(Tintin)
টিনটিনের দুনিয়ায় একটু উঁকিঝুঁকি মারা যাক। সেই দুনিয়ায় তো শুধু একা ক্ষুদে রিপোর্টার নয়, রয়েছে তাঁর সদা সহচর শ্বেত ফক্স টেরিয়ার কুট্টুস, রয়েছে তাঁর পরম উপকারি বন্ধু ক্যাপ্টেন আর্চিবল্ড হ্যাডক। রয়েছে বিশ্বময় টিনটিনের পিছু ধাওয়া করা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের চূড়ান্ত আনাড়ি মাণিকজোড় গোয়েন্দা থমসন আর থম্পসন। রয়েছে আরও হাজারো চরিত্র। আর সত্যি বলতে কি তারাও কম মজাদার বা আকর্ষণীয় নয়। টিনটিনের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনিগুলোর আসল আমেজ পাঠক পান এইসব চরিত্রগুলো থেকেই। (Tintin)
আরও পড়ুন: সিরিয়ার ঘূর্ণাবর্ত: এবার কি ইজরায়েল-তুর্কি সংঘাত?
(Tintin) সব মিলিয়ে অ্যার্জে টিনটিনের দুনিয়া গড়েছেন ‘অ্যাডভেঞ্চারস অফ টিনটিন’ সিরিজের প্রায় ৬ দশকের ব্যাপ্তিতে ২৪টি কাহিনিতে। যার শুরু ১৯২৯ সালে ‘টিনটিন ইন দ্য ল্যান্ড অফ দ্য সোভিয়েতস’ থেকে ১৯৮৬ সালে মরণোত্তর প্রকাশিত অসমাপ্ত ‘টিনটিন অ্যান্ড আলফ আর্ট’-এ। পরিসংখ্যান বলছে ২০২৪ পর্যন্ত বিশ্বের ৭০টি ভাষায় ২০কোটিরও বেশি বিক্রি হয়েছে টিনটিন কাহিনি। বিশ্বের বেস্টসেলার কমিকসের তালিকায় অষ্টম স্থানে রয়েছে এই সিরিজের বইগুলো।
শুরু হল টিনটিন কাহিনির দ্বিতীয় পর্ব। (Tintin)

কুট্টুস বা এক অমর প্রেম কাহিনি
তোপসে ছাড়া যেমন ফেলুদাকে ভাবা যায় না, অজিতকে ছাড়া যেমন ব্যোমকেশ অসম্পূর্ণ, ওয়াটসন ছাড়া যেমন হোমসকে বড় একা লাগে, লোথার ছাড়া যেমন ম্যানড্রেকের কোনও যাদুই ঠিক জমে না, তুফান ছাড়া অরণ্যদেব খাপছাড়া লাগে, তেমনই কুট্টুস ছাড়া টিনটিনের কোনও অ্যাডভেঞ্চারই রঙিন হয় না। (Tintin)
টিনটিন সিরিজের সবক’টা কাহিনির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কেউ যদি টিনটিনের সঙ্গে থেকে থাকে সে হল কু্ট্টুস। এই কুট্টুসের সৃষ্টি কাহিনিও কম মজাদার নয়। মূল ফরাসীতে কুট্টুসের নাম ছিল মিলু। (ইংরাজি অনুবাদে যা হয়ে দাঁড়ায় স্নোয়ি। বাংলায় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনুবাদে হল কুট্টুস)।
আর কুট্টুস হল টিনটিনের প্রধান সহচর। সত্যি বলতে টিনটিন সিরিজের নবম কাহিনি ‘দ্য ক্র্যাব উইথ গোল্ডেন ক্লস’এ ক্যাপ্টেন আর্চিবল্ড হ্যাডকের আগমনের আগে সেই ছিল টিনটিনের প্রধান সহচর। (Tintin)
‘সিগারস অফ দ্য ফারাও’ নামের এই অভিযানে ক্ষুদে গোয়েন্দাপ্রবর তাঁর সঙ্গী কুট্টুসকে নিয়ে এক আন্তর্জাতিক মাদক পাচার চক্রের পর্দাফাঁসের জন্য লোহিত সাগর থেকে ব্রিটিশ ভারতের এক করদ রাজ্যের জঙ্গলে দৌড়েছে।
টিনটিনের কাহিনিতে কুট্টুস হল এক দস্যি চরিত্র যার নানান মজাদার কাণ্ডকারখানায় পাঠককূল সবসময় মজে থাকে। টিনটিনের সঙ্গে নিয়মিত কথাবার্তাও বলত কুট্টুস। হ্যাডক এসে কার্যত কুট্টুসকে সেই জায়গা থেকে সরায়। তারপরও কুট্টুস কথা বলেছে কিন্তু তা মূলত অন্য প্রাণীদের সঙ্গে। সহজাত চাঞ্চল্য থাকলেও কুট্টুস কিন্তু টিনটিনে নিবেদিত প্রাণ। প্রখর বুদ্ধিও ধরে। সাহসীও সে। ‘টিনটিন ইন দ্য ল্যান্ড অফ সোভিয়েতস’ থেকে শুরু করে তারই বুদ্ধির জোরে টিনটিন বারংবার বেঁচেছে। দোষের মধ্যে দোষ হল সে বড্ড হাড়ের ভক্ত আর তা নিয়ে নানান মজাদার ঘটনাও ঘটেছে। সে ভয় পায় মাকড়শাকে আর ভয় পেয়েই তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছে ‘দ্য ব্ল্যাক আইল্যান্ড’ আর ‘দ্য সুটিং স্টার’ কাহিনিদুটিতেই। মদ খেয়েও কুট্টুস ‘টিনটিন ইন দ্য ল্যান্ড অফ দ্য সোভিয়েতস’, ‘দ্য ব্ল্যাক আইল্যান্ড’, ‘টিনটিন ইন টিবেট’ আর ‘টিনটিন অ্যান্ড দ্য পিকারোস’ এর মতো কাহিনিগুলোতে নানান মজাদার কাণ্ড করেছে। আবার অপরাধী চেনায় কুট্টুসের দক্ষতাও দেখা গিয়েছে বারংবার। (Tintin)
আরও পড়ুন: কেন থমকে গেল কমলার হোয়াইট হাউজ অভিযান
কেন টিনটিন সহচরের এই নাম? তাহলে এক প্রেমের গল্প বলতে হয়। অ্যার্জের প্রথম জীবনের প্রেমিকা ছিলেন ম্যারি লুই ভন কটসেম ওরফে মিলু। দু’জনেই দু’জনকে ভালবাসতেন। কিন্তু এই ভালবাসা পরিণয় অবধি যায়নি। কারণ স্কুলের গণ্ডি পার করে অ্যার্জের স্বপ্ন তখন শিল্পী হওয়া। দু’একটা ছোটখাটো পত্রপত্রিকায় সবে তাঁর আঁকা বেরোতে শুরু করেছে। কিন্তু মিলুর বাবার চোখে এই বাউণ্ডুলে আঁকিয়ের কোনও ভবিষ্যত চোখে পড়ল না। তাই চার হাত আর একও হল না। কিন্তু তা বলে জর্জ কিন্তু কোনওদিনও তাঁর প্রেমকে ভুলে যাননি। বরং এই শ্বেতশুভ্র ফক্স টেরিয়ারকে টিনটিনের সঙ্গী করলেন যখন তাঁর নাম তাঁর একসময়ের গার্লফ্রেন্ডের নামেই নামকরন করলেন। (Tintin)
১৯২৯-এ এসেও টিনটিনকে মহিলা সঙ্গী দিতে পারেননি তিনি। রাতে দু’জনে কী করবে এই ভেবেই পিছিয়েছেন অ্যার্জে।
হঠাৎ সারমেয় বিষয়টা অ্যার্জের মাথায় এল কেন? বলা হয় অ্যার্জে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস এর যে কাফেতে নিয়মিত যেতেন তার মালিকের ছিল ফক্স টেরিয়ার জাতের কুকুর। তার থেকেই মিলুর অণুপ্রেরনা। আরও একটি মতবাদ আছে। হ্যারি থম্পসন তাঁর ‘টিনটিন-অ্যার্জে অ্যান্ড হিজ ক্রিয়েশন’ এ লিখছেন, “ওই সময়ে বেলজিয়ামে মহিলা সঙ্গী থাকার কথা ভাবাই সম্ভব হত না। ছোট থেকেই এই ধরনের প্রথাগত আবহাওয়ায় অ্যার্জে বড় হয়েছেন। তাই ১৯২৯-এ এসেও টিনটিনকে মহিলা সঙ্গী দিতে পারেননি তিনি। রাতে দু’জনে কী করবে এই ভেবেই পিছিয়েছেন অ্যার্জে।” এ ছাড়া মনে রাখতে হবে ল্য পেতি ভ্যামচিয়েমার মতো গোঁড়া ক্যাথলিক কাগজে এসব সম্ভব নয়। অগত্যা সারমেয়ই সঙ্গী। কিন্তু তার নাম দিলেন মিলু। অর্থাৎ এক শ্বেত ফক্স টেরিয়ারের মাধ্যমে অ্যার্জে তাঁর প্রেমকেও অমরত্ব দিলেন। (Tintin)

দুঃখী ইংরেজ মাছের নাম হ্যাডক
বন্দর থেকে কারাবুজান নামে এক মালবাহী জাহাজ ছেড়েছে। ওই জাহাজের এক নাবিকের খুনের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য জাহাজে উঠেছিল টিনটিন। কিন্তু জাহাজের ফার্স্ট মেট অ্যালেনের ষড়যন্ত্রে টিনটিন বন্দি হল। এদিকে টিনটিনের ফিরতে দেরি হওয়ায় জাহাজে উঠে পড়েছে কুট্টুস। খোঁজ পেয়ে গিয়েছে টিনটিনের। দাঁত দিয়ে কেটে তাকে বন্ধনমুক্তও করেছে। তারপর আরেক কেবিনে ঢুকে টিনটিন আবিষ্কার করেছে কাঁকড়ার টিনে আফিম। জাহাজে যে আফিম চোরাচালান হচ্ছে তা বুঝতে টিনটিনের দেরি হয় না। এদিকে অ্যালেনের দলবল যেই বুঝেছে বন্দি পালিয়েছে ওমনি তারা টিনটিনকে খুঁজতে শুরু করে। টিনটিন তখন পালিয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেন, হ্যাডকের কেবিনে ঢুকল। হ্যাডক তখন মদের ঘোরে। কিন্তু টিনটিনের আসার শব্দে তাঁর ঘোর কাটল। চোখ খুলেই দেখলেন সামনে উদ্যত রিভলবার হাতে টিনটিন। (Tintin)
টিনটিন রিভলবার উঁচিয়ে-চেঁচালেই গুলি করব।
ক্যাপ্টেন হ্যাডক-(হতবাক হয়ে) তুমি তুমি আবার কে হে?
টিনটিন- এই বিচ্ছিরি জাহাজের একজন বন্দি।
হ্যাডক- (ক্ষেপে গিয়ে) বিচ্ছিরি? খবরদার…আমি…আমি-ক্যাপ্টেন হ্যাডক। আমার জাহাজকে বিচ্ছিরি বললে আমি ভীষণ রেগে যাই।
টিনটিন- তাতে আমার বয়েই গেল। আফিমের চোরাই ব্যবসা চালাচ্ছেন। আপনার লজ্জা করে?
হ্যাডক- (হতবাক হয়ে)আফিম? আমার জাহাজে? বলো কী?
টিনটিন- কেন আপনি জানেন না?
হ্যাডক- সত্যিই জানি না। দেখো ব্যাপার। শেষকালে কী না আমার মতো সৎ লোকের জাহাজে চোরাই আফিম! এ নিশ্চয়ই ওই হতচ্ছাড়া অ্যালেনের কাণ্ড।”
হ্যাডক নামটা পেলেন স্ত্রী জারমাইনের কাছ থেকে এক ডিনার টেবিলে মাছ খেতে খেতে-এক দুঃখী ইংরেজ মাছের নাম হ্যাডক।
শুরু হল টিনটিন সিরিজের নবম কাহিনি ‘দ্য ক্র্যাব উইথ গোল্ডেন ক্লস’। টিনটিনের দুনিয়ায় পা রাখলেন ক্যাপ্টেন আর্চিবল্ড হ্যাডক। রগচটা, খিটখটে, উন্নাসিক, রুক্ষ চুল, ঘন দাঁড়ি সবসময়ে ক্যাপ্টেনের টুপি আর পোশাক গায়ে দেওয়া এক ইংরেজ নাবিক। তারপর কাহিনির পর কাহিনিতে তাঁরা মাণিকজোড়। কাপ্টেনের যতই পাণাসক্তি থাক যতই রেগে গেলে হাত পা ছুঁড়ে তার মুখ দিয়ে বিচিত্রসব শব্দ বের হোক, যতই তিনি টিনটিনের সব দুঃসাহসিক অভিযানে জল ঢালার চেষ্টা করুক, যখন সময় আসে তখন দেখা যায় হ্যাডক রয়েছেন টিনটিনের পাশেই, তা সে জলদস্যুদের সঙ্গে যুদ্ধেই হোক বা রকেটে চড়ে চাঁদে যাওয়াই হোক। অবশ্য হুইস্কির খোঁজ তিনি সব জায়গাতেই করেছেন। (Tintin)
আরও পড়ুন: ডিপফেক-মানবসভ্যতার মারিয়ানা ট্রেঞ্চ?
হ্যাডক নামটা পেলেন কীভাবে অ্যার্জে? এই ইংরেজ নাবিকের বিচিত্র শব্দচয়নও বা কীভাবে অ্যার্জের মাথায় এল? হ্যারি থম্পসনের মতে, ১৯৩০ এর দশকে আর পাঁচজন বেলজিয়ামবাসীর মতো অ্যার্জেও ইংরেজদের পছন্দ করতেন। ফলে তাঁর যখন মনে হল কাহিনির স্বার্থেই টিনটিনের এক মনুষ্য সহচর দরকার, তখন এক ইংরেজ চরিত্র রাখার কথাই ভাবলেন। হ্যাডক নামটা পেলেন স্ত্রী জারমাইনের কাছ থেকে এক ডিনার টেবিলে মাছ খেতে খেতে-এক দুঃখী ইংরেজ মাছের নাম হ্যাডক। আর অ্যার্জেও যে চরিত্রায়ণ করলেন সেখানেও সদাই কল্পিত দুঃখে হ্যাডক হুইস্কিতে মুহ্যমান। মজার কথা হল আফ্রিকার দক্ষিণাংশে (দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাউয়ে) আফ্রিকান ভাষায় হ্যাডককে ‘ক্যাপ্টেন সার্ডিন’ নামে ডাকা হয়। (Tintin)
আর রেগে গেলে হ্যাডকের মুখ দিয়ে যে সব বিচিত্র শব্দ বার হয় তার উৎস আবার অন্যত্র। ব্রাসেলসে একবার অ্যার্জের সামনেই এক দোকানদারের সঙ্গে খদ্দেরের বচসা বাধল। অ্যার্জে অবাক হয়ে দেখলেন দোকানদারের বিচিত্র সব কথার জেরে খদ্দের রণে ভঙ্গ দিল। ১৯৩৩ এর এই ঘটনা অ্যার্জের মনে ঠাঁই করে নিল। তাই ১৯৪০ এ এসে যখন ‘দ্য ক্র্যাব উইথ দ্য গোল্ডেন ক্লস’ এ হ্যাডকের চরিত্রায়নের কথা ভাবলেন তখন সাত বছর আগের দেখা সেই অভিজ্ঞতা হুইস্কি প্রিয় ক্যাপ্টেনকেও দিলেন। (Tintin)
আরও পড়ুন: ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিদেশনীতি ও সমকালীন বিশ্ব
থম্পসনের মতে, টিনটিনের কাহিনি যত এগিয়েছে ততই হ্যাডকের চরিত্র আরও পরিষ্কার হয়ে দেখা দিয়েছে পাঠকের সামনে। প্রথমে হুইস্কিতে চুর সদা দুঃখবিলাসী অবিমিশ্রকারী হ্যাডককে দু্র্বল চিত্ত মনে হলেও টিনটিন বিপদে পড়লে খোলা তলোয়ার জলদস্যুদের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তে এক মুহূর্তও ভাবে না। (Tintin)
হ্যাডক চরিত্রটা আদতে অ্যার্জে তাঁর চারপাশের সহযোগীদের স্বভাব থেকেই গড়েছেন। এমনকি নিজেও বাদ যাননি। থম্পসনের মতে, প্রথমে তাঁর দলের কালারিস্ট ই পি জ্যাকবের ধাঁচে হ্যাডককে বানান অ্যার্জে। জ্যাকবের মতোই সদা চঞ্চল, দিলখোলা, কথায় কথায় উত্তেজিত হওয়া-জ্যাকবের সব স্বভাবই দিলেন হ্যাডককে। তবে মুখের উপর যা তা বলা স্বভাবটা নিলেন তাঁর আরেক সহযোগী কার্টুনিস্ট রবার্ট ফ্রাঁ মারি দ্য মুর বা বব দ্য মুরের থেকে। পরবর্তী কালে অ্যার্জের নিজের চরিত্রেরও প্রতিফলন দেখা যায় হ্যাডকের মধ্যে। (Tintin)

জনসন ও রনসন- তোমার নাম টিনটিন?
১৯৩২ সালের ২৪ শে নভেম্বর টিনটিন ভক্তদের কাছে এক স্মরনীয় দিন। সেদিনই ল্য পেতি ভ্যামচিয়েমা ঘোষণা করল মার্কিন মুলুকের অভিযানের পর টিনটিন ফের নতুন দেশে নতুন অ্যাডভেঞ্চারে নামছে।
“১৯২৯ সালের ‘টিনটিন ইন দ্য ল্যান্ড অফ সোভিয়েতস’, ১৯৩০ সালের ‘টিনটিন ইন দ্য কঙ্গো’ আর ১৯৩১ সালের ‘টিনটিন ইন আমেরিকা’-র পর টিনটিন ফের বেরোচ্ছে নতুন এক অভিযানে। ‘সিগারস অফ দ্য ফারাও’ নামের এই অভিযানে ক্ষুদে গোয়েন্দাপ্রবর তাঁর সঙ্গী কুট্টুসকে নিয়ে এক আন্তর্জাতিক মাদক পাচার চক্রের পর্দাফাঁসের জন্য লোহিত সাগর থেকে ব্রিটিশ ভারতের এক করদ রাজ্যের জঙ্গলে দৌড়েছে। (Tintin)
এই কাহিনিকে অনেকেই টিনটিন কাহিনি সিরিজের মোড় ঘোরানো আখ্যান হিসাবে দেখেন। তার একটা কারণ যদি টিনটিনের ভারত আগমন হয় তো অন্যটা এই কাহিনি থেকে শুরু হল টিনটিন দুনিয়ায় এমন কিছু চরিত্রের আগমন যারা পরবর্তী কাহিনিগুলোতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। শুধু তাই নয়, সমালোচকদের মতে মুখে অ্যাডভেঞ্চারের কথা বললেও আগের তিনটি কাহিনিই কোনও জমাট বাঁধা টান টান রহস্য গল্প বলে না। এগুলো বরং ছোট ছোট ঘটনার সমাহার। সেদিক দিয়ে দেখলে ‘সিগারস অফ দ্য ফারাও’ই হল টিনটিনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ রহস্য অ্যাডভেঞ্চার। (Tintin)
অগস্ট আন্দোলন কিংবা মধ্যবিত্তের এগিয়ে আসার গল্প
এতেই শেষ নয়। প্রথমেই বলতে হয় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দুই আনাড়ি গোয়েন্দা থম্সন আর থম্পসন (বাংলা অনুবাদে যা হয়েছে জনসন ও রনসন), এর কথা। ‘সিগারস অফ দ্য ফারাও’ এ লোহিত সাগরে প্রমোদতরীতে যাওয়ার সময় এই গোয়েন্দা যুগলের আবির্ভাব ঘটে। প্রথম দৃশ্যেই দেখা যায় এরা দূর থেকে টিনটিনের উপর নজর রাখছে। (Tintin)
তারপর টিনটিন জাহাজে তার কেবিনে ঢুকতেই এরাও পিছু পিছু সেখানে আসে। তারপরের কথোপকথন হল
জনসন ও রনসন- তোমার নাম টিনটিন?
টিনটিন- নিশ্চয়ই।
জনসন ও রনসন- তোমাকে আমরা গ্রেফতার করছি।
টিনটিন- গ্রেফতার? আমাকে? নিশ্চয়ই ঠাট্টা।
গল্পের শুরু হল এখানে। তারপর টিনটিন যেখানেই গিয়েছে এই মাণিকজোড়ও সেখানে হাজির হয়েছে। তা সে পোর্ট সৈয়দই হোক, মরুভূমিই হোক বা ভারতের জঙ্গল। এভাবেই পরবর্তী টিনটিন কাহিনিগুলোতে এই মানিকজোড়ের মজাদার উপস্থিতি পাঠকের কাছে টিনটিনের দুনিয়াকে আরও আপন করেছে।
আদতে গোয়েন্দাযুগল থম্সন আর থম্পসনের চরিত্র সৃষ্টির সময় ছোটবেলার এক স্মৃতি অ্যার্জের কাজে লেগেছে। অ্যার্জে ছোটবেলায় প্রায়ই দেখতেন বাবা আলেক্স রেমি আর কাকা লিঁয় হাঁটতে বেরোন।
আদতে গোয়েন্দাযুগল থম্সন আর থম্পসনের চরিত্র সৃষ্টির সময় ছোটবেলার এক স্মৃতি অ্যার্জের কাজে লেগেছে। অ্যার্জে ছোটবেলায় প্রায়ই দেখতেন বাবা আলেক্স রেমি আর কাকা লিঁয় হাঁটতে বেরোন। দূর থেকে তাদের দুজনের একই রকমের বউলার হ্যাট পরে একই ধরণের ছড়ি হাতে নিয়ে দেখলে কমিক্যাল ফিগার মনে হত ছোট্ট জর্জের। সেই ছবিটাই মনে গেঁথে গিয়েছিল জর্জের যা অ্যার্জে হয়েও ভোলেননি তিনি। (Tintin)
আরও পড়ুন: ফেসবুকের অক্সিজেন ও কলকাতার জেগে ওঠা
‘সিগারস অফ দ্য ফারাও’ আরও এক কারণে টিনটিন দুনিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ। কাহিনির শুরুতেই জাহাজের ডেকে টিনটিনের সঙ্গে দেখা হয় চূড়ান্ত ভুলোমনা প্রফেসর সোফোক্লিস সার্কোফেগাসের সঙ্গে। পাঠকরা পরবর্তীকালে ১৯৪৩ সালে টিনটিনের দ্বাদশ কাহিনি ‘রেড রেকহ্যামস ট্রেজারে’ আসা ভুলোমন, প্রফেসর কার্থবার্ট ক্যালকুলাসের সঙ্গে আশ্চর্য্য মিল পাবেন। মনে করা হয় সুইস পদার্থবিদ অগস্ত পিকার্ডের আদলে অ্যার্জে গড়েছেন ক্যালকুলাসের চরিত্র। (Tintin)
১৯৪৩ সালে টিনটিনের দ্বাদশ কাহিনি ‘রেড রেকহ্যামস ট্রেজারে’ আসা ভুলোমন, প্রফেসর কার্থবার্ট ক্যালকুলাসের সঙ্গে আশ্চর্য্য মিল পাবেন। মনে করা হয় সুইস পদার্থবিদ অগস্ত পিকার্ডের আদলে অ্যার্জে গড়েছেন ক্যালকুলাসের চরিত্র।
টিনটিনের মজাদার দুনিয়ায় রয়েছে আরও হাজারো চরিত্র যারা নিয়মিত রয়েছে নানান কাহিনিতে। উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের মধ্যে রয়েছে টিনটিনের চিনা বন্ধু চ্যাং চ্যাং-চেন, মিলানের গায়িকা বিয়াঙ্কা ক্যাস্টাফিওর, ক্যাপ্টেন হ্যাডকের পরিচারক নেস্টর, টিনটিনের পয়লা নম্বরের দুশমন রবার্তো রাস্তাপপুলাস, আরেক বদমাশ হ্যাডকের একদা ফার্স্ট মেট অ্যালান থম্পসন, গোয়েন্দা প্রধান কর্নেল স্পঞ্জ, রবার্তো রাস্তাপপুলাসের কুকর্মের সহযোগী ডাক্তার ক্রলসপেল আর টিনটিনের বন্ধু জেনারেল অ্যালকাজারের পয়লা নম্বর দুশমন জেনারেল ট্যাপিওকা। এদের নিয়েই টিনটিনের জমজমাট দুনিয়া। (Tintin)
তথ্যসূত্র:
(১) টিনটিন অ্যার্জে অ্যান্ড হিজ ক্রিয়েশন- হ্যারি থম্পসন,
(২) সোভিয়েত দেশে টিনটিন- আনন্দ পাবলিশার্স
(৩) দ্য রিয়েল অ্যার্জে- সিয়ান লি
(৪) টিনটিন ফারাওয়ের চুরুট- আনন্দ পাবলিশার্স
(৫) টিনটিন কাঁকড়া রহস্য- আনন্দ পাবলিশার্স
মূলত শিল্প বাণিজ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাংবাদিকতায় ব্যপ্ত বিগত তিন দশক। তবে সুযোগ পেলে ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়া বা অন্য ধরনের লেখাতে প্রাণের আরাম খোঁজার চেষ্টাও চলে