বাংলার এক কবি শতবর্ষ পার করলেন আজ। সেই কবির নাম বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কোনওদিন কোনও বড় প্রতিষ্ঠানের প্রচার না পেয়েও শুধুমাত্র পাঠকের সমর্থনে, সংগ্রামী জীবন ও কবিতার জোরে, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কবি হিসেবে আজও জীবন্ত। শতবর্ষ পার করেও অত্যন্ত জরুরি। দুঃসময়ে কবি যেন আরও অমোঘ এই বাংলাভাষায়। গত বছর ২রা সেপ্টেম্বর শতবর্ষে পা রেখেছিলেন কবি। আজ তাঁর জন্মশতবর্ষ পূর্তিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় অজস্র কবিতাপ্রেমী মানুষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। ফেসবুকে আজ তাঁর কবিতার ঝড়। সোশ্যাল মিডিয়ায় আজ প্রতুল মুখোপাধ্যায়, মৌসুমী ভৌমিক, বিপুল চক্রবর্তীর মতো গায়কদের কণ্ঠে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার গান ব্যাকুল করে তুলেছে মানুষকে। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কবিরাও সামিল হয়েছেন বীরেন্দ্র বন্দনায়।

সেই সঙ্গেই প্রশ্ন উঠেছে নিজেকে ‘ব্রাত্য কবি’ মনে করা, সাধারণ মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করা এবং একটি ‘পিদিম’-এর আলোর মতো নরম হৃদয় নিয়ে সারাজীবন কবিতায় বেঁচে থাকা এই কবিকে কি যথাযথ শ্রদ্ধা জানিয়েছি আমরা? এমনকী সরকারি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলি? পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমির মতো প্রতিষ্ঠান তাঁর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে কোনও অনুষ্ঠান করেনি। আজীবন লিটল ম্যাগাজিনে কবিতে লেখা এই কবিকে নিয়ে সরকারি লিটল ম্যাগাজিন মেলাতেও হয়নি কোনও সভা। গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে এই সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত একটা অনুষ্ঠানও কেন হল না—এই নিয়ে অনেকেই মুখর। ক্রান্তদর্শী বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাই তখন মনে পড়ে—
‘কবিতা
তুমি কেমন আছো?’
‘যেমন থাকে ভালোবাসার মানুষ
অপমানে।‘
[the_ad id=”270088″]
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ঢাকার বিক্রমপুরে ১৯২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর। যৌবনে অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। প্রতিবাদী রাজনৈতিক চেতনা কবি-মননকে ছুটিয়ে মেরেছে একজীবন। কোনও রাজনৈতিক সংঘে অবশ্য তিনি নিজেকে বন্দি রাখেননি। চেতনা ও গণসংগ্রামকে বিশ্বাস করেছেন। কবি স্পষ্ট করেছেন নিজের এই অবস্থানকে, “নিজের মতো করে বলার চেষ্টা করি। কোনও তত্ত্বই আমি কোনওদিন তেমন বুঝিনি।“ গায়ক হেমাঙ্গ বিশ্বাস, কবি রাম বসু, কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বন্ধু। বীরেন্দ্রর উৎসাহদাতা ছিলেন বিমল চন্দ্র ঘোষ, অরুণ মিত্র। বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে-র ছাত্র ছিলেন তিনি। প্রেমেন্দ্র মিত্র, দিনেশ দাশ ছিলেন প্রিয়। এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ছিল তাঁর ‘নিজস্ব পৃথিবী’। কবিতায় নিবেদিত বীরেন্দ্র অভাবকে পরোয়া করেননি। জীবনে খিদে ছিল বলেই অনুভব করেছেন বিশ্বজুড়ে, দেশজুড়ে সাধারণ মানুষের খিদেকে। এই মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অশেষ ভালোবাসা। লিখেছেন ‘আশ্চর্য ভাতের গন্ধ’ আকাশে বাতাসে। লিখেছেন,
”শুধু দুই বেলা দু’টুকরো পোড়া রুটি
পাই যদি তবে সূর্যেরও আগে উঠি…”।
ধুতি পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলা— বইমেলায়, গ্রামে গ্রামে ঘুরে নিজের বই বিক্রি করেছেন কবি। বিক্রি কি আর সঠিক কথা? আসলে স্পর্শ আর চিন্তা বিনিময়। তাঁর কবিতা বলে, “এসো, আমরা আগুনে হাত রেখে/ প্রেমের গান গাই।“ সেই আগুনের নাম রক্তজবা। ষাট-সত্তরে ঝলসে উঠেছিলেন কবি! আক্রমণাত্মক কবিতায় টলটল করত তাঁর হৃদয়। চিৎকারে মিশে থাকত কান্নাও। কবি বলেন,
“মানুষ রে, তুই সমস্ত রাত জেগে
নতুন ক’রে পড়,
জন্মভূমির বর্ণপরিচয়!”
কোনও শাসনেই সত্যকে মিথ্যা করা যায় না, এই কথা বলেছেন পালটা গলায়—
“চোখরাঙালে না হয় গ্যালিলিও
লিখে দিলেন, ‘পৃথিবী ঘুরছে না।‘
পৃথিবী তবু ঘুরছে, ঘুরবে;
যতই তাকে চোখরাঙাও না।“
গায়ক হেমাঙ্গ বিশ্বাস, কবি রাম বসু, কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বন্ধু। বীরেন্দ্রর উৎসাহদাতা ছিলেন বিমল চন্দ্র ঘোষ, অরুণ মিত্র। বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে-র ছাত্র ছিলেন তিনি। প্রেমেন্দ্র মিত্র, দিনেশ দাশ ছিলেন প্রিয়। এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ছিল তাঁর ‘নিজস্ব পৃথিবী’।
দেশভাগ, খাদ্য আন্দোলন, নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিল-বিরোধী আন্দোলন, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, জরুরি অবস্থা, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ বা নকশাল আন্দোলন— তাঁর জীবনের নানা সময়ে যে সমস্ত সামাজিক ঝঞ্ঝা এসেছে, প্রতিটিতে কবি তাঁর চেতনা ও কলম নিয়ে সক্রিয়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কখনও কোনও আপস করেননি। প্রাপ্তির লোভে কেঁপে যায়নি তাঁর লক্ষ্যভেদী কণ্ঠস্বর। একের পর এক অমর কবিতায় লিখেছেন—
“তোমার কাজ
আগুনকে ভালোবেসে উন্মাদ হয়ে যাওয়া নয়
আগুনকে ব্যবহার করতে শেখা।“
“মাটি তো আগুনের মতো হবেই
যদি তুমি ফসল ফলাতে না জানো;
যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও
তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি।“
“রাজা আসে যায় রাজা বদলায়
নীল জামা গায় লাল জামা গায়
এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামাকাপড়ের রং বদলায়…
দিন বদলায় না!”
সহজ সরল ভাষায় লেখা এইসব যন্ত্রণাদগ্ধ পর্যবেক্ষণ আজকের এই সময়েও পাঠকের কাছে অত্যন্ত বাস্তব বলে মনে হয়। কালজয়ী একজন কবিই কেবল এভাবে তাঁর দৃষ্টিকে ৫০-৬০ বছর পরের সমাজে পাঠিয়ে দিতে পারেন। কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে রচিত একটি কবিতায় তিনি যা লিখেছিলেন, তা পড়ে বিভ্রম জন্মায়— আজকের ক্রান্তিকালের কবিতা অত আগে তিনি কী করে লিখে ফেলেছিলেন?
“তাঁর মতো কেউ হব না উন্মাদ
যদিও আজ সমস্ত দেশ রক্ত বমন করছে;
তবু, মাটি মানুষ, আদর্শকে
ভয়ঙ্কর নরক থেকে তুলে আনতে
আমরা তাঁর মতো কিছুতে আর বুকের হৃৎপিণ্ডটাকে মুক্ত করে শুশ্রূষার মন্ত্র বলব না।
কেননা, মহামারীর মধ্যে নিজের বুক খুলে রাখার
এখন কোনও সত্যিকারের নিয়ম নেই।“
[the_ad id=”270086″]
তিন পাহাড়ের স্বপ্ন, রাণুর জন্য, লখিন্দর, মুখে যদি রক্ত ওঠে, মহাদেবের দুয়ার, মানুষের মুখ, মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে, পৃথিবী ঘুরছে, বেঁচে থাকার কবিতা প্রমুখ কাব্যগ্রন্থের কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা সমগ্র, শ্রেষ্ঠ কবিতা তরুণ প্রজন্মের কাছে অতি প্রিয়। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় কবি জয় গোস্বামী জানালেন,”তরুণ কবিদের আগ্রহেই প্রমাণিত হয় শারীরিক মৃত্যু হলেও কবি এখনও জীবিত। আবৃত্তিকাররাও তাঁর কবিতা এখনও শুনিয়ে চলেছেন।“ পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমি বা সরকারি লিটল ম্যাগাজিন মেলা কমিটির তরফে কেন অনুষ্ঠান হল না, এই প্রশ্নের উত্তরে জয় গোস্বামী জানিয়েছেন,”অতিমারীর প্রকোপে সব সরকারি আকাদেমির অনুষ্ঠান তো এখন বন্ধ। এমনকী কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মৃতিরক্ষা কমিটিও নিশ্চয়ই এই কারণে অনুষ্ঠান করতে পারেনি।“
কবির জন্মদিনে ফেসবুকে কবিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কবিতা লিখেছেন সুবোধ সরকার, যিনি বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ কবিতা অকাদেমির সভাপতি। শতবর্ষের অনুষ্ঠান নিয়ে কবি সুবোধ সরকার জানিয়েছেন,”পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমি সমস্ত আকাদেমির মতো এখন বন্ধ। যেই খুলবে প্রথম অনুষ্ঠানটা হবে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে।“
জনগণের সরকারের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক এই আয়োজনের দাবি যখন ন্যায্য মনে করছেন কবির গুণগ্রাহীরা, সব-তুচ্ছ-করা কবি তখন কোন গহনে দাঁড়িয়ে অশ্রুসজল উচ্চারণে মগ্ন—
“ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে
যদি আমি সমস্ত জীবন ধ’রে
একটি বীজ মাটিতে পুঁততাম
একটি গাছ জন্মাতে পারতাম
যেই গাছ ফুল ফল ছায়া দেয়
যার ফুলে প্রজাপতি আসে, যার ফলে
পাখিদের ক্ষুধা মেটে;
ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে
যদি আমি মাটিকে জানতাম!”
কবি, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক বিভাস রায়চৌধুরী দীর্ঘদিন কবিতার প্রকাশনা ও চর্চার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। 'কবিতা আশ্রম' পত্রিকার মুখ্য পরিকল্পক। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ওঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম নষ্ট প্রজন্মের ভাসান (১৯৯৬)। এর পরে কবি পাঁচটি উপন্যাস সহ কুড়িটিরও বেশি কবিতা গদ্য ও প্রবন্ধের বই লিখেছেন।
3 Responses
শতবর্ষের আলোয় প্রিয় কবিকে শ্রদ্ধা ভালবাসা জানাতে অনেক টা ভাল লাগলাগা।
এমন আলোচনা আরও বেশি করে প্রয়োজন। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আগামীতে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন। আমরা বিহিত উপশম চেয়ে বারবার দ্বারস্থ হব তাঁর কবিতার কাছে। তাঁর জন্ম-শতবর্ষ ঘটা করে উদযাপন হোক বা নাহোক, তিনি সমান প্রাসঙ্গিক থাকবেন পাঠকের কাছে।
বাহ! বেশ বেশ।