নেপচুন কয়েকটা মানুষ পুষেছে। বাবা! নেপচুনকে যা তা ভাবার জো নেই। রীতিমতো সোশাল মিডিয়ার বিখ্যাত লোক থুড়ি মার্জার অর্থাৎ বিড়াল। খুব ছোট বয়সে, যখন নেপচুনের বয়স এক দেড়মাস হবে, তখন বারুইপুরে, ফেসবুকে তাকে প্রথমে দেখা যায়। একটা ছোট ঝুড়িতে, নেপচুন আর তার যমজ ভাই ছিল। তখন অবশ্য ওদের অন্য নাম ছিল। যেমন মহাপুরুষদের পূর্বাশ্রমের নাম হয়। অমন সুন্দর গোল গোল মার্বেলের মতো চোখ, সাদা ফুলেল লোমে ভরা শরীর, কান দুটো কালো। পরবর্তীকালে সে নেপচুন নামে খ্যাতি লাভ করে। এদিকে ফেসবুকে আত্মপ্রকাশ করা মাত্র লাইকের ঝড় বয়ে চলে। কমেন্টের পর কমেন্টে, লাইন লেগে যায়। এ বলে, “আমি চাই”, ও বলে “আমি নেব”, সে বলে “কত দাম?”
তা বললেই হল? সব কিছু পয়সা দিয়ে পাওয়া যায়? যেমন পয়সাতে চশমা কেনা যায়, কিন্তু দৃষ্টি পাওয়া যাবে না। নেপচুনের বয়স কম হলে কী হবে? জ্ঞান টনটনে, ফেসবুকের ইনবক্স ঘেঁটে, খুঁজে নেয় মেঘনাকে।
মেঘনা স্কুলে পড়ে। মা গেরস্ত বাড়িতে রান্নার কাজ করে আর বাবা কোথায় যেন চলে গেছে! মেঘনার মা বলে, “আমাদের নিজেদেরই চলে না, তার মধ্যে আবার বিড়াল?” কিন্তু তা, বললে হবে? নেপচুন যখন ঠিক করেছে, তখন সে আসবেই। এরপর একদিন শুভক্ষণ দেখে নেপচুন মেঘনাদের বাড়ি চলে এল।
জঞ্জাল পুকুরের পাড় ঘেঁষে মেঘনাদের ভাড়া বাড়ি। মাঝে এক চিলতে উঠোন, কোণে একটা পেয়ারা গাছ। উঠোন ঘিরে পাঁচ ঘর ভাড়াটে। সকলের অবস্থাই মেঘনাদের মতো, কেউ লোকের বাড়ি বাসন মাজে, কেউ ভাড়ায় অটো চালায়, কেউ রঙের মিস্ত্রি। উঠোনের একদিকে কলঘর আর শৌচালয়। সপ্তাহে একদিন পালা করে একজন উঠোন ঝাঁট দেয়, পড়ে থাকা পেয়ারা পাতা পরিস্কার করে। দুচারটে কাঠবেড়ালি ঘুরে বেড়ায়।

মেঘনার মা রান্নার কাজ করতে বেরিয়ে পড়েন, কোন সকালে! বাড়িতে মেঘনা একা। নিজে নিজে তৈরী হয়ে স্কুল যায়, ফিরে আসে বিকেলে। এর মধ্যে মেঘনার মা সকালের কাজ সেরে ঘরে ফেরে। নিজেদের জন্য রান্না করে, স্নান সারে, খেয়ে একটু বিশ্রাম নেয়। যেদিন পালা থাকে, উঠোন ঝাঁট দেয়। তারপর আবার বিকেলের কাজে বেরিয়ে পড়ে। তখনও মেঘনার স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়নি। তাই নেপচুন যখন এলো, তখন মেঘনা বাড়িতে একা। রীতিমতো ফেসবুকে ঢাক বাজিয়ে মেঘনার বাড়িতে নেপচুনের অধিষ্ঠান হল। সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেট জুড়ে লাইকের শাঁখ বাজে, কমেন্টের উলু শোনা যেতে থাকে ঘনঘন।
ওদিকে রাতে কাজ সেরে, বাড়ি ফেরে মেঘনার মা। দেখে, মেঘনার বালিশের পাশে ছোট্ট একটা ফুটফুটে বিড়াল বসে আছে। নেপচুনকে দেখে তো প্রথমে আক্কেল গুড়ুম হল। নিজেদেরই খাওয়া জোটে না, তার মধ্যে ইনি? মেঘনা ঘুমিয়ে পড়েছিল। মায়ের চিৎকারে ঘুম ভাঙে, “এটা কী?”
মেঘনা স্কুলে পড়ে। মা গেরস্ত বাড়িতে রান্নার কাজ করে আর বাবা কোথায় যেন চলে গেছে! মেঘনার মা বলে, “আমাদের নিজেদেরই চলে না, তার মধ্যে আবার বিড়াল?” কিন্তু তা, বললে হবে? নেপচুন যখন ঠিক করেছে, তখন সে আসবেই। এরপর একদিন শুভক্ষণ দেখে নেপচুন মেঘনাদের বাড়ি চলে এল।
এতক্ষণ নেপচুন কোনো কথা বলেনি। চিৎকার শুনে বলে ওঠে, “মিমিউ চিচিউন”।
মা জিজ্ঞেস করে, “কী বলছে রে?”
মেঘনা বুঝিয়ে দেয়, “ও বলছে, ‘কী’ নয় ‘কে’? ‘এটা কে’ বলো। ওর নাম নেপচুন।” তারপর নেপচুনের দিকে তাকিয়ে বলে, “কী তাই তো?”
নেপচুন ঘাড় নেড়ে সায় দেয়।
মেঘনার মা চমকে যায় বিড়ালের কথা শুনে। এইভাবে ওদেরকে চমকে দিয়ে নেপচুন, মেঘনা আর তার মা-কে স্থায়ীভাবে পোষ্য করে নেয়।
কিন্তু গোল বাধে অন্য জায়গায়। মেঘনাদের বাসাই এখন অস্থায়ী হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ওদের বাড়ির সামনের জঞ্জাল পুকুর। বহুদিন ধরে একটু একটু করে জঞ্জাল জমতে জমতে পুকুরের অংশ কমে এতোটুকু হয়ে গেছে।
সেখানেই নাকি এবার ইমারত গজাবে, ভাঙা পড়বে মেঘনাদের বাড়িও। এখন ওরা কোথায় যাবে? মেঘনার মা, পাশের ঘরের রঙমিস্ত্রি, অটোকাকু সবাই হায় হায় করতে থাকে। নেপচুন বলে, “শুধু হায় হায় করলে কাজ হবে? ব্যবস্থা নিতে হবে।”
মেঘনা বলে, “আমাদের কথা কেউ শুনবে না।”

নেপচুন বলে, “শোনার মতো করে বললে তবে তো শুনবে।”
এই বলে নেপচুন তীরের বেগে জঞ্জাল পুকুরের পাশে বেড়ে ওঠা ঢ্যাঙা নিম গাছটায় চড়ে বসে।
মেঘনা “ধর ধর! পড়ে যাবি” বলতে বলতেই, নেপচুন সোজা মগডালে উঠে পড়েছে। সরু ডাল নেপচুনের ভারে পেন্ডুলামের মতো দুলতে শুরু করে। নেপচুনও দাঁত নখ দিয়ে নিজের সব শক্তি নিয়ে ঝুলে থাকে।
নিচে মেঘনা হায় হায় করতে থাকে। এখন কী করে নামাবে? অত উঁচুতে সাহায্য করতে উঠবেই বা কে? হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকে। গাছ তলায় ক্রন্দনরত মেঘনা আর গাছের মাথায় দোলায়মান বিড়াল দেখে পথ চলতি মানুষ দাঁড়িয়ে পড়ে। উদ্ধার করার চেষ্টা না করে, কয়কজন ফোন বার করে ছবি তুলতে আরম্ভ করে দেয়।
দেখতে দেখতে সেইসব ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। এলাকার যত মার্জার প্রেমী লোকজন আর সংগঠন ছিল, তারা সব হইহই করে ওঠে। সেই ঢেউ ভার্চুয়াল দুনিয়া পার করে এসে পৌঁছয় স্থানীয় পুলিশ আর দমকল বাহিনীর কাছে।
ওদিকে নেপচুন নিমগাছে দুলতে দুলতে নিচে তাকিয়ে দেখে, রীতিমতো মেলা বসে গেছে। কয়েকটা কুকুরকে বকলেস আটকে নিয়ে তাদের মনিবেরা ঘুরতে বেরিয়েছিল। তারা বেড়ানো ভুলে দাঁড়িয়ে পড়েছে। নেপচুন বিরক্ত হয়। এটা কি সার্কাস হচ্ছে? কুকুররা পোষ্য হিসেবে মানুষের মতোই বোকা হয়।

বাজার যেতে যেতে লোকজন থেমে গেছে। ভীড় ওখানে দাঁড়িয়ে আছে দেখে কিছু আনাজওয়ালা সবজির ডালি নিয়ে নিমগাছের নিচে হাজির। চলে এসেছে চা-ওয়ালা, ঝালমুড়ি, বেলুন সহ আরও অনেকে।
এর মধ্যেই ভেঁপু বাজিয়ে দমকল, পুলিশ এসে গেল। তারা ঝপাঝপ ব্যারিকেড করে দর্শকদের একটা গণ্ডির বাইরে পাঠিয়ে দেয়। দমকল যখন লম্বা সিঁড়ি বার করবে, তখন ওপর থেকে নেপচুন বলে ওঠে, “ম্যাম্যাও ম্যায়াও ম্যায়াও।”
শুনে মেঘনা বলল, “ও আপনাদের অপেক্ষা করতে বলছে, এখুনি চ্যানেলের ওবি ভ্যান এসে পৌঁছচ্ছে। তারপর আপনাদের উদ্ধারের কাজ করতে বলছে।”
নেপচুন বিরক্ত হয়ে আরও বলতে থাকে, “যাদের আসা উচিত সবার আগে, তারাই দেরী করছে। মানুষগুলোকে নিয়ে সত্যিই বড় আশান্তি! বোকা কুকুরগুলোর মতোই বকলেসের গণ্ডিতে থেকে যত লাফালাফি!”
দেখতে দেখতে মিডিয়া এসে গল্প জুড়ে দেয়। শুরু হয় টক শো। সেখানে এক পরিবেশবিদ হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, “আরে! পুকুর দখল করে আবর্জনা কেন?”

সাথে সাথে ক্যামেরা ঘুরে গেল, জঞ্জাল পুকুরের দিকে। অমনি সব সাহেবসুবো, পণ্ডিত, নেতা, মাস্টার, দোকানদার হইহই করে ওঠে, “অবৈধভাবে পুকুর দখল চলবে না।”
সেই গর্জনের ঢেউ ফেসবুকের পাতা ছাড়িয়ে আছড়ে পড়ে চ্যানেল থেকে চ্যানেল-এ।
অন্যদিকে নেপচুন যে কখন নিজেই গাছ থেকে নেমে এসেছে, কেউ খেয়াল করেনি।
সাংবাদিকরা টের পেয়ে চলে আসে। মেঘনার কোলে চড়ে নেপচুনের ফটো সেশন চলে অনেকক্ষণ।
মেঘনার কানে কানে নেপচুন বলে, “এবার আর তোমাদের বাড়ি থেকে কেউ ওঠাতে পারবে না।”
একজন সাংবাদিক বড় একটা মাইক্রোফোন এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ওপর থেকে কেমন লাগছিল।”
উত্তরে নেপচুন বলে, “ম্যাম্যাও মিও মিও।”
যার অর্থ একমাত্র মেঘনা জানে, “মাছের কাঁটার মতো সুন্দর।”
ছবি সৌজন্য: Facebook, pinterest
এক সর্বগ্রাসী হাঁ-করা চোখ নিয়ে, কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌরভের। যা দেখেন, তাই মনে হয় ছুঁয়ে দেখলে ভালো হয়। কিছুটা প্রকৌশল, কিছুটা ছবি আঁকা, ভাষা শিক্ষা, থিয়েটার এমন আরও অনেক কিছু। এভাবেই ভেসে চলা। শৈশবে স্কুল পত্রিকায় হাত পাকিয়ে রেল স্টেশনে দেওয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের পাতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক পত্রিকায় পৌঁছনো। জীবিকার তাগিদে কম্পিউটারের সাথে সখ্য। পাশাপাশি কয়েক মাইল ‘কোড’লেখা চলে সমান্তরাল। কর্পোরেটের হাত ধরে পৃথিবীর কয়েক প্রান্ত দেখে ফেলার অভিজ্ঞতা। সবই উঠে আসে লেখায়। আপাততঃ কলকাতা ও ঢাকা মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সাত।
3 Responses
Liked it .. most important of this write up that it’s so smooth and free flow to go through it , I enjoy it . I always love to through the story and write up of Sourav Howladar.
চমৎকার
ভাই বেশ বেড়ে হয়েছে।