আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১]
বাংলা গানে মান্না দে আসেন অনেক পরে, গত শতকের পাঁচের দশকে। ১৯৫২ সালে ভি শান্তারামের বাংলা-মারাঠি ডবল ভার্শন ছবি ‘অমর ভূপালি’-তে প্রথম গাইলেন বাংলা গান: গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়, বসন্ত দেশাইয়ের সুরে ‘ঘনশ্যাম সুন্দর’। পরের বছরই প্রথম বাংলা বেসিক আধুনিক, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়, নিজের সুরে ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে’ এবং ‘হায় হায় গো, রাত যায় গো’। গান দু’টি অবশ্য রেকর্ড করার কথা ছিল লতা মঙ্গেশকরের।
পরের বেসিক গান তিন বছর বাদে ১৯৫৬-তে। গৌরীপ্রসন্নর কথায়, নিজের সুরে ‘তুমি আর ডেকো না’ এবং ‘তীরভাঙা ঢেউ আর’। তারপরের কয়েক দশক জুড়ে মান্নার অসংখ্য বেসিক আর ছায়াছবির গান। তাঁর বেসিক গানের অনেকটাই জুড়ে আছে তাঁর নিজের সুর। তাঁর সুরের একটা নিজস্ব ধরন আছে, তা হল বিষাদ-ছোঁয়া মেলোডি। তার মধ্যে সূক্ষ্ম নানা সাঙ্গীতিক কারুকাজ। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতই তাঁর প্রধান আশ্রয়, তবে বিদেশি কোনও গান বা সুর ভাল লাগলে তা-ও সুরের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যেমন, প্রথম গান ‘হায় হায় গো’ জিম রিভসের একটি গানের অনুপ্রেরণায় রচিত।
মান্না দে-র প্রায় সব গানই একান্তভাবে ভালবাসার গান। আর আকাঙ্খিত আবেগে তাকে সঠিক মাত্রাও দিতে পারেন মান্না। নিজের সুরে এমনই আরও কিছু মনে রাখার মতো গান: শ্যামল গুপ্তের কথায় ‘আমি নিরালায় বসে বেঁধেছি আমার স্মরণবীণ’ (১৯৫৭), অনিল বিশ্বাসের কথায় ‘চাঁদের আশায় নিভায়েছিলাম’ (১৯৫৮), বঙ্কিম ঘোষের কথায় ‘এই কূলে আমি’ (১৯৫৮), প্রণব রায়ের কথায় ‘আমি সাগরের বেলা’ (১৯৫৮)।
প্রথম থেকেই গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের সঙ্গে একটা চমৎকার বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল তাঁর। তেমনই হল আর এক গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। ১৯৬০-এ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় প্রথম গাইলেন নিজের সুরে ‘আমার না যদি থাকে সুর’ এবং ‘ জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’। পুলক-মান্না জুটির আরও কিছু অনবদ্য দৃষ্টান্ত: ‘এই তো সেদিন তুমি’, ‘দরদী গো কী চেয়েছি’ (১৯৬৬), ‘ললিতা গো, ওকে আজ চলে যেতে’ (১৯৬৯), ‘কথা দাও আবার আসবে’ (১৯৭৩), ‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে’ (১৯৭৫) কিংবা ‘ও কেন এত সুন্দরী হল’ (১৯৭৫) প্রভৃতি। আর প্রতিটি গানে মান্না তাঁর রেওয়াজি কণ্ঠের আবেগ-ভরা গায়ন নিয়ে উপস্থিত।
মান্না বাংলা বেসিক ও ছবির গান যা গেয়েছেন, তার এক প্রধান স্তম্ভ সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত। তাঁর সুরে মান্নার প্রথম গান ‘ডাক হরকরা’ (১৯৫৮) ছবিতে। ছবির কাহিনিকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, লোকায়ত সুরের আবেশে চিরস্মরণীয় হয়ে রইল ‘ওগো, তোমার শেষ বিচারের আশায়’ বা ‘মনরে আমার শুনলি না বারণ’… হৃদয় উজাড় করে গেয়েছিলেন মান্না। মান্নার এই গানগুলি ছিল রবীন্দ্র-সান্নিধ্য-ধন্য শান্তিদেব ঘোষের লিপে। সাধারণভাবে সুধীন দাশগুপ্তের সুরের একটা নিজস্বতা আছে। তা বোঝা যায় স্বরবিন্যাসে, ছন্দবিন্যাসে আর যন্ত্র-আয়োজনে। তাঁর সুরে পাশ্চাত্য সুর-আঙ্গিকের এক বিশেষ ভূমিকা ছিল, সঙ্গে অনায়াসে মিশিয়ে দিতেন উত্তর বা দক্ষিণ ভারতীয় রাগসঙ্গীত।

সুধীনবাবুর বিভিন্ন গানে তারই পরিচয়। যেমন, ‘বসন্ত বিলাপ’ ছবিতে মান্নার ‘লেগেছে লেগেছে আগুন’ বা ‘ছদ্মবেশী'(১৯৭১)-তে ‘বাঁচাও কে আছ মরেছি যে প্রেম করে’। একটা সময় ছিল যখন উত্তমকুমার মানেই নেপথ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলা। সুধীনই প্রথম উত্তমকুমারের লিপে মান্নাকে দিয়ে গাওয়ালেন ‘গলি থেকে রাজপথ’ (১৯৫৯) ছবিতে। আর এক জনপ্রিয় নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লিপে মান্না গাইলেন প্রেমের সেই অসামান্য গান ‘হয়তো তোমারি জন্য’ (তিন ভুবনের পারে, ১৯৬৯)।
সুধীনের সুরে আরও কিছু উল্লেখযোগ্য চিত্রগীতি: ‘আমি কোন পথে যে’ (ছদ্মবেশী), ‘একদিন দল বেঁধে’ (পিকনিক, ১৯৭২, কথা: পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘এসেছি আমি এসেছি’ (হার মানা হার, ১৯৭২, কথা: সুধীন)। সুধীন দাশগুপ্তের কথায় সুরে উল্লেখ্য বেসিক ‘একই অঙ্গে এত রূপ’ বা ‘ চার দেয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে’। বিশেষত, শেষোক্ত গানটি কথার গভীরতায়, সুরের মূর্ছনায় অনবদ্য। নানা যন্ত্র-বাদনে পারদর্শী সুধীন দাশগুপ্তের যন্ত্র-আয়োজনও আকর্ষণীয়।
সুরকার নচিকেতা ঘোষ মান্না দে-র বাংলা গানের আরেক স্তম্ভ। নচিকেতার বৈচিত্র্যময় সুরে মান্নার অজস্র গান। প্রথম গাইলেন ‘হরিশচন্দ্র’ (১৯৫৭) ছবিতে। তারপর ১৯৬৮-তে ‘চিরদিনের’ ছবিতে উত্তমকুমারের লিপে ‘মানুষ খুন হলে পরে’ বা ‘লাল নীল সবুজেরই মেলা বসেছে’ (কথা: গৌরীপ্রসন্ন) গেয়ে মান্না সঙ্গীতজগৎ মাতিয়ে তুললেন।
নচিকেতা ঘোষের সুরে একটা স্পষ্ট স্বকীয়তা আছে। সেখানে কোথাও ক্রোম্যাটিক স্বরের ব্যবহার, মীড়ের প্রয়োগ, কোথাও অভিনব ছন্দবিন্যাস। গৌরীপ্রসন্নর কথায় ‘নিশিপদ্ম’ (১৯৭০)-তে ‘যা খুশি ওরা বলে বলুক’, ‘স্ত্রী’ (১৯৭২)-তে ‘হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা’ ( হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘সন্ন্যাসী রাজা’ (১৯৭৫)-তে ‘কাহারবা নয়, দাদরা বাজাও’, পুলকের কথায় ‘বিলম্বিত লয়’ (১৯৭০) ছবিতে ‘বেঁধো না ফুলমালা ডোরে’ ( আরতি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘ধন্যি মেয়ে’ (১৯৭১)-তে ‘লাঠি বাজি হকি নয়’– এক একটা গান এক এক রকম।
মান্না যে নানা ধরণের গানেই নিপুণ, তা এইসব গানের রূপায়নে খুব সহজে বোঝা যায়। নচিকেতা ঘোষের সুরে মান্নার উল্লেখযোগ্য বেসিক গান, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ‘ক’ ফোঁটা চোখের জল’, ‘তুমি একজনই শুধু বন্ধু আমার’, ‘আমার ভালবাসার রাজপ্রাসাদে’ এবং গৌরীপ্রসন্নর কথায় ‘যদি কাগজে লেখ নাম’।
‘এন্টনি ফিরিঙ্গি’ (১৯৬৭) ছবিতে মান্নার গাওয়া ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’, ‘আমি যে জলসাঘরে’ বা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘চম্পা চামেলি’ মানুষ আজও মনে রেখেছেন। সুরের চলন এখানে জটিল , সুরকার ছিলেন অনিল বাগচী। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর আবার সহজ অথচ মরমী। হেমন্তের সুরে মান্নার উল্লেখযোগ্য গান: ‘দীপ জ্বেলে যাই’ (১৯৫৯)-তে ‘এমন বন্ধু আর কে আছে’ বা ‘বাঘিনী’ (১৯৬৮)-তে লোকায়ত মেজাজে ‘ও কোকিলা তোরে শুধাই রে’। সলিল চৌধুরীর ব্যতিক্রমী কথায়-সুরে ‘একদিন রাত্রে’ (১৯৫৬) ছবিতে ‘এই দুনিয়ায় ভাই’ খুবই ব্যঞ্জনাময়, সেইভাবেই রূপায়িত করেন মান্না।
আর এরপর ছবিতে মাতালের গান মানেই মান্না দে। কেননা মাতালের ওই অভিব্যক্তি-নাটকীয়তা কে ফোটাবে গলায়, সুর নিখুঁতভাবে অক্ষুণ্ন রেখে! এই সলিলেরই সুরে ‘গঙ্গা’ (১৯৬০)-র ‘আমায় ডুবাইলি রে’ লোকসঙ্গীত-নির্ভর, আবার ‘মর্জিনা অবদাল্লা’ (১৯৭৩)-তে ‘বাজে গো বীণা’ রাগাশ্রিত। সলিলের কথায়-সুরে মান্নার বেসিক গান গণজাগরণের- ‘ ধন্য আমি জন্মেছি মা’ বা ‘মানব না এ বন্ধনে’।

রতু মুখোপাধ্যায়কে আমরা জানি শুধু বেসিক গানেই সুর দিয়েছেন, কিন্তু তার মধ্যেই একটা স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন। পুলকের কথায় রতুর মেলোডি-ভিত্তিক সুরে মান্নার ‘আবার হবে তো দেখা’ (১৯৬৪), ‘হৃদয়ের গান শিখে তো’ (১৯৬৫), ‘রাতজাগা দুটি চোখ’ (১৯৭৪) কখনও ভোলা যাবে? ভাই প্রভাস দে-র সুরে মান্নার উল্লেখ্য গান: ‘ও চাঁদ সামলে রাখ’, ‘আমার একদিকেই শুধু তুমি’ (১৯৭৬), ‘কে তুমি তন্দ্রাহরণী’ (১৯৭৮) কিংবা জহর মজুমদারের কথায় ‘সবাই তো সুখী হতে চায়’।
কফিহাউস নিয়ে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের চমৎকার একটি রচনা ‘কফিহাউসের সেই আড্ডাটা’ মান্নার কণ্ঠে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। সুরকার এখানে নচিকেতা-পুত্র সুপর্ণকান্তি ঘোষ। সুপর্ণকান্তি বিদেশি সুর-ছন্দকে কাজে লাগিয়ে একটা সংবেদনশীল সুর তৈরি করেছিলেন এ গানের। সুপর্ণকান্তির সুরে মান্নার আরও গান: ‘মা মা গো মা’, ‘মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়’। অসীমা ভট্টাচার্যের সুরে ‘চৌরঙ্গী’ (১৯৬৮) ছবিতে ‘বড় একা লাগে’ (কথা: মিলটু ঘোষ) হৃদয় ছুঁয়ে যায়। অজয় দাসের সুরে ‘চারমূর্তি’ (১৯৭৭)-তে ‘ভারত আমার ভারতবর্ষ’ তো এখন দেশাত্মবোধক গান হিসেবেই সুপরিচিত।
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরের একটা স্বাতন্ত্র্য আছে। মান্না তাকে মর্যাদা দেন ‘জীবনরহস্য’ (১৯৭৪) ছবিতে ‘পৃথিবী তাকিয়ে দেখো’ কিংবা ‘সেলাম মেমসাব’ (১৯৭৫)-এ ‘ঝর্না ঝর ঝরিয়ে’ গানে। তাছাড়া মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অনল চট্টোপাধ্যায়, তপন সিংহ, দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার মিত্র, অধীর বাগচী, মৃনাল বন্দ্যোপাধ্যায়, নীতা সেন, বিজন পাল প্রমুখের সুরেও মান্না অসাধারণ কিছু গান গেয়েছেন।

আধুনিক ও চিত্রগীতি ছাড়াও মান্না গেয়েছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলের গান, দ্বিজেন্দ্রগীতি, রজনীকান্তের গান। রবীন্দ্রসঙ্গীত তো তাঁর খুবই প্রিয় ছিল। তাঁর কণ্ঠে উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রনাথের ‘ ওগো স্বপ্নস্বরুপিনী’, ‘না চাহিলে যারে’, নজরুলের ‘রহি রহি কেন সেই’, ‘দেবদাস’ ছবিতে ‘শাওন রাতে যদি’ ( লেখা: কাজি নজরুল, সুর: জগন্ময় মিত্র, জগন্মযেরই একদা-বিখ্যাত বেসিক গান), দ্বিজেন্দ্রগীতি ‘ ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’, ‘ ঘন তমসাবৃত’, রজনীকান্তের ‘তব চরণ নিম্নে’ (ছবি: সুভাষচন্দ্র)। লং প্লেইং রেকর্ডে প্রকাশিত বিভিন্ন গীতিনাট্যেও অংশ নিয়েছেন মান্না– ‘শ্রীরাধার মানভঞ্জন’ (১৯৭৭), ‘আলিবাবা’ (১৯৮৩), ‘রামী চণ্ডীদাস’ (১৯৮৪) ইত্যাদি।
সুরকার মান্না দে-র কথা আর একটু বলা দরকার। নিজের গানের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। অন্য শিল্পীর বেসিক গানেও তাঁর সুর মনে রাখার মতো। যেমন, আশা ভোঁসলের ‘আমায় তুমি যে ভালবেসেছ’, ‘যে গান তোমায় আমি’, হৈমন্তী শুক্লার ‘আমার বলার কিছু ছিল না’, সুমন কল্যানপুরের ‘ কাঁদে কেন মন’, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘একটি ছোট্ট দ্বীপ’ । তাছাড়া গেয়েছেন উৎপলা সেন, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, পিন্টু ভট্টাচার্য, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, অসীমা ভট্টাচার্য, ভাইপো সুদেব দে প্রমুখ। অল্প কয়েকটি বাংলা ছবিতেও সুর দিয়েছিলেন। যেমন, ‘রামধাক্কা’ (১৯৬৬), ‘শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন’(১৯৭৩)।
দাদাসাহেব ফালকে, পদ্মভূষণ প্রভৃতি নানা সম্মানে ভূষিত মান্না দে চলে গেলেন ২০১৩-র ২৪ অক্টোবর। কিন্তু এমন ভার্সেটাইল শিল্পীর মৃত্যুই শেষ কথা নয়। তিনি নিশ্চিতভাবেই বেঁচে থাকবেন তাঁর বহুবিচিত্র গানের মধ্য দিয়ে।
স্বপন সোম এ কালের বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ও সংগীত গবেষক। গান শিখেছেন মোহন সোম, মায়া সেন ও সুভাষ চৌধুরীর মতো কিংবদন্তীদের কাছে। দীর্ঘদিন ধরে 'দেশ' পত্রিকায় সংগীত সমালোচনা করেছেনl গান নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন 'আনন্দবাজার পত্রিকা', 'দেশ', 'আনন্দলোক', 'সানন্দা', 'আজকাল', 'এই সময়', 'প্রতিদিন' প্রভৃতি পত্রপত্রিকায়l