চরিত্র
শ্যামলী – বাইশ তেইশ বছরের মেয়ে
মৃত্যুঞ্জয় – শ্যামলীর বাবা, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, কবি
মানসী – শ্যামলীর মা
সুজয় – শ্যামলীর বন্ধু
সৌবীর – আমেরিকা প্রবাসী যুবক
স্থান
পশ্চিমবঙ্গের কোনও এক মফস্বল শহর
(সকালবেলা। মৃত্যুঞ্জয় ঘোষের বাড়ির বসার ঘর। ঘরের একপাশে মৃত্যুঞ্জয়ের মেয়ে শ্যামলী গান গাইছে – পৃথিবীর গান আকাশ কি মনে রাখে। মৃত্যুঞ্জয়ের স্ত্রী মানসী একবার আসেন, কিছু বলতে গিয়েও থেমে যান। ঘর্মাক্ত কলেবরে মৃত্যুঞ্জয় প্রবেশ করেন, হাতে বাজারের থলে। গান শুনে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকেন। হঠাত্ শ্যামলীর মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। শ্যামলী গান থামিয়ে ফোন তুলে নেয়। সুজয় ফোন করেছে। মৃত্যুঞ্জয় বাজারের থলিটা মানসীর হাতে তুলে দেন। মানসী একবার উঁকি মেরে ব্যাগের ভেতরে দেখেন, তারপর বিরক্ত হয়ে ভেতরে চলে যান। মৃত্যুঞ্জয় ওর কবিতার পাণ্ডুলিপি খুলে নিয়ে বসেন।)
শ্যামলী:
– হ্যাঁ বল।
-কী করব আবার? গান গাইছিলাম।
-বারে, ভুলে গেছ? রবিবার আমার প্রোগ্রাম না –
-তাতে কী হয়েছে? রেওয়াজ না করলে গলা খারাপ হয়ে যাবে। তাছাড়া, কয়েকটা নতুন গান তুলেছি। ইউটিউব থেকে। পুরুষ কণ্ঠের গান – হেমন্ত, মান্না, সতিনাথ –
কেন, মেয়েরা ছেলেদের গান গাইতে পারে না? একটা নতুন ব্যাপার হবে। এই তুমি আসবে তো? তোমার কয়েকটা ফেভারিট গান গাইব – সত্যি!
-বললাম তো রবিবার –
-না না এই রবিবার না, পরের রবিবার।
-যাহ্ কী বলছ?
-যতসব আলতু ফালতু গুজব। কারা যে এসব রটায়?
(শ্যামলী ফোনে কথা বলে চলে। মানসী চায়ের কাপ নিয়ে প্রবেশ করে। মৃত্যুঞ্জয়কে চা দেয়।)
মানসী: তুমি এখন আবার কবিতা নিয়ে বসলে? স্নানটা সেরে নাও না।
মৃত্যুঞ্জয়: যাচ্ছি। পাণ্ডুলিপিটা ঠিকঠাক করে পাঠাতে হবে। ওরা তাড়া দিচ্ছে। বইমেলায় বের করতে হলে এই সপ্তাহের মধ্যেই জমা দিতে হবে।
মানসী: যা করবে তাড়াতাড়ি কর! তোমার তো স্নান করতেই একঘণ্টা। মনে আছে তো, ওবেলায় মিত্তির বাবুরা আসবেন।
মৃত্যুঞ্জয়: ও হ্যাঁ, তাই তো। (চাপা গলায়) মেয়েকে বলেছ?
মানসী: না। ওরা বলেছে কোনওরকম ফর্মালিটি না করতে। সাধারণ ভাবেই দেখতে চায়, গল্প করতে চায়। আমি কেবল ওকে বলেছি বাড়ি থাকতে। ও এমনিতেই বাড়ি থাকত। গানের অনুষ্ঠানটার জন্য একটু টেনশনে আছে।
শ্যামলী (ফোনে) :
-টোটাল ঢপ! আমি বিশ্বাস করি না।
-বেশ তো, নিয়ে এস না।
-তাড়াতাড়ি এস। আমাকে বেরতে হবে। রাখছি।
(ফোন বন্ধ করে হারমোনিয়ামের দিকে ফিরে যায়।)
মৃত্যুঞ্জয়: গান গাইতে গাইতে ফোন ধরিস কেন? ফোনটা বন্ধ রাখতে পারিস না?
মানসী: তাহলেই হয়েছে। পৃথিবী ঘোরা বন্ধ করে দিলেও, ওর ফোন বন্ধ হবে না।
শ্যামলী: তুমি কীকরে জানলে?
মানসী: দেখতেই তো পাচ্ছি সর্বক্ষণ কানে ফোন গুঁজে রয়েছ
শ্যামলী: আঃ তা নয়। পৃথিবী ঘোরা বন্ধ করে দেবে বললে কেন? যত সব বাজে কথা
মানসী: কী এমন ভুল কথা বলেছি? তুই কি এক মুহূর্তের জন্যেও ফোন ছেড়ে থাকিস? স্নান করার সময়েও বাথরুমে ফোন নিয়ে ঢুকিস। আগের ফোনটা তো জলে ভিজিয়েই নষ্ট করলি। গুচ্ছের টাকা গচ্চা গেল।
শ্যামলী: এই ফোনটা আমি নিজের উপার্জনের পয়সায় কিনেছি মা। আগের ফোনটা এমনিতেই বাতিল করতে হত। স্মার্ট ফোন ছাড়া আজকের দিনে চলা যায় নাকি?
মৃত্যুঞ্জয়: হ্যাঁ এখন যন্ত্র স্মার্ট হচ্ছে আর আমরা বোকা হয়ে যাচ্ছি। সামান্য যোগ বিয়োগের হিসেব করতেও আমাদের এখন ফোনের ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে হয়।
শ্যামলী: বুড়োদের মতো কথা বোলও না বাবা। তুমি জানো, আমি এই ফোন থেকে কতগুলো গান তুলেছি? এই স্মার্ট ফোনের দৌলতে সারা পৃথিবী এখন আমার হাতের মুঠোয়।
মৃত্যুঞ্জয়: সেটা ঠিক। টেকনোলজির দৌলতে পৃথিবীটা এখন অনেক ছোট হয়ে গেছে। আরও ছোট হবে – ছোট হতে হতে এক সময় ভ্যানিশ করে যাবে।
শ্যামলী: তোমাদের কী হয়েছে বলত? সবাই এক কথা বলছ কেন? সুজয়দা বলল, মা বলল, এখন তুমি বলছ –
মানসী: কী বলেছে সুজয়?
শ্যামলী: সুজয়দাটা পাগল হয়ে গেছে। এখন দেখছি তোমরাও বাদ নেই।
(শ্যামলী হারমোনিয়ামের সামনে বসে সুর তোলে)
মানসী: আঃ, সুজয় কী বলেছে বলবি তো?
শ্যামলী: ওই তোমরা যা বললে। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। যত সব বাজে কথা।
(শ্যামলী গান ধরে – পৃথিবীর গান আকাশ কি মনে রাখে। এক লাইন গেয়েই থেমে যায়)
শ্যামলী: এইবার বুঝেছি। তোমরা সবাই আমার পেছনে লাগছ না? আমি এই গানটা গাইছি বলে?
(মৃত্যুঞ্জয় হো হো করে হেসে ওঠে)
শ্যামলী: বাবা, ভাল হবে না বলছি। এত কষ্ট করে গানটা তুলছি –
মৃত্যুঞ্জয়: ওরে না, আমি কিন্তু তোর গান শুনে কিছু বলিনি। পৃথিবী ছোট হয়ে যাচ্ছে শুনে হঠাত্ মনে হল তাই বললাম।
শ্যামলী: মাও তো বলল
মৃত্যুঞ্জয়: ওটা তো একটা কথার কথা।
মানসী: সুজয় তোকে বলেছে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে? হঠাৎ ওই কথা বলল কেন?
শ্যামলী: আমি কী জানি? একটু বাদেই এসে পড়বে, তোমরা ওঁর কাছেই শুনে নিও।
মৃত্যুঞ্জয়: আচ্ছা তুই এত সিরিয়াসলি নিচ্ছিস কেন? সুজয় হয়ত ঠাট্টা করছে।
শ্যামলী: আমি সুজয়দাকে খুব ভাল চিনি বাবা। ও ভীষণ সুপারস্টিশাস। দেখনি ওঁর হাতে কতগুলো আংটি? যে যা বলে ও তাই বিশ্বাস করে।
মানসী: বিশ্বাসী হওয়াটা কি খারাপ নাকি? বিশ্বাস মানুষকে ভরসা দেয়।
শ্যামলী: ভিতু মানুষরাই অত বিশ্বাস টিস্বাস করে। সুজয়দা আসলে ভীষণ ভিতু। তাই আঙুলে আংটি, হাতে তাবিজ, কোমরে ঘুনসি, এইসব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মৃত্যুঞ্জয়: (উচ্চ কণ্ঠে হেসে ওঠে) কোমরে ঘুনসি? সত্যি? তুই দেখেছিস?
শ্যামলী: দেখার দরকার নেই। আছে, আমি জানি।
(হন্তদন্ত হয়ে সুজয় প্রবেশ করে।)
শ্যামলী: এই তো এসে গেছে। সুজয়দা, তোমার কোমরের ঘুনসিটা বাবাকে দেখিয়ে দাও তো। বাবা বিশ্বাস করছে না।
সুজয়: ইয়ার্কি মারবি না শ্যামলী। এটা ইয়ার্কি মারার সময় নয়।
মানসী: সুজয় এসব কী শুনছি বলত? তুমি নাকি বলেছ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে?
সুজয়: আমি বলছি না মাসিমা। বড় বড় বিজ্ঞানীরা বলছে। সাধক সন্ন্যাসীরা বলছে। এই দেখুন, আমি এনেছি কাগজটা। পড়ে দেখুন। আর মাত্র পাঁচ দিন। ব্যস, তারপর সব শেষ।
(মানসী কাগজটা হাতে নিয়ে পড়ে)
মৃত্যুঞ্জয়: বিজ্ঞানীরা বলেছে? কোথাকার বিজ্ঞানী।
সুজয়: ফরাসি বিজ্ঞানী – কি যেন নাম? (কাগজে উঁকি দিয়ে) এই তো – হেনরি প্যাঁপ্যাঁ। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ নিয়ে কাজ করেছেন। বলেছেন, আজ থেকে ঠিক দশ দিনের মাথায় পৃথিবীর ভেতর দিয়ে এক শক্তিশালী গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ পাস করবে, আর সেই ওয়েভের শক্তি পৃথিবীর গভীরে লাভাকে এত উত্তপ্ত করে দেবে যে পৃথিবী একটা বোমার মতো দুম করে ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। ব্যস সব শেষ। মানুষ পশু পাখি সব এক লহমায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
মানসী: এটা কার নাম লিখেছে? (পড়তে চেষ্টা করে) নস্ত্রা – দামা…
সুজয়: নস্ত্রাদামাস – বিখ্যাত ইতালিয়ান জ্যোতিষী পাঁচশ বছর আগে ঠিক এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন – এই ভয়ঙ্কর দিনের কথা। ওঁর আগের সব ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছে।
মানসী: সে কি গো? কী হবে তাহলে?
শ্যামলী: মা, তুমি সুজয়দার কথা বিশ্বাস কোরও না তো। সব বাজে কথা। ওই কাগজটা ফেলে দাও।
(চলবে)
ছবি সৌজন্যে: Jw.org
সুদীপ্ত ভৌমিক একজন প্রতিষ্ঠিত নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা। ওঁর নাটক অভিবাসী জীবনের নানা দ্বন্দ ও সংগ্রামের কথা বলে। সুদীপ্তর নাট্যদল একতা (ECTA) উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিমবঙ্গের নাট্যপ্রেমীদের কাছে এক পরিচিত নাম। ভাষানগর পুরস্কার, নিউ জার্সি পেরি এওয়ার্ড নমিনেশন, সিএবি ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস এওয়ার্ড ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত সুদীপ্ত ড্রামাটিস্ট গিল্ড অফ আমেরিকার পূর্ণ সদস্য। ওঁর পডকাস্ট স্টোরিজ অফ মহাভারত অ্যাপল আইটিউনস-এ শ্রেষ্ঠ পডকাস্টের স্বীকৃতি পেয়েছে।