(Bimal Chattopadhyay)

সত্যজিৎ রায়। বাঙালির চিরকেলে আইকন। ঘরের লোক। এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। শতবর্ষে সত্যজিতের অজস্র মণিমানিক্য থেকে গুটিকয়েক তুলে নিয়ে বাংলালাইভ সাজিয়েছে তাদের শ্রদ্ধার্ঘ্যের ছোট্ট নিবেদন। এক পক্ষকাল ধরে বাংলালাইভে চলছে সত্যজিৎ উদযাপন। কখনও তাঁর সুরের মায়া, কখনও তাঁর ক্যামেরার আঙ্গিক, কখনও তাঁর তুলিকলমের দুনিয়া – আমরা ধরতে চেয়েছি বিভিন্ন বিশিষ্টজনের লেখায়-ছবিতে-চলচ্ছবিতে-সাক্ষাৎকারে। আজ লেখার বিষয় সত্যজিৎ হলেও লেখার মধ্যমণি আর একজন বিশিষ্ট মানুষ, যাঁর নাম বিমলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন বহুপ্রতিভাশালী এক শিল্পী, সংগ্রাহক এবং সত্যজিতের পরম সুহৃদ। বিশ্ববরেণ্য পরিচালকের একাধিক ছবিতে অভিনয় ছাড়াও বিমলচন্দ্রের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা থেকে বহু জিনিস সত্যজিৎ ব্যবহার করতেন তাঁর ছবিতে। দু’জনের ভালোবাসার সম্পর্ক আমৃত্যু ছিল অটুট। আজ বিমলচন্দ্র ও সত্যজিৎকে নিয়ে কলম ধরেছেন বিমলবাবুর পুত্র তথা কথাকার ও সম্পাদক চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।
বিমলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (Bimal Chattopadhyay) শুধু আমার ‘বাবা’ ছিলেন না, ছিলেন আমার শৈশব থেকে যৌবনে পৌঁছনোর একমাত্র একান্ত বন্ধু। ২১শে এপ্রিল ১৯১২ সালে ভবানীপুরের বিখ্যাত চট্টোপাধ্যায় বংশে বিমলচন্দ্রের জন্ম। পিতা ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তৎকালীন যুগের নামী ইঞ্জিনিয়ার। তেজোদীপ্ত, সুপণ্ডিত ভোলানাথের পাঁচ পুত্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিলেন সাংসদ, ঐতিহাসিক, প্রথিতযশা ব্যরিস্টার নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সেই বড়দার হাত ধরেই কনিষ্ঠপুত্র বিমলচন্দ্রের পথ চলা শুরু হয়।
পথে চলতে গিয়ে বাবা থেমে থাকেননি কোনও নির্দিষ্টতায়। দিগন্তরেখার হাতছানিতে বারবার ছুটে গেছেন আকাশ ছুঁতে, বিভিন্ন মাধ্যমে। হয়তো এটাই তাঁর ব্যর্থতা অথবা এটাই তাঁর জীবনকে এনে দিয়েছিল বহুমুখী জনপ্রিয়তার স্বাদ। প্রথম জীবনে রাজনীতির অঙ্গনে ঘুরে বেড়িয়েছেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বীর সাভারকর, অগ্রজ নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে। কিন্তু সেখানেও মন টেঁকেনি। অভিমানে সরিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। তবলায় নাড়া বেঁধেছিলেন প্রখ্যাত তবলিয়া মজিদ খাঁ-র কাছে। আর সুর যাঁর কানে একবার ঢুকেছে, সুরহীন হয়ে তিনি কী ভাবে থাকবেন! জড়িয়ে পড়লেন সুরের দুনিয়ায়। হেন কোনও বাদ্যযন্ত্র নেই যা তিনি বাজাতে পারতেন না। মায়ের মুখে শুনেছি খুব ভোরবেলা, আলো ফোটারও আগে বাবা বাঁশি বাজাতেন। আমাদের পৈতৃক গ্রামের বাড়িতে (হুগলি জেলার তেলান্ডু, মালিপাড়া) দোতলায় একটা কালো সিমেন্ট বাঁধানো ভেঙে পড়া জায়গা আছে। বড় হয়ে যখন একদিন সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, শুনেছিলাম বাবা ওখানে বসেই আড়বাঁশিতে সুরের জাল বুনতেন। ভেঙে পড়া সেই খন্ডহরে এখনো কান পাতলে বুঝি শোনা যায় বাবার বাঁশির সুরের ভৈরবী। (Bimal Chattopadhyay)
তাঁর ৩৫ বছর বয়সে বাবা কলকাতার বুকে একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেন। প্রথম ‘শ্রীঅরবিন্দ আবির্ভাব মহোৎসব’ করেন কলকাতার হাজরা পার্কে ১৯৪৯ সালে। সঙ্গে পেয়েছিলেন অগ্রজ নির্মলচন্দ্র, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ডঃ কালিদাস নাগ, রাধাবিনোদ পাল, রাজা ধীরেন্দ্রলাল রাওয়ের মতো মানুষকে। অনুষ্ঠানের সূচনা করেছিলেন বীর সাভারকর। পরপর দশ বছর চলেছিল এই মহোৎসব। (Bimal Chattopadhyay)
বাবার জীবনের ব্রত ছিল হাত বাড়ালেই বন্ধু। সাত থেকে সত্তর- সবারই বিমলদা। কথায় আছে, তাল-মান-সুর, এই নিয়ে ভবানীপুর। ভবানীপুরে ২৫ নম্বর হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে তখন ছিল চাঁদের হাট। বড় জ্যাঠামশায়ের কাছে তখন দেশের তামাম প্রধান সারির নেতৃবৃন্দের অবারিত আনাগোনা। আর বাবার বৃত্ত তৈরি হচ্ছিল পরবর্তীকালে বিখ্যাত কিছু মানুষের সখ্যের বন্ধনে। বিখ্যাত হারমোনিয়াম শিল্পী মন্টু বন্দ্যোপাধ্যায়, সঙ্গীতজ্ঞ তারাপদ চক্রবর্তী, রাধিকামোহন মৈত্র, পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, ব্যারিস্টার বি.কে ঘোষ, অভিনেতা বিকাশ রায় ছিলেন বাবার ছোটবেলার বন্ধু। পরে সে পরিধি সীমায়িত থাকেনি কোনও সংখ্যার নির্দিষ্টতায়। শিল্প থেকে রাজনীতি, সাহিত্য থেকে বাণিজ্যের অঙ্গন, খেলা থেকে চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্র থেকে সংগীত, সমস্ত মানুষই হয়ে উঠেছিলেন বাবার বন্ধু। আর এটাই ছেলে হিসেবে ছোটবেলা থেকে আমাকে ভীষণ প্রভাবিত করেছিল। পেশার অন্তর্দ্বন্দ্বে অনেক সময় দেখেছি, এক পেশার মানুষ সমপেশায় অন্য মানুষকে ঈর্ষা করেন। মিশতে পারেন না ভালো ভাবে। কিন্তু বাবার অদ্ভূত আলাপচারিতায় ধরা দিয়েছিলেন সবাই। আর তারই ফল তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে জমানো কয়েকশো চিঠি। (Bimal Chattopadhyay)

যখন আমার জ্ঞান হল, তখন বাবার জীবন প্রৌঢ়ত্বের দিকে। একটু বেশি বয়সের সন্তান আমি। তাই আদর পেয়েছি বাবার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি। তবু ঈর্ষা হয় আমার নিজের দিদি-দাদাকে, যাঁরা বাবার সেই প্রবল তেজোদীপ্ত দিনগুলোর সাক্ষী। আমরা তিন ভাই বোন। দিদি বড় – মীনাক্ষি। দাদা – শিবাজি। আমার থেকে দু’জনেই যথাক্রমে কুড়ি ও আঠারো বছরের বড়। অনেকটা সময় পেছনে ফেলে আমি হামাগুড়ি থেকে দৌড়তে শিখেছি। দিদি চিত্রশিল্পী। সরোদে নাড়া বেঁধেছিলেন স্বয়ং আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছে। আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব আমাদের ভবানীপুরের বাড়িতে এসে পনেরো দিন ছিলেন। সে অন্য ইতিহাস। দাদা নাড়া বেঁধেছিলেন প্রখ্যাত তবলিয়া কেরামতুল্লা সাহেবের কাছে। মা বাজাতেন অর্গান। এই অদ্ভুত পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছিলাম আমি। (Bimal Chattopadhyay)
ছোটবেলা থেকেই দেখতাম বাড়িতে বসতো মাসিক জলসা। কে না আসতেন! পাহাড়ি সান্যাল, জগন্ময় মিত্র, সুপ্রভা সরকার, সুনন্দা পট্টনায়েক, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, অখিলবন্ধু ঘোষ…। আমাদের ১১৬ নং মিড্ল রোডের বাড়িতে নিচে দু’টি হলঘর আছে। বাবা যতদিন সুস্থ ছিলেন, নিয়মিত সেখানে সংস্কৃতিচর্চা হয়েছে। আমার কাজ ছিল বাবার সঙ্গে ঘরজোড়া শতরঞ্চি আর কার্পেট পাতা। আর অনুষ্ঠান শেষে চায়ের এঁটো ভাঁড় কুড়িয়ে জঞ্জালে ফেলা। হয়তো সাংসারিক অনটনের ছাপ পড়েছে মনে, কিন্তু এক অনির্বচনীয় আনন্দে বুক ভরেও উঠত। আর দেখতাম মায়ের সহনশীলতা। এমন অসাধারণ নারী আমি জীবনে দেখিনি। উত্তরপাড়া রাজবাড়ির আদুরে কন্যা। অসম্ভব সুন্দরী। স্বামীর অর্থনীতির পড়ন্ত বিকেলকে হাসি মুখে মেনে নিয়েছিলেন। যখন তখন ঘরে অতিথি এলে নিজের মুখের খাবারটুকু হাসিমুখে বিলিয়ে দিতেন। (Bimal Chattopadhyay)

আপাদমস্তক বাবু কালচারের প্রতিভূ ছিলেন বাবা। নস্টালজিক মেদুরতায় স্বপ্নালু চোখে বলে যেতেন গল্প। তাঁর জীবনের বিচিত্র ঘটনা। মানুষের সঙ্গমে ডুব দিয়েছেন বারবার। আহত হয়েছেন, আঘাত পেয়েছেন, কিন্তু নিরাশ হননি। আবার শুরু করেছেন। ঘর ভর্তি শুধু বই। বারবার পড়েছেন। টেনথ এডিশন এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিট্যানিকা থেকে শুরু করে ‘মুদির দোকান পরিচালনা ও গো-পরিচর্যা’। বিলেতে ছাপা প্রথম সচিত্র বই ‘মিরর অফ দ্য ওয়র্ল্ড’ থেকে শুরু করে ‘স্তবকবচমালা।’
যখনই বাবার কথা ভাবতে বসেছি, ভাবি কোনও কিছু একটাতে কেন আটকে থাকলেন না তিনি। তাহলে সেটাতেই বিখ্যাত হতেন। তবলা শুনলে মনে হত কেন তবলিয়া হলেন না। হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মতো। চিঠি লেখাও যে একটা শিল্প হতে পারে, সাহিত্য হতে পারে – এ কথা প্রথম অনুভব করি বাবার চিঠি লেখা দেখে। কি পরিশীলিত শব্দচয়ন, কেন সাহিত্যের অঙ্গনে এলেন না! অভিনয় দেখেও মনে হয়েছে, যেন সেই ভাবেই আলাপচারিতা করেছেন, যেমন কথা বলেন সবার সঙ্গে। জাগলিংও করতেন। অসাধারণ ফ্রেটওয়ার্ক, কাঠের কাজ করতেন। আর কোনও জিনিস ফেলতেন না। বাসের টিকিট থেকে মুড়ির ঠোঙা, কিছুই ফেলা যেত না। সবই যোগ হত তাঁর সংগ্রহে। এই করে করেই ক্রমে গড়ে ওঠে তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা। সেখানে পুরনো মূর্তি থেকে শুরু করে পুঁথি, চিঠিপত্র কী নেই। সবই অ্যান্টিক হিসেবে সযত্নে রেখেছেন। (Bimal Chattopadhyay)

একদা এই আড্ডার মাধ্যমেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল জয়পুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত প্যারাসাইকোলজিস্ট ডক্টর হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। মেতে উঠলেন আবার নতুন দিগন্তে। বিশেষ বন্ধু, প্রধান বিচারপতি প্রশান্তবিহারী মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে ষাটের দশকের শেষভাগে কলকাতায় গড়ে তুললেন ‘পশ্চিমবঙ্গ প্যারাসাইকোলজিক্যাল সোসাইটি।’ সেই সমিতিরই আজীবন সদস্য হয়েছিলেন জগৎবরেণ্য চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়। থাকতেন উত্তম কুমারও। নিয়মিত আড্ডা জমত সেখানে। সত্যজিৎবাবু ক্রমে উৎসাহিত হয়ে উঠতে থাকেন এ বিষয়ে। এবং সে বছরই (১৯৭১) শারদীয়া দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় জাতিস্মর মুকুলকে নিয়ে সত্যজিৎবাবুর ফেলুদা কাহিনি ‘সোনার কেল্লা’। বছর তিনেক পরে, সেটিকে যখন চলচ্চিত্রায়িত করেন, তখন বন্ধু বিমলদাকে ডাক দেন একটি ছোট্ট ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য, নকল মুকুলের দাদু সলিসিটর শিবরতন মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকায়। (Bimal Chattopadhyay)
বাবার নিজের লেখায় আছে – ‘প্রথম শুটিং-এর দিন বসলাম দৃশ্যে। আলো, ক্যামেরা সব ঠিক হলে সত্যজিৎবাবু কাছে এলেন। বললাম, “কী করে বলব, একটু বলে দিন!” কণ্ঠের স্বরে “চুপ করে বসুন”, বলে চলে গেলেন। আমি হতাশ হয়ে বসে রইলাম। কিছু পরে আবার সামনে এসে আমার গায়ের শালটা নেড়ে চেড়ে ঠিক করে দিলেন। তখন আমি মরিয়া হয়ে কাতর অনুরোধ করলাম, “একটু বলে দিন ভাই কী ভাবে বলব!” আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে বললেন, “আমার বাড়ি যান না আপনি! আড্ডা মারেন না!” ঘাড় নেড়ে বললাম, “তা তো মারি!” “ঠিক সে ভাবেই বলবেন” বলেই দ্রুত চলে গেলেন। এই হলেন সত্যজিৎ রায়। এই একটি বাক্যে তিনি আমায় অভিনেতা করে দিলেন। সারা জীবনে আমার সকল প্রান্তে ও কাজে পেয়ে এসেছিলাম আশ্চর্য সফলতা ও পরিপূর্ণতা। নিষ্ঠুর নিয়তি হঠাৎ আমায় নির্বাসিত করেছিলেন যে সোনালি জীবন থেকে, আমার কল্যাণ দেবতা আবার সেই নুয়ে পড়া জীবনে দান করলেন সত্যজিতের প্রীতি ও মমতা। মরণের দুয়ারে পেলাম অমৃতখণ্ড। এর মূলে আছে আমার হিতৈষী সত্যজিৎ রায়ের দেওয়া বীজমন্ত্র – ‘আড্ডা।’ আমি ছায়াছবিতে আড্ডা মেরেছি।’ (Bimal Chattopadhyay)

এ ভাবেই অসমবয়সের সখ্য গভীরতর হয়। এরপর ‘জন অরণ্য’-এ মিস্টার আদক, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ অম্বিকানাথ ঘোষাল, ‘হীরক রাজার দেশে’-তে অতিথি রাজা, ‘ঘরে বাইরে’-তে কুলদাবাবুর ভূমিকাতেও বাবা অভিনয় করেন। আর করেন মৃণাল সেনের ‘খারিজ’ ছবিতে। ছোটপর্দায় জোছন দস্তিদারের ‘তেরো পার্বণ’ ও সুপান্থ ভট্টাচার্যের ‘রজনী’ ধারাবাহিকেও অভিনয় করেছিলেন বাবা। (Bimal Chattopadhyay)

রবিবার রবিবার বিশপ লেফ্রয় রোডে সত্যজিৎবাবুর বাড়ির আড্ডায় বাবার উপস্থিতি থাকতই। বিজয়া রায় তাঁর ‘আমাদের কথা’ বইতে লিখে গিয়েছেন, ‘বিমলবাবুকে একটা ইন্টারেস্টিং চরিত্র দেওয়া হয়েছে। ডায়লগ মাঝে-মাঝে একটু ভুল হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু মানিক হেসে এত উৎসাহ দিচ্ছিলেন যে, নার্ভাস আস্তে-আস্তে চলে গিয়ে সুন্দর অভিনয় করলেন। ভদ্রলোকের আভিজাত্য আছে, নানারকম শখ- গান, বাজনা, থিয়েটার; আলাপ আছে বহু নামকরা লোকের সঙ্গে। নিজে এসে আমাদের বাড়িতে মানিকের সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। খুব আমুদে মানুষ, প্রচণ্ড সেন্স অফ হিউমার। মানিকের সঙ্গে নানা দিক থেকে মতের মিল থাকার দরুণ ভাবটা বেশ তাড়াতাড়ি জমে উঠেছিল। ওঁকে দিয়ে মানিক অভিনয় করিয়ে নিয়েছিলেন। থাকেন বেশ দূরে, কনভেন্ট গার্ডেন রোডে। সেখান থেকে আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসতেন, এবং ওঁর বাজখাঁই গলার আওয়াজ পেলেই আমি ছুটে আসতাম। কারণ জানতাম উনি এলেই আড্ডাটা জমবে ভালো।’ (Bimal Chattopadhyay)


আমাদের এন্টালির বাড়িতেও সত্যজিৎবাবু এসেছেন বেশ কয়েকবার বাবার সংগ্রহ ও বই দেখতে। ‘জন অরণ্য’ শুটিংয়ের সময়ও এসেছেন। বাবার সংগ্রহ থেকে বেশ কিছু জিনিস প্রপস হিসেবে ব্যবহার করেছেন তাঁর ছবিতে। তার মধ্যে একটা হল জয় বাবা ফেলুনাথের ডিম্বাকৃতি তাস! আর এক বার ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’-র সময়ে পুরনো বইয়ের প্রয়োজন পড়েছিল সত্যজিৎবাবুর। শুধু পুরনো হলে হবে না, হতে হবে ‘প্রিন্টেড বিফোর ১৮৫৭’! তেমন বই ছিল বাবার সংগ্রহে। ফলে এই ছবির জন্যে আমাদের বাড়ি থেকে বেশ কিছু বই পাঠানো হয়েছিল ওঁকে।
আজীবন এক অনাবিল বন্ধুত্বের সৌহার্দ্যে বদ্ধ ছিলেন দুজনে। আমার জীবনের সৌভাগ্য এই মানুষ দু’টিকে কাছ থেকে দেখেছি। দু’বার সত্যজিতের ছবির ইউনিটের সঙ্গে বাইরে গেছি। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ‘-এর শুটিংয়ে বেনারস ও ‘হীরক রাজার দেশে’-র শুটিংয়ে জয়পুর। সে স্মৃতি আমার সারাজীবনের সঞ্চয়। তবে সে গল্প অন্য আর একদিন শোনাব। (Bimal Chattopadhyay)
১৯৬১ সালে কলকাতায় জন্ম। সাংবাদিকতা নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করার পর লেখালিখি শুরু 'মহানগর' পত্রিকায়। পরে পিয়ারলেস সংস্থায় জনসংযোগ আধিকারিক হিসেবে যোগদান এবং দীর্ঘ দু'দশক পরে স্বেচ্ছাবসর। ১৯৭৮ সাল থেকে 'কিঞ্জল' পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। পুরনো কলকাতা নিয়ে গবেষণাই ধ্যান জ্ঞান। 'কলকাতার কথকতা' দল তৈরি করেছেন পুরনো কলকাতার নানা হারিয়ে যাওয়া বিষয় নিয়ে চর্চার জন্য। কবিতা যখন কবিতা, হ্যাপি হোম ক্লিনিক, গণসংযোগ, বঙ্গদর্শনে রবীন্দ্রনাথ, কার্টুন ক্যালকাটা-সহ একাধিক বই লিখেছেন ও সম্পাদনা করেছেন।
11 Responses
শ্রদ্ধেয় বিমালবাবুর কিছু সংগ্রহ দেখার ইচ্ছা রইল।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শ্রদ্ধেয় শ্রী বিমলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরে ভালো লাগলো। জয়পুর আর বেনারসের শ্যুটিং ইউনিটের অভিজ্ঞতা শোনাবার অনুরোধ রইলো।
Onek khobor janlam
অসাধারণ দুই ব্যাক্তিত্ব সম্মন্ধে অনেক কিছু জানতে পারলাম।
খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তথ্যে ভরা আপনার লেখাটা। দারুন লাগলো। আমার খুব প্রিয় অভিনেতা তিনি, তার সাবলীল অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছি সবসময়, বিশেষত সোনার কেল্লায় নাতির সাথে কমপ্লিমেন্টারি সংলাপ “যতসব”, এরকম আরো অনেক । আপনি ভাগ্যবান যে এরকম গুণী একজন মানুষ আপনার বাবা। ভালো থাকবেন। সুদূর ক্যানসাস থেকে শুভেচ্ছা।
খুব ভালো লাগলো লেখাটি পড়ে। আশা করি আরও অনেক তথ্য সমৃদ্ধ লেখা দিয়ে বিমল বাবুর সম্বন্ধে আমাদেরকে মুগ্ধ করবেন।
আমি তোর ভুলে যাওয়া বন্ধু সুমিত দে। মিনতি মাসীর ছেলে। ইচ্ছে হয় তো যোগাযোগ করতে পারিস। তোর সান্নিধ্য খুব উপভোগ করব। হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর 7539888711 । ভালো থাকিস
আমি ওনার অভিনয়ের জাদুতে সম্মোহিত । তবে ওনার অন্যান্য বিস্ময়কর প্রতিভা ও পারিবারিক পরিচয়ের কথা অজ্ঞাত ছিল । আপনার লেখা পড়ে এবং এবারের শারদীয়া ‘ দেশ ‘ পত্রিকায় প্রকাশিত ওনার সম্বন্ধে লেখা ও গুণীজনের চিঠি পড়ে অনেককিছু জানতে পারলাম । অসংখ্য ধন্যবাদ ।
এই অসামান্য স্বাভাবিক অভিনেতা কে আলোয় টেনে আনলেন,স্যার। ধন্যবাদ। আচ্ছা, যতদূর মনে হয়, শ্রী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ওনার আত্নীয় !!
দয়া করে একটা তথ্য জানালে উপকৃত হব, উনি কি সত্যজিৎ রায়ের নায়ক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন ?
না।