(Bengali Novel)
আগের পর্ব- [১],[২],[৩],[৪],[৫]
জুলাই মাস। বাইরে আজ দাবদাহ ছড়াচ্ছে। রাত্রি প্রায় বারোটা। নিজের বিছানায় শুয়ে ভিডিও দেখছেন সোমদত্তা। ঘরের আধা অন্ধকার জুড়ে শুধু এসির মৃদু গুঞ্জন। চার মাস পেরিয়ে গেছে সোনালী আর মলয়ের বিয়ের। এই ভিডিওতে তিন প্রজন্মের বৌ রান্নাঘরে সবার মাথায় ঘোমটা। ভিডিও পজ করে সোনালীর দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি, মুখে তৃপ্তির হাসি। ছোট্ট কপাল, কোঁকড়ানো চুল। শ্যামলা, ছেলেমানুষী মাখা মুখ, বিভূতিভূষণের গল্পের মতো, বাংলার অতল ছেনে এমন মায়াময় মুখশ্রী দেখা যায়। ঠাকুমা আজ খুদ সেদ্ধ করছেন, রসুন, লঙ্কা, কালোজিরে ফোড়ন দেওয়া সর্ষের তেল দিয়ে। তার সাথে আছে লাল ঢেঁকি শাক আর কড়া করে ভাজা টাটকা সরপুঁটি মাছ। নদী থেকে মলয়ের বাবা আর খুড়তুতো ভাইরা ধরে এনেছে। (Bengali Novel)
আজ অনেকদিন বাদে ঠাকুরদাও বসে আছেন। ওঁর সঙ্গে ইতস্ততঃ ইয়ার্কি ঠাট্টা হচ্ছে। মাছ ধরা নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে।
আজ অনেকদিন বাদে ঠাকুরদাও বসে আছেন। ওঁর সঙ্গে ইতস্ততঃ ইয়ার্কি ঠাট্টা হচ্ছে। মাছ ধরা নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। হঠাৎ মলয়ের বাবা সোনালীর দিকে তাকিয়ে বললেন
‘ওরে তোরা তাড়াতাড়ি খেয়ে ওঠ। বেলা কত হল, মায়ের আমার খিদেতে মুখ শুকিয়ে গেছে।’ (Bengali Novel)
আহা। সোমদত্তার বুকটাও কেমন করে উঠল। ইয়েস। একদম ক্যান্ডিড। এত সুন্দর করে কথা বলেন সুবোধ। (Bengali Novel)
মানুষটা বড় ভাল। খুব নরম সবার প্রতি। (Bengali Novel)

‘লেটস ব্রিঙ হিম মোর’। নিজের মনেই বলে উঠলেন তিনি।
তখনই মলয়কে ফোন করলেন তিনি। ভিডিও কল। রাত্রি একটা বেজে গেছে। (Bengali Novel)
কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে পাশাপাশি দু’জনে বসে। সোনালী বাবু হয়ে, মুখটা একটু শুকনো। ক্লান্ত মনে হচ্ছে। মলয়ের গায়ে একটা হাতকাটা গেঞ্জি। ঘরে টিউব লাইট জ্বলছে। পেছনে বেশ গাঢ় গোলাপি রঙের দেওয়াল। বার্নিশ করা নতুন খাটের ছত্রী দেখা যাচ্ছে। (Bengali Novel)
“কেমন আছো সোনালী”?
“ভাল দিদি”।
হঠাৎ করেই বলে উঠলেন তিনি-
“খুব ভাল কাজ করছ তুমি। আঙুল গুনে গুনে বললেন-
“বাবা, মা, ঠাকুমা, কাকা, কাকিমা, ভাইরা- চমৎকার জেল করে গেছ। ঠিক যেমনটা আমি ভেবেছিলাম।”
সোনালী একটু লজ্জা পেয়ে গেল। শহুরে প্রশংসার উত্তরে কী বলতে হয়, তা এখনও শেখেনি ও।
“ভাল কথা মলয়, তোমার ঠাকুরদা কেমন আছেন?”
‘ভালো দিদি’। এখন নতুন বাড়ির দরজায় এসে বসে। কথা বলে। আগের কটা ভিডিওতে ছিল তো?
খুব হাসি খুশি। এখন আপনাদের আশীর্বাদে ওষুধপত্র..’
কথা কেটে সোনালী বলে উঠল ‘টনিক, টনিক খাচ্ছে তো’ সোমদত্তার কানে ওর গ্রাম্য কথাটা কেমন ঝনঝন করে উঠল। ওকে বলতে হবে, একটু আস্তে কথা বলতে।
হ্যাঁ আগের দিন দেওয়াল, দরজা জানলা আপনাকে দেখিয়েছিলাম দিদি, ঠাকমা-দাদুর ঘর কমপ্লিট, বাকি ঘরও উঠছে সামনেটাতে মার্বেল বসানো হয়ে গেছে।
“হুম দেখলাম।” একটু অন্যমস্কতা থেকে সোমদত্তা দু’টো হাত জড়ো করে নিজের থুতনির নীচে রাখলেন।
“আচ্ছা ক’দিন আগের একটা এপিসোডে দেখলাম, উনি মানে তোমার ঠাকুরদা যেখানটাতে বসেছেন, পেছনে একটা হল মতো মনে হচ্ছে, মার্বেল বসানো পেছনে সিমেন্টের বস্তা, তোমাদের নতুন বাড়ি তো?’‘
“হ্যাঁ আগের দিন দেওয়াল, দরজা জানলা আপনাকে দেখিয়েছিলাম দিদি, ঠাকমা-দাদুর ঘর কমপ্লিট, বাকি ঘরও উঠছে সামনেটাতে মার্বেল বসানো হয়ে গেছে।” মলয়ের গলায় আনন্দের ছোয়াঁ। (Bengali Novel)
বাক্য সম্পূর্ণ হল না।
‘ওখানে শুটিং একদম বন্ধ করো। দাদু বাইরে আসতে না পারলে ওঁকে শুটিংয়ে তেমন দরকার নেই’।
‘কী?’
এবার একটু কেটে কেটে বললেন। (Bengali Novel)
‘শুটিংয়ে তোমাদের নতুন বাড়ি দেখানোর কোনও দরকার নেই। রান্নাঘর, পুরোনো বাড়ির বারান্দা ঠিক আছে। তোমার মা বাবার ঘর অব্দি। আমি একটা খোলামেলা বসার জায়গার কথা ভাবছি। বাঁশ দিয়ে বেঞ্চ, তক্তপোষ-কেমন হবে? আমার আরও কিছু প্ল্যান আছে। রান্নাঘরেই তো তোমরা খাও। রান্নাঘর ছাড়া ওখানেই তোমরা বসবে। সুন্দর সুন্দর মোড়া, টুল, বাঁশের… ওপর থেকে বেতের ঝুড়ি’। (Bengali Novel)
সুর কেটে গেছে। একটু নৈঃশব্দ ঘনিয়ে এসেছে। মলয় এতদিনে এই দ্রুত রং, আলো বাতাস বদলে একটু অভ্যস্ত হয়েছে, কিন্তু সোনালী একটু ঘাবড়ে গেছে। বারবার মলয়ের দিকে চাইছে, কিন্তু কিছু বলছে না। (Bengali Novel)
সোমদত্তা ওদের একটু সময় দিলেন। (Bengali Novel)
‘সামনের এপিসোড গুলোতে বাবা কাকাকে একটু সামনে আনবে। পুজোর বাজার হচ্ছে?’
একটু অনিশ্চিত গলায় কথা বলছে মলয়। সে ঠিক বলছে না ভুল বলছে সেটা বুঝতে পারছে না। ভালোই। এরকম নড়বড়ে অবস্থায় থাকা। এই দোলাচলে থাকা। একটু ভাবলেন সোমদত্তা।
‘না এখনও না। আমরা সবাই মিলে একদিন বর্ধমান টাউনে যাই, গত দু’বছর ধরে কলকাতা গেছি। মা, কাকা কাকিমা, মামী, ভাই বোনদের জামাকাপড় কিনতে। একসঙ্গে।’ একটু অনিশ্চিত গলায় কথা বলছে মলয়। সে ঠিক বলছে না ভুল বলছে সেটা বুঝতে পারছে না। ভালোই। এরকম নড়বড়ে অবস্থায় থাকা। এই দোলাচলে থাকা।
একটু ভাবলেন সোমদত্তা। (Bengali Novel)
‘এবার বাবা আর কাকা বাড়ির সবার জন্য, বিশেষ করে মহিলা সদস্যদের জন্য জামাকাপড় কিনে আনবেন। সারপ্রাইজ থাকবে এবং খুব আদর করে দুটো শাড়ী সোনালীকে দেবেন।’ (Bengali Novel)
একটু দম নিলেন তিনি। (Bengali Novel)
‘শাড়ির বিষয়টা আমাদের ওপর ছেড়ে দাও। তোমার বাবা মানুষটি বড় ভাল। কী সুন্দর করে আপন করে নেন সবাইকে। এখন থেকে ওঁকে একটু বিশেষ গুরুত্ব দেবে। আবার একটা মাছ ধরার এপিসোড করো না মলয়? মাছ ধরে এনে উনি কাটাকুটি করবেন, রান্নাও করবেন। তোমরা বেশ হই হই করে সাহায্য করবে’। (Bengali Novel)
আস্তে আস্তে সহজ হচ্ছে পরিবেশ। দু’জনের কাঁধ, পিঠ, সবই একটু শিথিল হচ্ছে। মুখে একটু সহজ ভাব। ঠিক তখনই হাওয়ায় প্রশ্নটা ভাসিয়ে দিলেন সোমদত্তা
আস্তে আস্তে সহজ হচ্ছে পরিবেশ। দু’জনের কাঁধ, পিঠ, সবই একটু শিথিল হচ্ছে। মুখে একটু সহজ ভাব। ঠিক তখনই হাওয়ায় প্রশ্নটা ভাসিয়ে দিলেন সোমদত্তা—
‘তোমরা দুজন কেমন আছো মলয়’?
মলয় আর সোনালীর বিয়ের পর কেটে গেছে বেশ কয়েক মাস। তারপর একা এবং পরিবারের লোকেদের সান্নিধ্যে দেখা হয়েছে মলয়ের সঙ্গে। কিন্তু তিনি একবারও জিজ্ঞাসা করেননি মলয় আর সোনালী একসাথে কেমন আছে। (Bengali Novel)
সোনালী একটু লজ্জা পেল মনে হল। সে মলয়ের দিকে তাকাল। মলয় তার ছবির দিকে তাকিয়ে। পড়ার চেষ্টা করছে প্রশ্নটা?
‘ভাল আছি।’ একটু থামল, একবার তাকাল সোনালীর দিকে। (Bengali Novel)

এবার তার মুখে একটু হাসি-
‘দিব্যি আছি। সোনালী খুব ভাল মেয়ে দিদি।’’
সোনালীর মুখটাতে যেন আলো জ্বলে উঠেছে।
‘গুড নাইট তোমাদের দুজনকেই। এইরকমই ভাল থেকো। ও হ্যাঁ একটা কথা বলার ছিল। তোমরা হনিমুন যাওনি তো?’
‘না’
আবার থতমত মুখ মলয়ের,
‘তবে দিদি’, হড়বড় করে বলে উঠল মলয়
‘নভেম্বর মাসে ও কাশ্মীর যাওয়ার বায়না করছে।’
একটু আড়ষ্ট হয়ে গেল সোনালী, কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে সোমদত্তা তাকিয়ে আছেন সোনালীর মুখের দিকে..
‘হবে হবে ডেফিনিটলি। তবে আমি একটা কাছাকাছি ট্রিপের কথা ভাবছিলাম…’
‘বায়না কই… দেখি সব ভিডিও পোস্ট করে কী সুন্দর বরফের। একদম সাদা’
একটু আড়ষ্ট হয়ে গেল সোনালী, কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে সোমদত্তা তাকিয়ে আছেন সোনালীর মুখের দিকে..
‘হবে হবে ডেফিনিটলি। তবে আমি একটা কাছাকাছি ট্রিপের কথা ভাবছিলাম…’
‘কলকাতা যাব?’
‘ধুর নানা… শান্তিনিকেতন যাও। সোনাঝুরির মেলাতে খুব সুন্দর করে কভার করবে… ওখানে থেকে পাঞ্জাবি, হ্যান্ড পেইন্টেড, হারবাল ডাইড, কাঠ, মাটির গয়না কিনবে পরবে, তেলে ভাজা খাবার খাবে খুব আনন্দ করবে… খুব সুন্দর ভিডিও হবে। কেমন?’
দু’জনেই মাথা নাড়ল। (Bengali Novel)
মলয় আমি তোমার ঠাকুমার মামারবাড়ির গ্রাম থেকে দুজন বয়স্ক মহিলাকে পেয়েছি যাঁরা এই কাজ করেন, খুব দক্ষ। সামনের মাসে তারা তোমাদের বাড়ি আসবেন। ঠাকুমার সাথে একসাথে সেলাই, গল্প পুরোনো দিনের, স্মৃতিচারণ।
‘এটা শুধু নয়। ওখানে থেকে কাঁথা কাজের শাড়ি কিনে আনবে, মা, ঠাকুমা, কাকীমার জন্য। তোমার ঠাকুমা ওঁর নিজের নকশি কাঁথার কাজ শেখার গল্প বলবেন। মলয় আমি তোমার ঠাকুমার মামারবাড়ির গ্রাম থেকে দুজন বয়স্ক মহিলাকে পেয়েছি যাঁরা এই কাজ করেন, খুব দক্ষ। সামনের মাসে তারা তোমাদের বাড়ি আসবেন। ঠাকুমার সাথে একসাথে সেলাই, গল্প পুরোনো দিনের, স্মৃতিচারণ। একদম জমে যাবে।’
মলয় সোনালী মন দিয়ে শুনছে।
‘আচ্ছা ঠিক আছে। অনেক রাত্রি হল। এবার তোমরা ঘুমোও। আমি আরও আপডেট দেব।’ (Bengali Novel)
(ক্রমশ)
ডিজিটাল ও মুদ্রিত মাধ্যমে সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত
মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায় বস্টন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। মূলতঃ ছোট গল্প এবং আর্টিকেল লেখেন। ছোট গল্প সংকলন ক্যালাইডোস্কোপ এবং অপরাজিতা প্রকাশিত হয়েছে, কমলিনী,দেজ পাবলিকেশন থেকে।একটি ছোট গল্পের অনুবাদ শর্টলিস্টেড হয়েছে, ‘Armory Square Prize for women writers in South Asian literature’ এ। অনুদিত গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত Words Without Borders এর পাতায় ।আনন্দবাজারের বিদেশ পাতার নিয়মিত লেখেন তাছাড়া রোববার-সংবাদ প্রতিদিন, বাংলা লাইভ, গুরুচণ্ডালী এবং আরো কিছু ম্যাগাজিনে গল্প এবং ছোট বড় প্রবন্ধ নিয়মিত লেখেন।