২৬শে জুন ছিল Kolkata’s Cuckoo’ গওহর জানের জন্মবার্ষিকী। সেই গওহর জান, যাঁকে নিতে আস্ত বারো বগির ট্রেন পাঠাতেন রাজা রাজড়ারা। সেই গওহর জান, যাঁর ঠুমরির মতোই বিখ্যাত ছিল তাঁর বেড়ালবিলাস। শোনা যায় বেড়ালের বিয়ে দিতে নাকি ২০০০ টাকা খরচ করে দাওয়াত দিয়েছিলেন সে যুগের সুপারস্টার গওহর জান। প্রবাদপ্রতীম এই শিল্পীকে বাংলালাইভের জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ। আজ দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি।
মিস্ গওহর জান কলকাত্তাওয়ালি
গওহর জানের খ্যাতি সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়লেও তিনি ছিলেন মূলত কলকাতার মেয়ে। সারা ভারত তাঁকে চিনত ‘কলকাত্তাওয়ালি গওহর জান’ নামে। সেকালের শায়েররা গওহরকে নিয়ে শায়েরী করে বলতেন, “শওহরহীন যুবতী আর গওহরহীন কলকাতা একই পর্যায়ে পড়ে”। আর তাঁর এই খ্যাতি কেবলই তাঁর নাচগানের জন্য ছিল না। নাচগানের পাশাপাশি তাঁর অমিতব্যায়ী ও চিত্তাকর্ষক জীবনযাত্রার গল্পও সে কালের কলকাতার মানুষের মুখে মুখে ফিরত। নিজের পোষ্য বেড়ালের বিয়েতে তিনি দুই হাজার টাকা খরচা করেন। আর কয়েক মাস পর সেই বেড়ালের ছানা হওয়ার আনন্দে যে পার্টি হয়েছিল তাতে খরচা হয়েছিল ২২ হাজার টাকা! কলকাতার এমন কোনও বড় মানুষ ছিলেন না যিনি সেই পার্টিতে নিমন্ত্রণ পাননি!
সেকালে নিয়ম ছিল গভর্নর জেনারেল ও কোনও বড় রাজ্যের রাজা বা নবাব পরিবারের সদস্যরা ছাড়া কেউ কলকাতায় চার ঘোড়ার গাড়িতে চেপে ঘুরতে পারবে না। গওহর জান চারটি সাদা আরবি ঘোড়া অর্ডার দিয়ে আনান এবং সেই চৌঘুড়ি-যুক্ত ব্রুহাম গাড়িতে চেপে তিনি প্রতিদিন ফ্রি স্কুল স্ট্রিট থেকে ইডেন গার্ডেন্স হয়ে রাজভবনের সামনে দিয়ে গঙ্গার ধারে হাওয়া খেতে যেতেন। একবার স্বয়ং গভর্নর জেনারেলের গাড়ি তাঁর গাড়ির সামনে এসে পড়ে এবং গভর্নর জেনারেল গওহর জানের রাজকীয় গাড়ি দেখে কোনও বড় রাজার গাড়ি মনে করে নিজের টুপি খুলে অভিবাদন জানান। পরে যখন জানা গেল যে সেটি আসলে তবায়েফ গওহর জানের গাড়ি, তখন তিনি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে গওহরকে এক হাজার টাকা জরিমানা করলেন। তবে এতে যে গওহর জানের বেড়ানো বন্ধ হয়ে গেল তা নয়। এরপর থেকে প্রতিদিন গওহর জান নিয়ম করে সেই চৌঘুড়িযুক্ত গাড়িতে চেপেই গঙ্গার ধারে হাওয়া খেতে যেতেন ও ফেরার পথে হাসি মুখে এক হাজার টাকা করে জরিমানা দিয়ে আসতেন!
গওহর জানের পোষাক প্রসাধন ও সর্বসমক্ষে নিজেকে উপস্থাপনার বোধ ছিল প্রবাদপ্রতিম। ফ্রেডরিক গাইসবার্গের ডাইরির পাতা থেকে তাঁর প্রথমবার রেকর্ডিং-এর সময়কার গওহর জানের আরও কিছু টুকরো ছবি ভেসে ওঠে। গাইসবার্গ লিখেছেন,-
“…তিনি যত বার রেকর্ড করতে আসতেন প্রতিবার একটি করে নতুন গাউন পরে আমাদের বিস্মিত করতেন। আর প্রতিটা পোশাক হ’ত আগেরটার চেয়ে আরও জমকালো। আসল সোনার জরিদার কাজ করা সুক্ষ কালো ওড়নাগুলি তিনি এমনভাবে নিতেন যাতে তাঁর একটি পা ও নাভি উন্মুক্ত হয়ে থাকত ও তাঁর মোহময়ী অঙ্গশোভা প্রকাশিত হ’ত। নিজেকে উপস্থাপনার ব্যাপারে তিনি সর্বদা ছিলেন পরিপাটি ও যত্নশীল”।

পোশাকের চাকচিক্য তো ছিলই, সেইসঙ্গে ছিল তাঁর গয়নার জৌলুস। শোনা যায় তিনি তাঁর বাঁ কাঁধে একটি মহার্ঘ্য হিরের ব্রুচ পরে আসরে গাইতে বসতেন এবং স্টেজের দু’পাশে দু’জন বন্দুকধারী ব্যক্তিগত বডিগার্ড সর্বক্ষণ পাহারায় থাকত।
দর্শকদের হাবভাব দেখে তাদের রুচির নাড়িনক্ষত্র বুঝে নেওয়ার এক অস্বাভাবিক ক্ষমতা ছিল গওহর জানের, যা একজন পারফর্মিং আর্টিস্টের সাফল্যের চাবিকাঠি। গওহর কেবল গান গাইতেন না, গানের মাধ্যমে দর্শকদের সিডিউস করার আর্টে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তিনি নিজেই এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে দর্শকদের মন জয় করার এই সমস্ত বিভিন্ন কৌশলগুলি তিনি তাঁর মায়ের কাছ থেকে রপ্ত করেছিলেন। একবার একটি ধ্রুপদের অনুষ্ঠানে গওহর জান ও তাঁর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আগ্রাওয়ালি মালকা জান (গওহরের মা বড়ি মালকা জান ছাড়াও সে যুগে আরও কয়েকজন মালকা জান ছিলেন)-কে একই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। আগে মালকা জান গাইবেন, তার পরে গাইবেন গওহর।
গান্ধীজি ১৯২০ সালে কংগ্রেসের স্বরাজ আন্দোলনের ফান্ড সংগ্রহের জন্য কলকাতায় আসেন এবং গওহর জানকে অনুরোধ করেন, একটি চ্যারিটি অনুষ্ঠান করে কিছু অনুদান তুলে দিতে। গওহর জান এ প্রস্তাবে এক কথা রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু একটি শর্ত রাখলেন। তিনি জানালেন যে অবশ্যই চ্যারিটি কনসার্ট করবেন, কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে গান্ধীজিকে উপস্থিত থাকতে হবে।
আসরের শুরুতেই মালকা জানের আগ্রা ঘরানার অসাধারণ ধ্রুপদী আলাপের সুরে আসরে মধু বর্ষিত হতে লাগল। গওহরের সঙ্গীরা চিন্তায় পড়ে গেলেন যে এই গানের পর গওহরের গান আদৌ কোনো ছাপ ফেলতে পারবে কিনা। কিন্তু গওহর উইং-এর পাশ থেকে উঁকি মেরে লক্ষ্য করলেন যে মালকা জানের গান যতই অসাধারণ হোক না কেন, দর্শকদের মধ্যে বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। তারা যেন সবাই কেমন উশখুশ করছে। গওহর ব্যাপারটি বুঝলেন এবং স্টেজে উঠে ধ্রুপদ-ধামারের ধারেকাছ দিয়েও না গিয়ে একটি হালকা চালের উর্দু গজল দিয়ে আসর শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আসরের চেহারা বদলে গেল। দর্শকদের মুহুর্মুহু “বাহ্ বাহ্, কেয়া বাত” ধ্বনিতে হল ভরে উঠল। এরকম ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। আর একবার, পাথুরিয়াঘাটায় এক অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি দেখলেন যে দর্শকাসনে ইংরেজ, বাঙালি, হিন্দুস্তানি, পাঞ্জাবি প্রভৃতির সমন্বয়ে একটি মিশ্র জনতা রয়েছে। গওহর জান কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করলেন যেন দর্শকদের বসার অ্যারেঞ্জমেন্টটি বদলে ভাষাভিত্তিক বসার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর তিনি স্টেজ থেকে নেমে প্রত্যেক ভাষাগোষ্ঠীর দর্শকের কাছে গিয়ে গিয়ে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষায় একটি-দুটি করে গান গেয়ে শোনালেন। দর্শকদের সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে দেওয়ার এরকম অজস্র কৌশল গওহর জানের জানা ছিল যা তাঁর দর্শকদের মনে ম্যাজিকের মত কাজ করত।

পোশাকআশাক, গয়নাগাঁটি, সম্পত্তি, আইনি ঝামেলা থেকে বড় বড় মানুষদের সঙ্গেই গওহর জানের যথেচ্ছ মেলামেশা ও রোমান্সের নিষিদ্ধ গসিপের গল্পগুলো সে কালে হটকেকের মত বিকতো। সেসব গল্প আজকের পেজ থ্রি-এর পাতা আলো করে থাকা সেলিব্রিটিদের রীতিমত লজ্জায় ফেলে দেবে। তবে এসবের ওপরে আরেকটি জিনিস ছিল যা গওহর জানকে সে যুগের বাকি সমস্ত শিল্পীদের থেকে এক স্বতন্ত্র আসনে বসিয়েছিল। তা হল তাঁর বর্ণময় ব্যক্তিত্বময়ী চরিত্র। স্বয়ং গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের পর যে ঘটনা ঘটেছিল তা সে যুগে একজন তবায়েফের পক্ষে অবিশ্বাস্য ও কল্পনাতীত!
গান্ধীজি ১৯২০ সালে কংগ্রেসের স্বরাজ আন্দোলনের ফান্ড সংগ্রহের জন্য কলকাতায় আসেন এবং গওহর জানকে অনুরোধ করেন, একটি চ্যারিটি অনুষ্ঠান করে কিছু অনুদান তুলে দিতে। গওহর জান এ প্রস্তাবে এক কথা রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু একটি শর্ত রাখলেন। তিনি জানালেন যে অবশ্যই চ্যারিটি কনসার্ট করবেন, কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে গান্ধীজিকে উপস্থিত থাকতে হবে। গওহর ভালো করেই জানতেন যে তবায়েফদের প্রতি গান্ধীজি যথেষ্ট রক্ষণশীল ও বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন। তবে এক্ষেত্রে গান্ধীজি গওহরের শর্তে রাজী হয়ে গেলেন, এবং নির্দিষ্ট দিনে কনসার্ট অনুষ্ঠিত হল।
শেষ বয়সে নিজের থেকে প্রায় কুড়ি বছরের ছোট সেক্রেটারির প্রেমে পড়ে সেই ব্যক্তির লোভ ও ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে নিজের বিপুল সম্পত্তির প্রায় সবঠুকু খোয়াতে হয় তাঁকে। এমনই কপর্দকশূন্য অবস্থা হয়েছিল যে বেড়ালের বিয়েতে বাইশ হাজার টাকা খরচা করা গওহর জানকে শেষ বয়সে এক টাকায় এক একটি বন্দীশ বিক্রি করতে হত।
গওহরের এই কনসার্টে কলকাতার মানুষ বিপুলভাবে সাড়া দিল এবং টিকিট বিক্রি করে মোট ২৪ হাজার টাকা উঠল। কিন্তু গওহর জানতে পারলেন যে গান্ধীজি বিশেষ রাজনৈতিক কর্মসূচীর কারণে সেদিন কনসার্টে আসতে পারছেন না। তার বদলে তিনি মৌলনা শওকত আলিকে নিজের প্রতিনিধি হিসাবে পাঠিয়েছেন। যাই হোক, কনসার্ট ভালো ভাবেই সম্পন্ন হল। কনসার্টের শেষে মৌলনা সাহেব গওহরের সঙ্গে দেখা করতে এলে গওহর তাঁর হাতে ১২ হাজার টাকা তুলে দিলেন। মৌলনা কিছুটা অবাক হয়ে বাকি টাকার কথা জিজ্ঞেস করায় গওহর জান তাঁকে বললেন যে, গান্ধীজিকে গিয়ে বলবেন যে তিনি এত বড় মানুষ হয়েও একজন তবায়েফের কাছে পুরো কথা রাখতে পারেননি, অর্ধেক কথা রেখেছেন, তাই টাকাও অর্ধেক পাবেন। মৌলনা সাহেব বিনা বাক্যব্যয়ে সেই টাকা নিয়ে সেখান থেকে চলে যান, এবং গান্ধীজিও আর এ বিষয়ে কখনও মুখ খোলেননি।
তবে নিজের আত্মমর্যাদার দিক থেকে গওহর যতটা বক্তিত্বময়ী ছিলেন, অন্যদিকে প্রেম ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিক থেকে তিনি ছিলেন ঠিক ততটাই আবেগপ্রবণ ও অতিসরলমতি প্রকৃতির। যে জন্য একদিকে যেমন তিনি বহু প্রভাবশালী পুরুষের ‘এক রাতের প্রেম’-এর প্রস্তাব মুখের ওপর প্রত্যাখ্যান করেছেন, তেমনই আবার একাধিক বার ভুল লোকের প্রেমে পড়ে দাগা খেয়েছেন এবং সেই সংক্রান্ত আইনি ঝামেলায় জড়িয়ে তাঁর সম্মানহানী ও বিপুল অর্থনাশ হয়েছে। শেষ বয়সে নিজের থেকে প্রায় কুড়ি বছরের ছোট সেক্রেটারির প্রেমে পড়ে সেই ব্যক্তির লোভ ও ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে নিজের বিপুল সম্পত্তির প্রায় সবঠুকু খোয়াতে হয় তাঁকে। এমনই কপর্দকশূন্য অবস্থা হয়েছিল যে বেড়ালের বিয়েতে বাইশ হাজার টাকা খরচা করা গওহর জানকে শেষ বয়সে এক টাকায় এক একটি বন্দীশ বিক্রি করতে হত।
১৯২৮ সালে গওহর জান শেষ বারের মত কলকাতা ছাড়েন এবং পয়লা আগস্ট তারিখে তিনি মাত্র ৫০০ টাকা মাসিক বেতনে মাইসোরের মহারাজার দরবারে সভাগায়ক হিসাবে যোগ দেন। কিন্তু তত দিনে গওহরের জীবনে অনেক কিছুই বদলে গেছে। পঞ্চাশোর্দ্ধ গওহর জান তাঁর জনপ্রিয়তা ও সুপার স্টার স্ট্যাটাস হারিয়েছেন। চোখে উঠেছে মোটা পাওয়ারের চশমা। মানসিক অশান্তি, দুশ্চিন্তা ও অর্থাভাবে তাঁর চেহারা ও বেশভূষার জৌলুস হারিয়ে দেখা দিয়েছে দৈন্যদশা। মনের গভীরে বাসা বেঁধেছে ক্রনিক ডিপ্রেশন। মাইসোরে গওহর বছর দুয়েক ছিলেন। নানাবিধ সমস্যায় জড়িয়ে থেকেই তাঁর জীবনের এই শেষ দুটো বছর কেটে যায়। ১৯৩০ সালের জানুয়ারি মাসের গোড়ার দিকে প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে গওহর জানকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং ১৭ই জানুয়ারির ১৯৩০ তারিখে এক প্রবল শীতের রাতে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে চিরকালের মত স্তব্ধ হয়ে যায় কলকাতার কুক্কু মিস গওহর জানের কণ্ঠ।
হুগলির চুঁচুড়ার বাসিন্দা শঙ্খশুভ্র ইতিহাসের খোঁজ করতে ভালোবাসেন। হুগলি জেলার ইতিহাসের চর্চা এবং সেখানকার স্থাপত্যের সংরক্ষণের কাজে তিনি যুক্ত। বিভিন্ন সংস্থার হয়ে প্রচারমূলক শর্ট ফিল্ম তৈরি করা শঙ্খর পেশা।