(Short Story)
যেহেতু নিজস্ব ট্রেডমার্ক হাসিটা গোটা মুখে খেলিয়ে তুলে দেবহূতি বলেছিল, ‘মফস্সলের ছোট কাগজ, একটা গল্প দিস, অনুরোধ’, আমিও, অতএব, তারপর থেকে একাধিকবার, চেষ্টা করে গেছি নিটোল একটি গল্প লেখার। যেমন-তেমন গল্প নয়; পাঠককে আন্দোলিত করবে, বিব্রত করবে, তার মধ্যবিত্ত যাপনের মূল পর্যন্ত নাড়িয়ে দেবে— এমন গল্প। আজকের রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে, সেক্ষেত্রে, বলাই বাহুল্য, বিদ্বেষের রাজনীতির থেকে জবরদস্ত্ বিষয় আর-কিছু হতে পারে না— প্রথমাবধি এইমতো মনস্থ করে ওই খাতেই ভাবতে বসি। (Short Story)
উল্লেখ থাক, এদিক-ওদিক কোনও উলটোপালটা ভাবনা যে মাথায় চলে আসেনি সেই সময়, তা হয়তো নয়; তবু যখন-যখন নতুন গল্প লেখার কথা ভেবেছি কিংবা মনে পড়ে গেছে দেবহূতির হাসিমুখ, প্রতিবার ধ্রুবতারার মতো মস্তিষ্কের ঠিক উত্তরে, স্থাণুবৎ, আটকে থেকেছে ওই একটিমাত্র বিষয়: বিদ্বেষের রাজনীতি; শেষমেশ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘাটে এসে নোঙর ফেলা, থিতু হওয়া নির্দিষ্ট আখ্যানবস্তুতে, অতঃপর। সেদিন কলেজে, ক্লাসের ফাঁকে, মনের ভিতর থেকে—উঁকি দিয়েই হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল মুহূর্তে— ছোট্ট একটা চিন্তাসূত্র দানা বাঁধছিল, চটজলদি যা লিখেও ফেলেছিলাম সামনেই টেবিলের উপর রাখা এলোমেলো কাগজে। (Short Story)
বাংলা পড়াতে গেলে সাধারণত ল্যাপটপ তেমন একটা লাগে না, ফলত ওটা তখন বাড়িতে, তক্তাপোশের উপর, আলগোছে। সেমিস্টারের ইন্টারনাল পরীক্ষার জন্য কলেজ থেকে মোট ষোলো পৃষ্ঠার যে-খাতা দেওয়া হয়, তারই একটার পিছনদিকে প্রাথমিক কাটাকুটি, প্ল্যান-প্রোগ্রাম— সাহিত্যের গবেষকদের মধ্যে অনেক বালখিল্যই যেসব কাগজপত্রকে খসড়া মনে করে থাকে, শুরু করি। যেন বিশাল কোনও দেশোদ্ধার করছি— এমন একখানা ভাব এনে ওই মুহূর্তে শুধু উপাদানটুকুই লিখি: চরিত্র যে-ক’টিই থাকুক-না-কেন, নামের মধ্যে দিয়ে কয়েকজনকে অন্তত, নিদেনপক্ষে প্রোটাগনিস্টকে তো বটেই, মুসলমান বোঝাতে হবে। (Short Story)
যদিও এর ঠিক পরে-পরেই খেয়াল হয় যে, আমাদের এখানে তো নাম দিয়ে পার্সি আর মুসলমান আলাদা করা হয় না, গুজরাট দাঙ্গার উপর বানানো দুর্দান্ত একটা ফিল্ম্—‘পারজানিয়া’, সম্ভবত—এই ফ্যালাসিটা চমৎকার ধরেছিল; চমৎকার বলছি বটে, আদতে যারপরনাই মর্মান্তিক। (Short Story)

প্রোটাগনিস্টকে, সুতরাং, নাম দিলেই হবে না, বাইরের অবয়বে মুসলমান বোঝাতে হলে সঙ্গে জুড়ে দিতে হবে প্রয়োজনীয় বেশ-কিছু প্রপ্স্। এক-দুই করে লিখলাম একে-একে: আরবি শবভাণ্ডার ছেনে তুলে-আনা জুতসই একটি নাম, গলায় কালো সুতোয় বাঁধা তাবিজ, মাথায় ছোট জালিকাবিশিষ্ট ফেজটুপি, চোখের কোলে সুর্মার ঈষৎ প্রলেপ, চিবুকে ছুঁচালো দাড়ি— গোঁফহীন: টিপিক্যাল মুসলমান। শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার কারণেই দেশের ভিতরে ক্রমাগত আক্রান্ত হতে হচ্ছে মানুষগুলোকে— কী কথায়, কী শরীরে! (Short Story)
পক্ষান্তরে অ্যান্টাগনিস্ট, অবশ্যই, উগ্র হিন্দুত্ববাদীর দল, যাদের পরিচয়চিহ্ন হিসাবে ভ্রূ-যুগলের ঠিক মাঝবরাবর থাকবে গেরুয়া বা লাল তিলকের আঙুলটান, গলায় গেরুয়া উত্তরীয় কিংবা কপালে ওই রঙেরই ফেট্টি। (Short Story)
প্রাথমিকভাবে এই অবধি ভেবে নিয়ে মনে-মনে ঠিক করি, গল্পটা, যেটা লিখব, তাতে পাঠকের কাছে দাঙ্গা যেন দাঙ্গার স্বরূপেই প্রতীত হয়; ঘুণাক্ষরেও যেন পাড়াতুতো কোন্দল অথবা লুঠপাট বলে ঠাহর না-হয়। দাঙ্গা যে কাকে বলে, আজকের এই ঘুলিয়ে দেওয়া প্রতিবেশে অনেকেই ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেন না; অথবা এমনও হতে পারে যে, হয়তো জানেনই না। যদিও তৃতীয় আর-একটি সম্ভাবনাও এখানে থাকতে পারে: হয়তো সবটাই জানে, পুরোটাই আছে বোঝাপড়ার মধ্যে, শুধু উপস্থাপনের সময়, দেখা গেল, ধর্মকে ধরে ইচ্ছাকৃত একটা উসকানি দিয়ে দিল: ধর্ম নিয়ে রাজনীতির দুরভিসন্ধি, কূট অভিপ্রায়। (Short Story)
“কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে, সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়ে, কাগজ-কলম— যেহেতু প্রাথমিক ছক কষেছিলাম কাগজে— টেনে নিয়ে বসি। গত ক-দিন ধরে এটাই আমার রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
অর্থাৎ, লেখবার সময় লেখককে— আপাতত আমাকে— সবচেয়ে বেশি সচেতন থাকতে হবে এই বিষয়টায়; প্রতিমুহূর্তে মনে রাখতে হবে, দাঙ্গায় নিশ্চিত মারামারি-লুঠপাট হবে, কিন্তু শুধুমাত্র সেসব হলেই যে যথার্থ অর্থে দাঙ্গা হয়ে উঠবে, তেমনটা না-ও হতে পারে। (Short Story)
কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে, সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়ে, কাগজ-কলম— যেহেতু প্রাথমিক ছক কষেছিলাম কাগজে— টেনে নিয়ে বসি। গত ক-দিন ধরে এটাই আমার রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গল্পটা জুতসই করে লিখে উঠতে না-পারা পর্যন্ত বিচ্ছিরি একটা অস্বস্তি কাজ করছে মাথার ভিতর, সেটার রেশ শরীর পর্যন্তও চারিয়ে যাচ্ছে এমনকি; এক তো বহুদিন নতুন কিছু লিখতে পারছি না আর দুই, দেবহূতিকে গল্প দেব— কথা দিয়ে বসে আছি। লিখতে বসে মনে হয়, গল্পের কাহিনি বর্তমান থেকে শুরু করে নিয়ে গিয়ে ফেলব অতীতে, তারপর সেই বর্তমানে— যেখান থেকে কাহিনির শুরুয়াত করেছি— এনে বৃত্ত সম্পূর্ণ করেই দাঁড়ি টেনে দেব; এগোব না আর।
এতে পাঠকের মনে একটা স্বাভাবিক কৌতূহল তৈরি হবে, পরের ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা জন্মাবে এবং গল্পে যেহেতু তার নিরসন দেওয়া হবে না কোনও, স্বভাবতই একাধিক সম্ভাবনা ভেসে বেড়াবে মাথার চারপাশে: আদ্যিকালের গল্পের পরিচিত আদল: শেষ হয়েও শেষ না-হওয়ার চিরায়ত এবং পরীক্ষিত কৌশল। (Short Story)
“ঘরময় পায়চারি করেছি উদ্ভ্রান্তের মতো। টেবিলের উপর খোলা কাগজ হাওয়ায় উড়েছে আপন খেয়ালে। ভাবতে থেকেছি একমনে। পা অস্থির, মন স্থির। ফিরে এসে ফের টেনে নিয়েছি কাগজ-কলম।”
সেইমতো প্রতিবেশী দুই পাড়ার বর্ণনা দিয়ে শুরু করি গল্প: জল আর আগুনের উপাখ্যান। দাউদাউ আগুন, চাপ-চাপ রক্ত, রুধিরস্রোত, পোড়া গন্ধ, আর্তনাদ, উল্লাস, জিঘাংসা, জলের সরণ ইত্যাদি। (Short Story)
দৃষ্টিপথ ঢেকে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। পাক খেয়ে উপরে উঠছে, ভেঙে যাচ্ছে তারপর। চোখ ক্রমে নিচের দিকে নেমে এলে ধরা দেয় আগুনের হল্কা। লু এসে লাগে চোখে, মুখে। ঘর-বাড়ি জ্বলছে। কোনওটা ধিকিধিকি, কোনওটা-বা দাউদাউ। লেলিহান সেই শিখার আবহে আর্তনাদের যথাযোগ্য সঙ্গত। উল্লাস চলে গেলে বুকফাটা ক্রন্দন। জলের সন্ধান। আগুনের ঔদ্ধত্যে জলের বিনয়। (Short Story)
শুরুটা লিখে মনের মধ্যে যে বেশ একটা তৃপ্তি হয়েছিল, সেটা বুঝেছিলাম পরদিন সকালে। মানসিক শান্তি ছাড়া অমন ভাল ঘুম সাধারণত হয় না আমার। প্রাতরাশ সেরে প্রফুল্লচিত্তে এসে বসেছিলাম লেখার টেবিলে। সেলাইহীন দিস্তে কাগজের পৃষ্ঠা উলটেছিলাম তারপর। সূচনার ওই দশটি বাক্য ফিরে পড়েছি। পরপর বেশ কয়েকবার। খানিক পরে মনে হয়েছে: দাঙ্গার মতো ক্রূর এবং কঠোর বিষয়ে লেখা কি এমন কাব্যিক হতে পারে? হওয়া উচিত কি আদৌ? এটা ঠিক যে, জ্যামিতির সেই সমান্তরাল দুই সরলরেখার মতো ঔচিত্য আর ঘটনার মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিলমিশ হয় না, তবু লেখার ক্ষেত্রে সচেতনতার গুরুত্ব তো অস্বীকারের নয়। সচেতন আর অচেতনের মধ্যে এখানেই মস্ত ফারাক। ‘সচেতন না-হলে লেখা উচিতই নয় কারও’— মাথার মধ্যে নিজস্ব কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছি থেকে-থেকেই। (Short Story)
ফ্রিডাসের সঙ্গে সক্রেটিসের সংলাপ ঘাই মেরেছে মস্তিষ্কে: মিশরদেশের দেবশ্রেষ্ঠ থামুসের কিংবদন্তী খেলা করেছে অবিকল: রাজা থামুসের কোনও লিপি জানা ছিল না, অবশ্য সেসবের দরকারও ছিল না তার। আসলে তার কথাই মান্য— সেখানে কোনও দ্বিধা নেই, অস্পষ্টতা নেই, অন্যার্থের পিছল ইশারা নেই; রাজকণ্ঠ সুনির্দিষ্ট, স্বরাট। একদিন রাজার সামনে এসে দাঁড়ায় দেবকল্প এক মানব— থেউথ; থেউথ এসে নিজের শিল্পকলার নমুনা পেশ করে রাজসমীপে এবং জানায় যে, এক আশ্চর্য কৌশল আবিষ্কার করেছে সে, যার নাম দিয়েছে ‘লিপি’। কথন আর লিখনের মধ্যেকার অন্তর্লীন দ্বন্দ্ব এসব। শাসক সর্বদাই চাইবে, লিখন নয়, কথন থাকুক ব্যপ্ত হয়ে; লিখনের মধ্যে অর্থের স্বাভাবিক যে-অস্থিরতা, অনির্দিষ্টতা, এমনকি দোলাচলতা থাকে, তা যে-কোনও স্থিতাবস্থার পক্ষেই বিপজ্জনক। (Short Story)
থামুস আর থেউথ এসে মাথায় চেপে বসতেই বুঝতে পেরেছিলাম, সূচনার যে-দশটি বাক্য লিখে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলে পরিতৃপ্তির ঘুম দিয়েছি আমি, তা আসলে অসৎ। গল্প ভাল হতে পারে, গল্প খারাপ হতে পারে। খারাপ গল্প, অসৎ সাহিত্য অশ্লীল চাটুবাক্যে ও তোষামোদী ভাবনায় খুশি করতে চায় ফ্যাসিস্ট শক্তিকে। ভাল গল্প, সৎ সাহিত্য, জন্মায় প্রচণ্ড তাগিদে, বিশ্বাসের তাড়নায়। ঔদার্যের যে-মুক্তচিন্তা ছড়িয়ে দিতে চাই আমি, তা কখনওই কোনও অন্যায়কে মেনে নেওয়ার অপযুক্তিতে থিতু হতে পারে না— শুরুর ওই দশটি বাক্য, ফলত, এক্ষেত্রে অশ্লীল। (Short Story)

হয়নি, কিচ্ছু হয়নি। লিখতে হবে ফের, নতুন করে লিখতে হবে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছি। ঘরময় পায়চারি করেছি উদ্ভ্রান্তের মতো। টেবিলের উপর খোলা কাগজ হাওয়ায় উড়েছে আপন খেয়ালে। ভাবতে থেকেছি একমনে। পা অস্থির, মন স্থির। ফিরে এসে ফের টেনে নিয়েছি কাগজ-কলম। (Short Story)
তলপেট দু-ফাঁক, নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে রক্তমাখা নিম্নাঙ্গ সম্পূর্ণ উদোম, মুখে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট—মরে পড়েছিল মেয়েটা। শরীর এখনও গরম, বোঝা যায়, খানিক আগেই মরেছে। চারজনের পা চেপে রেখেছিল মেয়েটার হাত আর পা, যখন পাঁচ নম্বর তার তলপেট ফুঁড়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ত্রিশূল আর কিছুক্ষণেই তুলে এনেছিল একটি অগঠিত ভ্রূণ; সূর্যের আলো এসে ত্রিশূলে ছিটকে পড়ে ধাঁধা লাগাচ্ছিল চোখে, তবু সেই আলোর ঝলকানি ছাপিয়েও কেঁপে-কেঁপে উঠছিল ফলায় আটকে-থাকা অগঠিত মাংসপিণ্ড। উল্লাসে আকাশের দিকে দু-হাত ছুঁড়ছিল পাঁচ নম্বর, নিচের সেই কাঁপুনিই ছড়িয়ে পড়ছিল সর্বত্র।… (Short Story)
“আগের দিন, একটু রাতের দিকেই, ফোন করেছিল সৌরীশ। লিসবন থেকে ওটাই সুবিধার: অফিস থেকে ঘরে ফিরে ফ্রেশ হয়, তারপর একটা বিয়ার নিয়ে গুছিয়ে বসে সব ফোনগুলো এক-এক করে সারে সে।”
ঠিক এইখান থেকেই ঘটনাকে টেনে নিয়ে যেতে হবে অতীতে। অতীতের সেই কাহিনিতে একটা মোলায়েম প্রলেপ দেওয়া যেতে পারত, কিন্তু যেহেতু বর্তমানের অংশটা— হার্ড রিয়্যালিটির চূড়ান্ত যে-জায়গাটা— গল্পের শুরুতেই দিয়ে দিচ্ছি, তাই আর কোনও পেলবতা নয়, বরং একটা চাপা টেনশনের পরিবেশ ক্রমাগত তৈরি করে যেতে হবে। বাকি গল্প সেই খাতেই এগোবে আর শেষে আবারও ফিরিয়ে আনব সূচনাদৃশ্যটি। (Short Story)
টেবিলের লাগোয়া দেয়ালের প্লাগ-পয়েন্টে মোবাইলটা চার্জ হচ্ছিল। বিথোফেনের ফিফ্থ্ সিম্ফনি বেজে উঠতেই চেয়ে দেখেছি; সৌরীশ। আগের দিন, একটু রাতের দিকেই, ফোন করেছিল সৌরীশ। লিসবন থেকে ওটাই সুবিধার: অফিস থেকে ঘরে ফিরে ফ্রেশ হয়, তারপর একটা বিয়ার নিয়ে গুছিয়ে বসে সব ফোনগুলো এক-এক করে সারে সে। গল্পটার ওই প্রথম শুরুর বিচ্ছিরি বাক্যগুলো নিয়ে তখন তৃপ্তি গড়িয়ে পড়ছে আমার— যাকে বলে একেবারে আত্মতুষ্টির কাঁঠাল— থোড়াই-না সেই মৌতাত কাটাতে মন চায়! ফোনটাও তাই ধরিনি তখন। (Short Story)
সেই সময়, টেবিলে-রাখা ঘড়ি সময় জানাচ্ছিল, সকাল দশটা পঁয়ত্রিশ; মনে-মনে হিসাব কষি, লিসবনে তখন ভোর ছ-টা বেজে পাঁচ মিনিট হবে, এত সকালে কেনই-বা ফোন করবে সৌরীশ, ওর বাড়ির কারও কি কোনও অঘটন ঘটল— এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতেই ফোনটা ধরেছিলাম আমি: ‘গুড মর্নিং! গতকাল আসলে এত টায়ার্ড ছিলাম—।’ (Short Story)
“বন্ধুত্ব তখনই বিচ্ছেদবিন্দুতে উপনীত হয়, যখন পারস্পরিক ভাঙন অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। যোগাযোগ না-থাকাটা মোটেও ঠিক কথা নয়, কিন্তু সেইসব অভিমান একান্তই বন্ধুত্বসম্পর্কের নিজস্ব এক্তিয়ার।”
‘ওটা কোনও ইস্যুই নয়। যে-কারণে তোকে কাল থেকে ফোন করে যাচ্ছি, সেটা বলি আগে।’
আমি চুপ করে থাকি। ওকে বলতে দিই।
‘মাসুমের কোনও খবর জানিস? গত ক-দিন ধরে ওকে ফোন করে যাচ্ছি, নো রেসপন্স! ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া?’ (Short Story)
মানতেই হল, আমি জানি না। বস্তুত, সৌরীশই একমাত্র যোগাযোগ রাখে সব বন্ধুদের সঙ্গে। ও যখন-যখন দেশে ফেরে, সবাইকে একজোট করে ছোটোখাটো একটা রিইউনিয়ন প্রতিবারই করে থাকে; স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় ওই সময়েই। তারপর আবার সব ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে-যার মতো। (Short Story)
|| দুই ||
আজকের তারিখে, সৌরীশের অনুরোধে, আমি রিষড়ায়। আপ ব্যান্ডেল লোকাল আমায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে উত্তরে। রেলস্টেশন ছাড়িয়ে স্কুলের দিকে এগোতেই ডানহাতের রাস্তায় রিষড়া থানা। থানার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করি, তিনটে পুলিশভ্যান রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে; উত্তরপাড়া কিংবা রিষড়া— কোনও থানাতেই একাধিক পুলিশভ্যান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখিনি কখনও। হাঁটায় যদিও কোনও বদল ঘটে না আমার; যেমন হাঁটছিলাম, তেমনই হেঁটে যাই আল-আমিন মসজিদের দিকে। মসজিদ ঘিরে যে-মহল্লা, সেখানেই ঠিকানা আমাদের বন্ধু মাসুম আখতারের। (Short Story)

ছেলেবেলায় একবার, মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পরই হবে— স্কুলে তখনও পর্যন্ত হায়ার সেকেন্ডারি চালু হয়নি— আমরা সদলবলে এসেছিলাম মাসুমদের বাড়ি। ওর চাচাতো ভাই আসিফ আর আতিফ তখন খুবই ছোটো, আমাদের কথাবার্তার মধ্যে এসে বেবাক চাইছিল এর-তার মুখের দিকে। অন্দর থেকে মাসুমের আম্মি কিংবা চাচি, কেউ-একজন, ডাক দিতেই একসঙ্গে ছুটেছিল দুই ভাই। তার কিছু পরেই ঘরে এসেছিল নাশ্তা: সুদৃশ্য রেকাবিতে ভাজা সেমাই, চিকেন রোস্ট, ফিরনি আর রু-আফজা। তারপর থেকে কম জায়গায় তো খেলাম না, সৌরীশই খাইয়েছে কত জায়গায়, মাসুমদের বাড়ির মতো অমন দুর্দান্ত চিকেন রোস্ট আর কোথাও পাইনি। (Short Story)
স্কুলের রাস্তা পেরিয়ে আরও কিছুটা এগোলেই, এসডি নার্সারি স্কুলের ঠিক আগে ডানদিকের গলি, আল-আমিন মসজিদ। মহল্লায় তেমন কোনও ব্যস্ততা নজরে পড়ে না। মোড়ের মাথা থেকে যতটুকু চোখে পড়ে, দেখি: মাথার উপর আড়াআড়ি শিক্লির সার, চাঁদ-তারার ছবিওয়ালা ফালি কাপড়, কিছু দূরে মসজিদের গম্বুজের উপর কোনাকুনি বাঁধা একটা চোঙ। ধীর পায়ে ওই থমথমে আবহাওয়ার মধ্যে দিয়ে আমি প্রবেশ করি মহল্লায়। একসময়ের চেনা চারপাশ ঠিকমতো আর ঠাহর করতে পারি না। যোগাযোগের সেতুটা ভেঙে গেলে পর আমরা সবাই, প্রকৃত প্রস্তাবে, বিচ্ছিন্ন দ্বীপমাত্র। মসজিদের দু-পাশে দুটো দোকানের আদল, হালে ভেঙে পড়েছে— মালুম হয়। (Short Story)
আরও পড়ুন: অর্থ কোনও খুঁজে নাহি পাই রে
রাস্তার ধারের টাইমকল থেকে জল পড়ে চলেছে নাগাড়ে। মাথায় ওড়না জড়িয়ে এক মহিলা, কোলে পিতলের কলসি, এসে দাঁড়ায়। উপচে-পড়া জলে কলসিটা ধুতে থাকে। খানিক ইতস্তত করে তাকেই জিজ্ঞাসা করি মাসুম আখতারের ঘরের হদিশ। ততক্ষণে মসজিদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এক যুবক। মহিলা তার দিকে আঙুল তুলে দেখাতে ঘাড় ঘুরিয়ে সেই যুবককে দেখতে পাই। এরপর তাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি। (Short Story)
‘আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না! আপনি কি মাসুমের দোস্ত হন?’
এতদিনের যোগাযোগহীনতা, অনাবশ্যক বিরতি কি বন্ধুত্বের অন্তরায় নয়! কী বলব, বুঝতে পারি না প্রথমে, তারপর মনে হয়, বন্ধুত্ব তখনই বিচ্ছেদবিন্দুতে উপনীত হয়, যখন পারস্পরিক ভাঙন অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। যোগাযোগ না-থাকাটা মোটেও ঠিক কথা নয়, কিন্তু সেইসব অভিমান একান্তই বন্ধুত্বসম্পর্কের নিজস্ব এক্তিয়ার। ঢোঁক গিলে অতঃপর নিজের নাম বলি, পরিচয় দিই মাসুমের বন্ধু বলেই। (Short Story)
“রামনবমীর সশস্ত্র মিছিল মহল্লার উপর তোড়ফোড় করে চলে গেলে পর আহতদের নিয়ে থানায় গিয়েছিল মাসুম। পুলিশ এফআইআর নিতে গড়িমসি করছিল, তাই থানার সামনে ধরনায় বসে পড়েছিল ও; সঙ্গে ওর বয়সি আরও কেউ-কেউ— মহল্লারই ছেলে সব।”
‘আপনি কি ওর সঙ্গে স্কুলে পড়তেন? মুখটা এখন, কী জানি, একটু চেনা-চেনা ঠেকছে। আমি ওর চাচাতো ভাই, আসিফ।’
আসিফের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে এগিয়ে দিই আমার হাত। উভয়ের তরফেই আলতো ঝাঁকি। (Short Story)
এরপর আসিফই পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় আমাকে। পথে যেটুকু কথা বলে, তাতে জানতে পারি, মসজিদের লাগোয়া দুটো দোকানঘরের একটা ওর আব্বার; পুরো দিন রোজা রাখার পর ইফতার শেষ হয়ে গিয়েছিল সেদিন, রামনবমীর মিছিল তারপর ভেঙে দিয়ে গেছে সেই দোকান; তার দিন তিনেক পর থেকে মাসুমেরও নাকি কোনও আতা-পাতা নেই। (Short Story)
মাসুমদের বাড়ি চলে এলে কথা থামায় আসিফ। একবার গলা, যতটা সম্ভব, খাদে নামিয়ে বলে, বাকি কথা মাসুমের আম্মিই বলবেন। হয়তো। (Short Story)

রামনবমীর সশস্ত্র মিছিল মহল্লার উপর তোড়ফোড় করে চলে গেলে পর আহতদের নিয়ে থানায় গিয়েছিল মাসুম। পুলিশ এফআইআর নিতে গড়িমসি করছিল, তাই থানার সামনে ধরনায় বসে পড়েছিল ও; সঙ্গে ওর বয়সি আরও কেউ-কেউ— মহল্লারই ছেলে সব। থানা সেই মুহূর্তে এফআইআর নিতে বাধ্য হয়। দিন দুয়েক পরে, একটু রাতের দিকে, সদরদরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলেছিল আতিফ। মসজিদের থেকে এসে-পড়া আবছা আলোয় সামনের চারজন পুলিশকে টপকে সে দেখেছিল, রাস্তায় গাড়ি নেই কোনও। মাসুম ততক্ষণে চলে এসেছে, পাশে দাঁড়ানো আতিফ পুলিশের জবানিতে জানতে পারে, রামনবমীর মিছিলের উদ্যোক্তারাই নাকি অভিযোগ করেছে তার দাদার নামে; তার দাদা, ঝামেলার সময় যে কী না ছিল লিলুয়ায়— আপ তারকেশ্বর লোকালে— ডেইলি প্যাসেঞ্জারের ভিড়ে-ঠাসা কামরায়, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যেতে এসেছে পুলিশ। (Short Story)
“দাঙ্গা না-দেখে, তার আঁচ শরীরে-মনে না-নিয়ে মধ্যবিত্ত সুখী যাপনে নিজের সামাজিক ভূমিকা প্রমাণে যতই তৎপর হয়ে উঠি-না-কেন, সেই প্রতিভূমিকায় রোম্যান্টিক প্রগল্ভতা মিশে থাকবে— থাকতে বাধ্য।”
সেই রাতে পুলিশের সঙ্গে বেরিয়ে যায় মাসুম। থানা থেকে যারা এসেছিল, মোবাইল ফোনটাও নেওয়ার সময় দেয়নি ওকে। সেই থেকে আর কোনও খবর নেই ওর। পরদিন থেকে রোজই নিয়ম করে দুই চাচাতো ভাই থানায় যায়, দাদার খোঁজ করে, জবাব আসে: ফেরার। (Short Story)
মাসুমের মাকে, মাসিমাকে, কী বলব— ভেবে পাই না। চলে আসার সময় আলতো করে হাত রাখি পায়ের পাতায়, মাসিমার হাত উঠে আসে আমার মাথায়— টের পাই। (Short Story)
ফেরার পথে, ট্রেনে বসে, মোবাইলটা বের করি। সৌরীশকে মেসেজ করি হোয়াট্স্অ্যাপে: রাতের দিকে ফোন করিস।
|| তিন ||
নিজেকে ভেঙেচুরে যে-গল্পটা লিখতে শুরু করেছিলাম, সেটা আর শেষ করতে পারিনি। দাঙ্গা না-দেখে, তার আঁচ শরীরে-মনে না-নিয়ে মধ্যবিত্ত সুখী যাপনে নিজের সামাজিক ভূমিকা প্রমাণে যতই তৎপর হয়ে উঠি-না-কেন, সেই প্রতিভূমিকায় রোম্যান্টিক প্রগল্ভতা মিশে থাকবে— থাকতে বাধ্য। তেলে আর জলে মিশ হয় না, দুধ আর জল মিশলেও যথাযথ পুষ্টি আর থাকে না। (Short Story)
বলাই বাহুল্য, দেবহূতিকেও আর গল্প দিয়ে ওঠা হয়নি আমার।
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
জন্ম : ১৩৯২ বঙ্গাব্দের ১২ আষাঢ়। আপাতত তিনটি উপন্যাস ও চারটি গল্পসংকলন প্রকাশিত হয়েছে। সম্পাদিত গ্রন্থ দু’টি। ‘এখানে যত্নসহকারে চক্ষু পরীক্ষা করা হয়’ গল্পগ্রন্থের জন্য ২০১৮ সালে রবিশংকর বল স্মারক সম্মান। ২০২৩ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ প্রদত্ত ইলা চন্দ স্মৃতি পুরস্কার।