(Short Story)
এই ঘটনা প্রাক্-মুঠোফোন যুগের। আশির দশক। আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতন, বিপ্লববাবুরও বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট এক অনু সংসার। সময়ের নিয়মে, বিপ্লববাবুও তখন বামপন্থায় বিশ্বাসি। ঘোর নাস্তিক। ওঁর স্ত্রী মলিনা, অন্যান্য গৃহবধুদের মতো অতটা পুজো-আচ্চায় বিশ্বাসি না হলেও, রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে খুব মান্যি-গন্যি করতেন। অতএব গিন্নীর আবদারে ঠিক হল পয়লা জানুয়ারিতে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে পুজো দিয়ে নতুন বছর শুরু করা হবে। মলিনার পুজো দেওয়ার সময়ে বিপ্লব ছেলেমেয়েকে নিয়ে গঙ্গার ঘাট, পঞ্চবটি ইত্যাদি ঘুরে বেড়াবে। তখনকার মধ্যবিত্ত পরিবারের ছুটি উদ্যাপন আর কী। (Short Story)
ভোর-ভোর স্নান করে পরিকল্পনা মতো তাই বেরিয়ে পড়া। তখন উড়ালপুল, মেট্রো-কানেক্টার, স্কাইওয়াক এতসব কিছু ছিল না। ট্যাক্সি থাকলেও, বাসই ছিল প্রধান বাহন। অত সকালেও দক্ষিণেশ্বর পৌঁছে তারা দেখে বিরাট ভিড়। এ যেন জনসমুদ্র। পুজো দেওয়ার লাইন এঁকেবেঁকে বহুদূর গড়িয়েছে। সেই দেখেই বিপ্লবের মুখ বিরক্তিতে ভরে উঠল। ওদিকে মলিনা এতদূর এসে পুজো না দিয়ে যাবে না। (Short Story)

এখানে এদের পরিবারের বিষয়ে একটু বিশদে পরিচয় দেওয়া যাক। বিপ্লবকেতন বিশ্বাস। নামেই আছে ‘বিপ্লব’, তাই আবার কমিউনিস্ট। বিপ্লব ভালই চাকরি করত এবং মাইনেকড়িও ভালই পেত। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী দুজনেই খুব হিসেবি। এক কথায় একটু বেশিই হিসেবি। নিন্দুকেরা আড়ালে বিপ্লবকেপ্পন বিশ্বাস বলে ডাকত তাকে। মধ্যবিত্তের মজ্জায়-মজ্জায় মূল্যবোধ। মাইনের সত্তর শতাংশ সেভিংস্ না করাকে তারা ঘোরতর পাপ মনে করত। কেন? না ছেলে, মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে না? আর সেই জন্যই বর্তমান কোনওদিনই সাদা-কালো ছবি থেকে ইস্টম্যান কালারে উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
অতএব মলিনার ঐ দু-তিনটি শাড়ি বই আর কিছু ছিল না আর বিপ্লবেরও অফিস যাওয়ার জন্য বরাদ্দ দু-তিন পিস্ জামা-প্যান্ট। এমন সংসারে কোনও কিছুই ফেলে দেওয়া হত না। বাড়ির ঘর-মোছার কাপড়টা পর্যন্ত বিপ্লববাবুর ছেঁড়া জাঙ্গিয়া ছিল। তাতে হয়তো ফুটোর সংখ্যা মশারি থেকেও বেশি। কিন্তু কাজ আটকে নেই তাতে। অবিশ্যি অন্যান্য পর্যটন-প্রিয় বাঙালিদের মতন বিশ্বাসরাও বেড়াতে খুব ভালোবাসত। আর ছিল যেকোনও জিনিসের প্রতি যত্ন। বিপ্লববাবুর জামা-কাপড়, ছাতা সবই চলত বহুদিন। মাথায় শ্যাম্পু না দিয়ে হয়তো সাবান ঘষা হচ্ছে, কিন্তু জামা-কাপড় সবসময় সযত্নে নিজের হাতে কাচে সে। তা যদি সাদা হয় তাহলে– রবিন-ব্লু দিয়ে ধুয়ে, ইস্ত্রি করে তবেই বিপ্লব গায়ে তুলত। ওয়াশিং মেশিনের বালাই ছিল না তখন। কাজের লোক বলতেও শুধু ঘর ঝাঁট দেওয়া ও মোছার। অতএব আপনা হাত, জগন্নাথ। (Short Story)
এই বিশাল পুজোর লাইন দেখে, ঠিক হল, বিপ্লব ও মলিনা পালা করে লাইনে দাঁড়াবে। অন্যজন ছেলে-মেয়েদের একটু এদিক-ওদিকে ঘুরিয়ে আনবে।
আর ছিল বিপ্লববাবুর জুতোর প্রতি দুর্বলতা। একটা জুতো কতদিন চালানো যায়, সেরকম কোনও ক্যাটাগরি থাকলে, বিপ্লব নিশ্চয়ই গিনিস-বুক অফ্ রেকর্ডসে স্থান করে নিতে পারত। (Short Story)
আবার মূল ঘটনায় ফিরি। এই বিশাল পুজোর লাইন দেখে, ঠিক হল, বিপ্লব ও মলিনা পালা করে লাইনে দাঁড়াবে। অন্যজন ছেলে-মেয়েদের একটু এদিক-ওদিকে ঘুরিয়ে আনবে। যখন মন্দিরের মেন দরজার কাছে লাইন এসে পৌঁছবে, তখন মলিনা ছেলে-মেয়ে সহ পুজোর ডালি নিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবে আর বিপ্লব বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের জুতো পাহারা দেবে। কমিউনিস্ট বিপ্লবের তো পুজো দেওয়ার বালাই নেই অতএব জুতো-রাখার ঠিকে দোকান গুলোতে আর আলাদা করে পয়সা দিয়ে মলিনা ও ছেলে-মেয়েদের জুতো রেখে যাওয়ার দরকার নেই। একেবারে নিখুঁত প্ল্যানিং।প্রথমে মলিনা লাইনে দাঁড়াল। বিপ্লব ছেলে-মেয়েদের নিয়ে গঙ্গার ঘাটের দিকটা ঘুরতে গেল। অনেকে স্নান করছে। চার-পাঁচটা নাপিতের কাছে একগাদা বাচ্চা-বুড়ো ন্যাড়া হচ্ছে। কোথাও পুরোহিতের মন্ত্র উচ্চারণ হচ্ছে, তো কোথাও হকার ও ক্রেতার মধ্যে দরাদরি চলছে। এক দঙ্গল ভিখিরি লাইন দিয়ে বসে আছে, তাদের আমদানিও বেশ ভালোই হচ্ছে । সেই দেখে বিপ্লব তাদের থেকে একটু তফাতে এসে দাঁড়াল। তার মেয়ের আবার দরাজ হৃদয়। এক্ষুনি হয়তো কিছু দান করতে চাইবে। একটা হকার, বাচ্চাদের দেখে বেলুন বিক্রি করতে এগিয়ে এল।
বিপ্লব তাকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিল। (Short Story)
“এইসব আজে-বাজে জিনিস বিক্রি না করে, ভালো বই তো ফিরি করতে পারো, যত্তসব”।
সেই দেখে আর একটি বাচ্চা মেয়ে, এক গাদা জ্যারিক্যান হাতে ধীরে সুস্থে পালিয়ে গেল। মেয়েটি জ্যারিক্যান বিক্রি করছিল, গঙ্গাজল ভরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ছেলে একটি আইস্ক্রিম খেতে চাওয়াতে বিপ্লব লম্বা এক লেকচার দিল ‘কীরকম নোংরা জল দিয়ে ঐ রাস্তার আইস্ক্রিম তৈরি হয়’ – যা খেলে বড়সড় পেটের রোগ হওয়া থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। বরং শশা খাওয়ার উপকারিতা বুঝিয়ে, তাই কিনে দিতে চাইল। কিন্তু বাচ্চারা শশা খাবে কেন। (Short Story)
বিপ্লব আবার সেখান থেকে সরে এসে সারিবদ্ধ দোকানের দিকে হাঁটতে লাগল বাচ্চাদের নিয়ে। সেখানেও কী শান্তি আছে। সব হকারগুলো এমন করে পশার সাজিয়ে বসেছে যে বাচ্চাদের চোখ ওখান থেকে সরেই না! দাম শুনে বিপ্লবের বিরক্তি শতগুন বৃদ্ধি পাচ্ছে। (Short Story)
“অ্যাবসার্ড দাম, এটা ভগবানের জায়গা না চোরেদের জায়গা” বিপ্লবের ভ্রু-জোড়া সেকেন্ড ব্র্যাকেট হয়েই থাকে।
“অ্যাবসার্ড দাম, এটা ভগবানের জায়গা না চোরেদের জায়গা” বিপ্লবের ভ্রু-জোড়া সেকেন্ড ব্র্যাকেট হয়েই থাকে। প্রতিটা দোকান চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে খদ্দের ধরতে ব্যস্ত। “কী চাই দাদা, যা নেবেন, তাই মাত্র পাঁচ টাকা– কী লাগবে বলুন… এই এদিকে আসুন” লোকগুলো নাছোড়বান্দা। বড় বড় পুতুল ঝোলানো। পুজোর জিনিসপত্র রাখা। শেষে এক হকার যখন বিপ্লবের হাত ধরে টেনে জিজ্ঞেস করেছে “আরে বলুন না, লাগবে টা কী?সব কিছু পাবেন”। অমনি আগুনে ঘি। বিপ্লব দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠল – “জুতো কিনব, জুতো আছে, আপনার কাছে জুতো আছে”? (Short Story)
লোকটি থতমত খেয়ে কী বলবে কিছু ভেবে না পেয়ে অস্পষ্টভাবে শুধু “অ্যাঁ, আজ্ঞে জুতো” বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। বিপ্লবও ভাবল অনেক হয়েছে, আর নয়। এর চেয়ে লাইনে দাঁড়ানো অনেক সেফ্ । অতএব ফিরে গিয়ে খুঁজে খুঁজে মলিনাকে বার করে ছেলে-মেয়েদের হেফাজত ট্র্যান্সফার করে, পুজোর ডালি নিয়ে লাইনেই দাঁড়াল। এতক্ষণেও লাইন বিশেষ এগোয়নি। এভাবে চললে বাড়ি কখন যেতে পারবে কে জানে! (Short Story)
যাও, তোমরা একটু ঘুরে এসো। আমি দাঁড়াচ্ছি। যা মনে হচ্ছে এখন অনেক সময় লাগবে। তাও প্রতি পনেরো-কুড়ি মিনিটে এসে একটু চেক্ করে যেও। (Short Story)
অন্তত আরো মিনিট পঁয়তাল্লিশ লাগবে। ওদিকে মেয়েটা এবার বায়না ধরেছে– তার পা ব্যথা করছে। কোথাও বসবে।
এবার মলিনা, মায়ের ঘর, পঞ্চবটি ইত্যাদি ঘুরতে শুরু করল। ছেলেমেয়েকে আইসস্ক্রিম কিনে দেওয়াতে তারাও বেশ খুশি। মাঝে একবার লাইনে ফিরে এর মধ্যে দেখে গেছে, লাইন কিছুটা এগোলেও, মন্দিরের মেন দরজা থেকে বিপ্লব তখনও বেশ খানিকটা দূরে। অন্তত আরো মিনিট পঁয়তাল্লিশ লাগবে। ওদিকে মেয়েটা এবার বায়না ধরেছে– তার পা ব্যথা করছে। কোথাও বসবে। তাই মলিনা আবার গঙ্গার ঘাটে ফিরে এসে, একটা চাতালে বসল। মেয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে চাতালেই শুয়ে পড়ল। ছেলেটা একটা বাঁশের কঞ্চি কুড়িয়ে, মাটিতেই আপন মনে দাগ কেটে নিজের খেয়ালে ছবি আঁকতে শুরু করল। আধঘণ্টা হতেই মলিনা মেয়েকে তাড়া দিয়ে ঘুম থেকে তুলল– “চ-চ, দেরী হয়ে যাবে, নিশ্চয়ই বাবা এতক্ষণে মন্দিরের দরজার কাছে চলে এসেছে। বাকিটা আমরাই লাইনে দাঁড়িয়ে যাব“। মেয়ে নড়ে-চড়ে বসে উঠতে সময় নিল। সবাই মিলে লাইনে ফিরে এসে বিপ্লবকে আর কোথাও খুঁজে পায়না। আগে, পিছের লোকও নেই। তাহলে কী লাইন তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাওয়ায় বিপ্লব মন্দিরের ভেতর চলে গেছে? কিন্তু বিপ্লব যা নাস্তিক, সে তো পুজো দেওয়ার পাত্র নয়। ক্রমশ টেনশন বাড়তে শুরু করল। ছেলেমেয়ে নিয়ে লাইন বরাবর কয়েকবার তন্নতন্ন করে খুঁজল। সূর্য তখন প্রায় মধ্য-গগনে। একজন বলল– একটু আগে এক ভদ্রলোক মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। তাকে ধরাধরি করে কয়েকজন নিয়ে গেছে ঠাকুরের ঘরের বাইরের সিঁড়ির দিকটায়। মলিনার তখন নাভিশ্বাস ওঠার মতন অবস্থা। ছেলেমেয়েকে নিয়ে সেখানে দৌড়ে গিয়ে খোঁজ নিল– সেই ভদ্রলোককে নাকি স্থানীয় নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে হয়েছে। (Short Story)

– কী পরেছিল বলুন তো? –মলিনার আকুল আর্তি, প্রায় কেঁদে ফেলে আর কী।
– ঐ চেক্ চেক্ বুশ সার্ট আর খয়েরি রঙের প্যান্ট। (Short Story)
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল মলিনা। না, তাহলে বিপ্লব নয়। কিন্তু এখন কী করা যায়। একজন বুদ্ধি দিল –আপনি লাউডস্পিকারে অ্যানাউন্স করান। অমনি ছেলেমেয়েকে নিয়ে মলিনা দৌড় দিল ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ সেকশনে। এই ধরনের কাজ সে আগে কখনও করেনি। ভীষণ অসহায় বোধ করছিল। কিন্তু ছেলেমেয়েদের সামনে ভেঙে পড়লে তো আরোই চলবে না। তাই, ‘কিছুই হয়নি’ ভাব দেখাতে হচ্ছে। এক রত্তি মেয়েটা, যে কিছুক্ষণ আগেও পা ব্যথা বলে ঘ্যানঘ্যান করছিল, সেও যেন কেমন মরিয়া হয়ে গেছে। তারও কপালে চিন্তার ভাঁজ।
কাউন্টারে বেশ ভিড়! এত লোক হারায় এখানে! এ কী কুম্ভের মেলা নাকি?
কাউন্টারে বেশ ভিড়! এত লোক হারায় এখানে! এ কী কুম্ভের মেলা নাকি? অবিশ্যি বিশেষ দিনে, দক্ষিণেশ্বরে ভিড়, জায়গার তুলনায় সত্যি অকুলান।
যাইহোক অ্যানাউন্সমেন্ট হল। মন্দিরের ভিতরে ও বাইরে দু’জায়গাতেই। “শ্রীযুক্ত বিপ্লবকেতন বিশ্বাস, আপনি যেখানেই থাকুন, মন্দিরের কাছে অ্যানাউন্সমেন্ট হলের সামনে চলে আসুন। এখানে আপনার স্ত্রী ও পরিবার আপনার জন্য অপেক্ষা করছে”। (Short Story)
পরপর তিনবার অ্যানাউন্স হল। তারপর অপেক্ষা। তিনজন মিলে এদিক-ওদিক তাকাতে শুরু করল, কোথাও থেকে যদি বিপ্লবকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। কিন্তু কোথায় কী। বুকের মধ্যে দা-মা-মা যেন দ্বিগুন বেগে বাজতে শুরু করেছে। যত রকমের অলুক্ষণে কথা মনে আসে অসময়ে! কদিন আগেই একটা সিনেমা দেখেছিল মলিনা, যেখানে হঠাৎ করেই এক ব্যক্তির স্মৃতিশক্তি সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে গিয়েছিল। তারপর সে দিশাহারা হয়ে সব ছেড়ে নিরুদ্দেশের পথে বেরিয়ে পড়েছিল। গত কয়েকবার বিপ্লবও বাজার করতে গিয়ে ফর্দের দু-একটা জিনিস আনতে মিস্ করে গেছে। তখন ব্যাপারটাকে অত গুরুত্ব দেয়নি মলিনা। ধরে নিয়েছিল হিসেবি বিপ্লব ইচ্ছে করেই খরচ বাঁচাতে জিনিসগুলো আনেনি। তবে কী এই ভুলে যাওয়ার রোগই বাড়াবাড়ি হয়ে… উফ আর ভাবা যাচ্ছে না! (Short Story)
– আচ্ছা মা, বাবা কি রাগ করে বাড়ি চলে গেল?
মেয়েটা শুকনো মুখে জিজ্ঞেস করল। তার চোখ ছলছল করছে।
রোদে পুড়ে, খিদে-তেষ্টায়-চিন্তায় সবার মুখ শুকিয়ে গেছে। কী করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। এমন সময় ছেলেটি হঠাৎ তারস্বরে চিৎকার করে উঠল– “জুতো”! (Short Story)
এক ফোকলা বুড়ো লোক, স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে সেই দোকান দেখভাল করছেন। নিপুন মুন্সিয়ানায় একটা লম্বা লাঠির দ্বারা খানিক দূরত্বে রাখা বিভিন্ন জুতো, চটিকে ধরে এনে জুতোর মালিকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন
“অ্যাঁ? কী?” চমকে উঠে তাকিয়েছে মলিনা এবং আশেপাশের আরও কয়েকজন।
“বাবার জুতো!” বিস্ফারিত চোখে, অঙ্গুলি নির্দেশে ছেলেটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে, জুতো-রাখার ঠিকে দোকানের দিকে।
সেই দোকানের থরে থরে নানা ধরনের জুতো, চটি রাখা। এক ফোকলা বুড়ো লোক, স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে সেই দোকান দেখভাল করছেন। নিপুন মুন্সিয়ানায় একটা লম্বা লাঠির দ্বারা খানিক দূরত্বে রাখা বিভিন্ন জুতো, চটিকে ধরে এনে জুতোর মালিকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন অথবা তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে রেখে দিচ্ছেন। পরিবর্তে তাদের কাছে দু’টাকা পাচ্ছেন। (Short Story)
“ওটা বাবার জুতো কী করে বুঝলি… ওখানে তো অনেক কালো জুতো রয়েছে!” মলিনা যাচাই করতে চায়।
“আমি শিওর”, ছেলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, “ঐ রকম উপরে পালিশ করা, অথচ জুতোর শুকতলার একদিকটা একটু বেশি ক্ষয়ে যাওয়া, এবং সব থেকে বড় প্রমাণ ঐ ফিতে গুলো, লক্ষ করো ফিতের শেষ মুখে যে প্লাস্টিক থাকে, সেগুলো কোনোটাতেই নেই –তাই ফিতের প্রান্তগুলো কেমন ঝাঁটার কাঠির মতন হয়ে আছে… ওটা বাবার ছাড়া কারুর হতেই পারে না।” (Short Story)

বলেই সে ওখানে উবু হয়ে বসে পড়ে। “বাবা তার মানে মন্দিরের ভেতরেই ঢুকেছে। পুজো দিয়ে বেরিয়ে এখানেই আসবে জুতো নিতে। আমরা এখান থেকে এক-পাও নড়ব না।”
“কিন্তু অ্যানাউন্সমেন্ট তো মন্দিরের ভিতরে হল, তাও তোর বাবা শুনতে পেল না? কই এল না তো? আর তোর বাবা পুজো দেবে?” মলিনার তখনও বিষয়টা বিশ্বাস হতে চায় না। (Short Story)
“নিশ্চয়ই শুনতে পায়নি ভেতরের হৈ-হট্টগোলে, অথবা এত কাছে পৌঁছে পুজো না দিয়ে বেরিয়ে আসাটা পুরো লোকসান হবে ভেবে…”, ছেলে স্বপক্ষে যুক্তি সাজায়।
“তা দ্বিতীয়টা হতে পারে বৈকি… তোর বাবা যা হিসেবি, লাভ-লোকসানের অঙ্কটা নিশ্চয়ই ঠিক কষে ফেলেছে… নিজের নাস্তিকতার চেয়ে সেটা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ঠিকই”, মলিনা যেন কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারে -“মা ভবতারিণী আজ তোর বাবার হাত থেকে পুজো নিয়ে তবেই ছাড়বে মনে হচ্ছে” (Short Story)
এরপরে তিনজন ঠায় বসে থাকে ওখানে। নিষ্পলকে চেয়ে থাকে জুতো জোড়ার দিকে। যেন অন্য কেউ এসে সে জুতো নিয়ে না চলে যায়।
এরপরে তিনজন ঠায় বসে থাকে ওখানে। নিষ্পলকে চেয়ে থাকে জুতো জোড়ার দিকে। যেন অন্য কেউ এসে সে জুতো নিয়ে না চলে যায়। তাহলে শুধু জুতো যাবে তা তো নয়, সম্পূর্ণ আশা-ভরসা তার সঙ্গে চলে যাবে। (Short Story)
প্রায় মিনিট কুড়ি পরে সত্যি দেখা যায় বিপ্লব হাতে পুজোর ডালি নিয়ে বেরিয়ে আসছে। কপালে লম্বা করে সিঁদুরের তিলক টানা, ভ্রূ-জোড়া তখনও সেকেন্ড ব্র্যাকেট। জুতো নিতে যেই গেছে, অমনি ছেলেমেয়ে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। মলিনাও দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চোখ দিয়ে অজান্তেই গড়িয়ে পড়ে আনন্দাশ্রু। এগিয়ে গিয়ে বলে “অনেক হয়েছে, চল এবার বাড়ি যাই”। উত্তরে বিপ্লব ক্লান্ত স্বরে বলে, “আগে কিছু খাই চল… খুব খিদে পেয়েছে।” সকলের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। পাশের স্টলে তখন গরম গরম কচুরি ভাজা হচ্ছে আর রসগোল্লা গুলোও যেন তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। (Short Story)
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
‘কুহকী’ তাঁর ছদ্মনাম। এই নামে লেখক এর আগে প্রকাশ করেছেন 'একলব্য অতঃপর ও অন্যান্য গল্প' বইটি যা পাঠকমহলে যথেষ্ঠ প্রশংসা লাভ করেছে । এছাড়াও দুই বাংলার লেখকদের নিয়ে অভিযান পাবলিশারের 'থ্রীলার অভিযান' সংখাতেও কুহকীর লেখা স্থান পেয়েছে । নবকল্লোল, আনন্দমেলা ও অন্যান্য পত্রিকাতেও গল্প লিখছেন। কুহকীর জন্ম ১৯৭৫-এ কলকাতায়। আইআইটি থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে একটি বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত। বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পেশা হলেও দেশবিদেশের সিনেমার বিশেষ অনুরাগী। নেশা, সাহিত্যচর্চা ও ছবি আঁকা।