পীযুষ: রিপ ভ্যান উইঙ্কল? ঠিকই বলেছ। আমি সত্যি এতদিন ঘুমিয়ে ছিলাম। এখন এই জীবন সায়াহ্নে এসে –
শেখর: ঠিক আছে। ঠিক আছে। ওইসব ভাল ভাল বাংলা তুমি তোমার গার্ল ফ্রেন্ডের জন্য রেখে দাও। এখন যা বলছি মন দিয়ে শোন। ম্যাডাম কখন আসবে বলে মনে হয়?
পীযুষ: সময় হয়ে এসেছে। একটু বাদেই এসে পড়বে।
শেখর: ঠিক আছে। তুমি ওই লিপস্টিক ফেরত দেবার এক্সকিউজ দেখিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলবে। চলে যেতে দেবে না, এনগেজ করে রাখবে। জোকটোক মারবে – মেয়েরা হিউমার খুব পছন্দ করে। যদি পারো, একটু চা কফি খাওয়াতে নিয়ে যাবে। লিপস্টিকটা দেখি।
(পীযুষ লিপস্টিকটা বার করে দেখায়। শেখর দেখে ফেরৎ দিয়ে দেয়।)
শেখর: লীনা বেটার বলতে পারত, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে দামী লিপস্টিক। তোমাকে টাইম দেবে। আর যদি ফেবারিট লিপস্টিক হয়, তাহলে তোমার সঙ্গে চা খেতেও যাবে।
পীযুষ: বলছ?
শেখর: বলছি। আমার কথা মতো চল, দেখবে সব একেবারে খাপে খাপ হয়ে যাবে। অবশ্য এর মধ্যেই তুমি যদি না ছড়াও।
পীযুষ: ছড়াব? কী?
শেখর: নেভার মাইন্ড। শোন, যখন ও তোমার সঙ্গে কফি খেতে যাবে, তখন আমার স্ত্রাটেজি এপ্লাই করো।
পীযুষ: তোমার স্ট্রাটেজি?
শেখর: যা বাবা! ভুলে গেলে? যেই দেখবে একটু পটে এসেছে, অমনি ঝুপ করে বলে দেবে – ডার্লিং, আর বেশিদিন এই পৃথিবীতে আমরা নেই। সব শেষ হয়ে যাবার আগে, চল দুজনে মিলে একটু ফুর্তি করে নিই।
পীযুষ: ফুর্তি করে নিই? তুমি মনে করেছ আমি সেই জন্য – ? নাহ, তোমার সঙ্গে কথা বলাটাই আমার ভুল হয়েছে।
শেখর: এই তো, আবার সেন্টি খেয়ে গেলে। আরে বাবা, তোমার ফুর্তি তোমার মত, আমার ফুর্তি আমার মতো। তোমার জেনারেশনের লোকেদের শুনেছি হাত ধরাধরি করে বসে থাকলেই অর্গাজম হয়ে যায়। আমাদের তো তা হয়না।
পীযুষ: ফুর্তি কথাটার মধ্যে একটা – বিশ্রী নেগেটিভ কনোটেশান রয়েছে।
শেখর: ঠিক আছে – উত্তম সুচিত্রার কিছু ইমোশনাল ডায়ালগই দিয়ে দিও নাহয়। রবীন্দ্রনাথও ঝাড়তে পার। জাস্ট মনে রেখ, ওর মনে একটু ভয় ঢুকিয়ে দিতে হবে, আর বোঝাতে হবে, এই দুঃসময়ে তুমি ওর পাশে আছ। একটু সেন্টু দিয়ে বলবে, এস আমরা দুজনে হাত ধরাধরি করে সূর্যাস্তের দিকে এগিয়ে যাব। আর হাত ধরাধরি মানেই তো তোমাদের –
পীযুষ: বাজে কথা বন্ধ করবে? (থেমে) কিন্তু – পৃথিবী ধ্বংস যদি না হয়?
শেখর: আরে তাহলে তো আরও ভাল। রিলেশানশিপ কন্টিনিউ করে যাবে – সারে জিন্দেগি।
পীযুষ: না! সরি, এভাবে আমি কাউকে ঠকাতে পারব না। আর যাকে ভালবেসেছি তাকে কখনও না।
শেখর: তোমাদের জেনারেশানের এই হচ্ছে দোষ – পেটে খিদে মুখে লাজ। শোয়ার ইচ্ছে ষোল আনার জায়গায় আঠের আনা, কিন্তু মুখে ভাব দেখাবে যেন ত্রৈলঙ্গ স্বামী। এই জন্যই শালা এই জাতটার কিছু হল না। তোমার গার্লফ্রেন্ড তোমাকে এত বড় হিন্ট দিয়ে গেল, আর তুমি তার ফয়দা না তুলে এখানে বসে বসে ব্যোমকেশ পড় আর দীর্ঘশ্বাস ফেল।
পীযুষ: হিন্ট দিয়ে গেছে?
শেখর: না তো কি? লিপস্টিক কি ওমনি ওমনি পড়ে গেছে ব্যাগ থেকে? অনেক দিন ধরে তোমাকে মাপছে ওই লেডি। তোমার জন্য ওর জেনুইন ব্যথা আছে, লিখে রাখ।
পীযুষ: জানিনা। কিন্তু এই বয়েসে রিজেকশান সহ্য করতে পারব না। তার চেয়ে না এগোনই ভাল। এই লিপস্টিকটাকেই স্মৃতি করে বেঁচে থাকব বাকিটা জীবন।
শেখর: কিছু পাবলিক মাইরি তুমি। থাক, ওই লিপস্টিক বুকে নিয়ে তুমি বসে থাক। আমি চললাম।
(শেখর উঠে যায়। একটু গিয়েই দেখতে পায় সুজাতা আসছে।)
শেখর: এসে গেছে কাকা, এসে গেছে। আরেব্বাস, এতো একেবারে ঝিঙ্কু চিজ গুরু! (পীযুষের কাছে এসে ওঁকে ধাক্কা দেয়) আরে ওঠ। যাও যাও, এই সুযোগ কিন্তু আর পাবে না।
পীযুষ: কিন্তু –
শেখর: ওসব কিন্তু ফিন্তু পড়ে হবে। ওঠ এখন। যাও !
(শেখর প্রায় ধাক্কা মেরে পীযুষকে তুলে দেয়। পীযুষ এদিক ওদিক তাকিয়ে সুজাতার দিয়ে এগিয়ে যায়। শেখর বেঞ্চে বসে নজর রাখে।)
পীযুষ (সুজাতা কে): এই যে, শুনছেন –
সুজাতা: আমাকে বলছেন?
পীযুষ: হ্যাঁ! আসলে একটা ব্যাপার হয়েছে –
সুজাতা: কি হয়েছে?
পীযুষ: ইয়ে – মানে – আপনি কিছুক্ষণ আগে এখান দিয়ে যাচ্ছিলেন।
সুজাতা: হ্যাঁ আমি রোজই যাই। একটু হাঁটা হাঁটি করি।
পীযুষ: আমি জানি। আমি দেখি আপনাকে, রোজই।
সুজাতা: আপনি আমাকে দেখেন?
পীযুষ: ইয়ে মানে – আমিও হাঁটি তো – এই বেঞ্চ টাতে এসে বসি। তাই আর কি –
সুজাতা: হ্যাঁ তাইতো! আপনি তো এখানে বসে থাকেন, বই পড়েন। আমার মনে হচ্ছিল আপনাকে আমি কোথাও দেখেছি। এই দেখুন, আমাদের পরিচয়টাই তো হয়নি। আমার নাম সুজাতা – সুজাতা সেন।
পীযুষ: আমার নাম পীযুষ – পীযুষ কান্তি চৌধুরী। বয়স ষাট! চার মাস আগে রিটায়ার করেছি। এখন –
(সুজাতা হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ে)
পীযুষ: আপনি – আপনি হাসছেন –
সুজাতা: সরি। আপনি যেভাবে আপনার বয়স, টয়স সব বলতে লাগলেন – না হেসে পারা যায়। আমি কিন্তু আমার বয়স বলছি না।
পীযুষ: না না তা কেন বলবেন। আমি জানতেও চাইব না।
সুজাতা: আপনি বলছিলেন আমাকে কিছু বলবেন?
পীযুষ: ও হ্যাঁ। (পকেট থেকে লিপস্টিকটা বার করেন) এটা আপনি এখানে ফেলে গিয়েছিলেন?
সুজাতা: আমি ফেলে গিয়েছিলাম? কই দেখি? (লিপস্টিক নিয়ে) ওমা, তাই তো। এটা তো আমারই লিপস্টিক। কোথায় পেলেন?
পীযুষ: এই তো – এইখানেই। আপনি যাবার সময় ব্যাগ থেকে ফোন বার করলেন আর তখনই লিপস্টিকটা পড়ে গেল।
সুজাতা: কী ভুলো আমি দেখেছেন? ভাগ্যিস আপনি এটা কুড়িয়ে তুলে রেখেছিলেন। জানেন, এটা আমার খুব প্রিয় লিপস্টিক – আমার ফেভারিট। আপনাকে যে কীভাবে ধন্যবাদ দেব জানিনা। এটা হারিয়ে গেলে আমার খুব ক্ষতি হয়ে যেত।
পীযুষ: ক্ষতি হয়ে যেত?
সুজাতা: আসলে এই লিপস্টিকটার একটা স্পেশাল ব্যাপার আছে। এটা সব সময় আমার সঙ্গে থাকে। কীভাবে যে এটা আজ পড়ে গেল? আপনি আমার কি যে উপকার করলেন আপনি জানেন না। আপনি কী খেতে চান বলুন, আপনাকে আমি খাওয়াব।
পীযুষ: আপনি আমাকে খাওয়াবেন? আসলে আমি ভাবছিলাম আমি আপনাকে –
সুজাতা: না না, আমি কোন কোথা শুনতে চাই না। ওই সামনে চায়ের দোকানটায় চলুন। ওখানে শুনেছি খুব ভাল মোগলাই পরোটা ভাজে। আপনি মোগলাই পরোটা খান তো?
পীযুষ: হ্যাঁ তা খাই, কিন্তু –
সুজাতা: কোনও কিন্তু টিন্তু নয়। আমারও খিদে পেয়েছে। চলুন জমিয়ে মোগলাই পরটা আর চা খাওয়া যাক।
(সুজাতা হাঁটা লাগায়)
পীযুষ: এক মিনিট। এক মিনিট। আসলে, আমার আরও দু একটা কথা ছিল –
সুজাতা: বেশ তো, বলবেন। মোগলাই পরোটা খেতে খেতে বলবেন। আসুন।
(পীযুষ ঘাড় ঘুরিয়ে একবার বেঞ্চে বসা শেখরকে দেখেন। শেখর থামস আপ দেখায়। পীযুষ সুজাতার পেছন পেছন চায়ের দোকানে গিয়ে বসে)
(চলবে)
সুদীপ্ত ভৌমিক একজন প্রতিষ্ঠিত নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা। ওঁর নাটক অভিবাসী জীবনের নানা দ্বন্দ ও সংগ্রামের কথা বলে। সুদীপ্তর নাট্যদল একতা (ECTA) উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিমবঙ্গের নাট্যপ্রেমীদের কাছে এক পরিচিত নাম। ভাষানগর পুরস্কার, নিউ জার্সি পেরি এওয়ার্ড নমিনেশন, সিএবি ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস এওয়ার্ড ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত সুদীপ্ত ড্রামাটিস্ট গিল্ড অফ আমেরিকার পূর্ণ সদস্য। ওঁর পডকাস্ট স্টোরিজ অফ মহাভারত অ্যাপল আইটিউনস-এ শ্রেষ্ঠ পডকাস্টের স্বীকৃতি পেয়েছে।