(Diego Maradona) ছিয়াশির বিশ্বকাপ। নীল-সাদা দশ নম্বর জার্সি গায়ে ছুটছে ছোটোখাটো চেহারার গাঁট্টাগোঁট্টা একটা লোক। তাকে কেউ থামাতে পারছে না। সে পড়ে যাচ্ছে, লাথি খাচ্ছে, তবুও উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়াচ্ছে আবার। চোখধাঁধানো ড্রিবলিঙ আর শাণিত তরবারির মতো চলা বাঁ পায়ের সামনে সবই কেমন ফিকে হয়ে যাচ্ছে! কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ। আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। (Diego Maradona)
বছর চারেক আগের ফকল্যান্ড যুদ্ধের স্মৃতি তখনও তাজা সকলের মনে। তারই প্রতিশোধ নিতে মরিয়া লোকটা একাই দু’গোল করে জিতিয়ে দিল আর্জেন্টিনাকে। প্রথমটা ‘হ্যান্ড অফ গড’, আর দ্বিতীয়টা ৬০ মিটার ড্রিবলিং করে, পাঁচ জন ইংরেজ ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে করা ‘গোল অফ দ্য সেঞ্চুরি’! সেই তিনিই সে বার কার্যত একার কৃতিত্বে বিশ্বকাপ এনে দিলেন দেশকে। জিতলেন সোনার বুট। হয়ে উঠলেন জীবন্ত কিংবদন্তি। লোকটার নাম দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। (Diego Maradona)
১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসের লানুস শহরে তাঁর জন্ম। বাবা কাজ করতেন কারখানায়, আট ভাইবোনের পরিবারে অভাব ছিল যথেষ্টই। কিন্তু খুব অল্প বয়স থেকেই দিয়েগোর ফুটবল স্কিল ছিল তাক লাগানোর মতো। শৈশবের দল লস সেবোলিটাসকে টানা ১৩৬-টি ম্যাচে অপরাজিত রেখেছিলেন, যা নজর এড়ায়নি ফুটবল স্কাউটদের। তাঁর বয়স যখন ১০, বুয়েনোস আইরেসের বিখ্যাত ক্লাব আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স সই করিয়ে ফেলল তাঁকে। ১৬ বছরে পা দেওয়ার আগেই সিনিয়র দলের দরজাও খুলে গেল তাঁর সামনে। (Diego Maradona)
পরবর্তী দু’বছরে তিনি যে ক্লাবের প্রধান ভরসার জায়গা হয়ে উঠলেন তা-ই নয়, মুখে মুখে ফিরতে লাগল এই ছেলেই আর্জেন্টিনার ভবিষ্যৎ। ১৯৭৭-এর ফেব্রুয়ারিতে, দেশের ইতিহাসে কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে আর্জেন্টিনার জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেলেন তিনি। মারাদোনার বয়স তখন ১৬ বছর ৪ মাস। পরের বছর বিশ্বকাপের আসর বসল আর্জেন্টিনায়। কিন্তু বয়স এবং অভিজ্ঞতা কম এই অজুহাতে কোচ মেনত্তি তাঁকে দলে নিলেন না। (Diego Maradona)
বড়দের বিশ্বকাপে জায়গা না হলেও, পরের বছর তাঁর নেতৃত্বেই জাপানে অনুষ্ঠিত ফিফা জুনিয়র বিশ্বকাপ জিতে নিল আর্জেন্টিনা। বিশ্ব ফুটবলে আগমন হল বাঁ-পায়ের জাদুকরের! সে বছরেই সিনিয়র দলের হয়েও প্রথম গোল করলেন তিনি। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই দক্ষিণ আমেরিকার সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হলেন মারাদোনা। অবিশ্বাস্য স্কিল, ড্রিবল, ক্ষিপ্রতা, অসামান্য বল কন্ট্রোল, দুরন্ত পাস — কী ছিল না তাঁর! (Diego Maradona)
ভিডিও: চিরচেনা ভবঘুরে, অচেনা চ্যাপলিন – জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য
১৯৮২ সালে রেকর্ড ট্রান্সফার ফি-র বিনিময়ে তাঁকে সই করাল বার্সেলোনা। বছর দুয়েকের মধ্যেই তাঁর নেতৃত্বে বার্সেলোনা জিতল কোপা ডেল রে আর স্প্যানিশ সুপার কাপ। ১৯৮৩-র এল ক্লাসিকোর সময়, হেরে গিয়েও শুধু তাঁর জন্যই স্ট্যান্ডিং ওভেশন জানায় বার্সেলোনার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদ-এর সমর্থকেরা। তারপরই ইতিহাস। ১৯৮৬।
এই বিশ্বকাপ যেন শুধুই মারাদোনার। ইংল্যান্ড, বেলজিয়ামের মতো দলকে হতভম্ব করে, শুধু পায়ের ভাঁজে দাঁড় করিয়ে গোল করা যে সম্ভব, তা এর আগে দেখেনি এই নীল গ্রহ। শতাব্দীর সবচেয়ে বিতর্কিত এবং প্রশংসিত দু’টি গোলই সে বার করলেন মারাদোনা। প্রথমটা ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদ ও গা-জোয়ারির মুখে সপাট জবাবের মতো ‘হ্যান্ড অফ গড’ এবং দ্বিতীয়টা শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গোল! যা মাঠে দাঁড়িয়ে চাক্ষুষ করে ইংল্যান্ডেরই স্ট্রাইকার গ্যারি লিনেকার বলেছিলেন – “It was the closest in my life that I’ve ever felt like I ought to applaud someone else scoring a goal.”
ইতোমধ্যেই, রেকর্ড ৪০ লক্ষ পাউন্ডে তাঁকে সই করিয়েছে ইতালির ক্লাব নাপোলি। সেখানেও প্রায় একক দক্ষতায় এসি মিলান, ইন্টার, জুভেন্তাসের মতো বড় ক্লাবদের পিছনে ফেলে নাপোলিকে ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন করলেন মারাদোনা। বিশ্বকাপ জয়ের পরেও সেই জয়যাত্রা অব্যাহত রইল। নেপলসে তিনি হয়ে উঠলেন ঈশ্বরসম। রোজারিও শহরে গড়ে উঠল এক আশ্চর্য গির্জা — ইগলেসিয়া মারাদোনিয়ানা। যীশু নন, মারাদোনাই সে গির্জার পূজিত ঈশ্বর।
তবে পরবর্তী দু’টি বিশ্বকাপে আশানুরূপ ফল পেলেন না তিনি। ততদিনে তাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে মাফিয়াযোগ, ডোপিং-এর মতো হাজারো বিতর্ক। তবুও ৬৯০ ম্যাচে ৩৪৮ গোল করা মারাদোনা ফুটবলের রাজপুত্র। ফিফার জনমত সমীক্ষাতেও, একাধিক বার, পেলে নয়, শতাব্দীর সেরা নির্বাচিত হয়েছেন মারাদোনাই। ২০১০ সালে আর্জেন্টিনার কোচ হয়ে এলেও, কাঙ্ক্ষিত সাফল্য মেলেনি তখন।
তবুও মাঠের মতোই, মাঠের বাইরেও আজীবন প্রতিবাদী দিয়েগো বারংবার সোচ্চার হয়েছেন দুর্বল দেশের প্রতি ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের অন্যায়-অত্যাচারে। প্রশ্ন তুলেছেন খেলোয়াড়রা কেন আন্তর্জাতিক শ্রমিকদের মর্যাদা পাবে না? বা সেপ ব্লাটার কোনওদিন ফুটবলে পা না ছুঁইয়েও কীভাবে ফিফার সর্বময় কর্তা হন? তাই তো, যে যেখানে লড়ে যায় তাকেই সাহস যোগায় তাঁর ওই ঐশ্বরিক দৌড়, উদ্দীপনা, বিপক্ষকে হেলায় উড়িয়ে দেওয়ার স্পর্ধা। মারাদোনা আসলে এক লড়াইয়ের নাম, এক স্বপ্নের নাম! জন্মদিনে তাঁকে আমাদের শ্রদ্ধা।
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।