দ্বিরাগমন থেকে ফিরে কলি জানতে পারল অভি ওদের হানিমুনে যাওয়ার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছে। এত তাড়াতাড়ি মধুচন্দ্রিমা যাপনের সুযোগ পাবে, আশা করেনি কলি। ভেবেছিল যাবে, কিন্তু এর মধ্যেই সব প্রোগ্রাম স্থির হয়ে গেছে জেনে মনে মনে খুব খুশি হল৷ আরও খুশি হল এটা জেনে যে বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে কলির শাশুড়ি ননদ আর নন্দাইয়ের উৎসাহই ছিল প্রবল৷ খুব ভাল লাগল কলির৷ আজকালকার দিনে এমন শ্বশুরবাড়ি কটা মেয়ের কপালে থাকে? সে এবাড়ির মানুষগুলোর উপর মনে মনে কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল৷ বলেও ফেলল শাশুড়ি মাকে কথাটা। তিনি হাসলেন৷ কলির চিবুক ধরে চুমু খেলেন।
কলির শাশুড়ি মায়ের নাম সুজাতা৷ স্বভাবেও সুজাতা। কত যত্ন করেন পুত্রবধূকে। আর খুব আধুনিকও৷ কলির পোশাক-আশাক বা চলা-ফেরায় কোনওরকম বিধি-নিষেধ আরোপ করেননি তিনি৷ তার স্বাধীনতা অবাধ৷ নিজেকে খুব ভারমুক্ত লাগে কলির৷ ওর প্রিয় বন্ধু পিঙ্কির বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি জিন্স পরার অনুমতি দেয়নি৷ যখন তখন বাড়ি থেকে বেরনোও পছন্দ করে না৷ বরের সঙ্গে বেড়াতে গেলেও আগে শাশুড়ির পারমিশন নিতে হয়৷ এসব শোনার পর কলির মনে মনে একটু ভয়ই ছিল৷ কী জানি তার শ্বশুরবাড়ি কেমন হবে? সত্যিই কলি লাকি৷ এরা সবাই খুব ভাল৷
গোয়ায় গিয়ে অভি আর কলি খুব আনন্দ করল৷ গোয়ার দু’টো দিক, নর্থ গোয়া আর সাউথ গোয়া৷ দুটো দিকই সুন্দর৷ প্রচুর বিচ৷ কালানগুট বিচের কাছে একটা হোটেলের বুকিং নিয়েছিল৷ বেশ ভাল হোটেলটা৷ সকাল বিকেল ওরা বিচে যেত৷ পুরো স্নান না করলেও বেশ অনেকটাই শরীর ভেজাত। তারপর হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিত৷ আসলে কলি জলকে একটু ভয় পায়। অভি ওকে টানাটানি করেও জলে নামাতে পারেনি৷ কিন্তু শেষ দিনটায় বিকেলবেলায় অভি কলিকে ‘ভিতু ভিতু’ বলায় কলি সমুদ্রের ঢেউয়ের সামনে বসে পড়ল৷ আর ঢেউয়ের ঝাপটায় পুরো ভিজে গেল৷ ওর জিন্স কুর্তি সপসপে হয়ে গেল৷ হোটেলে ফেরার পথে জোর হাওয়া দিচ্ছিল৷ প্রায় কাঁপছিল কলি। “স্যরি কলি, এই হাওয়ায় ভিজে গায়ে তোমার ঠাণ্ডা লেগে যাবে৷”
সবসময় কলির কাছে কাছে থাকেন সুজাতা৷ খাওয়া-দাওয়ার যত্ন করেন৷ জ্বর বাড়লে জলপট্টি দেন কপালে। যতক্ষণ না ঘুমিয়ে পড়ে কলি, মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দেন৷
“না না স্যরির কী আছে। হোটেলে গিয়ে গরম জলে ভাল করে হট শাওয়ার নিয়ে নেব। কিচ্ছু হবে না। খুব আনন্দ করেছি আমরাI”
কলির আনন্দটা বোধহয় একটু বেশি হয়ে গেছিল৷ ফেরার পথে জ্বর এল তার৷ বাড়ি এসে রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়ল। একেবারে শয্যাশায়ী৷ মধুচন্দ্রিমার মাধুর্য কাটতে না কাটতেই কাহিল অবস্থা৷ নতুন শ্বশুরবাড়ি, লজ্জায় পড়ে গেল৷ কিন্তু ও আবার অবাক হয়ে দেখল, সুজাতা কীভাবে ওর সেবার সব ভার নিজের হাতে তুলে নিলেন৷
খুব জ্বর কলির৷ ছাড়ছে না কিছুতেই৷ প্যারাসিটামলে একটু কমছে, আবার বেড়ে যাচ্ছে৷ ডাক্তারবাবু এসে দেখে গেলেন৷ সুজাতার গভীর উদ্বেগে গোলাপজল ছিটিয়ে বলে গেলেন, অত ভাবছেন কেন মিসেস গোস্বামী, সেরকম ভয়ের কিছু নেই।”
“না মনটা আমার খুব খারাপ হয়ে গেছে৷ অত আনন্দ করে গেল মেয়েটা, ফিরে এল অসুখ নিয়ে৷ বেচারি!”
সবসময় কলির কাছে কাছে থাকেন সুজাতা৷ খাওয়া-দাওয়ার যত্ন করেন৷ জ্বর বাড়লে জলপট্টি দেন কপালে। যতক্ষণ না ঘুমিয়ে পড়ে কলি, মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দেন৷ কলির মন আবেগে ভরে ওঠে।
ওষুধের গুণে না সুজাতার সেবার গুণে কে জানে, পাঁচদিন পর কলির জ্বর ছাড়ল৷ কিন্তু খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে৷ সুজাতা অভিকে বললেন “তুই আজ অফিস ছুটি নিয়ে কলির কাছে একটু থাক। ওর মন ভাল থাকবে৷”
“তোমরা তো আছ৷ আমি থাকলে আবার আলাদা করে কী ভাল থাকবে!”
“আমার থাকা আর তোর থাকার তফাৎ আছে। মেয়েটা যেন কেমন ঘাবড়ে গেছে৷ তুই ওর কাছাকাছি থাকলে মনের জোর পাবে৷ ভাল লাগবে ওর।”
কলি শাশুড়ি মায়ের ভালবাসায় দ্রব হয়ে গেল৷ ঠিক ওর মনের কথাটি বলেছেন উনি৷ অভি কাছে থাকলে খুব ভাল লাগবে৷ অলি সুজাতার আঁচল টেনে বলল, “তুমি আমার মনের কথাটা কী করে বুঝলে?”
“মায়েরা সব বোঝে।” হেসে বললেন সুজাতা। হেসে ফেলল কলিও৷ শাশুড়ির আঁচলের নীচে মুখ লুকোল৷ যেন কত ভরসার জায়গা ওর৷
জ্বর সারল তো স্টম্যাক লুজ় হয়ে গেল কলির৷ বেশ কয়েকবার টয়লেট যেতে হলে ওকে। বলতেও হল সবাইকে। সবাই আহা আহা করতে লাগল। পেট ব্যথা করছিল কলির। বিছানায় কুঁকড়ে মুকড়ে শুয়েছিল, ঘুমিয়ে পড়েছিল যেন কখন৷ হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেল, দেখল সুজাতা ওর পায়ের কাছে বসে আছেন৷ তাড়াতাড়ি উঠে বসল কলি। বলে উঠল, “একি মা আপনি এখানে এভাবে বসে?”
মধুচন্দ্রিমার মাধুর্য কাটতে না কাটতেই কাহিল অবস্থা৷ নতুন শ্বশুরবাড়ি, লজ্জায় পড়ে গেল৷ কিন্তু ও আবার অবাক হয়ে দেখল, সুজাতা কীভাবে ওর সেবার সব ভার নিজের হাতে তুলে নিলেন৷
“তোমার জন্য মুড়ি ভেজানো জল নিয়ে বসে আছি। ঘুমটা ভাঙলে দেব ভেবেছিলাম। এমন অকাতরে ঘুমোচ্ছ, ডাকতে মায়া লাগছিল। এই জলটা খাও। পেট ঠাণ্ডা হবে। জ্বরের সময় অত কড়া কড়া ওষুধ খেয়েছ!”
আপনি আর কত করবেন মা আমার জন্য? কেবলই ভুগছি।
“বা রে করব না? তুমি তো আমার মেয়েই। একটু পরে পেটে তেল-জল মালিশ করে দেব। ভাল লাগবে।”
চোখে জল এসে গেল কলির। মনে মনে ভাবল, বাড়িতে মা-ও তার অসুখের সময় খুব যত্ন করে, কিন্তু সঙ্গে বকুনিও চলে। এখানে বকুনি নেই, শুধু আদরটাই আছে। শাশুড়ি-মায়ের আঁচল ধরে শুয়ে থাকল কলি।
জ্বর পুরো সারেনি, সঙ্গে পেটে এমন ইনফেকশন। ডাক্তার নিজেই একটু চিন্তিত হলেন। তাঁর মতে কলিকে একটা ভাল নার্সিংহোমে মুভ করলে ভাল হয়। অভিরও তাই মত। সময় থাকতে সাবধান হওয়াই ভাল। বাড়িতে যখন তখন শরীর আরও বেশি খারাপ হয়ে পড়তে পারে। তখন ডাক্তার কোথায় পাবে?
কলি বুঝতে পারছে না কী হতে চলেছে। ওর ভয় করছে। তবে দরকার থাকলে তো এরা নার্সিংহোমে পাঠাবেই। হাসপাতাল আর জেলখানা, দুটোই ওর কাছে সমান ভয়ের। কী হবে? এরা তো ওর কথা শুনবে না। কে পাত্তা দেবে ওর ভয়কে? কিন্তু একজন পাত্তা দিল। সুজাতা নিজেই বলে দিলেন, “আমার নার্সিংহোম-হাসপাতালে বড় ভয় লাগে। বিশ্বাসও নেই। কলির এমন কিছু সিরিয়াস অবস্থা নয়। আমি তো আছি। আমি দেখাশোনা করব। আমার বিশ্বাস, ডাক্তারবাবুর ওষুধ আর বাড়ির যত্নেই কলি ভাল হয়ে উঠবে।” কলির যে কী ভাল লাগল শাশুড়ি-মাযের কথাগুলো। এ করুণ চোখে সুজাতার দিকে তাকাল। সুজাতা বলে উঠলেন, “না না, আমি তোমাকে কোথাও পাঠব না। বাড়িতেই চিকিত্সা হবে। আমি দায়িত্ব নিচ্ছি।”
কলি শাশুড়ি মায়ের ভালবাসায় দ্রব হয়ে গেল৷ ঠিক ওর মনের কথাটি বলেছেন উনি৷ অভি কাছে থাকলে খুব ভাল লাগবে৷ অলি সুজাতার আঁচল টেনে বলল, “তুমি আমার মনের কথাটা কী করে বুঝলে?”
প্রায় দশ দিন অনবরত চিকিত্সা আর সেবার ফলস্বরূপ কলি সুস্থ হয়ে উঠল। সুস্থ হয়েই প্রথমে সে শাশুড়ি-মাকে গড় হয়ে প্রণাম করল। সুজাতা বললেন, “আমাকে প্রণাম নয় মা কলি। এই যে, তোমার নামে আজ পুজো দিয়ে এলাম। প্রসাদ নিয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করো।” শাশুড়ি মেয়ার আঁচল মুঠো করে ধরে কলি বলল, “না মা, খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। শুধু তোমার জন্যই জীবন ফিরে পেলাম। তুমিই আমার ভরসা।” সুজাতার চোখে মুখে হাসির ঢেউ খেলা করে গেল।
“আরে আমিই কি কম ভয় পেয়েছিলাম নাকি? বলতে নেই, যদি তোমার একটা কিছু হয়ে যেত?”
আহ্লাদী গলায় কলি বলে উঠল, “আমি মরে গেলে তোমার খুব কষ্ট হত, না?”
“কষ্ট হবে না? এইতো কত খেটেখুটে মাত্র তিন মাস হল ছেলের বিয়ে দিয়েছি! তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার অভির কী হবে? আবার মেয়ে দেখা, পছন্দ করা, বিয়ের হুজ্জোত পোহানো! এসব কি আর পারব? তার ওপরে তোমার মতো ভাল মেয়ে না-ও পেতে পারি! খোঁজই বা দেয় কে? হাজারটা ঝামেলা।”
কলি নিষ্পলক তাকিয়ে আছে সুজাতার দিকে৷ সেদিকে অত লক্ষ নেই সুজাতার। হেসে হেসে বলে ফেললেন, “তাছাড়া ভাবছিলাম, তোমার বাবা যা সুন্দর সুন্দর ফার্নিচার দিয়ে আমাদের বাড়ি সাজিয়ে দিয়েছেন, এসব ফেরত দিয়ে দিতে হলে বাড়ি তো সেই আগের মতোই ফাঁকা হয়ে যাবে! পরে যাকে আনব, তারা তেমন কিছু দেবে কি দেবে না, তার ঠিক আছে? না না, তুমিই আমার ঘরের লক্ষ্মী৷” কলির চিবুক ছুঁয়ে চুমু খেলেন সুজাতা।
কলির হাতে প্রসাদ আর প্রণাম, দুটোই ধরা রইল৷ মুখে অজস্র কাটাকুটি৷ ভেতরটা কাঁপছিল ওর৷ শাশুড়ির আঁচল অনেক দূরে৷ ভরসা অনেক দূরে।
পেশায় অধ্যাপক বিনতা রায়চৌধুরী গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবে জনপ্রিয়। কবিতা ও প্রবন্ধ লেখাতেও সমান দক্ষ। নিয়মিত বিখ্যাত সাহিত্যপত্রগুলিতে ওঁর লেখা প্রকাশিত হয়। যাপনলিপি, তূণীরে তিনটি তীর, আলোর রাত আঁধার রাত, নিঃশব্দ জলরব, তোমাকে ছুঁয়ে, ছকের বাইরে ওঁর কিছু প্রকাশিত বই।
One Response
ভালো গল্প। ছোটগল্পের মোচড়টি সামান্যকথায় নিয়ে এসেছেন।