এবং প্রকৃতি পুজো। সময়ের ফুল-ফল গাণ্ডেপিণ্ডে খেতে শুরু না করে একটু উৎসর্গ করে খাওয়া! তা শুধু তো দেবতাকে নয়, বরং পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন এমনকী শত্রুকেও একটু দেওয়া থোয়া। ঘরটা শুধুমাত্র সাফ সুতরো করে নিকিয়েই নয়, সেই সঙ্গে একটু সাজিয়েও রাখা। সবাই মিলে ‘একস্থান’ হয়ে সেইসব নাচগান ছিল লোকাচারেরই অঙ্গ! সঙ্গে একখানা নতুন শাড়ি বা ধুতি, নিদেনপক্ষে একটা গামছা, লোকাচারের এই আয়োজনটুকু মনের মধ্যে আগে থেকেই রোপন না থাকলে মনে হবে অযথা চাপ, কুসংস্কার। না-করলে-কী-হয় গোছের কূটকচালে মনোভাব। অন্যদিকে, দিন বদলের পালায় সহজ যাপনকেই কৌশলে মান-প্রাপ্তির পথ করে তুলে রিলস বা ইন্সটাগ্রামের বদান্যতায় আরও মেকি এক উৎসব পালনে শামিল হওয়া। পরব মানে যে যাপনেরই এক ‘পর্ব’ এবং পালন মানে যে ‘যুক্ত’ হওয়া, সেটা কি আমরা শিখিয়েছি বা শেখাতে চেষ্টা করেছি এখনকার এই বুদ্ধিমান প্রজন্মকে! ‘বাঈ’ ললিতার প্রশ্নটাই তাই যেন ঘুরে ফিরে পাক খাচ্ছে মনের ভেতর- ‘তোমরা কীভাবে পালন কর তোমাদের নববর্ষ?’ কী করে আর বলি, কলকাতা দূরদর্শনের সেই হারিয়ে যাওয়া ‘নববর্ষের বৈঠক’ সমেত ছোটবেলার স্মৃতিকাতরতায় ভুগে ভুগে!

তবে, এবার আমার নববর্ষ এসেছে একেবারে রৈ রৈ রঙ্গে, হাওয়া বদলের আনন্দ জাগিয়ে। ভাগ্যিস তা বাংলার বাইরে কাটল, তাই তো কত রকম নববর্ষ যাপন একেবারে চোখের ওপর দেখতে পেলাম, একেবারে সাজো সাজো রবে। কলকাতার মতোই মুম্বাইতেও নববর্ষের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় ক্যালেন্ডারে দাগানো ছুটি আর রোজকার বাজারে সে দিনের আমদানি সাজিয়ে। মুম্বাই এমন এক শহর, যেখানে গুজরাটি, কর্ণাটকি, কোঙ্কনি এবং অন্ধ্রের সাধারণ মানুষের ছড়াছড়ি। আছে বাঙালি এবং নর্থ ইস্টের বহু সাধারণ মানুষও। এরা সকলেই বহুবছর ধরে মুম্বাইবাসী, কিন্তু সকলের মাথার মধ্যেই ঘুরে বেড়ায় তাদের নিজেদের প্রদেশ ও গ্রামখানি। সে সব অঞ্চলের নাম গুগুল বাবাজি এখনও গুলে খেতে পারেনি। এদের মধ্যে কিন্তু সশরীরে আসা-যাওয়াটা ঠিকই লাগু আছে। এদের হাতে হাতে স্মার্ট ফোন থাকলেও সুইগি-জিনির সুবিধে নেই। বরং দূরদূরান্ত থেকে তাদের এখানকার বস্তির ভাড়া ঘরে এসে পৌঁছে যায় দেশি চাল, লাড্ডু, ঘি, নারকেল আরও কত কিছু।

আগেরবার মেয়ের অন্য এক পরিচারিকা সুমন খাইয়েছিল পুরণপুলি। তাতে ছিল চিনাবাদাম, আটা আর গুড়ের স্বাদ। রুটির মতো বেলে বানানো একেবারে মসৃণ এবং গোল। সাইজেও বড়। সে নিজে কর্ণাটকি হলেও জন্ম থেকে মুম্বাইতে থাকায় মারাঠি রেসিপি সহজেই শিখেছে। এবারে ‘উগাডি’র দিন ছুটি নিয়ে এখনকার ‘বাঈ’ ললিতাও পরদিন নিয়ে এল পুরণপুলি। এটা আবার ডাল দিয়ে বানানো। বলল, মারাঠিদের মতো না বেলে হাতেই গোল করে বানিয়েছে। সাইজে তাই মাপসই হয়েছে। সঙ্গে আবার কৌটো ঘরে বানানো গন্ধ-ভুরভুর ‘ভঁইষা- ঘিউ’। ননস্টিক তাওয়ায় একটু সেঁকে, ঘি ছড়িয়ে দিতেই লা জবাব। মনে হয়, আমাদের ঘটি-বাঙাল লড়াইয়ের মতোই নিজেদের অস্তিত্ব অনুযায়ী এদেরও রান্না নিয়ে দুরন্ত ‘তফাৎ’ আছে। আহা, ভাগ্যিস তা আছে এবং জারিও আছে !
যে সব পালা-পার্বণের স্মৃতি আমাদের মনে, তার মূলে ছিল ধর্মীয় লোকাচার এবং প্রকৃতি পুজো। সময়ের ফুল-ফল গাণ্ডেপিণ্ডে খেতে শুরু না করে একটু উৎসর্গ করে খাওয়া! তা শুধু তো দেবতাকে নয়, বরং পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন এমনকী শত্রুকেও একটু দেওয়া থোয়া। ঘরটা শুধুমাত্র সাফ সুতরো করে নিকিয়েই নয়, সেই সঙ্গে একটু সাজিয়েও রাখা।
মেয়ে তো অর্ধেক খেয়েই ছবি তুলে ফেলল। নাতি ছুঁয়েও দেখল না। বাঙালি পরিচারিকা প্রমীলা বলল, তার নাকি সুগার এবং ঘি সহ্য হয় না। ফলে দেড়খানা সাঁটিয়ে তক্কে তক্কে আছি বাকি দুখানাও উদরস্থ করার। আমার তো আর প্রাণ যাওয়ার ভয় নেই! বয়সের বেশিটাই মেরে এনেছি। তার ওপর পাথর খেয়ে হজম করা এক পাহাড়ি পেট ! ফলে, চক্ষু লজ্জা ছাড়া আর আছেটা কী যে সতর্ক হব! একলা থাকা সাদামাটা ললিতার এই আদর অতুলনীয় ।
‘গুডি পাডোয়া’ মূলত মারাঠি এবং কোঙ্কানি হিন্দুদের উৎসব। মহারাষ্ট্রে এদিন স্কুল-কলেজ,দপ্তরখানা, কোর্ট সব জায়গায় সরকারি ছুটি। এখানকার মেয়েরা এদিন মারাঠি কেতায় কাছা দিয়ে শাড়ি পরে। কানের ওপর অংশে ‘বুগুড়ি’ এঁটে, বেণীতে মালা লাগিয়ে মন্দিরে যায়। আর ঘরে ঘরে বানানো হয় পুরণপুলি; আমাদের বাঙালি স্বাদে যা হল মিষ্টি ডালপুরি বা বাদাম পুরি। এখানে এটাই এদের বসন্ত উৎসব। ‘পাডোয়া’ মানে প্রতিপদ, শুক্লপক্ষের প্রথম দিন। আর ‘গুডি’ হল মানত করার আয়োজন। লাঠির আগায় কাপড়ের একখানা পতাকা লটকে, ফুলমালা, আমপাতা এবং পাতাসমেত নিমডাল দিয়ে তা সাজিয়ে, সেই লাঠিটার মাথায় উল্টো করিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয় একটা তামার ঘটি। তবে বাজারে যে রেডিমেড ‘গুডি’গুলো বিক্রি হচ্ছিল, তার মাথায় বসানো ছিল স্টিলের ঘটি। এই আয়োজন দিয়ে এরা সুবাতাসকে আহ্বান করে। একই সঙ্গে ঘরের চারপাশ থেক বিষ বাতাস তাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে আবার জবরদস্ত আধুনিক যুবতীরাও মারাঠি কেতায় সেজে, মাথায় পাগড়ি এঁটে স্কুটি মিছিল বার করে।

তবে খুশির বাঁধ ভেঙেছে ফেসবুক দেখে। কলেজস্ট্রীট পাড়ায় পাবলিশার্সের আমন্ত্রণে কত অসংখ্য মেয়েরা গেছে। বাংলায় কবিতা-গল্প-উপন্যাস লিখে, ‘লেখক’ হিসেবে পাবলিশার্সদের কাছে থেকে পাওয়া এই স্বীকৃতি এবং আমন্ত্রণ, ‘এ কী সহজ গান’! লালাপাড় শাড়ি, চিতল রসা, পুজোপাঠ, বাড়ির দেখভাল, এসবের পাশাপাশি লেখক বলে এই যে নিজেদের ভাবতে পারা এবং মেধার এই যে চর্চা, এ বোধহয় শুধু এই বাঙালি সংস্কৃতিতেই আছে! একদল লেখকের এই ফটোগুলো দেখতে দেখতে মনে হল, ললিতার কাছে এই তো আমার উত্তর! কারণ, এখন তো এই আমার নববর্ষ! কলম,থুড়ি টাইপের তোড় আর প্রকাশকের তোড়জোড়!
তবে খুব মনে ধরেছে, ‘বাঈ’ ললিতার সেই আপ্তবাক্যখানি। নববর্ষের আগের সন্ধেতে ‘চারবাংলা’ মার্কেট ঘুরে এসে ওর কাছে যখন জানতে চাইলাম এতগুলো পরব, মিঠি ঈদ পার করেও বাঙালি নববর্ষের বাজার এমন আগুন কেন? ললিতা বলল, এখানে বড়লোক বাঙালিরাই তো থাকে। সেই জন্যেই সাদা মল্লি মালা, নারিয়েল পানি,তাল গুটলি (তালশাঁস),আম,পান-সুপারি আর বাঙালি মচ্ছির আজ এত দাম। ‘বাঙালি ধনী!’ এ ধ্বনি যে কী মধুর শোনাল আমার কানে সে আর কী বলি!
বড় আপন হয়ে এল ১৪৩১। চৈত্র অবসানে, ভরসোভা বিচে গিয়ে ‘দরিয়া’-কে প্রণাম জানিয়ে যে প্রার্থনা জানিয়েছি, সেই শুভেচ্ছাই আজ জানাই সবাইকে।
অন্তরের শুভেচ্ছা এবং সর্বাঙ্গীণ শুভকামনায় শুভ নববর্ষ ‘১৪৩১’।
ছবি সৌজন্য: লেখক, yourhungerstop, Antara Psychiatric Centre
আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।