(Short Story)
দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার
(১৮৭৭-১৯৫৭)
এক দেশের এক রাজপুত্র। রাজপুত্রের রূপে রাজপুরী আলো। রাজপুত্রের গুণের কথা লোকের মুখে ধরে না।
একদিন রাজপুত্রের মনে হইল, দেশভ্রমণে যাইবেন। রাজ্যের লোকের মুখ ভার হইল, রাণী আহার-নিদ্রা ছাড়িলেন, কেবল রাজা বলিলেন,-“আচ্ছা, যাক্।”
তখন দেশের লোক দলে-দলে সাজিল,
রাজা চর-অনুচর দিলেন,
রাণী মণি-মাণিক্যের ডালা লইয়া আসিলেন। (Short Story)
রাজপুত্র লোকজন, মণি-মাণিক্য চর অনুচর কিছুই সঙ্গে নিলেন না। নূতন পোশাক পরিয়া, নূতন তলোয়ার ঝুলাইয়া রাজপুত্র দেশভ্রমণে বাহির হইলেন।(Short Story)
২
যাইতে যাইতে যাইতে, কত দেশ, কত পর্বত, কত নদী, কত রাজার রাজ্য ছাড়াইয়া, রাজপুত্র এক বনের মধ্যে দিয়া উপস্থিত হইলেন “দেখিলেন, বনে পাখ-পাখালীর শব্দ নাই, বাঘ-ভালুকের সাড়া নাই!-রাজপুত্র চলিতে লাগিলেন। \

চলিতে চলিতে, অনেক দূর গিয়া রাজপুত্র দেখিলেন, বনের মধ্যে এক যে রাজপুরী-রাজপুরীর সীমা। অমন রাজপুরী রাজপুত্র আর কখনও দেখেন নাই। দেখিয়া রাজপুত্র অবাক হইয়া রহিলেন।
রাজপুরীর ফটকের চূড়া আকাশে ঠেকিয়াছে। ফটকের দুয়ার বন জুড়িয়া আছে। কিন্তু ফটকের চূড়ায় বাদ্য বাজে না, ফটকের দুয়ারে দুয়ারী নাই।
রাজপুত্র আস্তে আস্তে রাজপুরীর মধ্যে গেলেন। (Short Story)
“অবাক হইয়া রাজপুত্র কাছে গিয়া দেখিলেন, কাতারে কাতারে সিপাই, লস্কর, কাতারে কাতারে হাতী ঘোড়া সব পাথরের মূর্তি হইয়া রহিয়াছে। কাহারও চে পলক পড়ে না কাহারও গায়ে চুল নড়ে না। রাজপুত্র আশ্চর্য হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।”
রাজপুরীর মধ্যে গিয়া দেখিলেন, পুরী যে পরিস্কার, যেন দুয়ে ধোয়া,-ধব্ ধব্ করিতেছে। কিন্তু এমন পুরীর মধ্যে জন-মানুষ নাই, কোন কিছুই সাড়া-শব্দ পাওয়া যায় না, পুরী নিভাজ, নিঝুম,-পাতাটি পড়ে না, কুটাটুকু নড়ে না।
রাজপুত্র আশ্চর্য হইয়া গেলেন। (Short Story)
রাজপুত্র এদিক দেখিলেন, ওদিক দেখিলেন পুরীর চারিদিকে দেখিতে লাগিলেন। এক জায়গায় গিয়া রাজপুত্র থমকিয়া গেলেন! দেখিলেন, মস্ত আঙ্গিনা, আঙ্গিনা জুড়িয়া হাতী, ঘোড়া, সেপাই, লস্কর, দুয়ারী, পাহারা, সৈন্য-সামন্ত সব সারি সারি দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। (Short Story)

রাজপুত্র হাঁক দিলেন।
কেহ কথা কহিল না,
কেহ তাঁহার দিকে ফিরিয়া দেখিল না। (Short Story)
অবাক হইয়া রাজপুত্র কাছে গিয়া দেখিলেন, কাতারে কাতারে সিপাই, লস্কর, কাতারে কাতারে হাতী ঘোড়া সব পাথরের মূর্তি হইয়া রহিয়াছে। কাহারও চে পলক পড়ে না কাহারও গায়ে চুল নড়ে না। রাজপুত্র আশ্চর্য হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। তখন রাজপুত্র পুরীর মধ্যে গেলেন। (Short Story)
এক কুঠরিতে গিয়া দেখিলেন, কুঠরির মধ্যে কত রকমের ঢাল তলোয়ার, তীর, ধনুক সব হাজারে হাজারে টানানো রহিয়াছে। পাহারারা পাথরের মূর্তি, সিপাইরা পাথরের মূর্তি। রাজপুত্র আপনার তলোয়ার খুলিয়া আস্তে আস্তে চলিয়া আসিলেন। (Short Story)
“রাজপুত্র দেখিলেন, রাজার মাথায় রাজছত্র হেলিয়া আছে, দাসীর হাতে চামর ঢুলিয়া আছে,-সাড়া নাই, শব্দ নাই, সব ঘুমে নিঝুম। রাজপুত্র মাথা নোয়াইয়া চলিয়া আসিলেন।”
আর এক কুঠরিতে গিয়া দেখিলেন, মস্ত রাজদরবার, রাজদরবারে সোনার প্রদীপে ঘিয়ের বাতি জ্বল্ জ্বল্ করিতেছে, চারিদিকে মণি-মাণিক্য ঝক্ঝক্ করিতেছে। কিন্তু রাজসিংহাসনে রাজা, পাথরের মূর্তি, মন্ত্রীর আসনে মন্ত্রী পাথরের মূর্তি, পাত্র-মিত্র, ভাট বন্দী, সিপাই লস্কর যে যেখানে, সে সেখানে পাথরের মূর্তি। কাহারও চক্ষে পলক নাই, কাহারও মুখে কথা নাই। (Short Story)
রাজপুত্র দেখিলেন, রাজার মাথায় রাজছত্র হেলিয়া আছে, দাসীর হাতে চামর ঢুলিয়া আছে,-সাড়া নাই, শব্দ নাই, সব ঘুমে নিঝুম। রাজপুত্র মাথা নোয়াইয়া চলিয়া আসিলেন। (Short Story)
আর এক কুঠরীতে গিয়া দেখিলেন, যেন কত শত প্রদীপ একসঙ্গে জ্বলিতেছে-কত রকমের ধন-রত্ন, কত হীরা, কত মাণিক, কত মোতি,-কুঠরিতে আর ধরে না। রাজপুত্র কিছু ছুঁইলেন না; দেখিয়া আর এক কুঠরিতে চলিয়া গেলেন। (Short Story)
সে কুঠরিতে যাইতে-না-যাইতে হাজার হাজার ফুলের গন্ধে রাজপুত্র বিভোগ হইয়া উঠিলেন। কোথা হইতে এমন ফুলের গন্ধ আসে? রাজপুত্র কুঠরির মধ্যে গিয়া দেখিলেন, জল নাই টল নাই, কুঠরির মাঝখানে লাখে লাখে পদ্মফুল ফুটিয়া রহিয়াছে! পদ্মফুলের গন্ধে ঘর ম’-ম’ করিতেছে। রাজপুত্র ধীরে ধীরে ফুলবনের কাছে গেলেন। (Short Story)
আরও পড়ুন: ছোটগল্প: ‘পয়োমুখম্’
ফুলবনের কাছে গিয়া রাজপুত্র দেখিলেন, ফুলের বনে সোনার খাঁট, সোনার খাটে হীরার ডাঁট, হীরার ডাঁটে ফুলের মালা দোলান রহিয়াছে; সেই মালার নিচে, হীরার নালে সোনার পদ্ম, সোনার পদ্মে এক পরমা সুন্দরী রাজকন্যা বিভোরে ঘুমাইতেছেন। ঘুমন্ত রাজকন্যার হাত দেখা যায় না, পা দেখা যায় না, কেবল চাঁদের কিরণ মুখখানি সোনার পদ্মের সোনার পাঁপ্ড়ির মধ্যে টুল্-টুল্ করিতেছে। রাজপুত্র ঝালর হীরার ডাঁটে ভর দিয়া, অবাক হইয়া দেখিতে লাগিলেন। (Short Story)
৩
দেখিতে দেখিতে, দেখিতে, দেখিতে, কত বচ্ছর চলিয়া গেল। রাজকন্যার আর ঘুম ভাঙ্গে না, রাজপুত্রের চক্ষে আর পলক পড়ে না। রাজকন্যা অঘোরে ঘুমাইতেছেন রাজপুত্র বিভোর হইয়া দেখিতেছেন।
চাঁদের কিরণ মুখখানি সোনার পদ্মের সোনার পাপ্ড়ির মধ্যে টুল্টুল্ …রাজকন্যার আর ঘুম ভাঙ্গে না, রাজপুত্রের চক্ষে আর পলক পড়ে না।…
হঠাৎ একদিন রাজপুত্র দেখিলেন, রাজকন্যার শিয়রে এক সোনার কাঠি! রাজপুত্র আস্তে আস্তে সোনার কাঠি তুলিয়া লইলেন। (Short Story)
“রাজা, মন্ত্রী জন-পরিজন সকলে আসিয়া দেখিলেন-রাজপুত্র রাজকন্যা মাথা নামাইলেন। রাজপুরীর চারদিকে ঢাক-ঢোল, শানাই-নাকাড়া বাজিয়া উঠিল!”
সোনার কাঠি তুলিয়া লইতেই দেখিলেন, আর এক দিকে এক রূপার কাঠি। রাজপুত্র আশ্চর্য হইয়া রূপার কাঠিও তুলিয়া লইলেন্ দুই কাঠি হাতে লইয়া রাজপুত্র নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতে লাগিলেন। (Short Story)
দেখিতে দেখিতে, সোনার কাঠিটি কখন টুক করিয়া ঘুমন্ত রাজকন্যার মাথায় ছুঁইয়া গেল! অমনি পদ্মের বন ‘শিউরে’ উঠিল, সোনার খাট নড়িয়া উঠিল; সোনার পাঁপ্ড়ি ঝরিয়া পড়িল, রাজকন্যার হাত হইল; পা হইল; গায়ের আলস ভাঙ্গিয়া, চোখের পাতা কচ্লাইয়া ঘুমন্ত রাজকন্যা চমকিয়া উঠিয়া বসিলেন। (Short Story)

আর অমনি রাজপুরীর চারিদিকে পাখি ডাকিয়া উঠিল, দুয়ারে দুয়ারী আসিয়া হাঁক ছাড়িল, উঠাতে হাতী ঘোড়া ডাক ছাড়িল, সিপাই তলোয়ার ঝন ঝন করিয়া উঠিল; রাজদরবারে রাজা জাগিলেন, মন্ত্রী জাগিলেন, পাত্র জাগিলেন, পাত্র জাগিলেন-হাজার বচ্ছরের ঘুম হইতে, সে যেখানে ছিলেন, জাগিয়া উঠিলেন-লোক লস্কর, সিপাই পাহারা, সৈন্য সামন্ত তীর তলোয়ার লইয়া খাড়া হইল।-সকলে অবাক হইয়া গেলেন-রাজপুরীতে কে আসিল। (Short Story)
রাজপুত্র। অবাক হইয়া গেলেন,
রাজকন্যা অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন। (Short Story)
রাজা বলিলেন,-“তুমি কোন দেশের ভাগ্যবান রাজার রাজপুত্র, আমাদিগে মরণ-ঘুমের হাত হইতে রা করিয়াছে!”
রাজা, মন্ত্রী জন-পরিজন সকলে আসিয়া দেখিলেন-রাজপুত্র রাজকন্যা মাথা নামাইলেন। রাজপুরীর চারদিকে ঢাক-ঢোল, শানাই-নাকাড়া বাজিয়া উঠিল! (Short Story)
রাজা বলিলেন,-“তুমি কোন দেশের ভাগ্যবান রাজার রাজপুত্র, আমাদিগে মরণ-ঘুমের হাত হইতে রা করিয়াছে!”
জন-পরিজনেরা বলিল,-“আহা। আপনি কোন্ দেবতা-রাজার দেব রাজপুত্র-এক দৈত্য রূপার কাঠি ছোয়াইয়া আমাদের গম্গমা সোনার রাজ্যে ঘুম পাড়াইয়া রাখিয়াছিল,-আপনি আসিয়া আমাদিগে জাগাইয়া রা করিলেন।
রাজপুত্র মাথা নোয়াইয়া চুপ করিয়া রহিলেন।
রাজা বলিলেন,-“আমার কি আছে, কি দিব? এই রাজকন্যা তোমার হাতে দিলাম, এই রাজত্ব তোমাকে দিলাম।” (Short Story)

চারিদিকে ফুল-বৃষ্টি, চারিদিকে চন্দন-বৃষ্টি; ফুল ফোটে, খৈ ছোটে,-রাজপুরীর হাজার ঢালে ‘ডুম-ডুম’ কাটী পড়িল।
তখন, শতে শতে বাঁদী দাসী বাট্না বাটে, হাজারে হাজের দাই দাসী কুট্না কোটে;
দুয়ারে দুয়ারে মঙ্গল ঘড়া
পাঁচ পল্লব ফুলের তোড়া;
আল্পনা বিলিপনা, এয়োর ঝাঁক,
পাঠ-পিঁড়ি আসনে ঘিরে’, বেজে ওঠে শাঁখ। (Short Story)
“তাহার পর, ফুটফুটে’ চাঁদের আলোয় আগুন-পুরুতে সম্মুখে, গুয়াপান, রাজ-রাজত্ব যৌতুক দিয়া, রাজা পঞ্চরত্ন মুকুট পরাইয়া রাজপুত্রের সঙ্গে রাজকন্যার বিবাহ দিলেন। চারিদিকে জয়ধ্বনি উঠিল।”
সে কি শোভা!-রাজপুরীর চার-চত্বর দল্দল্ ঝল্মল্। আঙ্গিনায় আঙ্গিনায় হুলুধ্বনি, রাজভান্ডারে ছড়াছড়ি; জনজনতার হুড়াহুড়ি,-এতদিনের ঘুমন্ত রাজপুরী দাপে কাঁধে, আনন্দে তোল্পাড়। (Short Story)
তাহার পর, ফুটফুটে’ চাঁদের আলোয় আগুন-পুরুতে সম্মুখে, গুয়াপান, রাজ-রাজত্ব যৌতুক দিয়া, রাজা পঞ্চরত্ন মুকুট পরাইয়া রাজপুত্রের সঙ্গে রাজকন্যার বিবাহ দিলেন। চারিদিকে জয়ধ্বনি উঠিল। (Short Story)

৪
এক বছর, দুবছর, বছরের পর বছর কত বছর গেল,-দেশভ্রমণে গিয়েছেন, রাজপুত্র আজও ফিরেন না। কাঁদিয়া কাঁদিয়া, মাথা খুঁড়িয়া রাণী বিছানা নিয়াছেন। ভাবিয়া ভাবিয়া চোখের জল ফেলিতে ফেলিতে রাজা অন্ধ হইয়াছেন। রাজ্য অন্ধকার, রাজ্যে হাহাকার। (Short Story)
একদিন ভোর হইতে-না-হইতে রাজদুয়ারে ঢাক-ঢোল বাজিয়া উঠিল, হাতী ঘোড়া সিপাই সান্ত্রীর হাঁকে দুয়ার কাঁপিয়া উঠিল।
রাণী বলিলেন,-“কি, কি?”
রাজা বলিলেন,-“কে, কে?”
রাজ্যের প্রজারা ছুটিয়া আসিল। রাজপুত্র- রাজকন্যা বিবাহ করিয়া লইয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন!!
কাঁপিতে কাঁপিতে রাজা আসিয়া রাজপুত্রকে বুকে লইলেন। পড়িতে-পড়িতে রাণী আসিয়া রাজকন্যাকে বরণ করিয়া নিলেন।
প্রজারা আনন্দধ্বনি করিয়া উঠিল (Short Story)
রাজপুত্র রাজার চোখে সোনার কাঠি ছোঁয়াইলেন, রাজার চোখ ভাল হইল। ছেলেকে পাইয়া, ছেলের বউ দেখিয়া রাণীর অসুখ সারিয়া গেল। (Short Story)
তখন, রাজপুত্র লইয়া ঘুমন্ত পুরীর রাজকন্যা লইয়া, রাজা-রাণী সুখে রাজত্ব করিতে লাগিলেন।
(বানান অপরিবর্তিত)
ক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার (১৫ এপ্রিল ১৮৭৭ - ৩০ মার্চ ১৯৫৭) ছিলেন বাংলার খ্যাতিমান শিশু সাহিত্যিক ও লোককথার সংগ্রাহক, যাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রূপকথাগুলিকে যথাসম্ভব অবিকৃত রেখে সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করা। সেগুলি মুখের কথার ধাঁচাতে হয়ে উঠেছে কথাসাহিত্যে তথা বাংলার সংস্কৃতিতে এক মূল্যবান সম্পদ।