(Birsa Munda) ‘অরণ্যের অধিকার কৃষ্ণ-ভারতের আদি অধিকার। যখন সাদা মানুষের দেশ সমুদ্রের অতলে ঘুমোচ্ছিল, তখন থেকেই কৃষ্ণ-ভারতের কালো মানুষরা জঙ্গলকে মা বলে চেনে’ – ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসে যাঁর মুখে এই সংলাপ বসিয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবী, তিনি প্রান্তিক মানুষের অধিকার এবং প্রতিবাদের আর এক নাম বিরসা মুন্ডা! ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল উনিশ শতকের শেষভাগে। তাঁদের আন্দোলনের মূল দাবি ছিল কৃষিজমি সহ বনের অধিকার রক্ষা। (Birsa Munda)
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো নানান ঔপনিবেশিক আইনের মধ্য দিয়ে কৃষি অর্থনীতিতে শাসন ও শোষণ হয়ে উঠেছিল মাত্রাছাড়া। এই সময়েই মুন্ডা জনজাতি তাঁদের নেতা বিরসার নেতৃত্বে সামাজিক শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যা এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। (Birsa Munda)
নানা তথ্যের সংযোগে মনে করা হয় বিরসার জন্ম ১৮৭৫ সালের ১৫ নভেম্বর, তৎকালীন বিহারের উলিহাতু গ্রামে। বাবা সুগান মুন্ডা ও মা কারমীর চতুর্থ সন্তান তিনি। একদিকে চরম দারিদ্র্য, অন্যদিকে মিশনারি প্রভাবে সুগান মুন্ডা, বিরসাকে স্থানীয় জার্মান মিশনারি স্কুলে ভর্তি করে দেন। পরে এক ক্যাথলিক গীর্জার স্কুলে ভর্তি হন বিরসা। যদিও মহাজনদের বিরুদ্ধে পাশে না থাকার জন্য মিশনারি চার্চের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ১৮৯০ সালে চার্চ ত্যাগ করে আশ্রয় নেন বন্দগাঁওয়ের বৈষ্ণব মুন্সি আনন্দ পাঁড়ের কাছে। কতই-বা বয়স তখন তাঁর, বড় জোর পনেরো-ষোলো। (Birsa Munda)
অস্থির বিরসা তখনই জমিদার, মহাজনদের অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি খুঁজছেন। ১৮৭৮ সালে যে বন আইনের মধ্য দিয়ে, বনবাসী ও বন নির্ভর আদিবাসী মানুষের চিরাচরিত সব অধিকার কেড়ে নিয়েছিল ইংরেজরা, তারই প্রতিবাদে মুন্ডা জনগোষ্ঠীর মানুষদের সংগঠিত করে প্রতিরোধ মঞ্চ গড়ার উদ্যোগ নেন তিনি। (Birsa Munda)
যদিও এর বহু আগে থেকেই মুন্ডাদের জীবনে চরম দুর্দশা নেমে এসেছিল। কোম্পানির সাহেবদের পাশাপাশি ছিল মহাজন, ব্যবসায়ী, ঠিকাদাররা। স্থানীয় রাজারা ভিনদেশি মহাজন, ঠিকাদারদের গ্রামের পর গ্রাম বেচে দেয়। এই সব বহিরাগতদের মুন্ডারা চিহ্নিত করেন ‘দিকু’ নামে। শেষমেশ, ছোটনাগপুরের সংরক্ষিত বনাঞ্চল ব্রিটিশরা দখল করার উদ্যোগ নিতেই বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে গেরিলা বাহিনী, তীর ধনুক এবং টাঙ্গি তরোয়াল নিয়ে মহাজনদের সামাজিকভাবে বয়কট এবং ঋণপত্র পুড়িয়ে ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহ শুরু করে। (Birsa Munda)
ধামসা আর মাদলের তালে তালে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে দিকে-দিকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৮৯৫ সালে ব্রিটিশ পুলিশ বিরসাকে বন্দি করে দু’বছরের কারাদণ্ড দেয়। যদিও ছাড়া পাওয়া মাত্রই ফের তিনি ব্রিটিশ বিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন।
১৮৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাঁচি ও গুপ্তি শহরে বিরসা বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণে বেশ কিছু পুলিশ-সহ নিহত হন বহু মানুষ। আক্রমণের জবাবে ব্রিটিশ সরকার ১৫০ জনের সেনাবাহিনী নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে ডোম্বারি পাহাড়ে। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে ৪০০ জন আদিবাসীকে। কিন্তু, বিরসাকে ধরতে না পেরে তাঁর মাথার দাম ৫০০ টাকা ঘোষণা করে। ১৯০০ সালে চক্রধরপুরে বনের মধ্যে ঘুমন্ত অবস্থায় নিরস্ত্র বিরসাকে বন্দি করা হয়।
ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আদেশ দেয়। কিন্তু, বন্দি অবস্থায় জেলে বিষ প্রয়োগে, আবার কারও মতে, কলেরায় মাত্র ২৫ বছর বয়সে শহিদের মৃত্যুবরণ করেন বিরসা মুন্ডা। তাঁর আত্মত্যাগ এবং আদর্শের কথা স্মরণ করে স্বাধীনতার পর তৈরি হয়েছে বিরসা মুন্ডা বিমানবন্দর, বিরসা ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি এবং বিরসা মুন্ডা ইন্টারন্যাশনাল হকি স্টেডিয়াম।
২০০৪ সালে বিরসার জীবন নিয়ে তৈরি হয় ‘উলগুলান এক ক্রান্তি’ নামে একটি সিনেমা। আবার তাঁর আন্দোলন নিয়ে মহাশ্বেতা দেবী লিখেছেন ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাস। ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করেই ২০০০ সালে বিরসার জন্মদিনে অর্থাৎ ১৫ নভেম্বর ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠন করা হয়। জঙ্গলমহলের প্রান্তিক মানুষগুলো আজও লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা খোঁজেন বিরসা ভগবানের মধ্যে যাতে তাঁদের সুস্থ, শান্তি সৌহার্দের জীবনের অধিকার কেউ যেন কেড়ে নিতে না পারে। যতদিন প্রান্তিক মানুষের অধিকারের লড়াই থাকবে ততদিনই ইংল্যান্ডের রানি, কোম্পানি রাজ এবং দিকুদের বিরুদ্ধে ‘উলগুলান’ বা পূর্ণ যুদ্ধের ডাক দেওয়া বিরসা মুন্ডার নামও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।