Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

অপুর ঠিকানা: পর্ব তিন

আলোলিকা মুখোপাধ্যায়

অক্টোবর ৩, ২০২৪

Alolika Mukhopadhyay
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

[] []

দুটো শোবার ঘরের একটায় অপু দিদিমার সঙ্গে থাকত। ও হোস্টেলে চলে যাওয়ার পর দিদিমাকে মা ওল্ড-এজ হোমে পাঠিয়ে দিতে, ঘরটা এখন অপুর জন্যে গোছানো হয়েছে। বিছানায় শুয়ে ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে অপু দেখল মা ঘরে এসেছে। সামনের চেয়ারে বসে বলল– “খুব দরকারে তোকে নিয়ে এলাম। তোর বাবা আবার কাস্টডি রাইট নিয়ে উকিলের চিঠি দিয়েছে। অথচ তোর এখনও আঠারো বছর হয়নি। শুনলাম তুই নাকি ওকে ফোন করেছিলি?” অপু উত্তর দিল- “আমি ফোন করিনি। জ্যাঠামশাই হোস্টেলে এসেছিলেন। ওঁর মোবাইলে ফোন করে বাবা আমার সঙ্গে কথা বলেছেন।” (Story)

“আমাকে বলিসনি তো! ওরা কী চাইছে এখন? তুই আমাকে ছেড়ে ইউ.এস.এ চলে যাস?”
অপু সরাসরি মার চোখের দিকে তাকাল– “বাবার ইচ্ছে আমি ওখানে কলেজে পড়ি। জ্যাঠামশাই বললেন সামনের বছর থেকে আমার জন্য বাবা আর চাইল্ড সাপোর্টের খরচ পাঠাবেন না। এখানে আমাকে নিজের ব্যবস্থা করতে হবে।”
“তোর কী ধারণা আমার সেই ক্ষমতা নেই? প্রাইভেট কলেজে ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে পারব না। সত্যি কথা। কিন্তু জয়েন্টে ভাল করলে যা হোক করে চেষ্টা করব। আরও কত লাইন আছে। অপু, এখন মন দিয়ে পড়াশোনা কর।”

অপু বিরক্ত হল “সেটা আর করব কখন? শুধু শুধু একজ্যামের মুখে বাড়িতে নিয়ে এলে। জয়েন্ট এন্ট্র্যান্সে ভাল করা অত সোজা! আমি কোথায় কলেজে পড়ব, সেটা আমাকেই ভাবতে দাও।”
মহুয়া ইদানিং ছেলের এই একরোখা ভাবটা লক্ষ্য করছিল। আজ মনে হল, অভীক ওকে ভাল করে কিছু বুঝিয়েছে। নয়তো এমন উদ্ধতভাবে উত্তর দিত না। ওর চোখে এখন আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্ন। গানের টিউশন করে সংসার চালায়, এমন মায়ের উপর ও আর আশা-ভরসা রাখতে পারছে না। মহুয়া ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় অপু বলল “বাবা আমাকে স্যাট একজ্যাম দিতে বলেছেন। প্রিপারেশনের জন্য বই পাঠিয়েছেন। দেখি, ফাইনালের রেজাল্টের উপরেই সব ডিপেন্ড করছে।”

সারারাত বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে কখন ভোর হয়ে গেল। ঘুমের বড়ি খেলে যেটুকু আচ্ছন্নভাব আসে, গত রাতে তাও হয়নি। মহুয়া বিছানা ছেড়ে বসার ঘরে এল। অপুর ঘরের দরজা বন্ধ। ছুটিতে বাড়ি এলে বেলা পর্যন্ত ঘুমোয়। আজ দশটায় গানের ছাত্রীরা আসবে। চা খেয়ে, স্নান সেরে এসে মহুয়া দেখল কাজের মেয়ে বুল্টি প্লাস্টিক মাথায় দিয়ে ঢুকে পড়েছে। সবিস্তারে রাস্তায় জল জমার বর্ণনা দিতে যাচ্ছিল, মহুয়া তারা দিল “আজ ক্লাস আছে। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ কর।”

দশটা-সাড়ে দশটার মধ্যে তিনজন ছাত্রী এল। মহুয়া হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছে। অপু নিজের ঘরে তৈরি হয়ে নিল। বেরোবার সময় মহুয়া বলল “দুপুরে ফিরতে দেরি করিস না।” সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অপু মায়ের গান শুনতে পেল “তোমার আমার বিরহের অন্তরালে কত আর সেতু বাঁধি…”
এটা মায়ের প্রিয় গান। আঙ্কল এলে শুনতে চাইত। সে লোকটা তো জাহাজের মধ্যে মরে ভূত হয়ে গেছে। মা তবু গানটা ভুলতে পারছে না।

বারিস্তায় বসে কফি খাওয়ার মতন বেশি টাকা-পয়সা অপুর পকেটে থাকে না। মিমি দু’জনের জন্যে স্যান্ডুইচ কিনল। খাওয়া শুরু করার আগে বলল “বলেছিলি বিকেলে দেখা করবি? আমি তো পুপুদের সঙ্গে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম।”

অপু জোরে জোরে হাঁটছে। মনের মধ্যে আবার সেই রাগ, অভিমান, বিতৃষ্ণা ফিরে আসছে। তখনই মিমিকে ফোন করল “তুই কোথায়? আমি বারিস্তার সামনে ওয়েট করছি। দেরি করিস না।”
বারিস্তায় বসে কফি খাওয়ার মতন বেশি টাকা-পয়সা অপুর পকেটে থাকে না। মিমি দু’জনের জন্যে স্যান্ডুইচ কিনল। খাওয়া শুরু করার আগে বলল “বলেছিলি বিকেলে দেখা করবি? আমি তো পুপুদের সঙ্গে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম।”

অপু হাসল “আবার সেই সাউথ সিটি মল? কী এত শপিং করিস?”
“কিনি আর কোথায়? দোকানগুলোয় ঘুরতে ভাল লাগে। তুই কাল অবধি আছিস তো?”
“না রে, আজ ফিরে যাব। তাই তোকে সকালে আসতে বললাম।”
“খুব পড়ছিস?”
“লাইফে আর কিছু আছে? গাদা গাদা টেষ্ট, টিউশন। তাও ভাবছিস ভাল কলেজে চান্স পাব? মা লেকচার দেয়, মুড়িওয়ালার ছেলে কী করে জয়েন্টে চান্স পায়? একদিন বলেছি তুমি মুড়ির ঠোঙা বানালে হয়তো আমিও ইন্সপায়ার্ড হতাম।”
মিমি হেসে উঠল “তুই পারিসও। সব বাড়িতেই এক অবস্থা! আমি অবশ্য বাবাকে বুঝিয়েছি কমিউনিকেশন নিয়ে পড়ব। মিডিয়ায় এখন অনেক স্কোপ!”
অপু বলল “মিমি, আমি হয়তো এখানে কলেজে পড়ব না। ফাইনালের পর বাবা ওঁর কাছে নিয়ে যেতে চাইছেন। ডিসিশনটা অবশ্য আমাকেই নিতে হবে।”
মিমির যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। গলায় আহত বিস্ময়ের স্বর ফুটল “আমেরিকায় পড়তে চলে যাবি? এতদিন তো কিছু বলিসনি? সব ঠিক হয়ে গেছে?”
“এখনও ফাইনালাইজড হয়নি। তোর কী মনে হয় মিমি? এত বছর বাদে বাবার কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও যাব না?”
“কিন্তু তোর মা? ওঁকে ছেড়ে চলে যাবি? শুনলাম সেই ভদ্রলোকও তো মারা গেছেন।”

অপু রেগে উঠল “সো হোয়াট? সব জেনে শুনে পুরনো কথা তুলছিস কেন? ঐ লোকটার জন্য আমার বারবার বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করত। বাবা তো ওখানেও নিয়ে যেতে চাইতেন। মা লিগ্যাল রাইট দেখিয়ে আটকে রাখল। তার বদলে কী দিয়েছে আমাকে? তোরা, পাড়ার ভদ্রলোকেরা কোনওদিন আমাদের অ্যাক্সেপ্ট করেছিস?”
অপুর উত্তেজনার আভাস পেয়ে মিমি বুঝতে পারছিল এবার ওদের উঠে পড়া দরকার। নিচু গলায় বলল “প্লিজ, এখন আর মাথা গরম করিস না। চল, বাইরে গিয়ে কথা বলি।”
বাইরে মেঘলা আকাশ। রোদের তাপ নেই। ওরা উদ্দেশ্যবিহীন পথে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় খেয়াল করল বাড়ি ফেরার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। মোবাইলে মিমির মায়ের ফোন এল। অপু বলল “আমার যাওয়ার ব্যাপারটা তুই ছাড়া কেউ জানে না। এর মধ্যে কী ডেভেলপমেন্ট হয়, তোকে ফোনে জানাব। তোর অবশ্য কোনও ইন্টারেস্ট দেখছি না।”
মিমি যেন চেষ্টা করে উচ্ছ্বাস গলায় এনে বলল “কী করব? তুই আমেরিকা যাবি বলে আনন্দ পাব? তোর কি একবারও মনে হচ্ছে? আমাদের মধ্যে আর হয়তো কন্ট্যাক্টই থাকবে না!”

মহুয়া উত্তর দিল “ভাল! তোর কেরিয়ার তৈরি হয়ে যাবে। আমার শুধু একটাই চিন্তা অপু। অচেনা দেশে একটা নতুন ফ্যামিলির সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে পারবি? তোর বাবার বউ আছে। দুটো ছেলে-মেয়ে আছে।

অপু হেসে উঠল “বোকার মতো কথা বলিস না! ইউ.এস.এ এখন বোম্বে, দিল্লি হয়ে গেছে। বাবা প্রত্যেক বছর কলকাতায় আসেন। আমাদের দেখা হবে না কেন? মিমি, ডোন্ট বি সো সেন্টিমেন্টাল!”
মিমি হাত ছেড়ে বলে গেল “স্টেটস-এ যাওয়ার আগেই এত ইংলিশ বলিস না। পাড়ার লোক চমকে যাবে! তখন আর সিক্রেট রাখতে পারবি না।”
সন্ধ্যেবেলায় হোস্টেলে ফেরার আগে অপু মহুয়াকে বলল “ভাবছি ফাইনালের পর এখানে আর পড়ব না। বাবার কাছে থেকে কলেজে আন্ডার গ্রাজুয়েট করব। বাবা বলেছেন চার বছরের কোর্সের টিউশন ফি দেবেন। ধরে নাও সত্তর-আশি হাজার ডলার।”
মহুয়া উত্তর দিল “ভাল! তোর কেরিয়ার তৈরি হয়ে যাবে। আমার শুধু একটাই চিন্তা অপু। অচেনা দেশে একটা নতুন ফ্যামিলির সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে পারবি? তোর বাবার বউ আছে। দুটো ছেলে-মেয়ে আছে। এতবার কলকাতায় আসে, তবু তোকে একবার দেখতেও চায়নি। আজ হয়তো তোর বাবার জেদের জন্য মেনে নিয়েছে। তোর জন্য ওদের সংসারে না অশান্তি শুরু হয়।”

“সেটা বাবা বুঝবেন। তাছাড়া আমি হয়তো কলেজ ক্যাম্পাসে থাকব। এখানে যেমন হোস্টেলে আছি।”
“আমার কী উপায় ছিল বল? এইটুকু ফ্ল্যাট। তর একটা ঘর নেই। পড়ার জায়গা নেই। মায়ের ঘরে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বসতে পারতিস না। একটু রাত অবধি আলো জ্বালিয়ে বই পড়লে মা ঘুমোতে পারত না। তাই নিয়ে ঝগড়া।”
অপুর স্পষ্ট মনে আছে, দিদিমার অশান্তির জন্যে নয়, আঙ্কলের কথাতে মা ওকে হোস্টেলে দিল। আঙ্কল যখন আসত, সন্ধ্যে থেকে মায়ের সঙ্গে বসে ড্রিঙ্ক করত। মাঝে মাঝে রাতে মায়ের ঘরে থাকত। অপু ক্রমশ নারী-পুরুষের শরীরের সম্পর্কটা বুঝতে পারছিল। মার উপর, আঙ্কলের উপর প্রচণ্ড রাগ হত। একদিন বাড়িওয়ালা এসে মাকে অপমান করল। আঙ্কলকে ধমকাল “বদমাইসি করতে হয় অন্য পাড়ায় যান। আমার বাড়িতে ‘কেপ্ট’ রেখেছেন, সে কথা আপনার বউ জানে? আমার পাড়ার ছেলেরা গিয়ে খবর দিয়ে আসবে?”

এরপরেই মা ওকে হোস্টেলে ভর্তি করে এল। ছুটিতে ও যখন বাড়ি আসত, আঙ্কল বিশেষ আসত না। মিমির কাছে অপু পাড়ার সব খবর পেত। আঙ্কল বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে দিতে, বাড়িওয়ালা আর ঝামেলা করত না। মা প্রথমদিকে উচ্ছেদের নোটিশ পেয়ে পাড়ার মস্তান কেষ্ট পালকে ধরেছিল। কেষ্ট ভরসা দিয়েছিল, মামলা টিকবে না। আপনার কাছে বন্ধু-বান্ধব আসে। তারা ব্যাটাছেলে না মেয়েছেলে তাতে ওর কী? দরকার হলে বলবেন, কড়কে দেব। পরে অপুকে মিমিই খবর দিয়েছিল, আজকাল আঙ্কল এ পাড়ায় বেশি আসে না। মাকে নিয়ে কলকাতার বাইরে চলে যায়। কেরালার একটা হোটেলে মিমির কাকা-কাকীমা মার সঙ্গে আঙ্কলকে দেখেছিল। মা কলকাতার বাইরে গেলে অপুকে জানিয়ে যেত। ওর হাতে টাকা-পয়সা দিয়ে আসত। বলত গানের প্রোগ্রাম করতে যাচ্ছে। দিদিমা সব জানত। মাঝে মাঝে মা আর দিদিমার রাগারাগির সময় মনে হত মার ডিভোর্সের জন্য হয়তো দিদিমাও দায়ী ছিল।
অপু আর পুরনো কথা ভাবতে চায় না। সামনে শুধু পরীক্ষার প্রিপারেশন। বাবা নিশ্চয়ই আশা করছেন, ওর রেজাল্ট ভাল হবে।

আজ কদিন ধরে বুকের কাছে চাপ ধরা একটা ব্যথা। রাতে ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম আসে। দীপংকর যে নেই, এখনও বিশ্বাস হতে চায় না। সুখে-দুঃখে তবু একজন পাশে ছিল। এবার অপুও চলে যাবে।

বিকেলে মহুয়া ছেলের ব্যাগ গুছিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল “ফিরে গিয়ে রাতের খাবার পাবি? না, বেরোনোর আগে রুটি করে দেব? ওবেলার চিকেন আছে।” অপু বাড়িতেই খেয়ে নিল। ওকে আটটার মধ্যে হস্টেলে পৌঁছে দিয়ে মহুয়া যখন বাড়ি এল, একতলার ওষুধের দোকানের ছেলেটা এসে ক্যুরিয়ারের খাম দিয়ে গেল। অভীকের পাঠানো ল-ইয়ারের চিঠি। অপু যে আর ইন্ডিয়াতে থাকতে চায় না, চিঠিতে তা জানান হয়েছে। মহুয়া যখন ছেলেকে নিয়ে চলে এসেছিল, ওর সেই পাসপোর্ট কবে এক্সপায়ার করে গেছে। তাও ল-ইয়ার চেয়ে পাঠিয়েছে। কলকাতার ইউ.এস কনস্যুলেট থেকে অপুর জন্য নতুন পাসপোর্ট ইস্যু করবে। তার জন্য মহুয়াকে বার্থ সার্টিফিকেট, আরও কী কী সব কাগজ জমা দিতে হবে। আশ্চর্য! কবে অভীক এসে এত ব্যবস্থা করে গেছে, ছেলেকে বুঝিয়ে গেছে, মহুয়া বুঝতেও পারেনি। অপু নিজেও যা বলার বলে গেল।

আজ কদিন ধরে বুকের কাছে চাপ ধরা একটা ব্যথা। রাতে ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম আসে। দীপংকর যে নেই, এখনও বিশ্বাস হতে চায় না। সুখে-দুঃখে তবু একজন পাশে ছিল। এবার অপুও চলে যাবে। জীবনে কোথাও কোনও সম্পর্ক স্থায়ী হল না। শেষ পর্যন্ত সবকিছু মেনে নেওয়া। ছেড়ে দেওয়া। অঝোর বৃষ্টির রাতে অন্ধকারে বসে থেকে মহুয়া এক অমোঘ একাকিত্বের যন্ত্রণা অনুভব করছিল।

পরের বছর নিউইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অপুর কলেজ অ্যাডমিশনের জন্য অভীক সময়মতো ব্যবস্থা করছিল। অস্মিতার আশঙ্কা, অনুমান সত্যি হলেও ওমি, শমী বাবার প্রথম বিয়ে, ওদের এক বড় ভাই আছে জানার পরে এখন আর আগের মতো মনখারাপ, কান্নাকাটি করছে না।

পরের বছর নিউইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অপুর কলেজ অ্যাডমিশনের জন্য অভীক সময়মতো ব্যবস্থা করছিল। অস্মিতার আশঙ্কা, অনুমান সত্যি হলেও ওমি, শমী বাবার প্রথম বিয়ে, ওদের এক বড় ভাই আছে জানার পরে এখন আর আগের মতো মনখারাপ, কান্নাকাটি করছে না। চাইল্ড সাইকোলজিস্টের দরকার ছিল। অপু নামের একজনের ছোটবেলা যে খুব দুঃখে কেটেছে, ওরা তাকে বিগ ব্রাদার বলে ভালোবাসলে সবাই মিলে হ্যাপি ফ্যামিলি হবে, ওমি, শমীকে যে সব তিনিই বুঝিয়েছেন। আমেরিকায় কত বাড়িতে নিরাশ্রয় ছেলেমেয়েরা। ফস্টার চাইল্ড হিসেবে থাকে, ওমি, শমী তাও শুনেছে। হয়তো নানা কারণে সমস্যা তেমন জটিল হল না। অস্মিতা সাময়িক স্বস্তি পেয়েছে। তবু সম্পূর্ণ অপরিচিত এক টিন-এজার ছেলেকে নিজের সংসারে অভীকের আপনজন বলে গ্রহণ করা। অস্মিতার সামনে এখন অনেক মানিয়ে নেওয়া, বোঝাপড়া বাকি। অভীকের বিশ্বাস অস্মিতার মতো সংবেদনশীল মানুষ সহজে ধৈর্য হারাবে না। এ বাড়িতে যে কয়েকদিনই থাকুক, অপু এসে এক সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ পাবে। যা তাকে মহুয়া কখনও দেওয়ার চেষ্টা করেনি। নিজের জেদ, উশৃঙ্খল জীবন যাপনের নেশায় ছেলেকে চূড়ান্ত অবহেলা করেছে।
অপুর আসার প্রতীক্ষায় থেকে অভীক আবার যেন নতুন করে পুরনো ঘটনাগুলোয় ফিরে যায়। সেই সময়ের সুখস্মৃতি বলে কিছু নেই। তখন ওরা লুইসিয়ালার ছোট শহরে থাকে। বিয়ের কয়েক মাস বাদে মহুয়া যখন জানল, মা হতে চলেছে, একটুও খুশি হল না। অভীকের নতুন চাকরি। মাঝে মাঝে কাজের জন্য বাইরে যেতে হত। মহুয়ার অজস্র অভিযোগ। আমেরিকার ওই মফঃস্বলের জীবনে যে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। ওখানে বাঙালি সমাজ নেই। মহুয়ার গানের কেরিয়ার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে কাজের লোক নেই। এত কাজ করার জন্যে লোকে আমেরিকায় আসে? মহুয়া গাড়ি চালানো শিখবে না। অভীক বাইরে গেলে ওকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্যে আমেরিকান প্রতিবেশীর সাহায্য নিতে হয়। তারা উপদেশ দেয় ড্রাইভিং না জানলে তুমি ইন্ডিপেন্ডেন্ট হতে পারবে না। মহুয়ার বিরক্তি বাড়তে থাকে। মাঝে মাঝে বমি আর মাথা ঘোরার কষ্ট। অভীক অফিস থেকে ফিরে যা পারে রান্না করে। বাধ্য হয়ে মহুয়ার কথায় দেশ থেকে ওর মাকে আনাতে হল। অভীক যে সময় সবেমাত্র সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। একার রোজগারে সবদিক সামলাতে হচ্ছে। শাশুড়ীকে আনতে গিয়ে খরচ বাড়ল। তাঁর ভিসার ব্যবস্থা, প্লেনের টিকিট, আমেরিকার মেডিকেল ইন্সিওরেন্স না করে তো উপায় ছিল না। মহুয়ার সি-সেকশন ডেলিভারির খরচ ও অভীকের কোম্পানির হেলথ ইনসিওরেন্স থেকে পুরো দেয়নি। কলকাতার বাড়িতে বাবা, মার জন্য মাসে মাসে টাকা পাঠাতে হত। মধ্যবিত্ত বাড়ির ইঞ্জিনিয়ার ছেলের অনেক দায় থাকে। তবু যদি মহুয়া আর ওর মা একটু বোঝার চেষ্টা করত। শুধু অসন্তোষ! মহিলা এসেছিলেন মেয়ের বাচ্চা হওয়ার সময় সংসারে সাহায্য করতে। অন্ততঃ মহুয়া তাই বলেছিল। অথচ তাঁর নায়াগ্রা ফলস্‌ দেখা হল না বলে, নিউ ইয়র্ক দেখা হল না বলে কী দুঃখ! কোথায় লুইসিয়ানার ছোট শহর লেক চার্লস, কোথায় নিউ ইয়র্ক। বাড়িতে ছোট বাচ্চা। মা, মেয়ের আবদারে অভীকের মাথা গরম হয়ে যেত। মহুয়ার গানের ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে গেল বলে যখন তখন রাগারাগি। বাড়িতে মেইড রাখা, বাচ্চা দেখাশোনার জন্য ন্যানী রাখা, আমেরিকার উচ্চবিত্ত বাঙালিদের মতো আর্থিক ক্ষমতা অভীকের তখন ছিল না। শেষ পর্যন্ত অশান্তি চরমে পৌঁছল। কোনও পক্ষ আপোষ করতে রাজি নয়। অপুর যখন দেড় বছর বয়স, মহুয়া ছেলেকে নিয়ে দেশে ফিরে গেল। অভীক বিয়ের চার বছরের মাথায় ডিভোর্স দিয়ে দিল। তারপর লুইসিয়ানা ছেড়ে নতুন চাকরি নিয়ে নিউ ইয়র্ক চলে এল। অপুর দায়িত্ব না পেলেও ষোল-সতের বছর ধরে ওর জন্য প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি ডলার পাঠিয়ে যাচ্ছে। বছর বছর অপুকে গিয়ে দেখে এসেছে। সেদিক থেকে কর্তব্য যা করার, অভীক সবই করেছে। এবার শুধু নিজের প্রথম সন্তানকে ফিরে পাওয়ার অপেক্ষা।

অভীকের ইচ্ছেয় অপু যে তার মাকে ছেড়ে চলে আসছে, অস্মিতার কি সে নিয়ে কোনও বক্তব্য আছে? অভীক ঠিক বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে অস্মিতার একটা পুরনো প্রশ্ন তাকে বিদ্ধ করে। অস্মিতা জিজ্ঞেস করছিল “তোমার কখনও মনে হয়েছে? তুমি নিজেও মহুয়ার কষ্ট বোঝার চেষ্টা করোনি?” আমেরিকায় বিয়ে হয়ে এলেই সবাই যে সর্বসুখে থাকবে, তা তো নয়। তার সোশ্যাল আইসোলেশন থাকতে পারে। সে হয়তো গানের কেরিয়ার বেছে নিতে চেয়েছিল। তাড়াতাড়ি মা হতে চায়নি। মেটিরিয়্যালিজম এর দেশে এসে প্রথমদিকের ছোটখাটো অ্যাডজাস্টমেন্ট বা তার মতে ‘স্যাক্রিফাইস’ গুলো করতে রাজি হয়নি। সে নিশ্চয়ই তোমার কাছে অনেক বেশি কমপ্যাশন আশা করেছিল।”

অস্মিতার প্রশ্নে অভীক আশাহত হয়েছিল “এত বছর আমার সঙ্গে থেকে তোমার তাই মনে হয় অস্মি? অ্যাম আই সো সেলফ-সেন্টার্ড অ্যান্ড সেলফিস?”
অস্মিতা বলে উঠেছিল “না গো, সে কথা বলিনি। জানি, তোমার কোনও রিগ্রেট থাকার কথা নয়। দু’বছরেও যখন একটুও অ্যাডজাস্টমেন্ট হয়নি, তোমাদের টেমপেরামেন্ট কোনওদিনই মিলত না।”

অলংকরণ – আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়

দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প‍র্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড‌ সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।

Picture of আলোলিকা মুখোপাধ্যায়

আলোলিকা মুখোপাধ্যায়

দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প‍র্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড‌ সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।
Picture of আলোলিকা মুখোপাধ্যায়

আলোলিকা মুখোপাধ্যায়

দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প‍র্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড‌ সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com